সেই ৩০শে মে!

nn মে মাস ১৯৮১। আমাদের এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। আমি নারায়ণগঞ্জ মহিলা কলেজের ছাত্রী ছিলাম এবং আমার সিট মহিলা কলেজেই পড়েছিলো। তখন দেশের প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। আমি রাজনীতি বুঝতাম না, ছাত্র রাজনীতিও বুঝতাম না। জিয়াউর রহমানকে অপছন্দ করতাম, কারণ বড়োদের মুখে শুনতাম যে বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে জিয়াউর রহমান জড়িত এবং বাংলাদেশের সংবিধান থেকে ধর্ম নিরপেক্ষতা মুছে তিনি বিসমিল্লাহ যোগ করেছেন। সংবিধানে বিসমিল্লাহ যোগ করার অর্থ, রাষ্ট্রের মুসলমানি হয়ে যাওয়া, অন্য ধর্মের নাগরিকের অধিকার খর্ব হওয়া, মনের দিক থেকে দুর্বল হয়ে যাওয়া।

পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের পর এমনিতেই বাংলাদেশে আওয়ামীপন্থী জনগণ মানসিকভাবে কুঁকড়ে গেছিলো। এরপর যখন জিয়াউর রহমান সাহেব সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা কেটে বিসমিল্লাহ যোগ করে দিলো, তাতে প্রতিবেশী মুসলমানদের খুব উল্লসিত হতে দেখে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মনে ভয়, ক্ষোভ, সন্দেহ, অবিশ্বাস জন্ম নিতে শুরু করে। আমরা জানতাম, সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতা থাকলে রাষ্ট্রের সকল ধর্মের অনুসারীদের সর্বক্ষেত্রে সম অধিকার থাকে, রাষ্ট্রের জনগণ অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী হয়।

কিন্তু জিয়াউর রহমান ধর্ম নিরপেক্ষতা কেটে বিসমিল্লাহ যোগ করার পর থেকেই যেনো আমরা বাঙালি পরিচয় হারিয়ে মুসলমান হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান আলাদা নামে পরিচিত হয়ে গেলাম। এবং অবশ্যই বিসমিল্লাহর জোরে মুসলমানরা এক দেশের এক মাটির সন্তান হয়েও আমাদের চোখে ‘ সুপিরিয়র’ হয়ে গেলো। কথা আরো আছে, জিয়াউর রহমান শুধু রাষ্ট্রের গায়ে বিসমিল্লাহ লাগিয়ে ক্ষান্ত হননি, পাকিস্তানের অনুকরণে আমাদের জাতীয়তা ‘বাঙালি’ মুছে দিয়ে বাংলাদেশী করে দিলেন। ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান মুছে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ করে দিলেন। ফলে অলিখিতভাবেই শিক্ষাঙ্গনে, কর্মক্ষেত্রে, কমপিটিটিভ পরীক্ষায় অমুসলিম ক্যান্ডিডেটরা মেধা থাকা সত্ত্বেও শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের বৈষম্যের কারণে অনেক পেছনে পড়ে থাকতো।

তখন কেউ কল্পনাই করতে পারতো না, অমুসলিম কেউ এসএসসি এইচএসসিতে প্রথম দ্বিতীয় স্থান পাবে! বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজাল্টেও দেখা যেতো, প্রচন্ড মেধাবী কোনো শিক্ষার্থী ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট সেকেন্ড হওয়ার দাবীদার, কিন্তু অমুসলিম নামের কারণে তাকে শীর্ষস্থানে পৌঁছাতে দেয়া হতো না। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর জিয়াউর রহমানের শাসনকালে দেশে যে পরিবেশ পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটানো হয়েছে, তাতে সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘু নামে দুটো প্রজাতি সৃষ্টি হয়েছে। সংখ্যাগুরুরা নিজেদের যতই সুপিরিয়র ভাবতে শুরু করলো, সংখ্যালঘুদের মাঝে ততই ইনসিকিউরিটি, ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স জন্ম নিতে শুরু করলো।

হীনমন্যতাবোধ নিয়ে আর যাই হোক, শান্তিতে অথবা স্বস্তিতে বাঁচা যায় না। সংখ্যালঘুদের হীনমন্যতাবোধ নিয়ে বাঁচার কষ্টটা জিয়াউর রহমানের হাত দিয়ে সৃষ্টি হয়েছে। উঠতি তারুণ্যে এমন পরিবেশ পরিস্থিতিতে জিয়াউর রহমানকে পছন্দ করার কোনো কারণ ছিলো না আমার। রাজনীতি না বুঝেও জিয়াউর রহমান যে ভিলেন ছিলেন, সেটা বুঝতাম।

