তেতো কথা!

তেতো কথা! “ধর্ষণে টপ লিস্টে আছে আমেরিকা, ইউরোপ, বাংলাদেশ নেই”– কি করে জানলে?
বাংলাদেশে তো ধর্ষণের কেইস হয় না, ধর্ষিতার সমাজে ঠাঁই হয় না, ধর্ষিতার বিয়ে হয় না। ফলে ধর্ষণের ঘটনা নথিভুক্ত হয় না। তাই প্রতিদিন কত শত ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে তার পরিসংখ্যান জানা যায় না। বাংলাদেশে নারী মূর্তিও ধর্ষিত হয়, দেবী প্রতিমাও ধর্ষিতা হয়।

৯৫ বছরের বুড়াও নারীকে তেঁতুল ভেবে জিভে লালা দিয়ে টকর টকর আওয়াজ তোলে, এটাও ধর্ষণ। ধর্ষণ যে করে, সে ধর্ষণের সংজ্ঞা জানেনা, ধর্ষিতা যে হয়, সেই শুধু জানে ধর্ষণের সংজ্ঞা। শফি হুজুরের তেঁতুল তত্ত্বে বাংলাদেশের সকল নারী ধর্ষিত হয়েছিল।

ধর্ষিতার মৃত্যু দেখানো হয় ভালুকের কামড়ে। মেডিক্যাল রিপোর্ট দুই রকম আসে, প্রথমে বলে, ধর্ষণ হয়েছে। দুই দিন পর কবর থেকে গলে যাওয়া দেহ পরীক্ষা করে বলা হয়, ধর্ষণের আলামত নেই। তাহলে??

যাও বা সাহস দেখিয়ে দুটো মেয়ে থানায় গিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ দাখিল করলো, তাতেও প্রশ্ন উঠেছে, মেয়ে কেন বাইরে গেলো? মেয়ে কেন ছেলে বন্ধুর নিমন্ত্রণে হোটেলে গেল? ধর্ষণের এক মাস পরে কেন অভিযোগ?

** শিশু পূজা কোন হোটেলে গেছিলো? তনু কোন ছেলের সাথে গেছিলো? মাদ্রাসায় ছোট ছেলেদের বলাৎকার করা হচ্ছে কেন? মাদ্রাসা তো পবিত্র স্থান!
বাকোয়াজদেরও নির্লজ্জতার সীমা থাকা উচিত!**

আমার বন্ধুদের মধ্যে দয়া করে আর কেউ বোকার মত বলো না, “ধর্ষণে আমেরিকা সবার উপরে, বাংলাদেশে ধর্ষণ হয়না।” কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা লাগে!

আমেরিকা ধর্ষণ লিস্টে কেন টপে আছে জানতে চাও? একটা ছোট অভিজ্ঞতার কথা বলি।

ওয়ালমার্টে একদিন কাজের ফাঁকে হাঁটতে হাঁটতে অন্য এক ডিপার্টমেন্টে গেছি। সেখানে পরিচিত এক মেয়ে এসোসিয়েটকে না দেখতে পেয়ে তার সহকর্মীকে ( ছেলে) জিজ্ঞেস করলাম, “আমান্ডা( কল্পিত নাম) আজ আসেনি?”
সহকর্মী বলল, “আমান্ডা আজ পুলিশের কাছে গেছে”।
-কেন?
-গত সন্ধ্যায় ওর এক ছেলে বন্ধু ওর ফ্ল্যাটে বেড়াতে এসেছিল। ড্রিংক করেছে , হাসি গল্প করেছে এরপর নাকি বন্ধু ওকে জোরপূর্ব্বক ফিজিক্যালি এবিউজ করেছে। তাই ও তখনই পুলিশ কল করেছিল। পুলিশ এসে বন্ধুকে নিয়ে যায়। সেটারই রিপোর্ট করতে হবে আজ, তাই ও আজ আসেনি”।

এই কারণেই আমেরিকার নাম সব কিছুর টপে দেখা যায়; কারণ আমেরিকানরা কোন কিছু নিয়ে লুকোছাপা করেনা অথবা লুকোছাপা করে রাখতেও পারে না। সব প্রকাশিত হয়ে পড়ে অথবা বিনা দ্বিধায় যার যার সমস্যা সে জায়গা মত প্রকাশ করে। আইন এদেশে সকলের জন্য প্রযোজ্য।

