জহির রায়হানের মত অসাধারণ জীবনশিল্পীর হাতেই নির্মিত হয়েছে এই সাদামাটা আখ্যান। কোথাও রহস্যময়তার জালে পাঠককে আটকাবার ফন্দি আটেন নি, তবুও পাঠক মধ্যপথে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় না, এগিয়ে যায়। এগিয়ে যায় জীবনরসের শেষ বিন্দুটুকু আহরণের জন্য। আখ্যানের শেষে এসেই চমকে উঠে পাঠক। এ কী ঘটল ! জীবনটা তো এমন হওয়ার কথা ছিল না। এটাকেই বুঝি বলে নিয়তির নির্মম পরিহাস ? হ্যাঁ, উপন্যাসটির শেষে এসেই বুঝতে পারা যায় সাদামাটা আখ্যানের ভিতর দিয়েই এক অসাধারণ শিল্প-সার্থকতা ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন এই জীবনশিল্পী ।
আখ্যানের মত উপন্যাসের নায়কও সাদামাটা। কাসেদ। মধ্যবয়সী এক যুবক। কেরানিগিরি তার পেশা। মা ছাড়াও তার ছোট্ট পরিবারে আছে নাহার। নাহার তার কেউই নয়। ছোট্টবেলায় বাবা-মাকে হারিয়ে কাসেদদের বাড়িতে তার আশ্রয় হয়েছে। কাসেদের মা এই মেয়েকে নিজের সন্তানের মত মায়া-মমতা দিয়েই বড় করেছেন। কাসেদের মত নাহারকে নিয়েও মায়ের সমান চিন্তা। ভালো দেখে একটা পাত্র জুটিয়ে নাহারকে বিয়ে দিবেন, মেয়েটি যেন তার চিরকালই সুখে থাকে ।
বেশিরভাগ সময় কেরানিগিরি নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও কাসেদের ভিতরে আছে এক রোমান্টিক মন। মাঝেমধ্যে টুকটাক কবিতাও লেখে কাসেদ। অবসর পেলেই সে জীবিকার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে এক অন্যরকম রোমান্টিক ভাবসাগরে আত্মনিমগ্ন হয়। জাগিয়ে তোলে কল্পনার চিত্রপটে আঁকা তার মানসীর ছবি। মানসীর নাম জাহানারা।
‘একদিন জাহানারাকে বিয়ে করবে কাসেদ। অর্থের প্রতি তার লোভ নেই। একগাদা টাকা আর অনেকগুলো দাসীবাঁদীর স্বপ্নও সে দেখে না। ছোট্ট একটা বাড়ি থাকবে, শহরে নয়, শহরতলীতে, যেখানে লাল কাঁকরের রাস্তা আছে আর আছে নীল সবুজের সমারোহ। মাঝে মাঝে দুপায়ে কাঁকর মাড়িয়ে বেড়াতে বেরুবে ওরা।’—
জাহানারাকে নিয়ে এমনই স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকে কাসেদ।
কিন্তু সময় যতই সামনে গড়ায় জাহানারাকে নিয়ে তার স্বপ্নের আলোগুলি ততই ক্ষীণ হয়ে আসে। জাহানারাকে কাসেদ ভালোবাসে, কিন্তু জাহানারা কি বাসে ? কাসেদ এর উত্তর খুঁজে পায় না। সংশয়ে পড়ে যায় কাসেদ।
এই সংশয়ের মধ্যেই কাসেদের জীবনে আবির্ভাব ঘটে আরো একটা মেয়ের— শিউলি। জাহানারাদের বাড়িতেই শিউলির সাথে প্রথম দেখা, প্রথম পরিচয়। সে জাহানারার কাজিন। শিউলি একটু একটু করে ঘনিষ্ঠ হতে চায় কাসেদের জীবনে। কিন্তু কাসেদ ভালোবাসে জাহানারাকেই। বিয়ে যদি তার কাউকে করতে হয়, জাহানারকেই করবে।
আকস্মিক একদিন একটি মেয়ে কাসেদের হাত ধরে পালিয়ে যেতে চায়। মেয়েটি জাহানারা নয়, শিউলিও নয়— সালমা। সালমা কাসেদের খালাতো বোন। কাসেদের ছোটবেলার খেলার সাথী। সালমা এখন অন্যের বিবাহিতা স্ত্রী। তার ছোট একটা বেবিও আছে। তবুও সালমার জীবনে এক অন্তহীন শূন্যতা। ভীষণ অসুখী সে। সুখের সন্ধানে সে ফিরে আসতে চায় বাল্যপ্রেমের কাছে। কিন্তু কাসেদ ওত ছেলেমানুষ নয়। সে সালমার ডাকে সাড়া দেয় না। শূন্য হাতেই ফিরিয়ে দেয় সালমাকে।