১৯৮১ সালের মে মাসের কথা বলছিলাম, আমাদের এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। খুব সম্ভবত বাংলা অথবা ইংলিশ পরীক্ষা ছিলো সেদিন। মহিলা কলেজ কেন্দ্রে বসে পরীক্ষা দিচ্ছি। হঠাৎ কলেজ করিডোরে কিছু চেঁচামেচি শুনতে পেলাম। ব্যাপার বুঝে ওঠার আগেই পাশের তোলারাম কলেজের কিছু ছাত্র জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে দিতেই আমাদের হলরুমে প্রবেশ করলো। তারা নিজেদের পরিচয় দিলো ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে, নেতৃত্বে ছিলো শামীম ওসমান ( তরুণ নেতা)। জিয়াউর রহমানের কোনো একটা কালা কানুনের বিরুদ্ধে সংক্ষেপে বক্তৃতা দিলো, এরপর বললো, পরীক্ষা দেয়া যাবে না। এবার এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল।

আমাদের খাতাগুলো দ্রুত গতিতে টান দিয়ে নিয়ে ইনভিজিলেটরের কাছে দিয়ে ওরা পাশের রুমে চলে গেলো। আমি খুব থ্রিল ফিল করছিলাম, তাৎক্ষণিকভাবে খুব খুশি হয়েছি পরীক্ষা দিতে হলো না বলে। উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে মাথাতেই আসেনি এটা এইচএসসি পরীক্ষা, পরীক্ষা দিতে না পারলে এক বছর লস হয়ে যাবে, বছর লস করলে আমার বাবা আছাড় দিবে আমাকে। আমি ভাবছিলাম, জিয়াউর রহমানের আমলে ছাত্রলীগ বলে কেউ আছে তাইই তো জানতাম না। এরা কোথা থেকে এলো, আর কী সাহস এদের! কয়েকটা ছেলে ঘরে ঢুকে আমাদের পরীক্ষা বন্ধ করে দিলো!

বাসায় যেতে যেতে ভয় পাচ্ছিলাম বাবার কাছে কি জবাব দেবো। মনে মনে বলছিলাম, আমার তো কোনো দোষ নেই। এক বছর লস হয়ে যাবে! বাবাকে বুঝিয়ে বলতে হবে, এই এক বছর আরো ভালো করে পড়তে পারবো, পরের বছর ডাবল ভালো রেজাল্ট হবে! বাসায় ফিরে শুনি, পরীক্ষার হলে গোলমালের সংবাদ অনেক আগেই তারা পেয়ে গেছে। ওরা নাকি খোঁজ নিতে জনে জনে জিজ্ঞেস করছিলো, আমরা সুস্থ আছি কিনা।
আমাকে বাসায় আস্ত ফিরতে দেখে বাবা মা’কে নিশ্চিন্ত হতে দেখে আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

পরীক্ষা দিতে হবে না, আমার এই আনন্দ বিকেলেই নিরানন্দ হয়ে গেলো। জানা গেলো, এইচএসসি পরীক্ষা চলবে। আজ যে পরীক্ষা দেয়া গেলো না, তা নিয়ে পরে সিদ্ধান্ত হবে। তবে আমাদের সিট নারায়ণগঞ্জ মহিলা কলেজ থেকে ঢাকা কলেজে স্থানান্তর করা হয়েছে। আমার সকল আশার গুড়েবালি, সকল থ্রিল ওখানেই ঠান্ডা। উলটো পরীক্ষার হল নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা কলেজে নেয়াকে মরার উপর খাঁড়ার ঘা মনে হলো।

বিকেলবেলায় মুখ কালো করে ঢাকা রওনা দিলাম। আমার দাদা ঢাকা ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টারে থাকেন। ঠিক হলো, ঢাকায় দাদার বাসায় থেকেই পরীক্ষা দিতে হবে আমাকে।

সেদিন ৩০ শে মে, ঢাকা কলেজের পরীক্ষার হলে কেমিস্ট্রি পরীক্ষা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ করিডোরে শিক্ষকদের দ্রুত হাঁটাহাঁটি, শিক্ষকদের মধ্যে ফিসফাস, গুঞ্জন! আমাদের রুমের ইনভিজিলেটর রুম থেকে বেরিয়ে বারান্দায় গেলেন। লেখা থামিয়ে আমি বারান্দার দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ দরজার কাছাকাছি বেঞ্চে বসা এক পরীক্ষার্থী বলে ফেললো, জিয়াউর রহমানকে মেরে ফেলছে। মেয়েটির কথা শেষ হওয়ার আগেই ইনভিজিলেটর ত্রস্ত পায়ে রুমে ঢুকে দ্রুত বললেন, আজ পরীক্ষা হবে না, তোমরা তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যাও।

আবার উত্তেজনা, থ্রিলিং ব্যাপার। পরীক্ষা দিতে হবে না। তখনো ঘটনার গুরুত্ব বুঝতে পারছিলাম না। বরং ক্লাসরুমের অধিকাংশ পরীক্ষার্থীর মুখ ভয়ার্ত দেখা গেলেও আমার কেনো জানি ভয় বা দুঃখ হচ্ছিলো না!
মনে হয়েছিলো, “এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিলো। উচিত শিক্ষা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত থাকার ফল হাতে নাতে পেয়েছে।”

