তখন ছিল ১৯৭০ সালের অগ্রহায়ণ মাস। আমাদের এলাকার বিস্তীর্ণ জমিতে চলছে আমন ধান কাটার পালা। ধান কাটার সময় চাষিদের ভাটিয়ালি গানের সুরে সুরে বাংলার আকাশ বাতাসে এক শান্তির পরিবেশ, আনন্দের পরিবেশ বিরাজ করছিল, মানুষের মনে সুখ ছিল, আনন্দ ছিল। ধান কাটার পরে নাড়ার মধ্যে কিছু কিছু ধানের শীষ থেকে যায় সেগুলো একটা একটা করে কেটে ছোট টুকরি ভরাকে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় লুড়া বলে। তবে অন্য জাগায় কি বলে সে আমার জানা নেই। অগ্রহায়ণ মাসে আমার বয়সের গ্রামের অনেক ছেলেরা লুড়তে যেত আমিও শখেরবসে প্রলুব্ধ হয়ে মাঝে মধ্যে নিজের জমিতেই অন্যান্য সমবয়সীদের সাথে লুড়তে যেতাম। কিন্তু টুকরি ভরা আমার পক্ষে কখনও সম্ভব হয়নি। যারা ধান কাটত তাদের দিয়ে কিছু ধান নিজের জমি থেকে খাটো করে কাটিয়ে টুকরিটা ভরে নিতাম।
তজই উল্লা ছিলেন আমাদের বাৎসরিক স্থায়ী কাজের লোক। তার নেতৃত্বে ধান কাটার অস্থায়ী দশ বার জন লোক পরিচালিত হতো। আমার বয়সী তার এক ভাগিনা ছিল নাম খুরশিদ। আমি এবং খুরশিদ একদিন লুড়তে গেলাম। যে জমিতে লুড়ব হাওরের মধ্যে ঐ এলাকার নাম ছিল মুলমাল। ওই দিন কাজের লোকদের দুই ভার করে ধান কাটা শেষ, তাই তারা প্রথম ভার নিয়ে বাড়ীতে আসল, আমি এবং খুরশিদ রয়ে গেলাম পরে আসব বলে। হঠাৎ আমাদের চোখে পরল একটা দিয়াশলাই পরে আছে নাড়ার উপরে যা কাজের লোকেরা তামাক বিড়ি খাওয়ার জন্য নিয়েছিল। আমাদের দুজনের মাথায় হঠাৎ শিশুসুলভ দুষ্টু বুদ্ধি এলো। তামাসা করে নাড়ার মধ্যে আগুন লাগিয়ে দিলাম কিন্তু ফলাফল কি হবে সেটা দুজনের আক্কেলের মধ্যে বিন্দু মাত্রও আসেনি। যেহেতু সারা জমি ছিল একদম শুকনো তাই অতি তাড়াতাড়ি আগুন চতুর্দিকে ছড়িয়ে গেল। আমরা আগুন নিভানোর চেষ্টা করার পাশা পাশী আশপাশ থেকে আরও লোকজন এসে অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। শুধু কাটা ধান গুলা কোনরকম সরিয়ে রক্ষা করা গেল।
ভাগ্য ভাল ছিল কারণ এই সময় ঐ এলাকায় অন্য সব লোকের জমিতে ধান কাটা শেষ। শুধু মাত্র আমাদের জমিতেই পোয়া দেড় পরিমাণ জায়গা ধান কাটার বাকি ছিল নতুবা অগ্রহায়ণ মাসে যে পরিমাণ ধান আমাদের পাওয়া হয়েছিল এর বিশ গুণ বেশী পেলেও মানুষের ক্ষতি পূরণ করা যেত না। আগুনের ঘটনার খবর ইতিমধ্যে বাড়িতে পৌঁছে গেছে। বাড়িতে ঢুকব এই সাহস মোটেই নেই। বাড়ির উত্তর দিকের রাস্তার পাশে বসে আছি সাথে ছোট বড় মিলিয়ে আরও কয়েক জন। বিভিন্ন কথা বার্তা চলছে কেউ আবার বলছে ঘটনার সূত্রপাত কিভাবে হলো আরও কত কিছু । আমাদের গ্রামের সম্পর্কে আমার এক চাচাও উপস্থিত ছিলেন। হঠাৎ আমাকে বলে উঠলেন ভাতিজা তোর বাপ আসছে। শুনে মেজাজটা গরম হয়ে গেল, এমনিই মনে দুঃচিন্তায় অস্থির তার উপর মশকারা । সত্যই পূর্ব দিকে চেয়ে