অণুগল্প: মীরার ৪১ দিন শেষ পর্ব

পরদিন মীরার জীবনে অর্থি ছাড়া নতুন সকাল। বুকের ভেতর কেবল শূন্যতা। রাহেলা বেগম মেয়েকে অনেক বার চেষ্টা করেন খাওয়াতে কিন্তু,ব্যর্থ হন। মীরা বড় খালার বাসায় চলে যায়, সব খুলে বলে। কিন্তু খালু আর বেঁচে নেই, নিজের বাবাকে তো হারিয়েছে অনেক আগেই। এইসব পুলিশ কেসে মীরা কাকে সাথে নেবে, সহজে কেও রাজি হয় না। মীরা বুঝতে পারছিল ও বাড়িতে খালি হাত পা’য়ে গেলে কাজ হবে না । সে খালাকে নিয়ে একজন পারিবারিক উকিলের সাথে দেখা করে। তিনি খুবই গুছিয়ে কথা বলেন, – “দেখেন, এই কেস খুবই সেন্সিটিভ, বাবা মেয়েকে নিয়ে গেছে, তার অর্থ হচ্ছে একজন অভিভাবকের তত্বাবধানে কন্যা সন্তান আছে, আর মুসলিম আইন অনুযায়ী ১৮ বছর পর্যন্ত মা হচ্ছে সন্তানের হেফাজতকারী, অভিভাবক নন।”

মীরা একটু যোগ করে কথার মাঝে, – “আসলে আমাদের মধ্যে এমন কোন কিছু হয়নি, যেখানে আইনগত কোন সমস্যার সম্মুখীন আমি হতে পারি, আমি ভয় পাচ্ছি যদি একা গেলে সে মেয়েকে না দেয় তখন আমি কী করবো। আমি তো বরগুনায় কাউকে চিনি না।”
– “আপনি আপনার থানায় একটি জিডি করেন, সেটার কপি নিয়ে যান, দেখেন দেয় কীনা। আর যদি একেবারেই না দেয় তখন মামলা করে ওয়ারেন্ট করতে হবে।”
উকিলের পরামর্শে খুব ভয় পেয়ে যায় মীরা, কিন্তু জিডি না করে ওখানে একা যাওয়া ঠিক হবে না তা পরিষ্কার বুঝতে পারে। বরগুনায় সাথে যাবার জন্য খালাতো – চাচাতো সব ভাইদের অনুরোধ করলেও এই ঝামেলায় অফিস ফেলে কেও যেতে চায় না। মীরার অফিস থেকে ফোন আসে। সে একটা সিক্ লিভ নেয় তিন দিনের, সেটাই ইমেইলে পাঠিয়ে দেয়।

তারপর দূরসম্পর্কের একজন কাকাকে সাথে নিয়ে রওনা দেয় বরগুনার উদ্দেশ্যে, সারা রাস্তা মেঝ খালা সালমা তাকে খাওয়ানোর অনেক চেষ্টা করে, কিন্তু মীরার চোখ দিয়ে শুধু পানি ঝরছে। বরগুনায় নেমে প্রথমেই থানায় যেতে মীরা রাজি হচ্ছিল না, অর্থিকে এক নজর দেখার তৃষ্ণা তার চোখে মুখে। কিন্তু জিডির কপি উকিল বলেছে আগে থানায় জমা দিতে। ওখানকার ওসি রহমতুল্লাহ বেশ বয়স্ক একজন মানুষ। তিনিই নির্দেশ দিলেন, – “আপনি ঢাকা থেকে মেয়েকে নিতে চলে আসছেন, ইফতির বাড়ি পর্যন্ত চেনেন না, ওদিকের এলাকা ভালো না, তাই আমি চাই আপনি একজন অফিসার নিয়ে যান।”