ধর্ষণ একটি মানসিক ব্যাধি হলেও গর্হিত অপরাধ। পৃথিবীর সব দেশেই ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। আমেরিকাতেও ঘটে, তবে আমেরিকায় ধর্ষিত/ধর্ষিতাকে সামাজিকভাবে বয়কট করা হয়না, তাকে ধর্ষকের বিরুদ্ধে আইনি সহায়তা দেয়া হয়, সমাজ তাকে মানসিক এবং মানবিক সাপোর্ট দেয়। ফলে যে কোন ধরণের লাঞ্ছনার অভিযোগ পুলিশি বইয়ে নথিভুক্ত হয়, তাতেই পরিসংখ্যানে ধর্ষণ লিস্টে আমেরিকার নাম টপে, আর আমেরিকার নাম টপে দেখতে পেয়েই গর্বিত বাংলাদেশীরা খুশিতে বগল চাপড়ায়। ১৬ই মে, ২০১৭।

১৬ই মে, ২০১৮ তে পৌঁছে জানতে পারলাম, বাংলাদেশে একটি কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়েছে প্রথমে। এরপর পারিবারিক এবং পারিপার্শ্বিক প্রতিক্রিয়ার শিকার হয়েছে। শেষে উপায় না দেখে মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যা করেছে।

হ্যাঁ, আপনাদের কথাই ‘ধ্রুব সত্য, ধর্ষণে আমেরিকা শীর্ষে। কথা সেটা নয়, ধর্ষণে শীর্ষে থাকা অথবা মাঝে থাকা নিয়ে আলোচনা হতে পারেনা। কথা হচ্ছে, ধর্ষণ একটি ভয়ঙ্কর অপরাধ কিনা! অপরাধ সংঘটিত হলে অপরাধী সনাক্ত হবে কিনা, অপরাধীকে আইনের হাতে সোপর্দ করা হবে কিনা, অপরাধী শাস্তি পাবে কিনা! আমেরিকা ধর্ষণের শীর্ষে থাকলেও ধর্ষণকে ভয়ঙ্কর অপরাধ হিসেবে দেখা হয়। আমেরিকায় ধর্ষককে অপরাধী গণ্য করা হয়, ধর্ষিতাকে অপরাধী হিসেবে দেখা হয় না। ধর্ষিতা পরিবারের কাছে, আইনের চোখে, সমাজের চোখে নিগৃহীত হয় না। আমেরিকায় ধর্ষিতা আত্মহত্যা করে না।

এদিক থেকে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান কিন্তু শীর্ষে। এসব দেশে মেয়েরা প্রথমে পুরুষের চোখের দৃষ্টিতে ধর্ষিত হয়, পরে শারীরিকভাবে ধর্ষিত হয়, এরপরের প্রতিক্রিয়ায় মানসিকভাবে ধর্ষিত হয়। তিন ধাপে ধর্ষিত হওয়ার ধকল যে মেয়ে সামলাতে পারেনা, সে আত্মহননের পথ বেছে নেয়।

এসব দেশে ধর্ষক পায় বীরের মর্যাদা, ধর্ষিতা পায় অপরাধীর তকমা। লোক জানাজানি হলে ধর্ষিতার কোনদিন বিয়ে হবেনা তাই ধর্ষণের ঘটনার কথা প্রকাশিত হয় না। ঘটনাক্রমে ধর্ষণের ঘটনা জানাজানি হয়ে গেলে মিডিয়ায় যে হই চই শুরু হয়, তাতে প্রতিবাদের চেয়েও অনেক বেশি প্রকাশ পায়, মানুষের কৌতূহল।

সকলের রসালো আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেঃ ধর্ষিতা মেয়েটি দেখতে কেমন, সুন্দরী হলেতো ধর্ষিতা হতেই হবে! ধর্ষিতার পরনে কি পোশাক ছিল, শাড়ির আঁচলের ফাঁক গলে পেটের অংশ দেখা গেলেতো ধর্ষিতা হতেই হবে, ধর্ষিতার গায়ে বোরকা ছিল কিন্তু বোরকা ছিল টাইট, ফলে তার দেহের বিশেষ অংশের ভাঁজ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। মেয়েদের বুকের ভাঁজ, কোমরের খাঁজ যদি স্পষ্ট দেখা যায়, ধর্ষিতা না হয়ে উপায় কি!

