ছড়াদাদুর পাঠশালা ৭

আজকের আলোচনা হবে অনুপ্রাস নিয়ে – ছড়াদাদু বলেন।
ওরা পাঁচজন মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
তবে তার আগে তিনপ্রকার ছন্দের মধ্যে পার্থক্যটা সংক্ষেপে একটু করা যাক।
-ঠিক। – ওরা সম্মতি জানায়।
-স্বরবৃত্তে রুদ্ধদল একমাত্রা আর মুক্তদলও একমাত্রা।
মাত্রাবৃত্তে রুদ্ধদল দুইমাত্রা আর মুক্তদল একমাত্রা।
অক্ষরবৃত্তে শব্দের শুরুর রুদ্ধদল একমাত্রা আর শব্দের শেষের রুদ্ধদল দুইমাত্রা।
পর্বের ক্ষেত্রে স্বরবৃত্ত চারচার চালে চলে। মাত্রাবৃত্ত চার, পাঁচ, ছয় ও সাত মাত্রার চাল হতে পারে। আর অক্ষরবৃত্তে মুলত চারমাত্রার চালে চলে। এটাকে আট বা দশ মাত্রা হিসেবেও গোনা যায়।
স্বরবৃত্ত চটুল, মাত্রাবৃত্ত শান্ত আর অক্ষরবৃত্ত গম্ভীর। স্বরবৃত্ত শ্বাসাঘাত বা ঝোঁকপ্রধান, মাত্রাবৃত্ত ধ্বনিপ্রধান আর অক্ষরবৃত্ত তানপ্রধান ছন্দ।
আর একটা কথা যদিও আমরা ছড়ার আলোচনায় বসেছি, তবু তোমার জ্ঞাতার্থে এখন মুক্ত বা গদ্যছন্দ নিয়ে দু’চার কথা বলবো।
– আদৃতা বলে – খুব ভাল হয় তাহলে।
দেখ, ছন্দ তো মূলত তিনপ্রকার। গদ্য বা মুক্ত ছন্দ আসলে কোনো ছন্দ নয়। মাত্রাসমতা ঠিক রেখে পর্ব কম-বেশি করে লেখা হলে মুক্তছন্দ আর টানাগদ্যে লেখা হলে গদ্যছন্দ।
অক্ষরবৃত্তই এই কাজের উপযুক্ত। তবে অন্য ছন্দও অসম্ভব নয়। এ বিষয়ে আলোচনা আর না এগিয়ে আমরা অনুপ্রাসে যাই।
দাদু একটু থেমে বলেন- -অনুপ্রাস হল একধরনের শব্দালংকার। অনু শব্দের অর্থ পরে বা পিছনে আর প্রাস শব্দের অর্থ বিন্যাস, প্রয়োগ বা নিক্ষেপ। একই ধ্বনি বা ধ্বনি গুচ্ছের একাধিক বার ব্যবহারের ফলে যে সুন্দর ধ্বনিসাম্যের সৃষ্টি হয় তার নাম অনুপ্রাস। এর ফলে সৃষ্টি হয় একটি সুন্দর ধ্বনি সৌন্দর্যের। যেমন ধরো-
“কাক কালো কোকিল কালো কালো কন্যার কেশ।” এখানে ক বর্ণটি ৭ বার ব্যবহৃত হয়েছে। এটাই হল অনুপ্রাস।
অনিক জানতে চায় – এই অনুপ্রাস কত রকম হতে পারে ছড়াদাদু?
– তিনরকম- ছড়াদাদু বললেন- অন্ত্যানুপ্রাস, বৃত্ত্যনুপ্রাস এবং ছেকানুপ্রাস।
কবিতার এক চরণের শেষে যে শব্দধ্বনি থাকে অন্য চরণের শেষে তারই পুনরাবৃ্ত্তিতে যে অনুপ্রাস অলঙ্কারের সৃষ্টি হয় তার নাম অন্ত্যানুপ্রাস। অর্থাৎ কবিতার দু’টি চরণের শেষে যে শব্দধ্বনির মিল থাকে তাকেই অন্ত্যানুপ্রাস বলে।
যেমন – হাঁস বলে – ও হাঁসিনী,
দু’জন মিলে পুকুর-বিলে
বল্ কতদিন ভাসিনি?
এখানে হাঁসিনী আর ভাসি নি। একে অন্ত্যমিলও বলা হয়ে থাকে।