মীরা গড়িমসি করে, “দেখেন আমি কোন পুলিশি ঝামেলায় যেতে চাচ্ছি না। আমি চাই তারা সুন্দর ভাবে আমার বাচ্চা আর আমার স্বামীকে আমার কাছে দিয়ে দিক, আমি দু’জনকে নিয়ে ঢাকায় চলে যাই।” ওসি জোরে হেসে উঠেন, – “আপনি হয়তো আপনার বাচ্চা সাথে করে নিয়ে যেতে পারবেন, সে ক্ষেত্রে অন্যের বাচ্চা আপনার সাথে যাবে কীনা সেটা নিশ্চিত বলা যাবে না। আর আমি আপনাকে আমার এলাকায় একা ছাড়তে পারবো না।” ওসি’র কথা মতোই এস আই রফিক তাদের সাথে ইফতির বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। ঠিকানা পাওয়া গেল ইফতির জাতীয় পরিচয় পত্রের কপি থেকে। ঠিকানা যেখানে দেওয়া আছে সে বাড়িতে গিয়ে জানা গেল তারা গেল মাসেই নতুন একটা ফ্ল্যাট কিনে সেখানে চলে গেছে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে ইফতির বাবা এবং মা পুরো ঘটনাটাই আগের থেকে পরিকল্পনা করে করেছেন। অর্থিকে দিয়ে তারা মীরাকে এইখানে নিয়ে আসবার একটা চেষ্টা করছেন, যেন নিজেদের বাড়িতে ইফতি নিরাপদে মাদক গ্রহণ করতে পারে আর অর্থি মফস্বলের পরিবেশে বড় হবে, মীরাকে এভাবে মেনে নিতে বাধ্য করার সুন্দর সাজানো নাটক ।

মীরা চোখের পানি মুছে, পাশের বাড়ির দরজায় নক করে নিজের পরিচয় দেয়। ওরা বলে, – “আমরা আপনাকে চিনি, ছবি দেখেছি ইফতিদের বাড়িতে। অমন ফেরেস্তা বাচ্চাকে মায়ের বুক থেকে আনে ? আপনি চিন্তা করবেন না, আমি ওদের নতুন বাড়ির ঠিকানা লিখে দিচ্ছি, ওর বাবার ডাক নাম বাবলা, নাম বললেই লোকে চিনবে।” মীরা ঠিকানাটা একদম মুখস্থ করে ফেললো। এই এলাকা থেকে দূরত্ব খুব বেশি নয়, তারা আবার ওসি সাহেবের দেওয়া জীপে উঠে বসলো। দূর থেকে পুলিশের গাড়ি দেখে ইতিমধ্যে ইফতির বাড়িতে খবর রটে গেছে – “ঢাকা থেকে একজন মহিলা ইফতিকে ধরতে আসছে।” এই যখন পরিস্থিতি তখন আর ভালো করে কথা বলার পরিবেশ রইলো না। থানার এস আইকে বাইরে বসিয়ে রেখে মীরাকে নিয়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করলেন সালেহা এবং কাকা মামুন। তাদের ঢুকতে দেখে বাবলা খুব বিরক্ত, – “আপনারা পুলিশ নিয়ে এসেছেন কেন ?”

মামুন তাকে আশ্বস্ত করবার চেষ্টা করেন, – “দেখুন, আমরা এই এলাকায় নতুন, পুলিশ আমাদের বাড়ি চিনতে সাহায্য করেছে।” তাদের বাক্ বিতণ্ডা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে, মীরা কেবল অস্থির পায়চারি করছে অর্থিকে বুকে নেবার জন্য। মা ছাড়া এক বছরের অর্থির হাতে তখন একটা বিস্কুট ধরা। সে অবাক চোখে মা’য়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, মীরা তাকে বুকে নেয়, কামিজের সামনের চেইন খুলে দুধ বের করে সন্তানের মুখে দেয়। উহহ! কী যে শান্তি, এতো শান্তি যেন দুনিয়ার আর কিছুতেই নেই। কোন রকম দুধটুকু খাওয়াতে পারলেও ইফতি মেয়েকে তার কাছে আর ঘেঁষতে দেয় না, – “তুমি অফিস করোগা যাও, অর্থি এখানেই থাকবে।”
মীরা খুব বিরক্ত হয়, – “তোমার বাবা মায়ের কাছে তুমি থাকো, আমার মেয়েকে টানবা না এখানে। আর আমি জব করি সংসার চালাতে, শখ করে নয়।”

