ধূপছায়ার কঠিন জেদ।
ঃ মায়ের কথা বলো।
ঃ সেই গল্পটার কথা মনে আছে তোমার ? ওই যে…..
নিঝুম এড়িয়ে যেতে চায় ধূপের জেদ। ধূপ ফের বলে।
ঃ মায়ের কথা বলো।
ঃ….. চাঁদ হারিয়ে গেলে যে রাত পড়ে থাকে….
কথা শেষ হয়না নিঝুমের, ধূপ কঠিন গলায় বলে
ঃ গল্পের কথা অনেক শুনেছি। এবার একজন মায়ের গল্প শুনতে চাই।
আকাশের দিকে তাকালো নিঝুম। নিঃশব্দে সন্ধ্যার আলোআঁধারি আকাশে মেঘের তোলপাড় গুনলো। মেঘেরা খন্ডিত হয়, টুকরো টুকরো হয়, তবুও ভাসে। খুব কষ্ট হলে মাটির কাছে জল গুলো জমা রাখে।
নিঝুম মেঘ হয়, খন্ডিত হয় ধূপের কথায়। জল হয়ে ঝরতে চায়। মাটি খুঁজে পায় না। তার পায়ের তলায় রাশি রাশি কংক্রিট।
আনমনে বলে ওঠে
ঃ মা মানে কয়েকটি সন্তানের জননী। মানুষ করার নামে মা ই তাদেরে অমানুষ হিসেবে গড়ে তোলে।
অবাক বিস্ময়ে তাকায় ধূপ। ঘোর লেগে যায়
ঃ মা কোথায়?
ঃ এখানে বা ওখানে ধুঁকে ধুঁকে মরছে।
ঃ সন্তানেরা?
ঃ ব্যস্ত। সব মা সন্তানদের ব্যস্ত বানাতেই তো চায়।
ঃ হ্যাঁ, ব্যস্ত মানুষ বানাতে চায়।
ঃ ব্যস্ততা তাদেরে আর মানুষ রাখে না। ওরা যন্ত্র হয়। অনুভূতি শূণ্য কিছু অমানুষ।
ধূপছায়ার মায়ের ম্যাসিভ এটাক হয়। নিঝুম ভাবে এমন একজন মা যার কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত সন্তান থাকা সত্ত্বেও তিনি পরনির্ভর আজ। গৃহকর্মীদের কাছে থাকেন। সন্তানেরা ব্যস্ততার অজুহাতে মাকে দেখতে আসে না। তিনি জগত সংসারে এখন একা।
নিঝুমের কষ্ট হয়। নিজের মাকে মনে পড়ে। মা এখন কোথায়? সে জানে সব; তবুও অজানার কাছে নতজানু হয়।
ছয় বছরের নিঝুম কোন এক লাল বেনারসি দেখে একা হয়েছিল। ট্রেনের শেষ হুইসেলের মতো বেনারসির আঁচল দুলিয়ে মা সেই অজানায় হারিয়ে গিয়েছিল তার।
এখন আর মাকে ভাবে না সে। বাবার মৃত মুখটাও কেমন ঝাপসা। নিঝুমের ভাবনা ছাড়িয়ে মা হয়তো দূরের কোন গাঁয় শাপলার ঝিলে অশ্রু ঝরান। মৃত বাবা সে অশ্রুতে নেয়ে পবিত্র হন। আর জীবিত বাবার বাকি সন্তানেরা মায়ের আঁচলটায় গিঁট দিয়ে রাখে তাদের সুখের চাবি।
গাঁও গেরামের মায়েরা একা থাকেন না। তাদের সন্তানেরা বড় মানুষ হতে গিয়ে যন্ত্র হয় না। নিঝুমকে একা রেখে গেলেও মা একা থাকেন না। বছর ঘুরতেই তিনি দুকা হন, তারপর তিনকা, চারকা।
ধূপ ঢোক গিলে। সে আর মায়ের গল্প শুনতে চায় না। নীরবে পুড়তে থাকে। অপরাধী হয়।
