বকফুল!
ছবিটি একটি ফুলের, ফুলের নাম বকফুল। কিছুদিন আগে গুগলে কি একটা তথ্য বের করতে গিয়ে কেমন করে যে বকফুলের ছবিটা পেয়ে গেলাম। ছবিটা দেখামাত্র হুড়মুড় করে ছুটে আসতে শুরু করলো শৈশবের সকাল, দুপুর আর বিকেল। যে সকাল বিকেল জুড়ে ছিল আমাদের পাশের বাড়ির একটি বকফুল গাছ আর থোকা থোকা বকফুল।
আমরা নারায়ণগঞ্জের আমলাপাড়ায় যে বাড়িটিতে ভাড়াটে হয়ে এসেছিলাম, সে বাড়িতেই কেটে গেছে ৪৭ বছর। ৪৭ বছর আগে আমলাপাড়ার চেহারা ছিল ছিমছাম সুন্দর, আমাদের বাড়িটা ছিল হালকা পাতলা সুন্দর, তিন চারটে উঠোন ছিল সারা বাড়ি জুড়ে। আমরা যে দালানের ঘরে থাকতাম, তার পাশেই ছিল একটানা লম্বা টিনের ঘর, যেখানে কোন পরিবার বাস করতোনা। ওটা ছিল গদি বাড়ি অথবা কাঁচামালের গোডাউন। যাকে আমরা ‘রামধন পসারি’র ঘর বলে জানতাম।
রামধন পসারিতে কোন পরিবার বাস না করলেও এই বাড়ির রান্নাঘরে প্রতিদিন রান্না হতো, সকাল দুপুর কিছু মানুষ খাওয়া দাওয়া করতো।
রান্না করতো একজন মহিলা, খাওয়া দাওয়া করতো যারা তাদের সকলেই পুরুষ। সকাল হলে রামধন পসারিতে প্রাণের শব্দ পাওয়া যেত। পাটা পুতায় মশলা পেষা হচ্ছে, বড় মাছ কাটা হচ্ছে, কড়াইতে গরম তেলে তরকারি পড়ে ছ্যাঁক ছোঁক আওয়াজ হচ্ছে। দুপুর হতেই কাঁসার থালা গ্লাসের টিন টিন ঝিন ঝিন আওয়াজ, কিছু পুরুষের নরম গলায় ” আরেকটু ভাত দেন, মাছের ঝোল এমুন পাতলা হইছে ক্যান” জাতীয় কথা শুনা যেত।
ছোটবেলা থেকেই মানুষের জীবন দেখতে আমার ভীষণ ভাল লাগে। আমাদের ঘরের জানালায় বসে লোহার শিকের ফাঁক দিয়ে রামধন পসারির সকাল থেকে দুপুর অবদি যাপিত জীবনের টুকরো অংশ আমি মন প্রাণ দিয়ে দেখতাম।
বিকেল হতেই রামধন পসারি নীরব হয়ে যেত। কোথাও কোন প্রাণের স্পন্দন শোনা যেত না। আসলে রামধন পসারিতে সকাল শুরু হতো যে রমণীর হাতে, সে ছিল রান্নার মাসী। সকাল দুপুরে যারা খেতে বসতো, তারা ছিল রামধন পসারির কর্মচারী। সকাল থেকে বিকেল, কাজ শেষে সকলেই যার যার বাড়ি চলে যেত, রামধন পসারির টিনের ঘরগুলিও নীরব হয়ে যেত।
রামধন পসারি নীরব হয়ে গেলেই আমাদের বাড়ির দুরন্ত কিশোরেরা সরব হয়ে উঠতো। সকাল হতেই দেখে রাখতাম রামধন পসারির টিনের ঘরগুলির মাথা ছাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বকফুল গাছটাকে। সাদা রঙের অর্ধ চন্দ্রাকৃতি থোকা থোকা ফুলে ছেয়ে আছে। তখনতো অর্ধা চন্দ্রাকৃতি শব্দটা মাথায় আসতোনা, আমার মনে হতো গাছে