এর মধ্যে ইফতির মা নাজমা এসে উপস্থিত হন, তিনি ডায়বেটিসের পেশেন্ট। বেশিরভাগ সময় বিছানায় কাটান। তিনি মীরার হাত ধরে বলেন, – “তুমি যেমন তোমার বাচ্চাকে ছাড়া থাকতে পারো না, আমিও তেমন আমার বাচ্চাকে ছাড়া থাকতে পারছি না।” মীরার মেজাজ যায় চড়ে, – “তাহলে আনি আপনার বত্রিশ বছরের বাচ্চাকে বিয়ে দিলেন কেন, তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমান।” মীরার চিতকারে পুলিশ অফিসার ভেতরে চলে এলো- “কি হয়েছে, ব্যাপার কী ?” তাকে শান্ত করতে বাবলা নিজের পকেটে হাত দিলেন। বাংলাদেশের বেশিরভাগ পুলিশ কীসে ঠান্ডা থাকে তার সব পদ্ধতি এই লোকের জানা। এবার এস আই উল্টো মীরাকে বোঝাচ্ছে, – “মেয়েতো ভালোই আছে দাদা দাদির কাছে, আপনি জব করেন, রাত বি- রাতে বাইরে থাকেন, সময় দিতে পারেন না, থাক ও এখানে, আমার এলাকা আপা, আমি আছি তো।”

মীরার মাথা ঘুরছে, সালমা আর নাজমা তর্ক করছে আর ওদিকে মামুনের সাথে বাবলা। সব মিলিয়ে অর্থি খুব ভয় পেয়ে গেল, জোরে চিৎকার করে কাঁদছে মেয়েটা।
এবার সুযোগ যেন পেয়ে গেল বাবলা, – “দেখেন আমার শান্ত নাতনিটা এদের কারণে ভয় পাচ্ছে।” মীরাকে রেখে দেবার জন্য অনেক চেষ্টা করলো ইফতি, কিন্তু সালমা তাকে এখানে রাখতে ভয় পাচ্ছে। যে লোক নিজের এক বছরের মেয়েকে না বলে নিয়ে আসতে পারে তার কাছে নিজেদের মেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠে যায়। এক রকম মীরাকে জোর করে গাড়িতে তোলা হলো। মেয়ের আধো আধো বোলের মুখ কেবল ভাসতে থাকে চোখের গভীরে।

ঢাকায় ফিরে আর জয়েন করতে পারলো না মীরা, ছুটি চাইবার আগেই তার কাছে স্যাক নোটিশ চলে এলো। অসুস্থতার কথা বললেও সে মুহূর্তে মীরা কোন প্রেসক্রিপশান দেখাতে পারেনি, তাই দায়িত্বে অবহেলার জন্য এই সিদ্ধান্ত। প্রাইভেট অর্গানাইজেশন, তাই তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। আর এমনিতেও মীরার পক্ষে জব করা সম্ভব ছিল না, কারণ তাকে উকিল সাহেব জানিয়ে দিয়েছেন –ওয়ারেন্ট না নিয়ে কোন ভাবেই বাচ্চাকে নিজের অধীনে আনা সম্ভব নয়।

রোজার মাস শুরু হয়ে গেছে, ওয়ারেন্ট করতে হলে মামলা করতে হয়। টাকা পয়সাতো লাগেই তার ওপর ঢাকার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে কোর্ট, যেতে আসতেই সারাদিন শেষ। মীরা ভোর ছ’টায় কিছু মুখে না দিয়েই জজ কোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়; সকাল ১০ টার মধ্যে কোর্ট বসার কথা থাকলেও অনেক সময় দেরি হয়। মীরার কেস শুরু হয়, পেশকারকে টাকা দিতে হয় তারিখ কাছাকাছি আনবার জন্য। উকিলকে তো প্রতি জেরাতে অনেক বড় অংকের টাকা দিতে হয় যদিও বিবাদী পক্ষের একজন উকিল ছাড়া আর কেও আসেনি। বাবলা এবং ইফতি হয়তো ধরেই নিয়েছিলেন, তারা পুরুষ, কোর্টে হাজিরা দেবার দরকার নেই, কিন্তু আইন সবার জন্য সমান তালে চল এটা তারা ভুলে যায়।

