মায়ের গন্ধ! ... আজও খুঁজি, আজও পাই

Screenshot আমার মা সারাজীবন চুলে নারকেল তেল মাখতেন। শ্যাম্পু করতে দেখিনি, মাঝে মাঝে জেট পাউডার জলে গুলে তা দিয়ে মাথার চুল ধুতেন। চুল শুকিয়ে ঝরঝরে হওয়ার সাথে সাথে তেলের শিশি নিয়ে বসতেন, চুল ভিজিয়ে তেল দিতেন। আমার মা কখনও গায়ে মুখে লোশান ক্রিম বা স্নো মাখেননি। পন্ডস পাউডার অথবা কিউটিকোরা পাউডার মুখে গলায় ঘাড়ে মেখে কপালে সিঁথিতে সিঁদুর দিতেন, হয়ে যেত সাজগোজ।

সবার মায়েরই আলাদা একটা গন্ধ আছে। সেই গন্ধ দিয়েই সন্তান তার মা’কে চিনতে পারে। জন্মের পর শিশু তার মায়ের কোলে থেকে যে গন্ধটা পায়, সেই গন্ধটাই তার মায়ের গন্ধ। আমার মায়ের গন্ধ ছিল মাথায় থাকা নারকেল তেল, আর গায়ে জড়িয়ে থাকা ব্লাউজ শাড়ি হতে আসা ন্যাপথলিনের গন্ধ মিলে মিশে ককটেল ধরণের একটা গন্ধ। এই গন্ধের বর্ণনা হয় না, এই গন্ধের সাথে ফুল ফল পারফিউমের গন্ধের মিল হয় না, এটা আমার মায়ের গন্ধ। গন্ধটা এমন ছিল যে, কেউ যদি একশটা একই রকম শাড়ি দিয়ে আমায় বলতো, গন্ধ শুঁকে বের করো কোন্ শাড়িটা তোমার মায়ের।

আমি প্রতিটি শাড়ি শুঁকে শুঁকে ঠিক বের করে ফেলতে পারতাম, কোন্ শাড়িটা আমার মায়ের। মায়ের বালিশের ওয়ার, গামছা বিছানার চাদরে ছিল আরেকরকম গন্ধ, শাড়ির গন্ধের থেকে আলাদা। এই গন্ধে নারকেল তেলের পুরানো গন্ধ মিশে থাকতো। ওটাও ছিল মায়ের গন্ধ, আমার মায়ের গন্ধ। আমার মাসি মামী পিসীদের জামাকাপড়, গামছা বালিশ থেকে অমন গন্ধ আসতো না।

২০১২ সালে বিনা নোটিশে আমার মা মারা যান।
মায়ের বয়স হয়েছিল পঁচাত্তর, কিন্তু মায়ের দেহ ছিল সতেজ সুঠাম, মৃত্যুর জন্য তখনও মায়ের দেহ মন তৈরী হয়নি। তারপরেও মা’কে চলে যেতে হয়েছে। বিনা নোটিশে মৃত্যুটা হয়েছে বলেই আমরা মায়ের মৃত্যুটাকে সহজ কঠিন কোনোভাবেই গ্রহণ করতে পারিনি। মায়ের মৃত্যুর পর এক বছর উদভ্রান্তের মত আমি চলেছি। রান্না খাওয়া চাকরি সংসার সবই করেছি, কিন্তু কিছুই স্বাভাবিকভাবে করিনি।

ওয়ালমার্টে কাজের ফ্লোরে আছি, ঝরঝর করে চোখ থেকে জল পড়ছে। কাস্টমারের সাথে কথা বলছি, চোখ জলে ভিজে যাচ্ছে। ঐ সময়টা আমি সুযোগ পেলেই সবার অলক্ষ্যে নিরালা স্থান খুঁজে নিজের মত হাঁটতাম আর মনে মনে মায়ের সাথে কথা বলতাম। একদিন কাজের ফাঁকে অমনই নিরালায় হাঁটছিলাম, পেছন থেকে হালকা বাতাসের ঝাপটা আমার কান ঘেঁষে চলে গেলো। সেই বাতাসের ঝাপটায় আমার মায়ের গন্ধ ছিল। মায়ের বালিশে গামছায় বিছানার চাদরে যে গন্ধটা ছিলো, মায়ের সেই গন্ধটা। নারকেল তেলের পুরনো গন্ধের মত, ওটার ব্র্যান্ড নেম ছিল, ‘আমার মায়ের গন্ধ’।

