পানা-পুকুর

– আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
-কেন?
-দম আটকে আটকে আসছে, পানা।

পুকুর পানাকে তার কষ্টের কথা বলছে।

বছর দু’য়েক আগে এক বর্ষার রাতে জলের ধারায় ভাসতে ভাসতে একটা পানা এসেছিল পুকুরে। অসহায়ভাবে আশ্রয় চেয়েছিল।
-পুকুর, তোমার বুকের এক কোণায় আমাকে একটু থাকতে দাও। আমি ঘুরে ঘুরে খুব ক্লান্ত হয়ে গেছি। আর পারছি না।
পুকুরের তরল হৃদয় বাষ্পায়িত হয়।
-ঠিক আছে। থাক না।
ভালবেসে পানাকে বুকে ঠাঁই দিয়েছিল পুকুর। আদরে-সোহাগে সবুজ সতেজ করেছিল তার দেহ-মন।

পানা নিশ্চিন্ত আশ্রয় পেয়ে সংসার সাজাতে মেতে ওঠে। বংশ বিস্তার করতে থাকে। ফুল ফোটায়। তাদের বেগুনি হাসিতে পুকুর মুগ্ধ হয়। পাড়ে দাঁড়িয়ে যখন কোনো মানুষ বলে – বাহ্ কি সুন্দর লাগছে পুকুরটাকে। ফুলে ফুলে যেন সেজে আছে । তখন পুকুরটি ভারি আহ্লাদিত হয়। পানাকে ডেকে বলে – তোর ফুলের জন্য আমাকে কত মানুষ প্রশংসা করছে দেখ।
পানা হাসে।
পুকুর আবার বলে- হ্যাঁ রে পানা, তোর ফুলের রঙ তো ভারি সুন্দর। দেখে দু’চোখ ভরে যায়।
পানা সহাস্যে বলে- তোমাকে আনন্দ দিতে পেরে আমি ধন্য।
– তাই? কিন্তু কেন রে ?
-হ্যাঁ গো পুকুর। তুমি যে আমার আশ্রয়দাত্রী। মায়ের মত। তোমার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
পুকুর বিনয়ের সাথে বলে- না না। ওভাবে বলিস না। এটা তো আমার কর্তব্য।
পানা সানন্দে বলে- তোমাকে আমার ফুল আনন্দ দিতে পারছে জেনে আমার কী যে ভাল লাগছে। এছাড়া তোমাকে আর কীই বা আমি দিতে পারি। তোমার অতবড়ো বুকে আমার বংশধরদের নিরাপদ ঠাঁই দিয়েছো। আগলে রেখেছো মায়ের মমতায়। তোমার এ ঋণ শোধ করার কোনো সাধ্য তো আমার নেই। শুধু —
পুকুর পানাকে থামিয়ে বলে- ছাড় ওসব। দেখ তোর ছানাপোনারা কেমন সবুজ হয়ে উঠেছে।
– সে সবই তো তোমার ভালবাসায় আর দয়ায় পুকুর।

রাতে যখন চারপাশ নীরব হয়ে যায় তখন পানা আর পুকুর নানা গল্পে মেতে ওঠে।

এভাবেই ওদের দিন যায়। রাত আসে। সময় গড়াতে থাকে জলের মত। আর পানার ছানাপোনা বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে ছানাদের ছানাপোনা। আর দখল করতে থাকে পুকুরের বিশাল বুকটাকে।

পুকুরের একটু কষ্ট হলেও সব মেনে নেয় সে। কারণ সে-ই তো একদিন ঘর দিয়েছিল পানাকে। বুকের পরে রেখে অাপন করে নিয়েছিল। খুশি হয়েছিল তার একাকীত্বের ফাঁকা বুকে একজন ছোট্ট সাথি পেয়ে। আশ্রয়হীনকে আশ্রয় দিয়ে।

কিন্তু আজ? পুকুরের সারাবুক পানায় পানায় ভর্তি। যেন পাষাণের মত চেপে বসে আছে। এতটুকু ফাঁকা জায়গা নেই তার জলীয় বুকের কোথাও।

পুকুর আগের মত আর আকাশ দেখতে পায় না। রাতে চাঁদের সাথে লুকোচুরি খেলায় মাততে পারে না। বাতাস তার গায়ে হালকা ঢেউয়ের পরশ বোলাতে আসে না। মাছেরা-হাঁসেরা- দামাল ছেলেমেয়েরা হইচই করে সাঁতার কাঁটতে আসে না। তার সমস্ত বুকই যে আজ পানাদের অধিকারে। পুকুরের মাঝেমধ্যে মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। ভাবে- পানাকে ঠাঁই দিয়ে কি তবে ভুল করেছে পুকুর?

– আমি আর পারছি না পানা। তুই একটা কিছু কর। আমার বুকের তলটা যে তোদের মরা শেকড়-বাকড়ে ভরাট হয়ে আসছে। আমি দিনদিন মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি তো। পানা, তুই একটা কিছু কর। নইলে – ভয়ার্ত হতাশার সুর পুকুরের গলায়।
– কি করি বলো তো?
– শ্বাস নিতে পারছি না। তুই তোর বংশ আর বাড়াস নে পানা।
– সে কি করে হয় পুকুর!
-তোর আশ্রয়দাত্রীকে এভাবে তোর বংশধররা গলা টিপে মেরে ফেলছে দেখেও চুপ থাকবি?

পানা উত্তর দেয় না।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৮ টি মন্তব্য (লেখকের ৪টি) | ৪ জন মন্তব্যকারী

  1. রিয়া রিয়া : ১২-১০-২০১৮ | ১৭:০৪ |

    অপার মুগ্ধতা নিয়ে অণুগল্পটি পড়লাম। আমার ভীষণ লেগেছে দাদা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

    GD Star Rating
    loading...
  2. মুরুব্বী : ১২-১০-২০১৮ | ১৭:২০ |

    গল্পটি হৃদয়ে গাঁথা হয়ে রইলো মি. শংকর দেবনাথ। অসাধারণ একটি লিখা।  

    GD Star Rating
    loading...
  3. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ১২-১০-২০১৮ | ২১:৩৪ |

    অণুগল্পটি সুন্দর হয়েছে শংকর দা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
  4. মিড ডে ডেজারট : ১৩-১০-২০১৮ | ১৪:০৬ |

    পারফেক্ট ফিনিশিং !

    GD Star Rating
    loading...
    • শংকর দেবনাথ : ১৩-১০-২০১৮ | ১৮:৫২ |

      ধন্যবাদ। শুভেচ্ছা।

      GD Star Rating
      loading...