ম্যাসিভ এটাক তার মাকে শ্বাসরুদ্ধ করতে যেয়েও পারেনি। কারণ তারা আল্লাহ্র নামে গরু, খাশী উৎসর্গ করেছিল। মসজিদে মসজিদে হুজুরদের দিয়ে দোয়াদরুদ ও কম করায় নি।
অসুখটা হয়তো গরু, খাশীর ভয়ে ভড়কে গিয়ে মাকে ছেড়ে দিয়েছিল এবারের মতো। বেঁচে যাওয়া এক অথর্ব মা এখন সংসারের বোঝা। সে বোঝা এতটাই ভারী যে উচ্চ শিক্ষিত সন্তানদের কাঁধটা একেবারে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়ার মতো। তারা ভয় পেলো। মা তাদের সব ভয় অন্তরে গোপন করে একা হলেন।
নিঝুমের মাকে খুঁড়ে বের করতে যেয়ে ধূপছায়ার চোখে নিজের মায়ের ছবি ভেসে উঠলো। লজ্জা হলো হয়তো তার। কিন্তু তাও ক্ষণিকের। তার সহোদরেরা যন্ত্র হয়েছে তারই মতো। যন্ত্র মানেই তো অমানুষ — মনুষ্যত্ববোধহীন জড়পিন্ড।
নিঝুম হাসে, ধূপের ঠোঁট জলশূন্য হয়। ঢোক ও গিলতে পারে না আর। ছুটে পালাতে চায়। আড়ষ্ট পা দু’টোকে নাড়াতে পারে না।
অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে নিঝুম। এবার খন্ডিত মেঘ নয়, অবিরাম জলরাশি হয়ে ঝরে। কংক্রিটে নয় মাটিতেই জল গড়ায়।
চার ভাইবোনকে দুই হাতে আগলে রাখতে গিয়ে মা নিজের অজান্তেই উঁচু প্রাচীর তৈরী করে ফেলেছিলেন। এত উঁচু যে, এই প্রাচীর টপকে মনুষ্যত্ববোধ ঘরে এসে ঢুকেনি। চাঁদ হারানো রাতের মতো তাই তিনি এখন একা।
ঃ মায়ের কথা শুনতে চাও না ধূপ?
ঃ চুপ করো।
ঃ কষ্ট না লজ্জা?
ঃ চুপ করো নিঝুম।
ঃ যার মায়ের দু’বার লাল বেনারসি পরার ঘটনা ঘটে এবং তার একবার নিজ সন্তানের সামনেই ঘটে, সেই হতভাগা সন্তানের কথা অন্তত জেনে যাও।
ঃ আমি আর শুনতে চাই না।
কান্নায় ভেঙে পড়ে ধূপছায়া।
ঃ ধূপ আমার মতো সন্তানরা শুধু নয়, ব্যস্ত সন্তানরাও দুর্ভাগা হয় তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো এখন ?
ঃ নিঝুম আমি আর পারছি না।
কিভাবে পারবে ধূপছায়ারা ! তাদের সে ক্ষমতা লুপ্ত। ধূপছায়াদের দুর্ভাগ্যকে মানিয়ে নিতে গিয়ে সব মায়েরা আজ অসহায়। শুধু অসহায়ত্বের ধরণটা ভিন্ন।
নিঝুম খোলা আকাশের নীচে পথ চলে। চলতে চলতে কখন যে ট্রেন লাইনের পাশে এসে দাঁড়ায় বুঝতে পারে না। কু ঝিক ঝিক ট্রেনটা কোন এক গাঁয়ের পাশ দিয়ে চলে যায় প্রতিদিন, যেখানে শাপলার ঝিলে আজো নোনা জল গড়ায়।
আর ধূপ ! সে তো আটকে থাকে টাইম মেশিনের স্থবির প্রেজেন্ট এ্যপস্ এ।
loading...
loading...
অণুগল্পের সব মশলার পরিমিত ব্যবহার করে লিখা পারফেক্ট অণুগল্প এটি। ভীষণ মুগ্ধ হয়েছি!
