মুক্তিযোদ্ধা আলীম ভাই আমাদের খুব ভালো বন্ধু। পেশায় মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, থাকেন আমাদের শহর থেকে তিরিশ মাইল দূরের আরেক শহরে। সপ্তাহে কমপক্ষে দুই দিন আলীম ভাই আমাদের বাড়িতে আসেন। আমার উত্তমকে তিনি রঞ্জুদা ডাকেন, আমাকে মিঠু। খুব সহজ সরল মনের এক মানুষ আলীম ভাই, আমাদের বাড়িতে আসলেই নাকি উনার মনে হয়, আপন ভাইয়ের বাড়িতে এসেছেন। রঞ্জুদার সাথে বসে রাজনীতির গল্প, অর্থনীতির গল্প করেন, টিভি তো চলতেই থাকে, খুব ভালো মুভি থাকলে একসাথে দেখেন। দেশী খাবার, দেশী ভাষায় গল্প চলতেই থাকে। আমি উনার কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের গল্পগুলো শুনি। আমার লেখা ” চোখ যায় যদ্দুর’ বইটায় উপহার বাণীতে উনাকে মুক্তিযোদ্ধা সম্বোধন করেছিলাম, খুশীতে আলীম ভাইয়ের চোখে জল চলে এসেছিলো।
আমাদের বাড়িতে আলীম ভাই সকালেই আসুন অথবা বিকেলে, সন্ধ্যেবেলাটা উনি মিস করেন না। কারণ সন্ধ্যেবেলায় আমি মাথায় ঘোমটা দিয়ে প্রদীপ আর ধূপকাঠি হাতে সারাবাড়িতে সন্ধ্যাবাতি দেখাই। আমাকে এই সাজে নাকি খুব পবিত্র স্নিগ্ধ মমতাময়ী মায়ের মতো দেখায়। সারা ঘরে বাতি দেখানোর পর প্রদীপ আলীম ভাইয়ের সামনে নিয়ে ধরতে হয়, আলীম ভাই দুই হাত উপুর করে প্রদীপের শিখায় হাত দুটো বুলিয়ে তা নিজের মাথায় আর গায়ে মাখেন। এটা উনি করবেনই, আমি একবার ভুল করে প্রদীপ উনার কাছে না নিয়েই ঠাকুরঘরে ফিরে যাচ্ছিলাম। আলীম ভাই আমার নাম ধরে ডেকে বললেন, মিঠু আজ তো আমি প্রদীপের আলো পাইলাম না!
সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালিয়ে সারাবাড়ি আলো দেখানোর এই দৃশ্যটা নাকি আলীম ভাইকে উনার শৈশবে টেনে নিয়ে যায়। উনার ছেলেবেলায় উনার নানীকে, আম্মাকে দেখেছেন মাথায় কাপড় দিয়ে সন্ধ্যাবেলায় বাতি জ্বালিয়ে সারাবাড়ি দেখাতেন। আর উনাদের প্রতিবেশী হিন্দু বাড়িতে দেখতেন, মাসিমা কাকিমারা প্রদীপের শিখা বাচ্চাদের মাথায় গায়ে বুলিয়ে দেয়। আলীম ভাইয়ের কাছে এই দৃশ্যটা খুব ভালো লাগতো। আমাকে সন্ধ্যাবেলায় এই সাজে দেখে উনার ছেলেবেলার নানী আম্মা মাসিমা কাকিমাদের কথা মনে পড়ে!
