আমি ততদিনে ফোন সার্ভিস ডিপার্টমেন্টের কাজ ভালোবাসতে শুরু করেছি এবং বহাল তবিয়তে কাজ করছি। ফোন সার্ভিস ডিপার্টমেন্টে আমাদের কাজ হচ্ছে ফোন সার্ভিস নিতে আগ্রহী গ্রাহকদের সহযোগিতা করা। এবং আমি তা অতি আনন্দের সাথে করার চেষ্টা করি। এই কাজ করতে করতে অল্প অসুন্দরের পাশাপাশি অনেক সুন্দর সুন্দর অভিজ্ঞতা হয়।
অসুন্দর কিছুই আমি মনে রাখি না।
আর সুন্দর যা কিছু দেখি সবই চিন্তা চেতনা স্মৃতিতে জমা রাখি।
আমেরিকায় এসে তো এমনিতেই চারপাশ সুন্দর দেখি। আর ওয়ালমার্টে চাকরি করতে করতে সুন্দর সুন্দর মানুষজনও দেখি, মানুষজনের কাজকর্ম দেখে সুন্দর সুন্দর অভিজ্ঞতাও হয়। আমেরিকার ইয়াং জেনারেশান হচ্ছে হুজুগে টাইপ। ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে খুব কম আমেরিকান, তারা চিন্তা করে জীবনের বর্তমান মুহূর্ত নিয়ে। আমাদের দেশে ভিটে মাটি বিক্রি করে হলেও বাবা মা চায় সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানাতে। আর আমেরিকায় ইয়াং জেনারেশান ঘটি বাটি বিক্রি করে হলেও লেটেস্ট মডেলের গাড়ি, জুতো আর লেটেস্ট মডেলের ফোন কিনবে! এই জিনিসগুলোর প্রতি এদের কী যে নেশা!
★***********************★
আজ আমাদের কাছে ফোন সার্ভিস নিতে এসেছে অনেকেই। তাদের মধ্যে দুটো ভিন্ন অভিজ্ঞতা হলো। যাদের দেখা পেলাম, তাদের সাথে গল্প করে মনটা ভালো লাগায় ভরে গেছে। কাজ শেষে বাড়ি ফিরেও ভালো লাগার রেশটা ছিলো।
এক হোয়াইট আমেরিকান ভদ্রমহিলা, বয়স আনুমানিক ৫৩ বা ৫৪ বছর হতে পারে, এসেছিলো ফোনের নেটওয়ার্কের সমস্যা নিয়ে কথা বলতে। যদিও এটা বিভিন্ন ফোন কোম্পানির টাওয়ারের সমস্যা, তবুও আমাদের গ্রাহক আমাদের লক্ষ্মী তাই ফোন কোম্পানির হয়ে আমিই এই কথাগুলো ভদ্রমহিলাকে বুঝিয়ে বললাম। ভদ্রমহিলা ফোনের নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণ জানার পর এটা নিয়ে আর কথা বললেন না, চলেও গেলেন না। ভাবলাম, আরও কিছু জানতে চায়। ভদ্রমহিলার কাছে জানতে চাইলাম, আর কিছু জানতে চায় কিনা।
না, তিনি আর কিছু জানতে চায় না। শুধু বললো যে, আমার ইংলিশ উচ্চারণ নাকি তার কাছে খুব ভালো লেগেছে। পরবর্তী প্রশ্ন ছিলো আমি কোন্ দেশ থেকে এসেছি। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনেই ভদ্রমহিলা, ‘এমিলি এমিলি শীগগীর আসো’ বলে ডাকতেই যে এসে হাজির হলো আমাদের সামনে, অপূর্ব সুন্দরী ২৪-২৫ বছর বয়সী এক তরুণী। একেবারে আমাদের দেশের মেয়েদের মতো অভিব্যক্তি চেহারায়। মুখে সলজ্জ হাসি, কী অমায়িক ভাব চেহারাতে! ভদ্রমহিলা যখন জানলেন যে, আমি বাংলায় কথা কই, খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, এমিলিও বাংলা বলতে পারে!