এসব কৌতূহল, মুখরোচক আলোচনার আড়ালে চলে যায় ধর্ষকের চেহারা, জেগে উঠে ধর্ষিতার মুখ। ধর্ষক আইনের আওতার বাইরে চলে যায়, ধর্ষকদের পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়না, ধর্ষকের বিচার হয় না। তাই প্রতিদিনের ধর্ষণের ঘটনা নথিপত্রভুক্ত হয়না। এজন্যই ধর্ষণে আমেরিকা শীর্ষে, বাংলাদেশ সর্বনিম্নে।

সকলেই তো পূর্ণিমা শীলের মত সাহসী, আত্মবিশ্বাসী স্বাধীনচেতা হয়ে বড় হয়ে উঠতে পারেনা। গণধর্ষণের শিকার হয়েও যে মেয়ে নিজের পায়ে ভর করে মাথা উঁচু করে সমাজে দাঁড়াতে পারে, তাকে তো ‘সাহসিকা’র খেতাব দেয়া উচিত ছিল। কিন্তু পূর্ণিমা শীলকে তেমন কোন খেতাবেই সম্মানিত করা হয়নি, বরং পূর্ণিমা শীল নামটিকে রাজনীতির দাবাখেলার গুটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে এতকাল।

বাংলাদেশের মেয়েদের পিতামাতাদেরও এতকালের ঘুণে ধরা চিন্তা ভাবনার বেড়াজাল ছিঁড়তে হবে। তাদের বুঝতে হবে, ধর্ষণের মত পাশবিক ঘটনায় একটি মেয়ে শারীরিক এবং মানসিকভাবে পর্যুদস্ত থাকে। সেসময় মেয়েটির পাশে থেকে তাকে এই ট্রমা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করা উচিত। নাহলে ঘরের মানুষদের মলিন মুখের ফুঁয়ে তাদের জীবনের আলো নিভে যেতে পারে।

লোকলজ্জার ভয় পাওয়ার পুরাতন নিয়ম ভাঙ্গতে হবে। মেয়েটিতো আপনাদের, তাকে সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্বও আপনাদেরই। কন্যাকে দোষ দেয়া নয়, মেয়েটিকে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াতে সাহস দিন। যদি পারেন ধর্ষক পুরুষটিকে গলায় গামছা পেঁচিয়ে টেনে এনে গাছের সাথে বেঁধে জুতা পেটা করে বুঝিয়ে দিন, আপনার কন্যাকে অপমান করার ফল কি হয়!

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১৬ টি মন্তব্য (লেখকের ৭টি) | ৯ জন মন্তব্যকারী

  1. রিয়া রিয়া : ১১-০৮-২০১৮ | ২২:১০ |

    যাও বা সাহস দেখিয়ে থানায় গিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ দাখিল করলো, তাতেও প্রশ্ন উঠেছে, মেয়ে কেন বাইরে গেলো? মেয়ে কেন ছেলে বন্ধুর নিমন্ত্রণে হোটেলে গেল? ধর্ষণের এক মাস পরে কেন অভিযোগ? Frown

    GD Star Rating
    loading...
    • রীতা রায় মিঠু : ১১-০৮-২০১৮ | ২২:৩০ |

      মনে হয়, আর অভিযোগের পাতায় নয়, ধর্ষকের বিচার নিজেই করি।

      GD Star Rating
      loading...
  2. মুরুব্বী : ১১-০৮-২০১৮ | ২২:২০ |

    মুখরোচক আলোচনার আড়ালে চলে যায় ধর্ষকের চেহারা, জেগে উঠে ধর্ষিতার মুখ। ধর্ষক আইনের আওতার বাইরে চলে যায়, ধর্ষকদের পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়না, ধর্ষকের বিচার হয় না। তাই প্রতিদিনের ধর্ষণের ঘটনা নথিপত্রভুক্ত হয়না। এজন্যই ধর্ষণে আমেরিকা শীর্ষে, বাংলাদেশ সর্বনিম্নে। ___ সঠিক বলেছেন। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Confused.gif.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • রীতা রায় মিঠু : ১১-০৮-২০১৮ | ২২:৩১ |