দেখি সুট টাই পরা একজন লোক হেটে আসছেন সাথে একজন কুলি মাথায় করে সুটকেস নিয়ে আসছে। আরও একটু কাছে আসতেই চিনে ফেললাম, সত্যিই আমার বাবা! তবে তিনি হঠাৎ আসেননি। আসার আগে বাবা চিঠি দিয়েছিলেন তারিখ জানিয়ে কিন্তু সে চিঠি তিনি আসার এক সপ্তাহ পরে বাড়িতে পৌঁছেছে। বাবা সোজা বাড়িতে ঢুকে গেলেন। আমিও আস্তে ধীরে এই সুযোগে বাড়ির ভিতর চলে আসলাম। সবার সাথে বাবার কুশল বিনিময় চলছে আর আমি দূরে দাঁড়িয়ে তাই দেখছি। এমন সময় আমার দাদি বাবাকে সেদিনের ঘটনার বিস্তারিত বিবরণী মুখস্থ বলা শুরু করলেন, তোমার ছেলে এই কামাই করেছে, সাড়া জমি জ্বালিয়ে দিয়েছে ইত্যাদি। অনেক দিন পর বাবা লন্ডন থেকে এসেছেন এই সুবাদে প্রচলিত আইন অনুযায়ী আমার অপরাধের যে দণ্ডাদেশ হওয়ার কথা ছিল সেই মামলা বাবার স্নেহের কাছে ডিসমিস হয়ে গেল। অনেকদিন পরে বাবা তার ছেলেকে কাছে পেয়ে তার আনন্দের আতিশয্যে আমি খালাস পেয়ে গেলাম।
অগ্রহায়ণ মাস প্রায় শেষ পর্যায়ে। সাড়া দেশে চলছে নির্বাচনী প্রচারণা। সপ্তাহ খানেক পরেই নির্বাচন। এইবারের ভোট কেন্দ্র ছিল দক্ষিণ বাড়ন্তী প্রাইমারী স্কুলে। প্রবাসী হিসাবে যদিও বাবার ভোটাধিকার ছিলনা কিন্তু ভোটের দিন সেন্টারে এমনিই বেড়াতে গেছেন, সাথে আমিও ছিলাম। ভোট কেন্দ্রে বেশ কিছু চা মিষ্টির দোকান বসেছিল। বাবা এক হিন্দু মিষ্টির দোকানে বসে অন্যান্য লোকদের সাথে গল্পগুজব করছেন । বাবা দোকানদারকে বললেন আমার ছেলে যত মিষ্টি খেতে পারে তাকে দিতে থাক। দোকানদার একটা প্লেট ভরে মিষ্টি দিল, দুটি মিষ্টি অনায়াসে খেয়ে ফেললাম কিন্তু তৃতীয় মিষ্টির অর্ধেক খেয়েই আর পারছিলাম না, বাকি টুকু খেলে হয়ত পেটের ভিতরে না গিয়ে বাইরে রেরিয়ে আসত।
নির্বাচন শেষ হলো, আওয়ামীলীগ বিপুল ভোটে পাশ করল। তারপর বঙ্গবন্ধুর সাথে শুরু হল ইয়াহিয়া-ভুট্টোর আলাপ আলোচনা। আলোচনা চলছে কিন্তু কোন অগ্রগতি হচ্ছে না। দিনে দিনে এ ভাবে ব্যর্থ আলাপ আলোচনার জের ধরে চলে আসে সেই উত্তাল মার্চ মাস। হানাদার বাহিনী বাঙালিদের উপর ঝাঁপিয়ে পরে। এক দিন বাবা কাজের লোক নিয়ে দিঘিরপার বাজারে গিয়েছেন হালের গরু কেনার জন্য, যথাসময়ের আগেই খালি হাতে বাবা বাড়ি ফিরে এসে বললেন যে পাঞ্জাবিরা হঠাৎ বাজারে আক্রমণ করেছে বলে বাজার ভেঙ্গে গেছে তাই গরু কেনা হয়নি। যে যে দিকে পারে পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করেছে। ঠিক ওই দিন আমাদের থানার বাজারেও পাঞ্জাবী এসেছিল তখন লোকজন লাঠি ঝাঁটা নিয়ে পাঞ্জাবিদের দিকে এগুতেই তারা গুলি চালায়। রাধানগর গ্রামের এক জন লোক (নাম জানা নেই) গুলিতে নিহত হয়। এর কয়েক দিন পরেই শেরপুরে শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ।