কোন কোন মায়ের সন্তানেরা বড় হতে হতে আর সন্তান থাকেনা; তারা মায়ের ম্যাসিভ এটাকে “আল্লাহর নামে গরু খাসি উৎসর্গ” করে দায় সেরে দেয়। যতো উঁচুতলার মা-ইই হোননা কেন তিনি অসহায় মা। আবার কোন কোন মা তার পিতৃহীন সন্তানের চোখের সামনে লাল বেনারসি পরে অন্যের ঘরে চলে যেতে বাধ্য হন। একা রেখে আসা সেই সন্তান একাই রয়ে যায়। সেই মা হয়ত আর একা থাকতে পারেননা, “দুকা হন, তারপর তিনকা বা চারকা”। এই মা-ও অসহায় মা যিনি “দূরের কোন গাঁয় শাপলার বিলে অশ্রু ঝরান”।
মা নিয়ে এই কাহিনির ভাজে ভাজে জমা রাখা মায়েদের দুঃখ কিংবা অসহায়ত্ববোধ পাঠকের অন্তরে আঁচড় কাটবে। এর অসাধারণ সমাপ্তিতে আমি ভীষণ মুগ্ধ হয়েছি।
বিন্দুর সমান একটা লেখা পড়লাম। কিন্তু এর ভিতরে থাকা সিন্ধুর সমান একটা গল্প অন্তর ভরে নিয়ে গেলাম যা পড়তে দীর্ঘ সময় লেগে যাবে।
loading...
সাহিত্যের আলোচনা বা সমালোচনা ও যে সাহিত্য হতে পারে তা এই মন্তব্য না পড়লে বুঝা যাবে না। অবশ্য বাস্তব সমালোচনাকে সাহিত্যের আওতাভুক্ত করা হয়েছে বহু আগেই।
একজন গল্পকার নিজের কিছু কাল্পনিক অনুভূতিকে ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে যদি পাঠকের অন্তরে প্রবেশ করতে পারে তবেই সার্থকতা আসে। এখানে আমার হযবরল লেখাটাও পাঠক প্রিয়তা পেতে পারে ভাবিনি ।এত সুন্দর মন্তব্য ও যে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল তাও কল্পনা করিনি। কৃতজ্ঞতা সহ ধন্যবাদ জানাই ।নিরন্তর শুভকামনা।
loading...
নিশ্চিত বলে দেয়া যেতে পারে হৃদয় ছোঁয়া একটি লিখা। রচনায় অসম্ভব সৌন্দর্য্য।
অণুগল্পের স্বরূপ এমনটাই মানায় ভালো। শুভ সন্ধ্যা আপা।
loading...
অণুগল্প বা অণু সাহিত্য কেনো যেন আমার মন ভরাতে পারে না। তবে এটাও সত্য যে ডিজিটাল পাঠকের এত সময় কোথায় ? অণু দিয়েই তাদের সাহিত্য ক্ষুধা মেটাতে হয়। ধন্যবাদ সুুন্দর মন্তব্যের জন্য।
loading...
মিড দা'র মন্তব্যের পরে আসলে বাড়তি মন্তব্য চলে না। তিনি বরাবরই ডিটেইল এন পজেটিভ সাইট দারুণ ফুটিয়ে তুলেন। আপনার লেখায় মুগ্ধ হয়েছি দিদি ভাই।
loading...
আপনি ঠিকই বলেছেন দিদিভাই। উনার আলোচনায় মন ভরে গেলো।
পাশে থাকার জন্য অশেষ ধন্যবাদ।
loading...
যন্ত্র মানেই তো অমানুষ — মনুষ্যত্ববোধহীন জড়পিন্ড।
loading...
চমৎকার অনুধাবন দাদা। শুভেচ্ছা নেবেন।
loading...
* মুগ্ধ পাঠক হয়ে পড়ে নিলাম।
শুভরাত্রি।
loading...
শুভ সকাল। শুভকামনা সবসময়।
loading...