ফেলনা থেকে খেলনা!

34 সেদিন ওয়ালমার্ট গার্ডেন সেন্টারে গেছিলাম, সস্তা দামের বেশ কিছু ফুলের চারা ট্রলিতে তুলেছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম, গার্ডেন সেন্টারের ফ্লোরে জল কাদায় মাখামাখি হয়ে পড়ে আছে এই রঙিন পাতাগুলো। এসোসিয়েট যখন গাছে জল দিয়েছে জলের আঘাতে কিছু পাতা ছিঁড়ে পড়ে গেছে। আমি জলকাদা থেকে প্রায় নেতিয়ে যাওয়া পাতাগুলো তুলে নিলাম। একজন এসোসিয়েটকে দেখিয়ে বললাম, এগুলো আবার টবে পুঁতে দাও, বেঁচে যাবে।

এসোসিয়েট বললো, ধুর এগুলো আরেকটু পরে বস্তায় ভরে ফেলে দেবো। আমি ওগুলো এসোসিয়েটের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে অন্য ফুলের চারার সাথে বাড়ি নিয়ে এলাম। বাড়িতে এনে পচা-ভালো সবকয়টা পাতাকে অনেক কসরত করে ঠিকই বাঁচিয়ে ফেলেছি। আগামীকাল আমার উত্তমের কোলনোস্কোপির তারিখ, আজ তাকে সারাদিন তরল খাবার খেতে হবে। তাই আজ রান্নাবান্নার ঝামেলা ছিলো না, উত্তমের জন্য সুগন্ধি লিকার চা, মুসুরের ডালের ক্লিয়ার স্যুপ আর মুরগির ক্লিয়ার স্যুপ বানাতেই চূলা অফ। জি বাংলার সিরিয়ালগুলোও বিকেলের আগেই দেখা হয়ে গেছে।

মনটা ফুরফুরে লাগছিলো তাই। বসে গেলাম কমপিউটারে। মাথার মধ্যে অনেক চাপ, কত লেখা জমে আছে, শুরুই করতে পারছিলাম না। আজ শুরু করলাম, একটা লেখা শেষ করতেই দেহ থেকে ক্লান্তি চলে গেলো। খেয়াল হলো, আজ সারাদিনে ঘুমও আসেনি। তার মানে, আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করেছি। সন্ধ্যের পর মনে হলো, সৃজনশীল কিছু করা যাক। আমি ভুলেই গেছিলাম, কৈশোরে আমাদের সাদামাটা সংসারে আমি নিজের মনেই মূল্যহীন কিছু জিনিসপাতি জোগাড় করে অমূল্য শিল্পকর্ম তৈরি করতাম। যেমন আমাদের ঘরে সোফাসেট ছিলো না৷ টিভি ছিলো না, ফ্রিজ তো ছিলোই না, ছোটো একটা বুকসেলফ ছাড়া দর্শনীয় কিছুই ছিলো না। বুকসেলফটাও মায়ের গল্পের বইয়ে ঠাসা থাকতো, বুকসেলফের উপর ফুলদানি রাখার জায়গাও ছিলো না।

অথচ আমার খুব ইচ্ছে করতো সুন্দর সুন্দর জিনিস দিয়ে ঘর সাজাই। কিন্তু কি দিয়ে সাজাবো, বই দিয়ে তো ঘর সাজানো যায় না। আমরা তখন কালি কলম দিয়ে লিখতাম। কালি থাকতো দোয়াতে, দোয়াত খালি হয়ে গেলে আমার মামীকে দিয়ে দিতাম। মামী ফেরিওয়ালার কাছে পুরানো কাগজ, কালির দোয়াত সের দরে বিক্রি করে দিতো। একদিন মাথায় এলো, আমাদের ফুলদানি নেই, শো কেইস নেই। তাতে কি, কালির দোয়াত আছে, কাপ প্লেট, আয়না চিরুনি জবাকুসুম তেলের বোতল, বসন্ত মালতী লোশন, মায়ের সিঁদুরের কৌটো, তিব্বত স্নো, পন্ডস পাউডারের কৌটা রাখার জন্য তারজালি দেয়া তিন তাকের একট মিটসেফ তো আছে।