বরগুনা কোর্টে তারা উলটো অভিভাবকত্বের মামলা করে বসে তাও আবার নাবালিকা কন্যা সন্তানের জন্য। বরগুনা একবার গিয়ে বার বার যাওয়া এখন মীরার পক্ষে সম্ভব। সে রাতের বাসে বরগুনা যায়, সকালে কোর্টে হাজিরা দিয়ে পরের দিন দুপুরের বাসে ফেরত আসে। ফেরার সময় বুকের ভেতর হুহু করে – “আহারে কলিজা পাখি যার জন্য এতো যুদ্ধ তাকে এক নজর দেখতেও পারলাম না।” এই যাওয়া আসা, কোর্টের খরচ সব মিলিয়ে জমানো সব টাকা শেষ। বিয়ের যে গহনাগুলো ছিল সেগুলো খুব কম দামে বিক্রি করতে হলো, সারাদিন রোজা রেখে শরীর যেন আর চলছিল না। এক ফোটা ঘুম নেই মীরার, বুকের দুধ প্রতিদিন টিপে টিপে বের করে ফেলে দিতে হচ্ছে।

ডাক্তার বলেছেন, – “দুধ এভাবে জমে থাকলে জ্বর হতে পারে।” সারা শহর ঈদের আনন্দে উদ্বেলিত, কেনাকাটা চলছে সবার হমদম। কোর্ট বন্ধ হয়ে যাবে সাত দিনের জন্য, ওয়ারেন্ট লেখা হয়নি এখনো। মীরা বার বার তাড়া দিচ্ছে – “প্লিজ ভাই, আপনি ওয়ারেন্ট করিয়ে দেন, স্যারের একটা সই এনে দেন যে করেই হোক।”
পেশকার হেসে উত্তর দেন – “বাবা মেয়েকে না বলে নিয়ে গেছে, এটার ওয়ারেন্ট কি খালি মুখে হয়।” আদালতে দাঁড়িয়ে থাকা মীরা বুঝতে সময় নেয় এই দেশে কী কী করলে কী কী হয়। তার পাশে একজন ভদ্রলোক স্বর নীচু করে বলে – “আপা কিছু টাকা ছাড়েন, সব এমনিই হইয়া যাইবো ?”
মীরা অবাক –“এইখানেও ঘুস ?”
লোকটি হাসে, “কী যে বলেন আপা, রোজার মাসই কামাই করার আসল সময়।” অনেক দেন দরবারের পর পেশকার ঘোষনা দেয় – “পঞ্চাশ হাজার টাকা না হলে
এই কেস আরো এক বছর চলবে।” কোন উপায় নেই; ব্যাংকের বাকি সম্বলটুকু পেশকারের রুমে দিয়ে সে বাংলাদেশ জর্জ কোর্টের সিল দেওয়া কাগজ হাতে পায়, যেটার মূল্য ৫০ হাজার টাকা। সেই মহামূল্যবান ওয়ারেন্ট হাতে নিয়ে মীরা একটি গাড়ি রেন্ট করে ফেলে বরগুনা যাবার জন্য। এবার আর খালি হাতে গেলে চলবে না, পুলিশের ফোর্স নিতে হবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে পরিবারের কোন পুরুষ সদস্য সঙ্গী হিসেবে পাওয়া যায় না, সবাই মামলা খাওয়ার ভয়ে শিথিয়ে আছে। উপয়ায়ন্তর না দেখে মীরা তার মেঝো খালা সালমাকে অনেকটা জোর করেই সাথে নেয়। সারাটা পথ সালমা তজবি বে করে আল্লাহ আল্লাহ পড়তে থাকেন। আর কিছুক্ষণ পর পর মীরাকে বলেন – “যদি অর্থিকে না পাওয়া যায়, তখন আমরা কি করবো ?”
মীরার কণ্ঠে প্রত্যয় – “দুনিয়া ফুড়ে আমি আমার মেয়েকে বের করে আনবো।”

সত্যিই যেন তাই, থানার ওসিকে আগ থেকেই উর্ধ্বতন কর্মকর্তার মাধ্যমে পুরো বিষয়টা জানিয়ে রেখেছিল মীরা। তাই বরগুনায় পা রেখেই এক গাড়ি পুলিশ ফোর্স পাওয়া গেল। আজ ৪১ তম দিন মীরা অর্থিকে দেখেনি। ব্যস্ত থানা লোকে লোকারণ্য, মীরা রুগ্ন শরীর টেনে জিপে উঠলো। আবার মেয়েকে দেখতে পাবে কীনা সারাক্ষণ একটা অজানা আশংকা বুকের ভেতর কাজ করছিল। সেই বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে পুলিশ যখন দরজায় জোরে জোরে নক করছিল – “দরজা খোলেন, আমাদের হাতে ওয়ারেন্ট এসেছে।” তখন মীরার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছিল, বাড়ির ভেতর থেকে কোন সাড়া শব্দ নাই।