এদিকে শিউলি এসে কাসেদকে এমন একটা সংবাদ দেয়— শুধু চমকেই উঠে না কাসেদ; বিষাদের ঘন কালো ধোঁয়ায় ভরে উঠে হৃৎপিণ্ড। জাহানারা অন্য একজনকে ভালোবাসে ! ছেলেটা গান শেখায় জাহানারাকে। ওতেই ভালোলাগা, তারপর প্রেম। জাহানারা অন্য কারো হয়ে গেছে— কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না কাসেদ। সে জাহানারার কাছে ছুটে যায়। জাহানারাকে সব মনের কথা বুঝিয়ে বলবে, সব। কিন্তু মনের কথা মনেই রয়ে যায়। জাহানারা সেদিন কাসেদকে বাড়ির দরজা থেকে বিনা বাক্যে ফিরিয়ে দেয়।
ব্যথায় অভিমানে কাতর কাসেদ শিউলির সামনে এসে দাঁড়ায়। নিউমার্কেটের মোড়ে। সন্ধ্যার ধূসরতায় ঢেকে গেছে পুরো শহর। শিউলি মিটি মিটি হাসছে। শিউলির মাঝে তার তার মানসীকে আবিষ্কার করতে চায় কাসেদ। না, পারে না, এবারও কাসেদ ব্যর্থ ! শিউলিও তাকে প্রত্যাখ্যান করে ! তখন সালমাকে খুব মনে পড়ে কাসেদের।
বিপন্ন কাসেদ অবশেষে আপন নীড়ে ফিরে আসে। তার মায়ের কাছে। সেই রাতেই মাও তার চলে যায় অনেক দূরে— যেখানে গেলে কেউ ফিরে আসে না। দুঃস্বপ্নের বালুচরে হাতড়াতে হাতড়াতে ক্লান্ত কাসেদ ধপ করে শুয়ে পড়ে বিছানায়।
মায়ের মৃত্যুর দু’দিন পরে আবারও চমকে উঠে কাসেদ ! সময়টা তখন শেষ বিকেল। মেয়েটি তার সামনে দাঁড়িয়ে— শেষ বিকেলের মেয়ে। পরনে শাড়ি, গায়ে হলুদমাখা। আগামিকাল মেয়েটির বিয়ে। মেয়টি জাহানারা নয়, শিউলি নয়, সালমা নয়— মেয়েটি নাহার। না, নাহারকে কাসেদ ফিরিয়ে দেয় না।
loading...
loading...
জহির রায়হানের ‘শেষ বিকেলের মেয়ে‘ উপন্যাসটির চমৎকার রিভিউ হয়েছে। আপনি সঠিক বলেছেন, সাদামাটা আখ্যানের ভিতর দিয়েই এক অসাধারণ শিল্প-সার্থকতা ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন জহির রায়হান।
শব্দনীড় এ আপনাকে স্বাগতম মি. সালমান মাহফুজ। সাথে থাকুন।
loading...
শব্দনীড়ে আপনাকে স্বাগতম।
সবায় যখন বাহুবলী-২ বা কাশেম বিন আবুবাকার কে নিয়ে ব্যাস্ত তখন আপনার এই লেখনী আমাদের আপ্লুত করে। আমি মনে করি এটা একটা প্রসংশিত বিপরীত ধারা।
চমৎকার রিভীউ।
আশা করি শব্দনীড়ে আপনার পথ চলা হবে আনন্দের।
loading...
আপনাকে শব্দনীড়ে স্বাগতম জানাই। আহলান সাহলান।
আপনার রিভিউ আমার খুবই ভাল লেগেছে। শেষ বিকেলের মেয়ে আমি পড়েছি, বেশ আগে। আপনি ঠিক ধরেছেন, সহজ সরলের মাঝে এক অসাধারন শিল্প। আমার ধারনা হুমায়ুন আহমেদ একই ধারার লেখক।
আশা করি এই ধরনের সাহিত্য সমৃদ্ধ লিখা দিয়ে আমাদের মুগ্ধ করবেন। অনেক কবিতার ভীড়ে আপনার এই বুক রিভিউ পড়ে যেন দু দন্ড শান্তি পেয়েছিলাম। শব্দনীড়ে আপনার পথচলা শুভ হোক।
শুভ ব্লগিং।
loading...
আপনাকে স্বাগতম শব্দনীড়ে ! ভালো লাগলো আপনার বুক রিভিউ ! আরও চাই এমন সরস লিখা !
loading...