সেদিন একবার নয়, দুই তিনবার মায়ের গন্ধটা নাকে এসে লাগলো। অমন বেদিশা সময়েও আমি দিশা ফিরে পেয়েছিলাম। প্রথমবার গন্ধ নাকে আসতেই খুঁজছিলাম গন্ধের উৎস। এটা তো হতে পারেনা যে এক বছর পর স্বর্গ থেকে মা বাতাসে ভেসে এসেছে! তাহলে মায়ের গন্ধ কোথা থেকে আসতে পারে! ঘাড় থেকে আমার চুলের গুছি টেনে নাকে ছোঁয়ালাম, সেখানে আমেরিকান শ্যাম্পুর গন্ধ। আমি মাথায় তেল দেই না, তেলের গন্ধ আসবে কোত্থেকে! বিয়ের আগে হলেও কথা ছিল, তখন মায়ের নির্দেশে চুলে জবজবে করে তেল দিতেই হতো, সেটাওতো নারকেল তেল নয়। আমার মাথার চুলে মাখা হতো জবাকুসুম তেল। আমি দাঁড়িয়েছিলাম ইলেকট্রনিক ডিপার্টমেন্টের টিভি আইলের সামনে, সেখানে তেল স্নো পাউডার সামগ্রীও সাজানো নেই। তাহলে মায়ের গন্ধটা এলো কোথা থেকে, তবে কি মনের ভুল!

ঠিক তেমন সময় আরেকবার, আরও একবার মায়ের গন্ধের ঝাপটা আমার নাকে ছুঁয়ে গেলো! আশেপাশে আর কেউ ছিলোও না যে তাদের গায়ের গন্ধ বাতাসে আসছে। আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো! তবে কি সত্যিই মা বাতাসের সাথে ভেসে আমায় ছুঁয়ে দিতে এসেছিলো! মা কি স্বর্গে বসে দেখতে পায় যে, আমি ওয়ালমার্টে কাজের ফাঁকেই আনমনা হয়ে মা’কে খুঁজি, মায়ের জন্য কাঁদি! তাই মা বলে গেলো, আমি আছি!
মায়ের গন্ধটা এরপর অনেকদিন আর পাইনি। মায়ের কথা ভেবে এখন উনমনাও হই না। তবে খুব একাকী বোধ করি।

দশ বছর পেরিয়ে গেছে মা নেই, গত দশ বছরে প্রতি দিন টের পেয়েছি, আমি কতখানি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছি। এখনও চোখে জল আসে, তবে সব সময় আসে না। প্রতি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে, ঘুম থেকে উঠে শিয়রের কাছে রাখা মায়ের ছবিতে হাত ছুঁয়ে প্রণাম করি। ভক্তিতে গদগদ হয়ে এই কাজটা করি না। মায়ায় মমতায় ভালোবাসায় আপ্লুত হয়ে এই কাজটা করি। মনে হয়, মা আছে। এখন আমার আর মনে হয় না, মা নেই।

বেশ কিছুদিন হয়ে গেলো, মনটা অস্থির। অস্থির সময়ে আগে মা’কে ফোন করতাম। মায়ের সাথে চেঁচামেচি করতাম, চোপা করতাম, মা’কে বকতাম সবই করতাম, এরপর মায়ের কাছ থেকে পাওয়া উপদেশ বাণী নিয়ে অস্থির মনটাকে সুস্থির করতাম। এখন তো মা নেই, কার সাথে চোপা করব? মাসীর সাথে, পিসীর সাথে, মামীর সাথে, কাকীর সাথে? তাঁদের সাথে চোপা করলে তাঁরা দ্বিতীয় দিন আর আমার সাথে কথা বলবে? মোটেও না। রাগারাগি, গলাবাজি মায়ের সাথে করা যায়, আর কারো সাথে না। একমাত্র মায়েরাই বুঝতে পারে ছেলে মেয়ের অস্থিরতা।