আমাদের বাড়ি বাড়ন্তী গ্রামের একদম পশ্চিমে অবস্থিত। এর পরে কাশির বাড়ি, সেখান থেকেই হাওরের শুরু। আমরা গ্রামের ছোট বড় সবাই কাশির বাড়ির কাছে দাড়িয়ে যুদ্ধের গোলাগুলির আওয়াজ শুনতাম। পাকিস্তানি বোমারু বিমান অনবরত মুক্তি বাহিনীর উপর বোমা বর্ষণ করছে সেই দৃশ্য আমরা সবাই দেখতাম। কেউ কেউ আফসোস করে বলতেন হায়রে যদি আমাদের ঐ রকম একটি বিমান থাকত! যুদ্ধ চলছে, উত্তর থেকে লোকজন প্রাণের ভয়ে বাড়ি ঘর ছেড়ে সপরিবারে দল বেধে হাওর দিয়ে দক্ষিণ দিকে আসছে। কোথায় যাবে সেই ঠিকানা তাদের জানা নেই। এক লোক তার বৃদ্ধ পিতাকে কাঁধে করে নিয়ে আসছিল এই হৃদয় বিদারক দৃশ্যটা এখনও বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠে। মনটা অস্থির হয়ে পরে। ভীষণ বেদনাদায়ক দৃশ্য।
সন্ধ্যার পরে তিন জন মুক্তি সেনা সোজা হাওর দিয়ে আমাদের বাড়িতে উঠে রেডিওতে খবর শুনে রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে চলে গেলেন। এক তরফা বোমা নিক্ষেপের ফলে মুক্তি বাহিনীর পক্ষে শেরপুরের যুদ্ধ বেশি দিন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তখন তারা সেখান থেকে চলে এসে কামালপুরে মনু নদীর পূর্ব এবং পশ্চিম দিকে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধের পুন: প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। কামালপুর বাজার সপ্তাহে দুই দিন, শনি এবং মঙ্গল বার। আমাদের ইউনিয়নের প্রত্যেকের পারিবারিক রসদ যোগান হয় ঐ বাজার থেকেই। সে দিন ছিল বাজার বার, গ্রামবাসী অনেকেই সকাল সকাল বাজার খরচ সেরে বাড়িতে এসে বলাবলি শুরু করেন যে, তারা দেখে এসেছেন মুক্তি বাহিনী গর্ত খুরে বিভিন্ন মারণাস্ত্র ফিট করছে, হয়তো কাল কিছু একটা ঘটতে পারে। পরের দিন ভোর বেলা হানাদার বাহিনী শেরপুরের নদী পার হয়ে কাজীর বাজার এসে গুপ্তচরের মাধ্যমে জানতে পারে সামনে মুক্তি বাহিনী ওত পেতে আক্রমণের জন্য অপেক্ষায় আছে, তারা তখন পায়ে হেটে সেখান থেকে রওয়ানা দেয়। সকাল সাত বা আটটার মত হবে হঠাৎ ভটভট করে মেশিনগানের আওয়াজ শুনে বুঝলাম যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।
আমাদের প্রয়োজনীয় মূল্যবান জিনিসপত্র আগের দিন গুছিয়ে রাখা ছিল, যদি বাড়ি ছেড়ে যেতে হয় সেই জন্য। কাজের লোক ভার নিয়ে প্রস্তুত, বাড়ি ছেড়ে চলে যাব এমন সময় ঘটে গেল এক এলাহি কাণ্ড । আমাদের পাঁচ মৌজার কয়েক গ্রামের লোক বাড়ি ঘর ছেড়ে সপরিবারে আমাদের বাড়িতে নিরাপত্তার জন্য আশ্রয় নিচ্ছে। মহিলারা ঘরের ভিতর, কিছু লোক গাছের নিচে, বাঁশ ঝাড়ের নিচে, উঠানে অর্থাৎ যে যেখানে পারছে অবস্থান নিয়েছে। বেশীর ভাগ পুরুষ মানুষ রাস্তার উপর দাড়িয়ে নানা রকম আলাপ আলোচনা করছে, সবাই একটা অনিশ্চিতের মধ্যে রয়েছে, কেও শান্তি পাচ্ছে না। সবার মনেই আতংক। বাবা তখন ভাবলেন এত লোক আমার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে তাহলে এদেরকে রেখে আমরা বাড়ি ছেড়ে যাই কেমন করে? সবার যা হবে আমাদের ও তাই হবে। আমাদের আর কোথাও যাওয়া হলো না।