– আমার অর্থিকে কী ওরা ? ভাবতেই পারছিল না মীরা। পুলিশ আরো জোরে জোরে দরজা ধাক্কা দিল। তখন ভেতর থেকে আলো জ্বলে উঠলো। দরজা খুলে ইফতি বের হয়ে এলো, মীরার উৎসুক চোখ তখন ভেতর ঘরে- “কোথায় আমার মেয়ে ?” পুলিশ ততক্ষণে ভেতরের রুমে চলে গেছে। অর্থিকে কোলে নিয়ে বাবলা হম্বিতম্বি বেরিয়ে এলো – “আমি এভাবে বাচ্চা দেব না, কোর্টে যাব।” বেলা তখন ৩টা বেজে গেছে, রোজার মাস; আদালত শেষ পর্যায়ে। কিন্তু কোন এক অদ্ভূত কারণে সহকারি জাজ সাহেব রাজি হলেন কোর্ট চালাতে। বরগুনায় এমন কাউকে মীরা চেনে না যে তার পক্ষ হয়ে লড়তে পারে, পেশকার এসে কানে কানে বললো – “আরে আপা, মহিলা আইনজীবী অফিসে কল দেন, এরাই পারবে আপনাকে সাহায্য করতে।” সম্বিত ফিরে পেল মীরা। তাইতো !! সে নিজেও তাদের ব্যাপারে বহু সংবাদ পড়েছে।

তাই আর দেরী নয়, ফোন দিয়ে দিল তেজগাঁও হেড অফিস। ওপাশ থেকে মুহূর্তে ফোন চলে গেল বরগুনা পারিবারিক আদালতে। একজন পঞ্চাশোর্ধ্ব মহিলা কালো কাপড় পরিহিত কোর্টে পা রাখলেন; তিনি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন – “মীরা কে?”
ভীত মীরা তখন যেন অন্ধকার ঘরে এক টুকরো আলো দেখতে পেল, – “আমি।”
– “আপনি এজলাসে দাঁড়ান এবং এই কাগজে সই করুন।”
অতো কাগজ ঘাটার সময় তখন মীরার নেই বং নিজের হাতে ধরা কাগজ উকিল আপার হাতে দিল। তার অর্থি তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা মনে হয় চিন্তেও পারছে না নিজের মা-কে। মীরা কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে শপথ নিল – “আমি শপথ করিতেছি যে যা বলিব সত্য বলিব …।”

খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি মীরার। দু’টো মাত্র কথা বলেছিল উকিল আপা। – “মাননীয় কোর্ট, বুঝলাম আমার ক্লায়েন্ট চাকরি করেন, তার একার আয়ে
পুরো সংসার চলে। তাহলে কেন ইফতি সাহেব সমর্থ হয়েও ঘরে বসে খান ?” উত্তরে তাদের উকিল বলেন – “না, তিনি ঘরে বসে মোটেও খান না, একটি মাল্টিন্যাশনাল কম্পানিতে কাজ করেন।” কিন্তু তারা জানতো না যে ইফতিকে যে চাকরি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল সেই কাগজ ইতিমধ্যে উকিলের হাতে মীরা দিয়ে দিয়েছে। দ্বিতীয় আর্জি যেটা ছিল তা খুব ভয়াবহ, সেটা মীরা নিরবে হজম করে নেয়। উকিল আপা কোর্টকে বলেন, – “আমি যদি ধরেও নেই, আমার ক্লায়েন্ট
বেশ্যাবৃত্তি করে পয়সা উপার্জন করছে, তবুও এটাই সত্যি কোন মায়ের কাছ থেকে তার নাবালিকা কন্যাকে আলাদা রাখা যাবে না।”

বাদী পক্ষের উকিল অনেক বার মীরা দুশ্চরিত্র, বেশ্যা, শিশু পাচারকারী এই ধরণের বিশেষণে বিশেষিত করেছেন, কিন্তু তার দেওয়া শূলে যে নিজেই আঘাতপ্রাপ্ত হবেন বোঝেন নি।

