শুভরাত্রি!
গত কয়েকদিনে ‘ক্রসফায়ার’ শব্দটি বহুবার লেখা হয়েছে। শিক্ষিত সচেতনদের অধিকাংশই ক্রসফায়ারের বিপক্ষে, আমিও তাই। গত পনেরো দিনে ক্রসফায়ারে অনেক মানুষ মারা পড়েছে। যারা মারা পড়েছে তাদের সকলেই হয়তো অপরাধী, হয়তো অপরাধী নয়। অপরাধী কে তা নির্ধারিত হয় বিচারালয়ে, যেহেতু ক্রসফায়ারিং-এ হাতের কাছে পেলেই মেরে ফেলা হয়, তাই যে মারা পড়ে তার অপরাধের মাত্রা কতটুকু তা জনসাধারণের জানার উপায় থাকেনা। কাউকে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলার পর জনসাধারণ পত্র পত্রিকা, ফেসবুক, নানাজনের নানা মন্তব্য থেকে জানতে পারে, যাকে মারা হয়েছে সে ছিল দস্যু বনহুর, সে ছিল জলাতঙ্ক রোগের মত ভয়ঙ্কর। সে সব সময় প্রশাসনের চোখের আড়ালে থাকতো বলে তাকে গ্রেফতার করা যায়নি। তাকে ক্রসফায়ারে দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিলনা।
ক্রসফায়ারের সর্বশেষ ইস্যু কমিশনার একরামুল। কমিশনার একরামুল হত্যা নিয়ে ফেসবুক, মিডিয়া সরগরম। সকলেই জানে, একরামুল হত্যাকাণ্ডের শুরু থেকে শেষ, অত্যন্ত হৃদয় বিদারক। সকল মৃত্যুই কারো না কারো কাছে হৃদয় বিদারক ঘটনা, তবে কমিশনার একরামুলের ক্রসফায়ারে মৃত্যু বলে দিচ্ছে, ক্রসফায়ারে শুধু অপরাধীরাই মারা পড়েনা, ক্রসচয়েসের শিকার হয়ে নিরপরাধও মারা পড়ে।
সকলেই বুঝতে পারছে, কমিশনার একরামুল ছিলেন ভুল চয়েসের শিকার। মন্ত্রীও বলেছেন, এমন দুই একটা ভুল হতেই পারে। হ্যাঁ, ভুল হয়, মানুষ মাত্রেই ভুল হয়। তাই বলে মানুষের প্রাণ নিয়ে ভুল খেলা? ভুলের শিকার হয়ে মারা গেলো একরামুল,’ ভুল হয়ে গেছে’ কথায় হতভাগ্য একরামুলের পরিবার পরিজন, সন্তানেরা জীবিত একরামুলকে ফিরে পাবে? নাকি মন্ত্রী মহোদয়ের কথায় সান্তনা পাবে!
সব ঘটনাই প্রথম কিছুদিন গরম থাকে, ধীরে ধীরে তার উত্তাপ কমে আসে, একসময় শীতল হয়ে যায়। ধারণা করি,আর দুই দিন পর একরামুল হত্যা ঘটনাও শীতল হয়ে যাবে। শীতল হওয়ার আগেই একটা প্রশ্ন মাথায় জেগেছে। শিক্ষিত সচেতন জনগণের অধিকাংশই ক্রসফায়ার পছন্দ না করলেও কিছু সংখ্যক শিক্ষিত লোক কেন ক্রসফায়ার সমর্থন করছে? তারা ক্রসফায়ার সমর্থন করছে এই অজুহাতে, ” মাদক ব্যবসায়ীরা, ইয়াবা ব্যবসায়ীরা নাকি বাংলার প্রতি ঘরে ঘরে তরুণ সমাজ যুব সমাজকে মদ, ইয়াবায় আসক্ত করে ফেলেছে। তাই ইয়াবা ব্যবসায়ীদের ক্রসফায়ারে মেরে ফেলাটাই সঠিক কাজ।”
আমি বুঝতে পারিনা, বিচার না করেই, শুধু অনুমানের ভিত্তিতে কাউকে মেরে ফেলা যায়? নাকি মেরে ফেলা উচিত? যেখানে দেশে স্বাধীন বিচার বিভাগ আছে, সন্দেহজনক আসামীকে ধরার জন্য প্রশিক্ষিত পুলিশ বাহিনী আছে, সেখানে ঘরে ঘরে তরুণ তরুণীদের মাদকাসক্ত করার অভিযোগ দেখিয়ে ক্রসফায়ারে কাউকে হত্যা করা যায়? নাকি এই ধরণের হত্যাকে উৎসাহ দেয়া যায়? শিক্ষিত জনেরা কি করে ভুলে যায়, একটি অন্যায় প্রতিহত করতে আরেকটি অন্যায় করা উচিত নয়। একটি ভুল থেকে আরেকটি ভুলের জন্ম হয়।
কেন হবে আমার সন্তান মাদকাসক্ত? কেন ঘরে ঘরে তরুণ তরুণীরা ইয়াবা আসক্ত হবে? এই সকল তরুণ তরুণীদের বাবা মা নেই? বাবা মা তরুণ তরুণীকে ছোটবেলা থেকে সুশিক্ষা দেয়নি? ঘরে ঘরে তরুণ তরুণী, যুব সমাজ কি পারিবারিক শিক্ষা ছাড়াই ছোট থেকে বড় হয়েছে?