কামালপুরেও মুক্তিবাহিনীর সাথে পাকিস্তানি হানাদারদের যুদ্ধ চলছে আর আমরা গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছি। ভয়ে সবার মুখ শুকিয়ে গেছে কিন্তু কেও কোন কথা বলতে পারছে না। সবার মনেই অজানা ভয়, মুখ শুকনো। বিপুল পরিমাণ অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হানাদার বাহিনীর সামনে সামান্য অস্ত্র নিয়ে মাত্র কয়েক জন মুক্তি বাহিনীর বেশী সময় যুদ্ধে টিকে থাকা সম্ভব নয়, প্রায় বিশ মিনিট পরেই গোলাগুলি থেমে যায়। তিন জন মুক্তি বাহিনী ঐ দিন শহীদ হন এবং হানাদার বাহিনীর বেশ কয়েকজন নিহত হয় (সংখ্যা জানা নেই)। মনের আক্রোশ মিটাতে গিয়ে ঐ দিন কামালপুর বাজারের অধিকাংশ দোকানপাট হানাদার বাহিনী জ্বালিয়ে দেয়। হঠাৎ দেখি এক জন মুক্তি সেনা রাস্তা দিয়ে পূর্ব দিক থেকে দৌড়ে আসছে, যেই মাত্র বেচারা ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পরে অমনি মুসলিম লিগের দোসররা তাকে ধরে শুরু করল টানাহেঁচড়া, লাথি, তারপর, অকথ্য ভাষায় গালাগালি, শালার বেটারা তোদের কারণে আমাদের দেশ ভাগ হতে যাচ্ছে, ইত্যাদি। এক পর্যায়ে ওর পেন্ট এবং গায়ের জামা খুলে যায়, শুধু একটা কালো আন্ডার প্যান্ট ব্যতীত পরনে আর কিছুই ছিলনা। আত্মরক্ষার জন্য দৌড়ে আমাদের বাড়িতে ঢুকে পরে। আমার বাবা লোকটাকে একটা লুঙ্গি দিয়ে হাওরের পশ্চিম দিকে যেতে বললেন। এখনও মনে আছে ঐ মুক্তি সেনার বাড়ি ছিল দিনাজপুর কিন্তু নামটা জানতে পারিনি। নাম না জানলে কি হবে তার মুখের ওই ছবি কোনদিনও ভুলব না। যতদিন বেচে থাকব ওই মুখের ছবি আমার অন্তরে গেঁথে থাকবে। থাকবে না কেন? সে যে মুক্তি যোদ্ধা! এই প্রথম আমি কোন মুক্তিযোদ্ধা দেখলাম নিজের চোখে। আমার খুব আনন্দ হলো আমি মুক্তি যোদ্ধা দেখেছি। সে দেশের জন্য ওই মুখ ওই প্রাণ বলি দিতে এসেছে। সে বেচে আছে কিনা তাও জানি না। তবে সে যেখানেই থাকুক আল্লাহতাআলা যেন তাকে শান্তিতে রাখেন এবং বেহেস্ত নসিব করেন।
যে উঠতি বয়সের তাজা মানুষগুলি নিজের জীবন বাজি রেখে দেশের জন্য যুদ্ধ করছে তাদের প্রতি এ ধরনের অমানুষিক, হিংস্র আক্রমণ কতটা দুঃখ জনক তা যে দেখেনি তাকে বোঝান সম্ভব নয়। গ্রামের অধিকাংশ লোকের সকালের খাওয়া দাওয়া হয়নি পেটের ক্ষুধায় ছোট বাচ্চারা কান্নাকাটি করছে। এই দৃশ্য দেখে বাবা খুবই চিন্তিত হলেন, মর্মাহত হলেন। শুধু বাড়ির উঠানে এপাশ থেকে ওপাশে পায়চারী করছেন আর ভাবছেন কি করা যায়? ভাবছেন এই লোকগুলি বিপদে পরে আজ আমার বাড়িতে এসেছে, হঠাৎ করে এত লোককে খাওয়ানো ও সম্ভব নয় অথচ খেতে না