আমেরিকান তরুণী বাংলা বলতে পারে শুনেই তো আমার চোখ ছানাবড়া! ভদ্রমহিলা জানালেন, এমিলি কলকাতায় থেকেছে এক বছর। অই এক বছরে বাংলা পড়তে ও লিখতে শিখেছে, বলতে তো পারেই। উনার দেয়া তথ্যের সত্যতা জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রমাণ করার জন্যই হয়তো তিনি এমিলিকে অনুরোধ করতে লাগলেন আমার সাথে বাংলায় কথা বলার জন্য। এমিলি নামের সুন্দরী মেয়েটি বাঙালি মেয়েদের মতোই খুব লজ্জা পাচ্ছিলো! আমিই পরিস্থিতি সহজ করে দিলাম, বাংলায় বললাম, এমিলি তুমি কথা শুরু করো।
এমিলি স্পষ্ট বাংলা উচ্চারণে বললো, “আমার নাম এমিলি, কলকাতাতে আমার স্বামীর সাথে এক বছর ছিলাম। ওখানে গড়িয়াহাটে থেকেছি। আধুনিক শিশু শিক্ষা বিষয়ে পড়াশোনা করতে গিয়েছিলাম আমি। আজ আমি খুব আশ্চর্য্য হয়েছি এই ওয়ালমার্টে একজন বাঙালিকে দেখতে পেয়ে”। এমিলির বাংলা শুনে আমার আক্কেলগুড়ুম! মাত্র এক বছর বাংলা পড়ে এমন শুদ্ধ বাংলা বলতে আমি অন্ততঃ কাউকে দেখিনি। আমি এমিলির সলজ্জ মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ।
বাংলাতেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘এমিলি, তোমার সাথের মানুষটি তোমার কে হন?”
এমিলি বললো, ‘উনি আমার শাশুড়ী। আচ্ছা রীতা আন্টি, আপনি কি রান্নাও করেন এখানে? সব বাঙালি খাবার রান্না করেন?”
এমিলির কথা শুনে আমার জ্ঞান হারানোর অবস্থা। এই মেয়ে আমাকে আন্টি ডাকছে! বুঝলাম সে অলরেডী শিখেছে, আমাদের দেশে কাউকে নাম ধরে ডাকার রেওয়াজ নেই, তাই সে আমার নামের ব্যাজ থেকে নামটি নিয়ে সাথে আন্টি যোগ করে ফেলেছে। বাঙালি নারীর যে রান্নাবান্নাই প্রধান কাজ, এটাও সে জেনে গেছে! তাকে জানালাম যে আমি প্রতিদিন রান্না করি, এবং বাঙালি খাবার রান্না করি।
এমিলির শাশুড়ী এবার জানালেন যে উনারা মিসিসিপির অধিবাসী নন, উনারা এসেছেন ইন্ডিয়ানা থেকে। বললাম, তাই তো বলি, আমার ইংরেজি উচ্চারণ কেন তোমার পছন্দ হয়েছে! মিসিসিপির মানুষ তো আমার ইংরেজি উচ্চারণ কিছুই বোঝে না, আমিও মিসিসিপির ইংলিশ কিচ্ছু বুঝি না। মিসিসিপির মানুষদের সাথে কথা বলতে বলতে আমি ইংলিশই ভুলে যাচ্ছি— বলে হেসে ফেললাম।
এমিলির শাশুড়িও খুব হাসলেন। স্বীকার করলেন, সাউদার্ন ইংলিশ উনিও বলতে পারেন না, বুঝতেও পারেন না! ওরা মিসিসিপিতে এসেছে কারণ এমিলির স্বামী, অর্থাৎ ভদ্রমহিলার ছেলের চাকরির পোস্টিং হয়েছে মিসিসিপি এয়ারবেসে, তাই ছেলে- বৌমার কাছে উনি বেড়াতে এসেছেন। ভদ্রমহিলা বললেন, তাঁর ছেলে ফুল ব্রাইট স্কলারশীপ পেয়ে ইন্ডিয়াতে গিয়েছিল উচ্চ শিক্ষার জন্য, সাথে এমিলিও গেছে। এমিলি কলকাতায় বসে থাকেনি, শিশু শিক্ষা নিয়ে পড়াশোনা করেছে। এক বছরে ওরা দুজনেই যতখানি বাংলা শিখেছে, এখানে ফিরে এসে কারো সাথে বাংলা চর্চা করার সুযোগ পাচ্ছে না বলে দুজনেই খুব আপসেট ছিলো।
আজ আমার দেখা পেয়ে ভদ্রমহিলা মহাখুশি। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালেন আমার মত একজন খাঁটি বাঙালির খোঁজ পেয়ে গেছেন বলে। আর চিন্তা নেই, ছেলেকে গিয়ে বলবেন বাংলা চর্চা করার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। উনার ফোন নাম্বার দিলেন, এমিলির ফোন নাম্বার দিলেন এবং আমার ফোন নাম্বার নিলেন। ফিরে যাওয়ার সময় ভদ্রমহিলা ইংলিশে ধন্যবাদ জানালো এবং অনুরোধ করে বললো, আমি যেনো মাঝে মাঝে ফোনে এমিলির খোঁজ নেই। আর এমিলি বাংলায় বললো, আবার কথা হবে রিটা আন্টি!