সন্তানের মা আমিও। দেশে সংখ্যালঘু ছিলাম, প্রবাসেও সংখ্যালঘু। কাজেই মানসিকভাবে কিছুটা দূর্বল তো ছিলামই, সমস্যা কখনও পিছু ছাড়েনি। সাথে অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা ছিল। এর মধ্যেই সন্তানদের বড় করেছি। প্রাথমিক শিক্ষা দেয়ার সময়ই সমাজ সম্পর্কে, সমাজের নানাবিধ মানুষ সম্পর্কে সচেতনতামূলক শিক্ষা দিয়েছি। মদ গাঁজা ইয়াবা বিড়ি সিগারেটের খারাপ দিক সম্পর্কে জানিয়েছি। নিজের ভাল মন্দ বুঝে চলার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে টিপস দিয়েছি।
এত কিছু শেখানোর পরেও যদি আমার সন্তান বাইরের লোকের হাতছানিতে ভুলে মদ ইয়াবায় আসক্ত হতো, তাহলে বুঝতাম, আমার শিক্ষা দানে ভুল ছিল, ইয়াবা ওয়ালার ভুল ছিল না।
ইয়াবাওয়ালার কাজই ভাল মানুষকে ইয়াবার প্রলোভন দেখানো। আর আমার দায়িত্ব সন্তানকে বলে দেয়া, ইয়াবাওয়ালা মন্দ লোক, তাদের কাছ থেকে যেন দূরে থাকে। এরপরেও যদি আমার সন্তান ইয়াবাওয়ালার প্রলোভনে পারিবারিক শিক্ষা ভুলে ইয়াবাওয়ালার কাছেই ছুটে যায়, প্রাথমিক পরাজয়টা হবে আমার। আমি আমার সন্তানকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারিনি, অথবা শিক্ষাদানে অবহেলা করেছি। তারপরেও আমি চেষ্টা করবো আমার সন্তানকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে, চেষ্টা করবো ইয়াবাওয়ালার বিরুদ্ধে প্রশাসনকে সজাগ করতে। কখনওই চাইবো না ইয়াবাওয়ালাকে বিনা বিচারে হত্যা করা হোক।
ইয়াবার ব্যবসা বন্ধ করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, ইয়াবাওয়ালাকে আইনের আওতায় ধরে আনার দায়িত্ব প্রশাসনের। ইয়াবাওয়ালার অপরাধের বিচার করার দায়িত্ব বিচারালয়ের।
চারদিকে এত দায়িত্ববান মানুষ থাকার পরেও বলবো, সন্তান আমার! সন্তানের মঙ্গল অমঙ্গল, ভাল মন্দ দেখা, সুশিক্ষা দেয়া আমারই দায়িত্ব।
আমার যতটুকু বলার বলে দিয়েছি। আমার বন্ধুদের মধ্যে যারা আওয়ামীলীগের প্রকৃত কর্মী, শুভানুধ্যায়ী, সমর্থক তাদের কাছে আমার বার্তা পৌঁছে গেছে। তারা বুঝেন, রাজনীতি না করেও আমার মত কিছু মানুষ আছে যারা আওয়ামীলীগের মঙ্গল চায়, আওয়ামীলীগের কাছ থেকে সুশাসন চায়, নাগরিক নিরাপত্তার বাস্তবায়ন চায়।
আওয়ামীলীগের কাছে আমাদের ব্যক্তিগত কোন চাওয়া নেই, কিছু পাওয়ার নেই। তবুও আওয়ামীলীগের নামে মন্দ কিছু শুনলে, আওয়ামীলীগের কেউ ভুল কিছু করলে, ভুল বা মন্দ কিছু ঘটে গেলে চারদিকে যখন নিন্দার ঝড় উঠে, আমাদের খুব খারাপ লাগে। বুকে বড্ড অশান্তি হয়, রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়া থেকে বিরত থাকবো বললেও একেবারে চুপ থাকতে পারিনা। সমালোচনা করে ফেলি আওয়ামীলীগের।
হ্যাঁ, আওয়ামীলীগেরই সমালোচনা করি, কারণ আওয়ামীলীগই জনগণ বান্ধব দল, আওয়ামীলীগই ভুল করে, ভুল ধরিয়ে দিলে ভুল শোধরানোর চেষ্টা করে। আওয়ামীলীগই জনগণের শেষ আশ্রয়, জনগণও আওয়ামীলীগের শেষ আশ্রয়। আর আমি তো আওয়ামী বান্ধব সেই জনগণেরই একজন।
[ এই লেখায় ‘ইয়াবাওয়ালা’ যে কোন মন্দলোকের সিম্বলিক প্রয়োগ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে]
শুভরাত্রি! আগামী সকাল সকলের ভাগ্যে প্রসন্নতা নিয়ে আসুক।
____________
৩রা জুন। ২০১৮
loading...
loading...
আওয়ামীলীগের লোক বা আওয়ামী হলেই আওয়ামীলীগের সমালোচনা করা যাবে না, এটা ঠিক নয়। আপনি বরং আপনার লিখায় যথেষ্ট প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আপনার মতো সরব সরল মানুষের আশা আকাঙ্খার কথা মাথায় রাখলেই হয়।
loading...
ঠিক বলেছেন। ধন্যবাদ আজাদ ভাই।
loading...
শুভরাত্রি! আগামী সকাল সকলের ভাগ্যে প্রসন্নতা নিয়ে আসুক।
loading...
ধন্যবাদ দিলওয়ার ভাই।
loading...
ভাল থাকুন দিদি ভাই।
loading...
ধন্যবাদ রিয়া বোন।
loading...