পর্ব – ৩
মিলুর বাবা সত্যানন্দ বরিশাল শহরের ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের শিক্ষক। অল্প বয়সে শিশুদের স্কুলে পাঠানোর পক্ষে নন তিনি। বাড়িতে ভাল মত পাঠ দিয়ে তবেই স্কুলে ভর্তি করতে চান ছেলেদের। তাই স্কুলে যাবার বয়স হলেও মিলুকে স্কুলে ভর্তি না করে বাড়িতেই প্রাথমিক পাঠ দেওয়া চলতে থাকে।
সকাল বেলায় সাংসারিক কাজের চাপে মা ছেলেকে পড়ানোর সুযোগ পান না।
তাই প্রতি সন্ধ্যায় মায়ের কাছে পড়াশুনো করে মিলু। পড়াশুনো সেরে মিলু আর অশোক ঠাকুরমার কাছে বসেছে প্রতি সন্ধ্যার মত আজও। মা রান্নাঘরে ঢুকেছেন রাতের খাবার তৈরীর জন্য। ঠাকুরমা গল্প করছেন তাদের ছেড়ে আসা ভিটেমাটির। অশোক এখনও অবুঝ শিশু। সে ঠাকুরমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়েই পড়েছে হয়তো। মিলু কিন্তু গভীর মনযোগে শুনছে।
ঢাকায় পদ্মারই এক শাখানদী কীর্তিনাশার তীরে বিক্রমপুরের গাঁওপাড়া গ্রামে ছিল তাদের আদি বাড়ি। ঠাকুরমা সে সব স্মৃতি ভূলতে পারেননি। তাই সুযোগ পেলেই মেতে ওঠেন রোমন্থনে। গ্রামখানি কীর্তিনাশার জলে তলিয়ে গিয়েছিল।
সেই বিক্রমপুর আর পদ্মা নদীর গল্প, রাজা রাজবল্লভের একুশ চূড়াযুক্ত প্রাসাদ ‘একুশ রত্ন’ – এর গল্প শুনতে শুনতে বালক মিলু হারিয়ে যায় অতীত কল্পনার রাজ্যে।
হঠাৎ ধাক্কা খায় তার স্বপ্নের পথচলাতে।
মিলু দেখে মেঝ পিসেমশাই তাদের সামনে দাঁড়িয়ে। তিনি তার শ্বাশুড়ি মাকে বললেন – মেঝ বৌঠান কী রান্না ঘরে ?
জামাতার হঠাৎ আগমনে প্রথমটায় একটু হতচকিত হয়ে যান শ্বাশুড়ি। সামলে নিয়ে বলেন- তুমি কখন এলে বাবা ?
– এই এলাম। মেঝ বৌঠানকে খুব দরকার। উনি কি রান্না ঘরে ?
– হ্যাঁ।
মিলুর দিকে তাকিয়ে বললেন – যাও তো বাবা তোমার মাকে একবার ডেকে নিয়ে এসো তো।
মিলু মাকে ডাকতে চলে যায়।
কিছুক্ষণ পরে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে মিলুর মা আসেন। সাথে সাথে মিলুও।
– আরে ঠাকুর জামাই যে। তা এই অসময়ে হঠাৎ আগমনের হেতু কী?
মিলুর মা একটু অবাক হয়েই জানতে চান।
– না এসে আর উপায় আছে ? আপনার কবিতা চাই এক্ষুনী।
– এখন কীভাবে দেব। লেখা আছে নাকি?
– সে জানি নে। পত্রিকা নিয়ে দাদা প্রেসে চলে গেছেন। পান্ডুলিপিতে আপনার লেখা না দেখেই ছুটে এলাম। আপনার লেখা ছাড়া ব্রহ্মবাদী বের হোক সে আমি মেনে নেব না।
– আপনার দাদা আমাকে কয়েকদিন আগে একটা লেখা দিতে বলেছিলেন কিন্তু কাজের চাপে আর লিখে উঠতে পারি নি। এই সংখ্যাটায় আমার লেখা নাইবা থাকলো।
ঠাকুরজামাই মনোমোহনবাবুও নাছোড়বান্দা।
অগত্যা মিলুর মা বললেন – আচ্ছা তাহলে একবার চেষ্টা করে দেখি।
শ্বাশুড়ি মায়ের কোলে ছোট ছেলে ঘুমিয়ে গেছে দেখে – দিন মা ওকে ঘরে শুইয়ে দিই বলে তাকে কোলে তুলে নিলেন।
মনোমোহন বাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন – আসুন ঘরে একটু বসবেন ক্ষণ।
ঘরে গিয়ে অশোককে শুইয়ে দিলেন।
ঠাকুর জামাইকে বসার ব্যবস্থা করে দিয়ে
খাতা আর কলম নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন।
মিলুও খাতা পেন্সিল নিয়ে ছবি আঁকতে বসে যায়।
মিলুর বাবা সত্যানন্দ বরিশাল ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক এবং ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র ব্রাহ্মবাদী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক। তার মেঝ ভগ্নিপতী মনমোহন চক্রবর্ত্তীকে নিয়ে পত্রিকা সম্পাদনার সকল কাজ করেন। এরা দুজনেই বরিশাল ব্রাহ্মসমাজের বিশিষ্ট মানুষ।
বেশ কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে সলজ্জ ভাবে কাগজটি এগিয়ে ধরেন ঠাকুর জামাইয়ের দিকে – দেখুন। ভাল হয়নি। রান্না করতে করতেই লিখলাম।
কাগজখানা হাতে নিয়ে জোরে জোরে পড়তে লাগেন মনোমোহনবাবু –
খোকার বিড়ালছানা
সোনার ছেলে খোকামণি, তিনটি বিড়াল তার,
একদণ্ড নাহি তাদের করবে চোখের আড়।
খেতে শুতে সকল সময় থাকবে তারা কাছে,
না হ’লে কি খোকামণির খাওয়া দাওয়া আছে?
এত আদর পেয়ে পেয়ে বিড়াছানাগুলি,
দাদা, দিদি, মাসি, পিসি সকল গেছে ভুলি।
সোনামুখী, সোহাগিনী, চাঁদের কণা ব’লে
ডাকে খোকা, ছানাগুলি যায় আদরে গলে।
“সোনামুখী” সবার বড় খোকার কোলে বসে,
“সোহাগিনী” ছোটো যেটি বসে মাথার পাশে।
মাঝখানেতে মানে মানে বসে’ “চাঁদের কণা”,
একে একে সবাই কোলে করবে আনাগোনা।
তারপর বললেন – বাহ্ অপূর্ব বৌঠান অপূর্ব। আপনী সত্যি স্বভাবকবি। তা না হলে রান্না করতে করতে এত সুন্দর কবিতা লেখা সম্ভব?
মিলুর মা কিছু একটা বলতে চাইছিলেন কিন্তু সে সুযোগ না দিয়েই মনমোহনবাবু আসি বলেই দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যান।
মিলু ছবি আঁকার মাঝেও উৎকণ্ঠার সাথে সমস্ত ঘটনার দিকে খেয়াল রাখছিল। মায়ের এত তাড়াতাড়ি এত সুন্দর একটি কবিতা লিখতে পারার ক্ষমতা দেখে সেও অবাক হল। গর্বিত হল মায়ের জন্য। কোনো কথা সে বলল না। শুধু বিস্ময় ভরা চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল।
loading...
loading...
দারুণ এক উপন্যাসের খণ্ডাংশ পড়লাম। আমার কাছে বেশ লাগছে প্রিয় কবি।
loading...
ধন্যবাদ দাদা
loading...