গাছের জন্মদিন
শংকর দেবনাথ
– দাদা, বাবাকে যা যা আনতে বলেছিলি, বাবা কি সে সবকিছু নিয়ে এসেছেন?
সন্তু বলে ওর দাদা রন্তুকে।
হ্যাঁ, সবই এনেছেন। এখন আমাদের কাজগুলো তাড়াতাড়ি করে ফেলতে হবে। চল ভাই।
রন্তু সন্তুর হাত ধরে এগিয়ে যায় ওদের বাগানের দিকে।
সকাল থেকে রন্তু আর সন্তু খুবই ব্যস্ত। জন্মদিন বলে কথা।
ওরা পিঠে-পিঠি দুই ভাই। রন্তু পড়ে ফাইভে আর সন্তু ফোরে। সীমান্তঘেঁষা ছোট্ট সবুজ শহর বনগাঁ। তার মাঝে প্রায় মজে যাওয়া প্রিয়নদী ইছামতি।
আর এই ইছামতির পাড়েই ওদের সুন্দর একটা একতলা বাড়ি। বিঘে খানেক জমির উপর ওদের ছোট্ট বাড়ির চারপাশে গাছগাছালির ভিড়।
ওরা দু’ভাই কমলালেবু গাছের চারাটির কাছে আসে। আশপাশটা ভাল করে পরিস্কার করে দু’জনে মিলে। কিছু গুঁড়োমাটি এনে রাখে গাছটির পাশে।
এই গাছটি ঠিক একবছর আগে আজকের দিনে প্রথম মাটি ফুঁড়ে আলোর মুখ দেখেছিল।
ওদের বাবার এনে দেওয়া কমলা খেয়ে কয়েকটা বীজ পেয়েছিল ওরা। সেগুলো দেখিয়ে মাকে বলেছিল- মা, বীজগুলো পুঁতলে কি কমলালেবুর গাছ হবে মা?
-দেখ পুঁতে, হলেও হতে পারে।
মায়ের কথায় ভরসা পেয়ে সেদিন দুই ছোট্ট শিশু গভীর মমতায় বীজগুলো পুঁতে রেখেছিল উঠোনের এককোণে। কলতলার পাশে।
ঠাকুরদা ঠাকুরমাকেও জানিয়েছিল ওরা। তারাও খুব খুশি হয়েছিলেন। ঠাকুরমা বলেছিলেন- নিশ্চয় চারা হবে। আমাদের তো আগে একটা কমলালেবু গাছ ছিল। তোর ঠাকুরদা বীজ পুঁতেছিলেন। হয়েও ছিল।
ঠাকুরদা বললেন- ফলও হতো কত। তবে সামান্য টক হতো। আমাদের এই জলবায়ুতে বোধহয় এরকমই হয়।
ওরা প্রতিনিয়ত নজরে রাখতে শুরু করে – বীজ থেকে চারা বের হয় কিনা দেখার জন্য। ওদের এই আগ্রহ আর বৃক্ষপ্রীতিতে মা-বাবাও উৎসাহি হয়ে ওঠেন।
-কিরে চারা বেরিয়েছে? বাবা মজা করে কখনও সখনও জানতে চান।
-না বাবা। ওদের মনে হতাশা।
হঠাৎ একদিন ভোরে উঠোন ঝাঁট দিতে দিতে মায়ের চোখে প্রথম ধরা পড়ে ব্যাপারটি। দু’টো কচিপাতা নিয়ে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে একটি চারা। কমলার চারা। আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিল সেদিন ওরা। তারপর কত যত্ন। কত ভালবাসা।
আজ গাছটির বয়স ঠিক একবছর।
হিসেবটা রেখেছিলেন ওর ঠাকুরদা। গত দু’তিনদিন আগে ঠাকুরদার সাথে পরামর্শ করে ওরা সিদ্ধান্ত নেয় গাছের জন্মদিন করার। তারই পরামর্শমত গতরাতে ওদের বাবাকে দিয়ে সারের দোকান থেকে দশ কিলো সুফলা আনিয়েছে।
ঠাকুরদা এগিয়ে আসেন ওদের কাছে। বলেন- তোরা দু’জনে গিয়ে বাগানের সকল গাছকে কমলার জন্মদিনের নেমতন্ন করে আয়।
-আচ্ছা দাদু। রন্তু বলে – কি বলতে হবে গাছেদের?