মেয়ে কেন এত চেঁচামেচি করছে, মায়ের সাথে চোপা করছে তা মা ছাড়া কার এত দায় পড়েছে বুঝতে চাওয়ার! আমার অস্থিরতা কমানোর মানুষটা দশ বছর হয়ে গেলো নেই, তাই আমি সুস্থির হতে পারি না। আমার পারিবারিক জীবনে, ব্যক্তি জীবনে কতইতো উঠা নামা চলে, সবই মনের ভেতর চেপে রাখি। মনের ভেতর চাপি আর ভাবি, মা যদি থাকতো, মা’কে ফোন করে সব খুলে বলতাম। মা নিশ্চয়ই আমায় ইতিবাচক কথা বলে মন খুশি করে দিত। সকল পুরানো কলিগদের সাথে মায়ের যোগাযোগ ছিল, তাছাড়া স্কুলের আয়া ছিল কয়েকজন যারা মাঝে মাঝে আমার মায়ের কাছে এসে কোথায় কার পরিবারে কি কি ঘটেছে তার বার্তা শুনিয়ে যেতো। সেগুলো থেকেই মা আমার কাছে কোট করতো।

মা হয়তো বলতো, ” থাক, যা হইছে হইছে, এত ভেবে করবি কি? ঐ তো আমাদের শিউলি টিচারের কথা শুনলাম, আঞ্জুমান আরা আপার কথাও শুনলাম। তাগোও একই সমস্যা। আজকাইল এই রকম ঘটনা আকছার ঘটে। এইসব দুশ্চিন্তা মাথা থিকা ঝাইড়া ফালাইয়া সংসারে মন দে”।
নাহ! মা চলে যাওয়ার পর এখন কেউ আমায় কিছু বলে না, আমিও কাউকে কিছু বলি না।
মনে মনে মা’কে মিস করি।

এভাবেই দিন কাটে, মায়ের গন্ধও ভুলে গেছি। আজ দুপুরের দিকে ডিভানে শুয়ে টিভিতে জি বাংলায় রাণী রাসমণি’ দেখছিলাম। আমি এই ধারাবাহিকগুলো পছন্দ করি। দুই শত বছর আগের ঘটনাগুলোর নাট্যরূপ, এগুলো দেখে হুবহু না হোক, কিছু তো ইতিহাসের গন্ধ পাই। ঠিক সেই সময় আমার নাকে মায়ের গন্ধ এসে ছুঁয়ে গেলো!

চমকাইনি, আরেকবার পেলাম গন্ধটা। শাড়ি ব্লাউজ পাউডারের গন্ধ নয়, সেই নারকেল তেলের পুরনো গন্ধ যা মায়ের বালিশ, গামছা, বিছানার চাদর থেকে আসতো। মনে পড়ে গেলো, শৈশব কৈশোর যৌবনের শুরুর দিকে প্রতি রবিবার এবং গরমের ছুটির দুপুরে মা গল্পের বই নিয়ে শুতো। আমি মায়ের বালিশে মাথা দিয়ে শুতাম, আর মায়ের তেলে ভেজা চুল নিয়ে খেলা করতাম। সেই থেকেই ঐ গন্ধটাই আমার মস্তিষ্কের কোষে কোষে ছড়িয়ে গেছে।

আজ আর চারদিক খুঁজিনি, কোথা থেকে গন্ধ আসে বলে। অভ্যাসবশে নিজের চুলের গুছিতে নাক দিলাম, শ্যাম্পুর গন্ধ। থাক, মায়ের গন্ধ মায়েরই থাক। মায়ের গন্ধ কেন আমার চুলে আসবে? আমার মনটা যে এত অস্থির, তাতো মা স্বর্গ থেকে দেখতেই পায়। মা’কে মিস করি, আজও মিস করি। তাই মা মাঝে মাঝেই আমায় ছুঁয়ে যায়, এবং প্রতি বার বলে যায়, “আমি আছি”।

.
‘ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টার’—- ( আর্কাইভ থেকে )

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
মায়ের গন্ধ! ... আজও খুঁজি, আজও পাই, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ৩০-০৩-২০২৩ | ১০:৩৪ |

    জীবন ভিত্তিক বা জীবন নির্ভর আপনার প্রতিটি লিখাই পাঠক হৃদয় ছুঁয়ে যায়। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...