পুলি পিঠা ঝুলছে। পরের বাড়ির গাছে আমার বরাবরই লোভ ছিল। কারো বাড়ির উঠোনে কাঁচামরিচ গাছ লাগিয়েছে, আমার লোভ হতো। ইচ্ছে করতো রাত হলেই চুরী করে নিয়ে আসবো। মনে হতো কিন্তু চুরী করা হতোনা। গাছ চুরী করে লাভ কি, মরিচ গাছ ট্রাংকেও রেখে দেয়া যাবেনা, মরিচ গাছ চিবিয়েও খাওয়া যাবেনা। তাই হাত নিশপিশ করলেও চুরী করা হয়ে উঠতোনা।
তবে রামধন পসারির বকফুল চুরী করা হতো। চুরী করতে যেতো আমার ছোট মাসি, মেজদা আর তার বন্ধু শ্যামল। আমার কাজ ছিল ঘরের জানালায় বসে বকফুল গাছ রেকী করা, আর মেজদা-শ্যামল দুই চোরের কাজ ছিল ছাদ টপকে রামধন পসারির ঘরের টিনের চালে নেমে পা টিপে টিপে এগিয়ে গিয়ে বকফুল গাছে চড়া। একজন গাছে চড়ে বকফুল ছিঁড়ে আরেকজনের কাছে দিত।ছোট মাসি আর আমি ছাদে দাঁড়িয়ে এই চুরী উৎসব দেখতাম। আমার আবার অল্পে পোষায়না। “মেজদা, আরও পাড়ো, আরো, আরো” করতে থাকতাম। আমার জামার কোচরে, মাসীর জামার কোচরে নিতাম কিছু বকফুল, মেজদার প্যান্টের পকেটে কিছু, শ্যামল চুরী করতে ভালোবাসতো, বকফুলের ভাগ নিতো না।
চুরীর নেশা বড় নেশা। আমাদেরও বকফুল চুরীর নেশা অনেক বড় নেশা ছিল। হলে হবে কি, প্রতিদিন বকফুল বাসায় আনলেই তো আর বিনা প্রশ্নে মা বকফুলের বড়া ভেজে দিতোনা। মায়ের কাছে বকফুল চুরীর কথাও বলা সম্ভব ছিলনা। তাই মাঝে মাঝে মিথ্যে কথা বলতেই হতো। “রামধন পসারির মহিলাটা বলছে ওরা বকফুল খায়না, আমরা যেন নিয়ে আসি”। এমন বললে দোষ থাকে না, মাও বকফুলের বড়া করে দিতে আপত্তি করেনা। পিটালি গোলার মধ্যে বকফুল চুবিয়ে ডুবো তেলে মচমচে করে ভেজে দিত, খেতে কী যে ভাল লাগতো। ভালো তো লাগারই কথা, একে তো ফুলের বড়া তার উপর চুরীর জিনিসে স্বাদ মনে হয় একটু বাড়তি পাওয়া যায়।
মেজদা আর শ্যামলকে বকফুল পাড়তে দেখে চোরের সংখ্যা বেড়ে যেতে লাগলো। পাড়ার অন্য ছেলেরাও এসে যোগ দিতে লাগলো। একটা মাত্র বকফুল গাছ, তাও আমাদের ঘরের লাগোয়া যেহেতু তাই আমাদের দাবী বেশি থাকার কথা। মেজদা আর শ্যামল সেই দাবীতেই মাতব্বরি বেশি করতো।
আমরা অযথাই বকফুল চুরী করতাম। আমরা জানতামই না বকফুল গাছের মালিক এই গাছের খোঁজ রাখেনা। রামধন পসারির রান্নার মহিলা বকফুল নিয়ে মাথা ঘামায় না। যারা দুপুরে খেতে আসতো, তারা ডাল তরকারি মাছের ঝোল দিয়েই খেত, বকফুলের বড়া খাওয়া যায়, এই ব্যাপারটাই হয়তো তাদের জানা ছিলনা। অনেক পড়ে বকফুল চুরী করার সময় রামধন পসারীর কোন একজন কর্মচারী তা দেখে ফেলে, অথবা রান্নার মহিলা দেখে ফেলে। পরে তারা বলে, “এই ফুল আবার খাওয়া যায়? খাওয়া গেলে তোমরা পাইরা লইয়া যাও যত ইচ্ছা”।