কারো অপমৃত্যুতে আমার মতো সাধারণ মানবিক বোধসম্পন্ন কারোর মনে স্বস্তি আসার কথা নয়! তবে আমি যে সময়ের কথা বলেছি, ওটা ছিলো আমার উঠতি তারুণ্যের শুরু। মানবিকতা বোধ জাগ্রত হওয়ার বয়স, অসাম্প্রদায়িক চেতনা শেখার বয়স। সেই বয়সে আমি বুকে বয়ে বেড়াচ্ছিলাম বঙ্গবন্ধুর (পরিবারসহ) নির্মম হত্যাকাণ্ডের দুঃসহ স্মৃতি, বুকে সৃষ্টি হচ্ছিলো সংবিধানে বিসমিল্লাহ যুক্ত হওয়ার ফলে আমার অমুসলিম পরিচয়ে অনিরাপত্তা বোধ— এবং এর সাথে সরাসরি জড়িত ব্যক্তিটি জিয়াউর রহমান। ঐ বয়সে তাই জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার ঘটনায় ঐটুকুই মনে হয়েছিলো, যেমন কর্ম তেমন ফল”! ওটাই ছিলো ঐ বয়সের ধর্ম।

** আমার পরীক্ষা বাতিলের আনন্দ আবারও নিরানন্দ হয়ে গেছিলো। দুই দিন পরেই আবার পরীক্ষা শুরু হয় এবং হুড়মুড়িয়ে শেষও হয়। তবে পর পর দুই বার পরীক্ষা বাতিল হয়েও বাতিল হলো না, পরীক্ষা কেন্দ্র আমার কলেজ থেকে টেনে ঢাকা কলেজে নিয়ে যাওয়ার ধকল আমি নিতে পারিনি, ফার্স্ট ডিভিশন হারিয়ে সেকেন্ড ডিভিশন পেয়ে কোনোমতে বাবার সামনে দাঁড়িয়েছি! এটাও আমার প্রাপ্য ছিলো, পরীক্ষা দিতে বসেও যে মেয়ে রাজনীতির হিসেব নিকেশ করে, তার তো পরীক্ষায় পাশই করার কথা ছিলো না! যেমন কর্ম তেমন ফল পেয়েছি।**

**জিয়াউর রহমানের নিহত হওয়ার ঘটনায় আজও আমার শোক হয় না। জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা হয়েও মুক্তিযুদ্ধের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অকৃত্রিম উদারতার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।
নিজে হাতে বঙ্গবন্ধুর বুকে গুলি ছোঁড়েন নাই, তবে বঙ্গবন্ধুর বুক গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয়ার ম্যাপ এঁকে দিতে উনি প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেছেন। উনি ক্ষমতায় যেভাবেই যাক, ক্ষমতায় গিয়েই হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করিয়েছেন। উনি বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে বাঙালি, ধর্ম নিরপেক্ষতা মুছে দিয়ে বাংলার জনগণকে শতভাগে বিভক্ত করেছেন।

বাংলাদেশ আজ কোথায় পৌঁছানোর কথা, জিয়াউর রহমানের স্বার্থলোভী, কুচক্রীপনার পাঁকে পড়ে বাংলাদেশ আজ কোথায় দাঁড়িয়ে আছে! সেই যে সংবিধান থেকে ধর্ম নিরপেক্ষতা কেটে বিসমিল্লাহ যোগ করে বাংলাদেশের সংবিধানের বুকে, অমুসলিম নাগরিকদের বুকে চিরস্থায়ী ক্ষত করে দিলেন, এরপরে কত রাজা এলো, কেউ আমাদের সেই ক্ষত সারানোর চেষ্টা করলো না। উলটো পরের রাজা এসে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ধর্ম ইসলাম করে দিলো। এরপরেও কত রাজা এলো, বাংলাদেশটা আর আগের মতো হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিষ্টানের হলো না, বাংলাদেশটা মুসলমানেরই রয়ে গেলো। অথচ মুক্তিযুদ্ধটা করেছিলো বাংলার মুসলমান হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে।

আর স্বাধীনতার বাহান্ন বছর পরেও মাতৃভূমিতে একই মায়ের সন্তান হয়েও আমরা মুসলমানদের বৈমাত্রেয় ভাই বোন হিসেবেই জীবন কাটিয়ে গেলাম।

**বঙ্গবন্ধু আজ নিজের গ্রামের মাটিতে বাবা মায়ের পাশে নিদ্রিত আছেন, আর জিয়াউর রহমানের লাশেরই হদিস পাওয়া যায়নি। দেশের সাথে, দেশের জনগণের সাথে এমন বেইমানি করেছেন যিনি, তাঁর পরিণতি তো এমনই হওয়ার কথা। **

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
সেই ৩০শে মে!, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০৫-০৭-২০২৩ | ১৩:৩৫ |

    সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতা থাকলে রাষ্ট্রের সকল ধর্মের অনুসারীদের সর্বক্ষেত্রে সম অধিকার থাকে, রাষ্ট্রের জনগণ অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী হয়। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...