বৃহস্পতিবার রাত এবং শুক্রবার সারাদিন মেস বন্ধ থাকে, যাদের সাথে মেসে খাই তাদের প্রায় সবার বাড়ি মোটামুটি কাছে হবার কারণে তারা সাপ্তাহিক ছুটি কাটাতে বাড়ি চলে যায় তারজন্যই মূলত মেস বন্ধ থাকে, আমার বাড়ি দূরে হবার কারণে যেতে পারিনা। সাধারণত এই সময়ের খাবারটা আমার হোটেলে খেতে হয়, শুরু থেকে ইচ্ছেটা এমন যে প্রতিবার নতুন নতুন হোটেলে খাবো এতে ঘুরাঘুরি হবে সাথে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদও পাবো।
.
প্রথম কয়েক সপ্তাহ এমনটাই করলাম কিন্তু এখন সেটা করিনা একটা ছেলের জন্য। মেস বন্ধ থাকলে এখন ওর ওখানেই যাওয়া হয়, আমি গেলে ওকে আর বলতে হয়না কখন কী খাবো। আর সম্ভবত ও আমার অপেক্ষা করে কারণ আজকে দুপুরে জিজ্ঞেস করলো “এত দেরি করলেন যে ?” আর আমাকে ও যতটা যত্নের সাথে খাওয়ায় আর কাউকে ততটা যত্নের সাথে খাওয়ায় কিনা জানিনা।
.
বিষয়টা পরিস্কারভাবে বোঝার জন্য একটু পিছনে যেতে হবে। সপ্তাহ দুই আগে ওই হোটেলে দুপুরে খাবার জন্য যাই, রীতিমতো খাওয়ার শেষের দিকে জিজ্ঞেস করলাম কোন পানীয় হবে কিনা ? একজন ওয়েটার বললো আমাদের এখানে নেই তবে বাইরে থেকে এনে দেয়া যাবে। যশোরে এতবেশী গরম যে দুপুরের দিকে ঠাণ্ডা পানীয় না খেলে চলেনা।
.
সে যাইহোক সর্দার টাইপের ওয়েটার একটা ছেলেকে ডেকে আমার জন্য পানীয় আনতে বললো। আমি ওয়ালেট থেকে টাকা বের করে ছেলেটাকে দিলাম, বড় নোট দিলাম যাতে সেটা ভাঙতিও হয়। ছেলেটার বয়স ৯-১০ বছর, এই বয়সের একটা ছেলে পড়াশোনা আর খেলাধুলায় মত্ত থাকার কথা অথচ ও এই হোটেলের সবথেকে কনিষ্ঠ ওয়েটার, ছেলেটা রোদের ভিতর বাইরে চলে গেলো। এদিকে প্রায় পাঁচ-সাত মিনিট পার হয়ে গেলো ছেলেটা আসছেনা, আমার খাওয়াও শেষ হয়ে গেলো।
.
যিনি তাকে বাইরে পাঠালেন তিনি এগিয়ে এসে বললেন হয়তো নোট খুচরা করতে পারেনি, আপনি ক্যাশে দিলেইতো খুচরা করতে পারতেন। আমি বললাম ওহ তাইতো আমার খেয়ালই ছিলোনা, মনে মনে ভাবলাম ছেলেটা কি চলে গেলো ? তারপর বললাম আমি তাহলে বাইরে যাই, পথেই নিয়ে নেবো ওর থেকে, আমার আবার একটু কাজ আছে। এই বলে বিল চুকিয়ে আমি বেরিয়ে পড়লাম।
.
বের হয়ে একটু আগাতেই দেখি পাশের এক দোকানের বেঞ্চিতে বসে ছেলেটা কোলাকোলার বোতল ওর গালে, কপালে ঘাড়ে চেপে ধরতেছে। আমাকে দেখতেই হচকয়িয়ে গেলো, আমি জিজ্ঞেস করলাম দেরি করতেছো কেন ? ও কোন উত্তর দিলোনা, ওর থেকে বোতল আর টাকা বুঝে নিয়ে বললাম ঠিক আছে। আর মনে হলো হয়তো ওর কোক খেতে ইচ্ছে করতেছে তাই বললাম দাঁড়ায়ও আর আমি কিছুটা খেয়ে বাকিটা ওকে সাধলাম, ও বললো নিবেনা ওর জ্বর, ঠাণ্ডা খাওয়া যাবেনা। বললাম ওষুধ খাওনি ? মাথায় পানি দেওনি ? মাথা নেড়ে জানালো কিছুই করেনি।
.
কপালে হাত দিয়ে দেখলাম সত্যি সত্যি অনেক জ্বর, তখন বোঝলাম কেন কোকের ঠাণ্ডা বোতল ওইভাবে চাপতেছিলো। তারপর বললাম এই জ্বর নিয়ে তুমি কাজ করতেছো কেন ? মালিকরে বলে বাড়ি চলে যাও, ও বললো যেতে দিবেনা আর গেলে হাজিরা দিবেনা। তারপর ওর সাথে আরও কথা হলো, ওর বাবা বেঁচে নাই, ওর মা বাসায় কাজ করে, ও স্কুলে পড়েছে থ্রি পর্যন্ত আর ওর বাবা মারা যাবার পর থেকে এখানে আছে। জোর করে ওকে একটা নরমাল কোক আর নাপা এক্সট্রা কিনে দিলাম, ও নিবেইনা, কারণ হিসেবে বললো মালিক জানলে বকবেনি, আমি বললাম এখানে খেয়ে যাও কোন সমস্যা হবেনা। ছেলেটা দ্রুত কোক খেলো, আমার সামনে টেবলেট খেতে বললাম, তারপর টেবলেট খেলো আমি বললাম হোটেলে গিয়ে মাথায় পানি দিবা। ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসলো তারপর শরীরে জ্বর নিয়েই আবার হোটেলের দিকে চলে গেলো…
.
১০/০৬/২০২০
loading...
loading...
অণুগল্পটি পড়ে আবেগ তাড়িত হলাম। ভালো থাকবেন ভালো রাখবেন সবাইকে।
loading...
অনবদ্য রচনাশৈলী।
মুগ্ধ হলাম ।ভালোবাসা জানবেন।
loading...