34j কালির দোয়াতটাকেই তো ফুলদানি বানাতে পারি, তাজা ফুল কোথায় পাবো, প্লাস্টিকের ফুল আমার পছন্দ না। স্কুলের মাঠে দেখেছি মাঠ জুড়ে দূর্বা ফুল, কাশফুলের মতোই দেখতে। নিয়ে এলাম এক মোঠা দূর্বা ফুল। কালির দোয়াতে দূর্বাফুল ভরে মিটসেফের উপরের তাকে বসাতেই মনে হলো, আমাদের সাদামাটা ঘরটাকে খুব সুন্দর লাগছে। এর কয়দিন পর রান্নাঘর থেকে মায়ের ডাক এলো। মায়ের স্কুলে যাওয়ার সময় হয়ে যাচ্ছে, একা হাতে রান্নার কাজ কুলিয়ে উঠতে না পারলেই মা আমাকে ডাকতো। ছোটোবেলা থেকেই রান্নাঘর আমার খুব প্রিয় স্থান, মন্দিরের মতো। কাজেই মা ডাকলে আমি খুশি হতাম।

সেদিন মা’কে ডিম ভেঙে ফেটিয়ে দিতে হবে। প্রথম ডিমটা হাত ফসকে পড়ে ঠাস করে ফেটে গেলো। আমার হড়বড় কাজে মা অসন্তুষ্ট হলো। তাই দ্বিতীয় ডিমটা খুব সাবধানে একটু একটু করে ফাটানোর চেষ্টা করতে গিয়েই মনে হলো, ডিমের খোসাটা আস্ত রেখে যদি ডিমটা ভাঙতে পারি, তাহলে এই খোসাটার গায়ে পেন্সিল দিয়ে এঁকে পুতুলের মুখ বানাতে পারবো।

যেই ভাবা সেই কাজ। কিন্তু একটা সমস্যা দেখা দিলো। সব হিন্দু বাড়িতে তখন এঁটোকাঁটা আমিষ নিরামিষ বাছবিচার করা হতো। সেই হিসেবে ডিম আমিষ, রান্নাঘর থেকে ডিম কোনোভাবেই পড়ার টেবিলে যাওয়ার কথা নয়। কারণ পড়ার টেবিলে বই পুস্তক থাকে, সেখানে দেবী সরস্বতীর অধিষ্ঠান। আমিষ তো পড়ার টেবিলে যেতে পারবে না, পড়ার টেবিল ছাড়া আমি ডিমের খোসায় চিত্রকর্ম করবো কি করে! আমার একটা সুবিধা ছিলো। এঁটোবাসি মাও মানতেন, তবে খুব কড়া বাছবিচার করতেন না। জামায় ভাত পড়লে আমার মামী যেখানে অই জামা পাল্টাতে বাধ্য করতো, মা সেটা করতো না। ভাতটা ঝেড়ে জামার অই জায়গাটা একটু জল দিয়ে মুছে ফেললেই সাতখুন মাফ। আর আমার ভাইদের বেলায় ওটুকুও করতে হতো না, ছেলেদের বেলায় সব ভুলই ক্ষমার যোগ্য ভুল।

তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি, স্কুলে যাওয়ার আগে নিজের টিফিন নিজেই বানিয়ে নেই। রুটি আলুভাজা, কখনো ঘি দিয়ে রুটি মাখিয়ে তার উপর চিনি ছড়িয়ে নেয়া, সবই নিজেকে করতে হতো। মা একা হাতে মাছ তরকারি কেটে, মশলা বেটে সকাল দুপুরের রান্না সেরে সকাল ১১টার স্কুল ধরতো। আমার টিফিন কি হবে, এসব দিকে নজর দিতে পারতো না। তাই ডিমের খোসার গায়ে ছবি আঁকবো না কি করবো, ডিমের খোসা পড়ার টেবিলে তুলবো না ফেলে দিবো, এসব দিকে মায়ের নজর ছিলো না। ডিমের খোসাগুলো ধুয়ে মিটসেফের এক কোণে শুকাতে দিয়ে স্কুলে চলে গেলাম। স্কুল থেকে ফিরেই বসে গেলাম ডিমের খোসা নিয়ে। মায়ের কাছে পরীক্ষার খাতা দেখার জন্য লাল নীল রঙের পেন্সিল ছিলো। সেই লাল নীল পেন্সিল আর আমার কাজল পেন্সিল দিয়ে এঁকে ফেললাম একটা মেয়ের মুখ, একটা ছেলের মুখ। নিজের প্রতিভায় নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