এমিলিরা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই কালো এক তরুণ এলো নতুন ফোন সার্ভিস কন্ট্র্যাক্ট নিতে। তখনও আমিই ছিলাম ডিউটিতে। কেউ নতুন ফোন সার্ভিস নিতে চাইলে আমাদের প্রথম কাজ হলো, গ্রাহকের ক্রেডিট হিস্ট্রি চেক করা। গ্রাহকের সমস্ত পারসোন্যাল ইনফর্মেশান কম্পিউটারে সাবমিট করার পর ক্রেডিট ব্যুরো থেকে রেজাল্ট আসে। সেই রেজাল্টের ভিত্তিতেই ঠিক হয় গ্রাহককে কোনো ডিপোজিট মানি জমা দিতে হবে কিনা।
ক্রেডিট হিস্ট্রি চেক করার কথা শুনে তরুণ একটু আমতা আমতা করছিলো।
তাকে বুঝিয়ে বললাম যে এটা ফোন কোম্পানিগুলোর বেঁধে দেয়া নিয়ম। ক্রেডিট স্কোর ভালো হলে গ্রাহককে কোনো ডিপোজিট মানি জমা দিতে হয় না। আর ক্রেডিট স্কোর খুব ভালো না হলে কিছু ডিপোজিট দিতে হয়। এক বছর সার্ভিস কন্টিনিউ করতে পারলে ডিপোজিট মানি ওরা মান্থলি বিলের সাথে ব্যালেন্স করে দেয়। সব শুনে তরুণ আধ ঘন্টার মধ্যে ফিরে আসবে বলে চলে গেলো। আধঘন্টা বাদে সে সত্যিই ফিরে এলো, এবার একা আসেনি। সাদা আমেরিকান সুন্দরী এক মেয়েকে বগলদাবা করে এনেছে।
অভিজ্ঞ চোখ দিয়ে দেখলাম, এরা প্রেমিক- প্রেমিকা। ইদানিং প্রায়ই দেখি কালো ছেলেদের সাথে সাদা মেয়েকে গলাগলি করে চলতে। কিনতু সাদা ছেলের পাশে কালো মেয়ে এখনও দেখিনি। কে জানে, এদেশেও হয়তো সাদা চামড়ার কদর বেশী! বাচ্চা মেয়ে, কেমন অভিমানী অভিমানী মুখ করে পাশে দাঁড়িয়েছে। ছেলেটির ক্রেডিট স্কোর চেক করে দেখলাম দুই ফোন লাইনের জন্য তাকে জমা দিতে হবে ৬০০ ডলার ডিপোজিট।
এবার ফোন পছন্দ করার পালা। মেয়েটি পছন্দ করেছে ‘ আইফোন ফোর’। দুই বছরের জন্য কন্ট্রাক্ট, প্রতি আইফোন ফোরের জন্য দিতে হবে আরও ৯০ ডলার।
টাকার পরিমাণ শোনার পর ছেলেটির মুখের চেহারা করুণ হয়ে গেলো। আমি তাকে অন্য ফোন পছন্দ করতে বললাম, যেগুলো দামে একটু সস্তা হবে। কিন্তু অভিমানী বালিকার জেদ, ‘আইফোন ফোর’ দিতেই হবে তাকে।ছেলেটি মেয়েটির দিকে অনুনয়ের চোখে তাকাতেই মেয়ে মুখ ঘুরিয়ে ছেলেটির পাশ ছেড়ে সোজা হাঁটা দিলো। ছেলেটি উতলা হয়ে বললো, বেইবি ফিরে আসো, তোমার পছন্দের ফোনই নেয়া হবে। বলেই আমাকে বললো, ঠিক আছে, আমি ৬০০ ডলার ডিপোজিট দিবো। ছেলেটিকে বললাম যে, তুমি তো অনেক বড়লোক মনে হয়, নাহলে ৬০০ ডলার ডিপোজিট দেয়া তো সোজা কথা না!