      দ্বিমতের অবকাশ নেই আজাদ ভাই। অপরাধীর শাস্তি সঠিক হতে হবে।

      GD Star Rating
      loading...
  3. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ১১-০৮-২০১৮ | ২২:২৭ |

    আমাদের ভারতের পেক্ষাপটও এর চেয়ে কোন অংশে পিছিয়ে নেই।

    GD Star Rating
    loading...
    • রীতা রায় মিঠু : ১১-০৮-২০১৮ | ২২:৩৩ |

      পুরো ভারতবর্ষের সামাজিক আদল যেন পরিবর্তনহীন। একই ছাঁচের। Frown

      GD Star Rating
      loading...
  4. মরুভূমির জলদস্যু : ১১-০৮-২০১৮ | ২২:৫৩ |

    আমাদের সব কিছু উলটো পথে চলে।

    GD Star Rating
    loading...
    • রীতা রায় মিঠু : ১১-০৮-২০১৮ | ২৩:০৭ |

      দুঃখ আর কষ্টবোধ সেখানেই ভাই।

      GD Star Rating
      loading...
  5. ইলহাম : ১১-০৮-২০১৮ | ২২:৫৪ |

    এর একটা ব্যাবস্থা হওয়া প্রয়োজন

    GD Star Rating
    loading...
    • রীতা রায় মিঠু : ১১-০৮-২০১৮ | ২৩:০৮ |

      প্রশ্ন হচ্ছে হবে কি আমাদের জীবদ্দশায় !! সিস্টেম পাল্টানো জরুরী।

      GD Star Rating
      loading...
  6. নিতাই বাবু : ১২-০৮-২০১৮ | ৯:৩৩ |

    আপনার লেখা পড়ে শুধুই ভাবছি! ভাবিয়ে তুললেন । ধন্যবাদ অসংখ্য ।

    GD Star Rating
    loading...
    • রীতা রায় মিঠু : ১২-০৮-২০১৮ | ২১:৩৭ |

      সচেতনতার বিষয় নিতাই বাবু দা। Frown

      GD Star Rating
      loading...
  7. আলমগীর সরকার লিটন : ১২-০৮-২০১৮ | ৯:৫২ |

    সুন্দর ও বোধময় লেখা

    তবে ধর্ষণ করার পিচলে ভিবিন্ন কারণ থাকে

    সবচেয়ে পারিবারিক সমস্যাটাই হলো বড়

     আর আমি মনে করি কিছু ক্ষেত্রে উভয় দায়- 

    কারণ উভয় মধ্যে আচার আচারণ চলাফিরা রাগ

    অহংকার-পারস্পারিক ভাল ব্যহার করা হয় তাহলে

    আমার বিশ্বাস ধর্ষণ কমবে —–

    GD Star Rating
    loading...
    • রীতা রায় মিঠু : ১২-০৮-২০১৮ | ২১:৩৮ |

      এমন সমাজই চাই দাদা। যেখানে অনাচার থাকবে না। ধন্যবাদ আপনাকে।

      GD Star Rating
      loading...
  8. মুহাম্মদ দিলওয়ার হুসাইন : ১২-০৮-২০১৮ | ২২:৫৯ |

    ধর্ষণ যে করে, সে ধর্ষণের সংজ্ঞা জানেনা, ধর্ষিতা যে হয়, সেই শুধু জানে ধর্ষণের সংজ্ঞা। শফি হুজুরের তেঁতুল তত্ত্বে বাংলাদেশের সকল নারী ধর্ষিত হয়েছিল।

     

    * এই ব্যাধি রোধে সামাজিক সচেতনতার বিকল্প নেই…

    GD Star Rating
    loading...
  9. মিড ডে ডেজারট : ১৩-০৮-২০১৮ | ১৪:১৯ |

    তেতো কথায় সত্যের আধিক্য থাকে; গ্রহণ করার সক্ষমতা থাকলে জীবনের ঘাটতিগুলি কমে যায়। তেতো সব্জি করল্যার মতোই।

    অনেক "সত্য" পড়লাম!

    GD Star Rating
    loading...