সন্তু সোৎসাহে বলে- হ্যাঁ দাদু, তুমিও চলো আমাদের সাথে।
-ঠিক আছে। চল।
ওরা তিনজনে মিলে বাগানের আম, জাম, জামরুল, কাঁঠাল, পেয়ারা, বাতাবি, নারকেল, সুপারি, বেল, কুল সব গাছকেই জানিয়ে আসে কমলার জন্মদিনের কথা।
বাবা এলেন। মা ঠাম্মা এলেন। এল ওদের পাড়ার বন্ধুরাও। একটা অন্যরকম আনন্দ আর উচ্ছ্বাস সবার ভেতরে।
ঠাকুরদার নির্দেশে বাবা একটা কোঁদাল নিয়ে এলেন। জল তোলা মটরের পাইপটাও আনা হল বাগানে।মা আর ঠাকুমার উলুধ্বনির ভেতর দিয়ে শুরু হয়ে গেল কমলার জন্মদিনের অনুষ্ঠান।
সবাই সোৎসাহে হাততালি দিয়ে বলল- হ্যাপি বার্থ ডে টু কমলা। শুভ জন্মদিন কমলা।
সকলে একসাথে কমলার ছোট্ট চারাটির গায়ে হাত বুলিয়ে দিল গভীর মমতায়।
রন্তু বলল- ও দাদু, এবার কী করতে হবে বলনা?
সন্তু বলল- তাড়াতাড়ি বলো।
ওদের মা বলেন- তোদের ঠাকুরদা পারেনও বটে।
বাবা মজার সাথে বললেন- বল বাবা বল। পাগলদের ক্ষেপিয়েছো তো তুমিই।
ঠাকুরদার মুখে মৃদু হাসি। তৃপ্তির হাসি। বলেন- সবাই তো মানুষের জন্মদিন করে। আমরা না হয় গাছের জন্মদিন করলাম একবার গাছকেও আমাদের পরিবার ভেবে। দোষ কি?
-না বাবা, সেকথা বলছি না। তুমি তো ভাল কাজই করছো। ওদের ভেতরেও গাছের প্রতি ভালবাসা গড়ে তুলছো তুমি।
ও দাদু, বল না এখন আর কি কি করতে হবে? সন্তুর যেন আর তর সইছে না।
ঠাকুরদা বললেন – আগে কমলার চারাটির গোড়ায় একটু জল দাও। তার সুফলা দাও কিছুটা। তারপর মাটি দিয়ে ভাল করে গোড়াটি ঢেকে দাও।
সযত্নে কমলার গোড়ায় জল, সার আর মাটি দিয়ে দেওয়া হল বাবার সহযোগিতায়।
ঠাকুরদা আবার বললেন- কমলার জন্মদিনে তো বাগানের সব গাছকেই নেমতন্ন করা হয়েছে। ওদের প্রত্যেকেই আপ্যায়ন করতে হবে না? তাই এবার একে বাগানের সব গাছের গোড়ায় আগে জল দিয়ে দাও পাইপটা দিয়ে। তারপর সার আর প্রত্যেকটির গোড়া মাটি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। চলো সবাই কাজে লেগে পড়ি।
প্রচন্ড উৎসাহে সবাই হাতেহাতে কাজগুলো করতে লেগে যায়।
একসময় বাগানের সকল গাছের সেবাযত্ন শেষ হয়।
ঠাকুমা বলেন- বাহ্, কমলার জন্মদিনের অছিলায় সমস্ত গাছপালার যত্ন করা হয়ে গেল।
মা বললেন- এরকম প্রতিবছরই করা উচিত। তাতে গাছগুলোরও উপকার হবে।
ঠাকুরদা সানন্দে বললেন- বৌমা, এবার ওদের বন্ধুদের মিষ্টিমুখ করাও একটু।
মা বললেন- চলো সবাই ঘরে।
একটা অদ্ভূত অন্যরকম আনন্দ সবার মনে।
রন্তু আর সন্তু দু’জন বাগানের চারপাশে তাকাল। মনে হলে গাছগুলো যেন পরম আনন্দে হাসছে।
মৃদু হাওয়ায় সবুজ পাতা দুলিয়ে বাগানের সবগাছগুলোই যেন বলছে- গাছের জন্মদিন করে তোমরা আমাদের চিরবন্ধুত্বের স্বীকৃতি দিলে।
কমলালেবু গাছটির দিকে আবার তাকাল ওরা। মনে হলো- গাছটি যেন সানন্দে, সকৃতজ্ঞ চোখে ওদের দিকে চেয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে সবুজাভ হাসি।
loading...
loading...
সুন্দর অণুগল্প। প্রাণঢালা শুভেচ্ছা কবি শংকর দেবনাথ। শুভ সকাল।
loading...
ধন্যবাদ দাদা
loading...