পেলে এরা করবেই বা কী? এমত অবস্থায় ওদের জন্য সামান্য কিছু ও যদি করতে না পারি তাহলে সাড়া জীবন অনুশোচনার মধ্যে থাকব, অমনি হঠাৎ তার মনে পড়ে যে আমাদের ঘরে একটা বড় ডেকচি ছিল যেটা শুধু ব্যবহার হত বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের জন্য। আমার বাবার তাৎক্ষণিক উদ্যোগে লোক দ্বারা ঐ ডেকচি উঠানে বের করে ওতে করে খিচুরি রান্না করা হয় এবং যথাসাধ্য উপস্থিত সবাইকে কোনভাবে কিছু কিছু দিয়ে চালিয়ে নেয়া হয়। পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার কিছুক্ষণ পরে সবাই যার যার বাড়িতে চলে গেলেন।
মানুষের বিপদের সময় সামান্য একটু উপকার করতে পারলে সেটা সাড়া জীবন মনে থাকে। এই প্রেক্ষিতে ছোট একটা কথা মনে এলো যা এখানে অপ্রাসঙ্গিক হলেও না বলে পারছি না। আমার বাবা মরহুম আব্দুল গণি ২০০৪ সালে মারা যান। কামালপুর ইউনিয়নের ছোট বড় সকলের কাছেই উনি বেশ পরিচিত এবং প্রিয় ছিলেন। বাবার জন্য শিরনী করব এই পরিকল্পনা নিয়ে আমরা চার ভাই ২০০৭ সালে লন্ডন থেকে বাংলাদেশে যাই। আমাদের এলাকার স্থানীয় প্রথা অনুযায়ী যে কোন শিরনীর পূর্বে মুছলত করতে হয় যার মানে হল পূর্ব প্রস্তুতির জন্য আলোচনাসভা। যেহেতু ঐ শিরনীটা ছিল বড় আকারের, সাড়া ইউনিয়ন নিয়ে। কাজেই কয়েকটা মুছলত করতে হয়। কে কি ভাবে নিবে বা কার কি মতামত বা পরামর্শ সবই জানতে হবে। এক দম শেষের মুছলতের দিন বিভিন্ন গ্রামের কয়েক জন প্রবীণ মুরব্বিয়ান উপস্থিত ছিলেন। তারা তখন আমার চাচা তালেব উদ্দিন মালদারকে উদ্দেশ্য করে বললেন যার জন্য আপনারা শিরনী করতে যাচ্ছেন ঐ ব্যক্তির শিরনীতে মুছলত করার প্রয়োজন নাই, আমাদেরকে শুধু বললেই হত, যত প্রকার সাহায্য সহযোগিতার প্রয়োজন সব কিছু আমাদের কাছ থেকে পাবেন। আপনারা আপনাদের সুবিধা অনুযায়ী যা ভাল হয় তাই করেন, আমরা আপনাদের সাথেই আছি। তিনি এই এলাকার একজন সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন এবং আমাদের জন্য যা করেছেন তা আমরা কেও ভুলে যাইনি, আমাদের সবই মনে আছে। কামালপুরের যুদ্ধের দিন উনি আমাদের জন্য যা করেছিলেন এখনও সেটা আমাদের হৃদয়ে চীর স্মরণীয় হয়ে আছে। আলহামদুলিল্লাহ ঐ শিরনী খুব সুন্দর ও সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন হয়েছিল।
এবার যুদ্ধের কথায় আসি। সাড়া দেশেই যুদ্ধ চলছে। ছয় সাত দিন পরে বিকাল বেলা আমরা গ্রামবাসীরা দেখতে পেলাম হাওরের পশ্চিম দিকে বেশ দুরে নড়িয়া গ্রামে কালো ধোয়া উড়ছে, অনেকেই ভাবলেন হয়ত কারো বাড়িতে আগুন লেগেছে, কিন্তু পরে জানা গেল যে হানাদার বাহিনী তাদের দোসরদের সহযোগিতায় মাড়া গোষ্ঠীর বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে সপরিবারে হত্যা করেছে। এত দুরে বড় হাওরের পাশে অবস্থিত ঐ গ্রামে পাঞ্জাবী যেতে পারে এই খবরটা প্রথমে অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেন নাই। কিন্তু পাকিস্তানিদের দোসর তাদের চেলা শয়তান রাজাকারদের সাহায্যে তারা ঠিকই পৌছে গেছে।