সেই দূর্বা ফুলের দোয়াতের পাশে সাজিয়ে রাখলাম ডিমের শিল্পকর্ম। আমার শিল্পকর্ম নিয়ে ঘরের কেউ মাথা ঘামাতো না। তবে এরপর যতবার ডিম ভাঙার দরকার হতো, হয় মা আমাকে ডাকতো, নয়তো মা নিজেই যত্ন করে ডিমের খোসা আস্ত রেখে ডিম ভেঙে খোসাগুলো আমার জন্য তুলে রাখতো। এরপর তো আমার চিত্রকর্ম শুধু ছেলে আর মেয়ের মুখে সীমাবদ্ধ থাকলো না। ডিমের খোসাতেই লাল নীল কালো পেন্সিলে আকাশ পাখি নদী গোলাপ ফুল কত কি যে এঁকেছি আর অই মিটসেফে সাজিয়ে রেখেছি।

ক্লাস টেনে উঠতেই ডিমের খোসা পর্ব শেষ, ততদিনে নতুন শিল্পকর্ম শুরু করেছি। চাল ডাল কালোজিরা মেথি মৌরি দিয়ে গ্রিটিং কার্ড বানানোর চেষ্টা। আর্ট পেপার তো তখন ছিলোই, স্কুল থেকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতাম, গ্রাফ আঁকার জন্য তো স্কুল থেকেই আর্ট পেপার দেয়া হতো। আর্ট পেপারের বাড়তি টুকরোগুলো ফেলে দিতে মন চাইতো না। তখনই কার্ড বানানোর চিন্তা মাথায় এলো।

আর্ট পেপার দুই ভাঁজ করে কার্ডের মতো শেইপ করে কার্ডের উপরে আঠা দিয়ে তার উপর মুসুরের ডাল, চাল, কালোজিরা জিরা মেথি দিয়ে এতো সুন্দর সুন্দর ডিজাইন করতাম। কেউ ছিলো না আমার যাকে গ্রিটিং কার্ড দেয়া যায়। আমিই বানাতাম, আমার কাছেই রেখে দিতাম।

আজ এতো বছর বাদে সেই কৈশোরের কথা মনে পড়ে গেলো। রান্নাঘরে গেছি, ছোটো একটা জলের খালি বোতল দেখতে পেলাম। বোতলটা ট্র‍্যাশ ক্যানে ফেলতে গিয়েও থেমে গেলাম। মাথার ভেতর কৈশোর জেগে উঠেছে। পেঁয়াজ কাটার ছুরি দিয়ে বোতলটাকে কাটলাম। কায়দা করে ফুলদানির মতো একটা অবয়ব বানালাম। এরপর মাটি দিয়ে, বেঁচে ওঠা রঙ বাহারের পাতা দিয়ে তৈরি করে ফেললাম ইন্ডোর প্ল্যান্ট পট। টেবিলে ছিলো অর্কিডের শুকনো পাপড়ি, দুটো পাপড়ি লাগিয়ে দিলাম পটের গায়ে।

ফেলনা থেকে খেলনা বানানোর সাথে সাথে আমার ভেতরে হাজার ওয়াটের বাতি জ্বলে উঠলো।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
ফেলনা থেকে খেলনা!, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১৪-০৫-২০২৩ | ১২:৫৪ |

    যাপিত জীবনের অসামান্য স্মৃতি শব্দের … শাব্দিক প্রকাশ। বেশ। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...