সে বললো, আমি খুবই সাধারণ মানুষ, কিনতু আমার ফিঁয়াসেকে এত ভালোবাসি যে এই টাকার পরিমাণ তুচ্ছ আমার কাছে। শেষ পর্যন্ত প্রিয়ার আবদারে সে ৬০০ ডলার ডিপোজিট, ২০০ ডলার ফোনের জন্য , ৮০ ডলার একটিভেশান ফি দিয়ে দুটি ‘আইফোন ফোর’ নিতেই মেয়েটির মুখ অনিন্দ্য সুন্দর হাসিতে ভরে গেলো। তরুণ যখন চুক্তিপত্রে সাইন করছিলো, আমি জানতে চাইলাম তারা কবে বিয়ে করতে যাচ্ছে। সাথে সাথে তরুণ বললো, ‘এই ডিসেম্বারে আমরা বিয়ে করবো”
আর মেয়েটি ধীরে সুস্থে বললো, “আমি এখনও জানিনা কবে বিয়ে করবো। এক বছর আগে আমাদের এমগেজমেন্ট হয়েছে, আরও সময় দরকার বিয়ের ডিসিশান নিতে।” মেয়েটির বয়স ১৮, ছেলেটির বয়স তো আমি আগেই জেনেছি ২৬ বছর। মনে মনে স্বীকার করতেই হলো, এই জগত সংসারে সব দেশেই মেয়েরা খুব হিসেবী হয় এবং ছেলেরা হয় বেহিসেবী। ছেলেদের সাথে সম্পর্ক তৈরির আগে প্রায় প্রতিটি মেয়ে সম্পর্কের বর্তমান এবং ভবিষ্যতের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নেয়, সম্পর্ক চলকালেও সম্পর্কের বর্তমান এবং ভবিষ্যতের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নেয় সম্পর্কটা রাখবে কিনা।
*এবং পরিসংখ্যান খতিয়ে দেখলে জানা যাবে, বেশীর ভাগ প্রেমিক- প্রেমিকার ব্রেক আপ হয় প্রেমিকার হিসেবী স্বভাবের কারণে, আর ছেলে-মেয়ের বিবাহিত সম্পর্ক ভেঙে যায় ছেলেদের বেহিসাবী স্বভাবের কারণে।* চুক্তিপত্র সাইন হয়ে যেতেই দেখি মেয়েটির মুখে হাসির বন্যা দেখা গেলো, ছেলেটির মুখেও প্রশ্রয়ের এক অপূর্ব হাসি। আমার দেখে এত ভালো লাগলো যে ছেলেটিকে বলেই ফেললাম, ‘জীবনে টাকা আসে টাকা চলেও যায়, কিনতু এমন মুহুর্ত বার বার আসে না। তোমাদের সুখী সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য শুভকামনা রইলো”।
বাড়ি ফিরে আমার স্বামীর কাছে এমিলি আর তার শাশুড়ির গল্প করলাম। কিছুক্ষণ পরে আমার স্বামী বললেন যেনো নেক্সট ছুটির দিনে এমিলি, তার বর আর এমিলির শাশুড়িকে আমাদের বাড়িতে ডিনারের নেমন্তন্ন করি।
মনে পড়ে গেল, এমিলির শাশুড়ীও আমাকে বলেছিল, মাঝে মাঝে যেনো এমিলির খোঁজ খবর নেই!★★
কিন্তু আমি এমিলির শাশুড়ির দেয়া ফোন নাম্বার লেখা কাগজের টুকরোটি আর খুঁজে পাইনি। খুব সম্ভবতঃ এমিলির শাশুড়িও আমার ফোন নাম্বার লেখা কাগজটি খুঁজে পাননি।
তাই আমাদের আর কখনো কথা হয়নি।
— ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টার
loading...
loading...
যাপিত জীবনের কথা গুলোন আপনার হাতে অসাধারণ উঠে আসে।
loading...