একটি ব্যঞ্জনধ্বনি একাধিকবার ধ্বনিত হলে, বা বর্ণগুচ্ছ স্বরূপ অথবা ক্রম অনুসারে বহুবার ধ্বনিত হলে যে অনুপ্রাসের সৃষ্টি হয় তাকে বলা হয় বৃত্ত্যনুপ্রাস।
যেমন: কাক কালো কোকিল কালো কালো কন্যার কেশ। বা চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা।
এখানে প্রথমটিতে ক এবং দ্বিতীয়টিতে র বা আর বৃত্তের মত বৃহুবার উচ্চারিত হয়েছে।

আর দুই বা ততোধিক ব্যঞ্জনধ্বনি যুক্ত বা বিযুক্ত ভাবে একইক্রমে মাত্র দু’বার ধ্বনিত হলে যে অলঙ্কারের সৃষ্টি হয় তার নাম ছেকানুপ্রাস। একে আদ্যানুপ্রাসও বলা হয়ে থাকে। এ ধরণের অনুপ্রাসের বাস্তব ব্যবহার বাংলায় খুব বেশি দেখা যায় না।
যেমন: অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?
আসলে এগুলো তো অলঙ্কার। হলে ভাল লাগে। শব্দচলনে একটা সমধ্বনির অনুরনণ আসে। পড়তে ভাল লাগে।

আদৃতা জানতে চায় – ছড়ার ক্ষেত্রে অন্ত্যমিলটা বাধ্যতামুলক। কিন্তু অন্যগুলো না হলে কি কোনো ত্রুটি হয় ছড়াদাদু?

দাদু বলেন- অন্ত্যমিল বাধ্যতা মূলক ঠিকই কিন্তু অন্তে মিল না রেখেও যে লেখা যাবে না তা কিন্তু নয়। ছন্দচলনটা ঠিক থাকলে ওটা গৌণ হয়ে যায়, তা ইদানিং কোনো কোনো ছড়াকার তো দেখিয়েছেন।
-তাই? মামুন বিস্মিত হয়।
-একটা উদাহরন দিতে পারবেন দাদু? – অনিক বলে।
– শোন তবে- দাদু বলেন-
দুয়ারে নীরবে দাঁড়িয়ে বাতাস
বাড়িয়ে বাউল-ডানা,
হৃদয় নাড়িয়ে চলে যায় দুরে
বলে যায় নানা কথা।
এখানে দেখ লাইন শেষে অন্ত্যমিল নেই। কিন্তু দাঁড়িয়ে, বাড়িয়ে, নাড়িয়ে -অনুপ্রাসের ব্যবহারে আর স্বরবৃত্তের চলনে লেখাটি ছন্দময় হয়ে উঠেছে।
ওরা একসাথে -বাহ্ – বলে ওঠে।
দাদু বলেন – আসলে কবিতা বা ছড়া রচনার প্রধান শর্ত হল সাবলীল আর নির্ভুল ছন্দ। অন্ত্যমিল নয়। (চলবে)

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১৯ টি মন্তব্য (লেখকের ৯টি) | ৮ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ২৩-০৯-২০১৮ | ৮:২৫ |

    পাঠশালায় আজ আমিই প্রথম। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_yahoo.gif আজকে শিক্ষানুরাগীর সংখ্যা কেমন হবে জানি না; কারণ বাংলাদেশের ওয়ার্কিং ডে আজ থেকে শুরু। পড়লাম এবং আমার এই অবাধ্য মগজকে কিছু শেখার সুযোগ করে দিলাম। ধন্যবাদ মি. শংকর দেবনাথ। শুভ সকাল। Smile