লন্ডন থেকে দেশে আসার সময় বাবা একটা বড় রেডিও এনেছিলেন, প্রতি দিন সন্ধ্যার পরে গ্রামের ছোট বড় অনেকই আমাদের বাড়িতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে খবর শোনার জন্য এসে জড়ো হতেন। আমি নিজেও উপস্থিত থাকতাম এবং অনেক কিছুই মোটামুটি বুঝতেও পারতাম। প্রতি দিন বঙ্গবন্ধুর সেই বজ্র কণ্ঠের আওয়াজ, “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা”। শুনতে খুবই ভাল লাগত। আমি তখন প্রাইমারী স্কুলে পড়ি তবুও মনে হতো আহা আমিও যদি ওই মুক্তি সেনাদের সাথে যুদ্ধ করতে পারতাম! শরীরের রক্তে কেমন যেন একটা উন্মাদনা অনুভব করতে পারতাম। বুঝতাম বঙ্গবন্ধুর সেই বজ্র কণ্ঠের আওয়াজ আমাকে কেমন উন্মাদ করে দেয়। তখন আমার যে বয়স ছিল আজকাল সেই বয়সের ছেলেরা হাই স্কুলে পড়ছে। পড়া লেখার জন্য যদিও কড়া শাসনের মধ্যে ছিলাম কিন্তু যুদ্ধ কালীন সময়ে স্কুলে যেতে হতনা, পারিবারিক দিক থেকেও বাড়িতে পড়াশোনার জন্য বকুনি শুনতে হতনা। খাওয়া, ঘুম এবং খেলাধুলা ঐ তিন কাজ নিয়েই সময় কাটত। আর যখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শুনতাম তখন মনে অন্যরকম জোয়ার আসত বেশ বুঝতাম। দেশাত্মবোধক গানগুলি মনে ভিন্ন অনুভূতির সঞ্চার করত রাতে শুয়ে শুয়ে ঘুমাবার আগে কত কি ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পরতাম।
মাস দু এক পরের ঘটনা, তখন সম্ভবত আষাঢ় মাস, ঐ দিন কামালপুরে বাজার বার ছিল। শোনা গেল হানাদার বাহিনী কামালপুরের মাহিনদের বাড়িতে আক্রমণ করেছে। প্রাণ বাঁচানোর জন্য পরিবারের সবাই দেবতার ঘরে ঢুকেছিল কিন্তু শয়তান পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের চেলারা ঘর থেকে ওদের সবাইকে এক এক করে বাহির করে, লাইনে দাড় করিয়ে গুলি করে মেরে ফেলে ওদের উঠানেই আনন্দ করে নৃত্য করেছিল। ঐ সময় মাঠে গরু আনতে গিয়েছিল বলে ভাগ্যক্রমে শুধু চৌদ্দ বা পনের বয়সের একটা ছেলে বেঁচে যায়। পরে জানা গেল পাকিস্তানের পোষা সেই কালো হায়েনা এবং তাদের সহচরদের প্ররোচনায় নড়িয়া এবং কামালপুর গ্রামে হানাদার বাহিনী গণহত্যা চালায়। কি অপরাধ করেছিল ওরা, কার পাকা ধানে মই দিয়েছিল, তাদের কি এই পৃথিবীতে বাঁচার অধিকার ছিলনা, কেন তাদেরকে হত্যা করানো হল, এসব প্রশ্নের উত্তর আজ পর্যন্ত পেলামনা। এই দেশের মাটি, বাতাসে বেড়ে উঠে অন্যের উৎসাহে, অন্যের স্বার্থে কেন নিজের ভাইকে হত্যা করল? আবার তারাই দেখি এখন টেবিলে এই দেশের মানুষের রক্তে রাঙ্গা পতাকা উড়িয়ে অফিস করছে! হায়রে মানুষ!