গতকালও আলীম ভাই এসেছিলেন দুপুরের আগে রঞ্জুদার সাথে দেখা করতে। রঞ্জুদা কোলোনোস্কোপি করিয়ে বাড়ি ফিরেছেন, তাই রঞ্জুদার শরীর কেমন তা দেখতে আসা। এসেই বললেন, আরে আমার রঞ্জুদা তো একদম ফিট আছে। চলেন রঞ্জুদা, আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করে আমরা আজ রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করে আসি। আমি বললাম, আলীম ভাই, আমি তো পেঁয়াজ দিয়ে৷ চিনিগুড়া চাল আর মুসুরের ডালের খিঁচুড়ি রেঁধে ফেলেছি, আলুভাজা ডিমভাজা দিয়ে খিঁচুড়ি খান। রেস্টুরেন্টে অন্য একদিন খাওয়া যাবে। আইটেমের নাম শুনেই আলীম ভাই আবার শৈশবে চলে গেলো। আরে মিঠু, আমার আম্মা মুসুরের ডাইলের খিঁচুড়ি রানতো, সাথে ডিম ভাজা। আহা, অমৃত।
তারপর যথারীতি সন্ধ্যা হয়ে এলো, আমি পূজার পোশাক পরে মাথায় ঘোমটা দিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে সারা বাড়ি দেখিয়ে আলীম ভাইয়ের সামনে প্রদীপ ধরলাম। আলীম ভাই প্রদীপের শিখা মাথায় গায়ে মেখে বললো, আচ্ছা মিঠু, আমার আম্মা খালা নানীকে দেখেছি সন্ধ্যার আগেই কাপড় পালটে ঠিক এমন করেই ঘোমটা দিয়ে অজু করে নামাজ পড়তে বসতো। আপনি তো আধুনিক যুগের মেয়ে, আপনিও সন্ধ্যার পূজার সময় মাথায় ঘোমটা দেন, তার মানে হিন্দু মুসলমানের একই নিয়ম? দুই ধর্মেই মাথায় কাপড় দিতে হয় সবাইরে?
বললাম, ধর্ম দুইটা হলে কি হবে, মাথায় কাপড় দিয়ে যাঁরে স্মরণ করি, তিনি তো এক এবং অদ্বিতীয় সৃষ্টিকর্তা। আমরা দুই ধর্মের মানুষেরা নিজেরা কাইজ্জা ঝগড়া করে তাঁরে দুই নামে ডাকি। তাতে তো উনার শ্রেষ্ঠত্ব দুই ভাগ হয় না। দিনের একটা সময়ে তো দুই ধর্মের মানুষই আল্লাহ আর ভগবান নামের একই সৃষ্টিকর্তার কাছে মাথা নত করে কিছু সময়ের জন্য আত্মনিবেদন করে। সারাদিনের করা ভুল ভ্রান্তির জন্য ক্ষমা চায়, সকলের মঙ্গল কামনা করে। আসলে সৃষ্টিকর্তার ঊদ্দেশ্যে মাথা নত করার সময় মাথায় ঘোমটা দিতে হয় চুলগুলো ঢেকে রাখার জন্য, নইলে মনটাকে পুরোপুরি সঁপে দেয়া যায় না, মাথার চুল মুখের সামনে পিছনে এসে মনোযোগে বিঘ্ন ঘটায়।
এই জন্যই হিন্দু মুসলমান সকল নারীই সন্ধ্যাবেলা আরাধনা অথবা নামাজ পড়ার সময় মাথায় ঘোমটা দেয়, অই সময়ে তাদের দিকে তাকালে আপনার মতো অনেকেরই মনটায় পবিত্র বোধ হয়। আলীম ভাই শুধু বললেন, ফ্যানটাসটিক। দারুণ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। চলেন, তাইলে কালকেই রেস্টুরেন্টে খেতে যাই, নেপালি রেস্টুরেন্টে।
বললাম, আলীম ভাই, আমাকে এই সাজে দেখলেই আপনার আম্মার কথা মনে পড়ে। আগামী রবিবার মাদার’স ডে। রবিবারেই বরং রেস্টুরেন্টে খাওয়ান, একজন মা হিসেবে নিজেকে সম্মানিত বোধ করার সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাই না।
loading...
loading...
যাপিত জীবনের অসামান্য স্মৃতি গাঁথা। ভালো থাকুন প্রিয় লেখক।
loading...
ভালো লাগলো! লেখকের জন্য শুভকামনা থাকলো।
loading...
গভীর ভালোবাসার প্রকাশ——
অনেক শ্রদ্ধা জানাই!
loading...