কোর্ট রায় দিল, – “নাবালিকা কন্যা শিশু অর্থি বিয়ে না হওয়া অব্দি তার মা’য়ের হেফাজতে থাকবে, পিতা ইচ্ছে করলে দেখার অনুমতি পাবেন।” নিজের কানকে খুব ভাড়ি মনে হচ্ছিল মীরার। যখন সে নীচে নেমে আসে বাচ্চাকে কোলে নিয়ে উকিল আপা তার কোলে দেয়। সাথে সাথে পুলিশ তাকে ঘিরে দাঁড়ায়। একজন এস আই দ্রুত এগিয়ে আসেন, – “আপা তাড়াতড়ি বের হয়ে যান, মুভ।” আদালত থেকে বেরুবার সময় বাবলার ক্ষিপ্ত দল তাদের তেড়ে আসছিল মারার জন্য। উক্ত এস আই খুব দ্রুত মীরা –অর্থি আর সালমাকে গাড়িতে তুলে দেন। ফিরে আসবার সময় কিছু সন্মানী তার হাতে দিয়ে মীরা বলেন, – “আপনি আমার ভাইয়ের কাজ করলেন।”

গাড়ি ছুটে চললো চল্লিশ- এর উপরে, ড্রাইভার বুঝতে পারছিল এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়ালে বিপদ হতে পারে। মীরা অর্থিকে বুকে পেল ঠিকই, কিন্তু কিছুতেই বাচ্চাটা বুকের দুধ মুখে দিচ্ছিল না। খালা বার বার সূরা পড়ে ফুঁ দিচ্ছিল, কোন কাজ হচ্ছিল না। ড্রাইভার কিছুক্ষণ বিষয়টি খেয়াল করলেন তারপর বললেন, – “দেখেন তো আপা, বাচ্চার গায়ে কোন তাবিজ পান কীনা।” অর্থির কোমরের কাপড় সরিয়ে মীরাতো অবাক, – “সত্যি ভাই, একটা ছোট সাইজের তাবিজ প্যাঁচানো।” – “আপনি ওটা ছিঁড়ে এখানেই গেড়ে ফেলুন, বরগুনার সীমা পাড় হয়ে গেলে কাজ হবে না।” মীরা গাড়ি সাইড করতে বলে দ্রুত নামলো, তাবিজ ছিঁড়ে ফেলে সেটা মাটিতে গর্ত করে ঢুকিয়ে দিল।

বিজ্ঞানের সব ফর্মুলা উপেক্ষা করে অর্থি সত্যি সত্যি আবার মীরার বুকের দুধ পান করতে শুরু করলো। জগতে এমন কিছু থাকে যার ব্যাখ্যা কোন দিন বিজ্ঞান দিয়ে করা যাবে না, এটাও বোধ কই এমন একটি ব্যাপার। ইফতির জন্য মায়া হলো মীরার, ছেলেটা নেশার ঘোরে বাবা মা যা বলছে তাই করছে, সে জানতেও পারলো না – মা’ডাকটার পর সব চাইতে মধুর সম্বোধন “বাবা”। যা একবার শোনার জন্য মানব সন্তান দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে, কারো কপালে জোটে আবার কারো বা জোটে না।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৫ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ৫ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ২৮-০৯-২০১৯ | ১৭:১৯ |

    পরিশ্রম আর ধকল গেলেও মীরার মধ্য দিয়ে যেন একজন মায়ের জয় হলো। জয়তু মা।

    GD Star Rating
    loading...
  2. সুমন আহমেদ : ২৮-০৯-২০১৯ | ২০:০৭ |

    শত কষ্ট হলেও পরিণতিতে একজন মায়ের জয় হলো। এই জয় অবসম্ভাবী ছিলো। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
  3. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ২৮-০৯-২০১৯ | ২৩:২২ |

    এমনি করেই সব মীরাকে ঘর-সমাজের সাজিসের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। তবেই না জয়। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
  4. আনু আনোয়ার : ২৯-০৯-২০১৯ | ১৭:০০ |

    পুরোটা পড়ে ভাল লেগেছে। 

    একজন সংগ্রামী মাকে দেখতে পেলাম।

    শুভেচ্ছা নেবেন। 

    GD Star Rating
    loading...
  5. শাকিলা তুবা : ৩০-০৯-২০১৯ | ২২:৪৩ |

    একজন মায়ের জয় হলো। মায়ের জয় যে অবধারিত। 

    GD Star Rating
    loading...