আমাদের গ্রামের লোকজন সব সময় একটা আতঙ্কের মধ্যে থাকতেন। কে জানে কখন পাঞ্জাবী এসে যায়। হঠাৎ একদিন উদ্দেশ্যমূলক ভাবে রঞ্জন পালের বাড়ির নিকটে কে যেন বাঁশ দিয়ে বন্দুকের মত আওয়াজ করে, সাথে সাথে গুজব ছড়িয়ে যায় পাঞ্জাবী আসছে, আর এই সুযোগে গ্রামের কিছু লোভী ব্যক্তি তাদের বাড়ি আংশিক লুট করে নেয়। আমার নিজেরও কৌতূহল হত পাঞ্জাবী দেখতে কেমন? একদিন যদি এসে যেত তাহলে দেখতে পারতাম। সেই আশাটাও পূরণ হয়ে গেল। বাবার সাথে একদিন কামালপুর বাজারে গিয়েছিলাম সেখানে দেখি সিলেট থেকে তিনটি ট্রাক ভরে পাঞ্জাবী শ্রীমঙ্গলের দিকে যাচ্ছে। দেখেই একটা ঘৃণার ভাবের উদয় হলো।
এভাবেই দেখতে দেখতে এসে গেল ১৬ই ডিসেম্বর, দেশ স্বাধীন হলো। এতদিন ধরে যারা নির্বিবাদে মানুষ হত্যা করেছে সেই পিশাচেরা বিড়ালের মত শক্তিহীন মেরুদণ্ডহীন হয়ে ভাঙ্গা কোমর নিয়ে আমাদের মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করল। পৃথিবীর মানচিত্রে নতুন একটি দেশের জন্ম হলো। আজকে এই দেশের নামই বাংলাদেশ। আমরা বাঙালি হয়ে নতুন করে আবার জন্ম নিলাম। নতুন সূর্যের উদয় হলো, শুরু হোল আমাদের নতুন যাত্রা। ৭২ সালের জানুয়ারি মাস থেকে স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত রীতিমত খুলে গেল। আমাকেও এখন আগের মত নিয়মিত স্কুলে যেতে হয়, পাশাপাশি বাড়িতেও ঠিক মত পড়াশোনা করতে হয়। আমরা সবাই আবার নতুন করে শুরু করলাম এই দেশ গড়ার জন্য নতুন অভিযান।
সংগ্রামের বৎসর আমার যতখানি বয়স ছিল বিবেক বুদ্ধিটাও সেই পরিমাণেরই ছিল। তখনকার সময় মানুষ কত ভয়ংকর অবস্থার মধ্যে জীবন যাপন করছিল সেটি এখন যে ভাবে অনুধাবন করতে পারি তখন কিন্তু তা পারিনি। সে সময় স্কুলে যেতে হয়নি , বাড়িতেও পড়তে হতনা কত আরামের জীবন ছিল তাই মনে মনে ভাবতাম যদি গত বৎসরের মত আরেকটি যুদ্ধ লেগে যেত তাহলে স্কুলে যাওয়া আসার কষ্ট থেকে মুক্তি পেয়ে যেতাম! কতটা অবুঝ ছিলাম!! এ কথা মনে হলে অবাক হই, তখন আমি এত বোকা কেন ছিলাম?