    GD Star Rating
    loading...
    • শংকর দেবনাথ : ২৩-০৯-২০১৮ | ১০:৩৮ |

      ভাল লাগল। তবে ব্লগে পাঠকসংখ্যা খুব কম। এখানে শেখার সংখ্যা কম। লেখার সংখ্যা বেশি।

      GD Star Rating
      loading...
      • মুরুব্বী : ২৩-০৯-২০১৮ | ১১:০২ |

        ঠিক বলেছেন। লিখা দিয়ে প্রস্থান করেন। হয়তো ব্যস্ত বলেই।

        GD Star Rating
        loading...
  2. রিয়া রিয়া : ২৩-০৯-২০১৮ | ১৩:০০ |

    লেসন নিতে চলে এসেছি। মন্তব্য করবো না শেখার জন্য সংগ্রহ করে নিয়ে গেলাম। Smile

    GD Star Rating
    loading...
    • শংকর দেবনাথ : ২৩-০৯-২০১৮ | ১৩:১৫ |

      বাহ্, আপনাদের মতামত না পেলে লেখায় উৎসাহ কমে যায়।

      GD Star Rating
      loading...
  3. মিড ডে ডেজারট : ২৩-০৯-২০১৮ | ১৫:০৯ |

    ভীষণ দামি পোস্ট।

    GD Star Rating
    loading...
  4. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ২৩-০৯-২০১৮ | ১৫:১৫ |

    ক্লাসে আসে দেরি হলো। কিছু কিছু শিখতে পাচ্ছি। জানিনা চর্চা করতে পারবো কিনা। ধন্যবাদ আপনাকে।

    GD Star Rating
    loading...
    • শংকর দেবনাথ : ২৩-০৯-২০১৮ | ১৫:১৮ |

      ধন্যবাদ সৌমিত্রদা 

      GD Star Rating
      loading...
  5. ইলহাম : ২৩-০৯-২০১৮ | ১৮:০২ |

     ঐ যে ওদের সাথে পাঠশালায় এক জন আছে সে জানতে চাইছে,

    চুল / তার

    কবে / কার

    বিদি / শার

    অন্ধ / কার

    এটা কোন প্রকারের অনুপ্রাস এর মধ্যে পড়ে!

    GD Star Rating
    loading...
    • শংকর দেবনাথ : ২৩-০৯-২০১৮ | ১৯:০৭ |

      বৃত্তানুপ্রাসের মধ্যে পড়ে। এখানে তার কার কার শার – বৃত্তের মত এসেছে 

      GD Star Rating
      loading...
      • ইলহাম : ২৩-০৯-২০১৮ | ২০:৪৮ |

        সেই ছেলেটি ছড়াদাদুকে নমষ্কার জানিয়েছে!!!!https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

        GD Star Rating
        loading...
      • শংকর দেবনাথ : ২৩-০৯-২০১৮ | ২১:৪৭ |

        ছড়াদাদুকে জানিয়ে দিলাম

        GD Star Rating
        loading...
  6. মুহাম্মদ দিলওয়ার হুসাইন : ২৩-০৯-২০১৮ | ২০:২৫ |

    * আজও অনেক পুরনো পড়াগুলো মিলিয়ে নিলাম। ধন্যবাদ কবি … https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

    GD Star Rating
    loading...
  7. শাকিলা তুবা : ২৩-০৯-২০১৮ | ২২:২২ |

    মুগ্ধ হবার মতো আলোচনা পড়লাম।

    GD Star Rating
    loading...
  8. নাজমুন : ২৩-০৯-২০১৮ | ২২:৩১ |

    আজ অনেকেই  ছন্দের বিরুদ্ধে একপ্রকার বিদ্রোহ ঘোষনা করছে । 

    তারা মনে করছেন ছন্দ  প্রবাহমান ধারাকে অনেকটা যেনো রুদ্ধ করে দেয় । কবি তখন ভাবের চাইতে স্ট্রাকচারের  দিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন । 

    আপনি কি মনে করেন ? ছন্দ কি ভাবপ্রকাশে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না ?

     

    GD Star Rating
    loading...
    • শংকর দেবনাথ : ২৩-০৯-২০১৮ | ২২:৪৮ |

      আপনি এই যে কথাগুলো ব্যাকরণের নিয়ম মেনে লিখলেন, এটাই ছন্দ। এতে কি আপনার ভাব প্রকাশে বিঘ্ন ঘটেছে? আসলে ছন্দ মানে লাইন শেষে মিল নয়, ছন্দ হল বাক্যের মধ্যে শব্দসমুহের সাবলিল চলন। সেটা দক্ষ গদ্যলেখকের গদ্যেও থাকে। আমার মুখের আটপৌরে ভাষাতেও থাকে। তাই ছন্দ কখনও বন্ধন নয়- বাঁধাহীন নিটোল চলন। এটা মনে রাখতে হবে। যারা টানা গদ্যে কবিতা লেখেন, তারাও তাই বলেন গদ্যছন্দ।

      GD Star Rating
      loading...