যখন জানলাম, চুরী করার দরকার নেই, এমনি এমনিই বকফুল আনা যাবে, তখন থেকেই বকফুল খাওয়ার আগ্রহ কমে গেলো। তাছাড়া মেজদা ইউনিভারসিটিতে চলে গেলো, মাসী বড় হয়ে গেলো, আমি যদিও জানালায় বসে রামধন পসারির সকাল থেকে দুপুরের জীবন পরিক্রমা দেখতাম, সেটাও অনিয়মিত হয়ে যেতে লাগলো। বড় তো আমিও হচ্ছিলাম, স্কুল শেষ করে কলেজে গেলাম, জানালায় বসে থাকার সময় কই। ততদিনে আমার জীবনে সরবতা আসতে শুরু করেছে, সেই ফাঁকে রামধন পসারি ধীরে ধীরে আরও নীরব হয়ে গেছে।
আমলাপাড়ার ঐ ঘরটাতে আমরা ৪৭ বছর ছিলাম। ৪৭ বছর পর পুরো বাড়ির চেহারা বদলে গেছে, আমলাপাড়ার চেহারা বদলে গেছে, আমাদের চেহারা বদলে গেছে। অনেক কিছু হারিয়ে গেছে, সবগুলো উঠোন হারিয়ে গেছে, শ্যামল হারিয়ে গেছে, শৈশবে দেখা সব ভাড়াটে হারিয়ে গেছে, অনেক চেনা মুখ চিরতরে হারিয়ে গেছে। আর সব কিছুর সাথে হারিয়ে গেছে বকফুল গাছটা। রামধন পসারির টিনের লম্বা ঘরটা কালের সাক্ষী হয়ে পুরনো রোগাভোগা চেহারা নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে ঠিকই, তবে শৈশবে দেখা সকাল দুপুর বিকেলের যাপিত জীবন নেই। আর নেই বকফুল গাছটা, নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
loading...
loading...
অপলক মুগ্ধ হয়ে পড়লাম দিদি ভাই।
loading...
ধন্যবাদ রিয়া বোন।
loading...
আপনার প্রতিটি স্মৃতিকথন আমাদের নস্টালজিক করে তোলে। অভিনন্দন বন্ধু।
loading...
ধন্যবাদ আজাদ ভাই।
loading...
সরস লেখাটি পড়ে ভালো লাগলো।
loading...
ধন্যবাদ সৌমিত্র দা।
loading...
অসাধারণ হয়েছে।
loading...
খুশি হলাম শাকিলা দি।
loading...
ছবিটা দেখামাত্র হুড়মুড় করে ছুটে আসতে শুরু করলো শৈশবের সকাল, দুপুর আর বিকেল।
* উপস্থাপনা কৌশলে অনেক বেশি শৈল্পিক মনে হচ্ছে…
শুভরাত্রি।
loading...
ধন্যবাদ দিলওয়ার ভাই। শুভরাত্রি।
loading...
বকফুলের বড়া কখনো খাওয়া হয়নি।
আমার এলাকায় এই গাছ দেখিনি কখনো। কার্জন হলের বাগানে একটা গাছ দেখেছি।
loading...
loading...
মুক্তি-যুদ্ধ কালীন আপনার নারায়ণ গঞ্জের স্মৃতিকথা সহ অনেক লেখা পড়েছি, সব গুলোই আমাকে নস্টালজিক করে তোলে।
শুভকামনা রইলো
loading...
আপনার জন্যও শুভকামনা থাকলো।
loading...