আজকে আমার পরিচিত অনেক বন্ধু বান্ধব আছেন তাদের মধ্যে অধিকাংশই আমার চেয়ে বয়ঃকনিষ্ঠ। ওদের মধ্যে অনেকেই আবার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে গভীর ভাবে সক্রিয়। প্রায় সময় সবাই একত্রে জড়ো হলে আড্ডা বসে। বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ আলোচনা জমে উঠে। যখন স্বাধীনতা বা পাকিস্তান আমলের ইতিহাস নিয়ে কথা হয়, তখন তারা বিস্মিত হন। তাদের মধ্যে কিছু লোক আবার এসব কথা আষাঢ়ে গল্পের মত মনে করেন। অবশ্য আমরা বয়োজ্যেষ্ঠরা তাদেরকে দোষারোপ করিনা, হয়ত তারা সঠিক ইতিহাস জানার বা বোঝার তেমন সুযোগ পায়নি। আমাদের স্বাধীনতার ৪৪ বৎসর পার হয়ে গেছে আর এখনও আমাদের সিনিয়র রাজনীতিবিদরা ক্যালকুলেটর নিয়ে হিসাব মিলাচ্ছেন কত লোক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য প্রাণ দিয়েছেন অথচ তারা নিজেই সেই রক্তাক্ত নয় মাসের চিত্র স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন। ওদের মুখ থেকে এ ধরনের শিশুসুলভ কথা বার্তা শুনে আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায়। রাজনীতি করবেন, ভাল কথা তাই বলে নিজের দলের স্বার্থ রক্ষার্থে স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃত করে বিতর্ক সৃষ্টি করা কখনও সমীচীন নয়। নিজের স্বার্থের উদ্দেশ্য ভুলে আসুন আমরা সবাই দেশের স্বার্থের কথা ভাবি, দেশকে ভালবাসি। আমাদের জাতিকে উন্নতির দিকে নিয়ে যাবার পথ খুঁজি। নিজেকে বাঙালি বলে পরিচয় দিয়ে গর্ব বোধ করি। এতেই শান্তি, এতেই সুখ যে সুখ আর কিছুতে নেই।
loading...
loading...
নিজের দলের স্বার্থ রক্ষার্থে স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃত করে বিতর্ক সৃষ্টি করা কখনও সমীচীন নয়। নিজের স্বার্থের উদ্দেশ্য ভুলে আসুন আমরা সবাই দেশের স্বার্থের কথা ভাবি, দেশকে ভালবাসি। আমাদের জাতিকে উন্নতির দিকে নিয়ে যাবার পথ খুঁজি। নিজেকে বাঙালি বলে পরিচয় দিয়ে গর্ব বোধ করি।
এতেই শান্তি, এতেই সুখ যে সুখ আর কিছুতে নেই।
স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা মি. সমছু মিয়া।
loading...
জয় বাংলা!
আমাদের এই বাংলাকে সুন্দর করে সাজিয়ে তোলার দায়িত্ব আমার আপনার সকলের।
বাংলা আমাদের গর্ব আমাদের একমাত্র অহংকার।
loading...
দীলখুশ মিঞার পক্ষ থেকে লাল গোলাপের শুভেচ্ছা।
হাই হ্যালো।
কি বলব আপনার লেখা নিয়ে আর আপনাকে নিয়ে। শুধু এটুকু বলব, শব্দনীড় একজন খুব ভালো মানের লেখক পেয়েছে যিনি শুধু লিখেনই না অন্যের পোষ্টে মন্তব্যও করেন।
আপনার কল্যাণ হোক।
loading...
জয় বাংলা!
জনাব দিলখুশ ভাই বালা আছেননি?
loading...
ধন্যবাদ সমসু ভাই। অনেক পুরন স্মৃতি হলেও মনে হলো এইতো সেদিনের কথা।
loading...
ধন্যবাদ দাদা।
জয় বাংলা!
ধন্যবাদ দাদা।
loading...
স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা রইল
loading...
জয় বাংলা! শুভেচ্ছা আপনাকেও।
loading...