দুধমাখা ভাত কাকে খায়!

দুধমাখা ভাত কাকে খায়!

আজ দুধকলা ভাত খাচ্ছি। কত বছর পর দুধকলা ভাত খাচ্ছি তা স্মরণে আসছেনা। যে ছবি মনের পর্দায় ভাসছে তা আমার কৈশোরের। ঐ সময়টাতেই আমরা সবচেয়ে কঠিন সময় পার করেছি।

সদ্য স্বাধীনতার পরবর্তী বছরগুলোর কথা বলছি। আমরা সকালে খেতাম রেশনের চালের আঠালো ভাত আর পাতলা মুসুরের ডাল, দুপুরে খেতাম মোটামুটি ভাল মানের চালের ভাত, সকালের রান্না করা ডাল, সাথে কিছু একটা ভাজাভুজি বা তরকারী আর খুব সাধারণ মাছ, রাতে খেতে হতো আটার রুটি, এক পদের তরকারী, আধসের দুধ রাখা হতো, সেই আধসের দুধ থেকেই আমাদের মা বাদে বাবা আর চার ভাইবোন খেতাম। পেতলের একটা গোল মাথা হাতা ছিল, সেই হাতা দিয়ে এক হাতা দুধ, চিনি রুটি।এই রুটিনে চলতে হয়েছে আশির দশকের শুরু পর্যন্ত।

ভাইদের নিয়ে সমস্যা হতোনা, আমার তিন ভাই কোনদিন খাওয়ার আইটেম নিয়ে কোন বায়নাক্কা করেনি, মেজদা একটু পেটুক ছিল, সে মাছের টুকরাটা বড় চাইতো, এ ছাড়া আর কোন বায়নাক্কা করতোনা।

খাওয়ার আইটেম নিয়ে বায়নাক্কা করতাম আমি। সকালে ডাল আর আঠা ভাত খাবনা, দুপুরে কোনমতে খেয়ে নিলেও রাতে রুটি খেতে গেলেই আমার গাল ফুলে থাকতো। যেদিন মা তরকারী রানতো না, সেদিন হয়তো ঘি মাখিয়ে চিনি ছড়িয়ে রুটি খেতে দিত, সেদিন ছিল আমার জন্য সবচেয়ে কঠিন দিন। অন্য প্রতিবেশীদের বাসায় রোজ কলা আসতো, আমাদের বাসায় ফল আসতো শুধুমাত্র গ্রীষ্মকালে, আম আর কাঁঠাল। আমি মনে মনে জেদ করতাম, বাইরে শুধু বলতাম, “আমি ঘি দিয়ে রুটি খামুনা”।

মা জানতো ঝাল তরকারী হলে আর কোন বায়নাক্কা করিনা। কিন্তু সবদিন দুপুরে ভাল তরকারীও রান্না হতোনা, আলু উচ্ছে ভাজা দিয়েতো রুটি খাওয়া যায়না। কে জানে, হয়তো যায়, আমার ভাইগুলো ঠিকই শুধু উচ্ছে ভাজা দিয়েও রুটি খেতে পারতো হয়তো। দুপুরের তরকারী থেকে কিছু বাঁচলে আমাকে দিত। তখন ফ্রিজ ছিলনা, তাই তরকারী বিকেলে জ্বাল দিতে হতো, জ্বাল দেয়া তরকারী আমার ভালো লাগতোনা। খাওয়া নিয়ে অনেক দিগদারী করেছি।

শুধুমাত্র শীতকালে আমার মন ভালো থাকতো। শীতকালে ফুলকপি, বাঁধাকপি পাওয়া যেত, মায়ের হাতের রান্না তরকারীর সে কী স্বাদ! আর ভালো লাগতো যেদিন ইলিশ মাছ রান্না হতো। ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে মা যে তরকারীই রানতো, আহাহা! আমার মনে হতো রাজভোগ খাচ্ছি। কিন্তু সেতো সবসময় নয়।

যেদিন মনমত খাবার না থাকতো, আমার কেবলই মনে হতো, “আমরা কেন গরীব হলাম?”

এর উপর চলতো মায়ের আদর্শ বাণী। “আমার পোলাগুলি অনেক লক্ষ্মী, এই মাইয়া হইতাছে একটা জিদাইল্লা চরিত্র। বাপের সামর্থ্য বুঝতে চায় না, কত যে প্যাকনা মাইয়ার। সকালে আঠা চাউলের ভাত খাইতোনা, রাতে রুটি খাইতোনা। টের তো পাওনা, এই যে পাইতাছস, সেইটা নিয়েই শোকর কর, কত বাড়িতে মানুষ তিনবেলা রেশনের চাউলের ভাত খায়। তোগোরে তো তাও দুপুরে ভাল চাউলের ভাত খাওয়ানো হয়”।

মা’র কথাগুলো শুনলে মনে মনে একটু খারাপ লাগতো। জেদ বাদ দিয়ে খেতে বসতাম। আমি ছোটবেলা থেকেই অমন, শুরুতে অবুঝের মত রেগে যাই, পরে বোধ ফিরে এলে একেবারে মাটি হয়ে যাই।

আমার এই জেদী স্বভাবের কারণে প্রায় সকালে মা আমার জন্য আলাদা কিছু রেঁধে দিত, কেচকি মাছের ভাগা থেকে চিমটি দিয়ে গুঁড়া বাইল্লা, গুঁড়া চিংড়ি সরিয়ে রাখতো, সেগুলো ঝিঙ্গা আর বেগুন দিয়ে ঝাল করে পাতুরি রানতো। আমার জেদ কমে যেত, রাগ জল হয়ে যেত। মাকে তখন অসম্ভব দয়াময়ী মনে হতো।

তবুও একটা অতৃপ্তি থেকেই যেত। আমার দুধকলা ভাত খেতে ইচ্ছে করতো, কিন্তু দুধ কোথায় পাব, আধসের দুধ থেকে দুই বেলা বাবা মায়ের জন্য চা হয়, বাকিটা রাতে খাওয়া হয়। মা দুধ খেতোনা, বাবা আর আমাদের চার ভাইবোনের পাতে ঐ আধসের দুধ থেকেই পেতলের হাতা দিয়ে এক হাতা করে দিত, তাতেই দুধের ভান্ড উজাড় হয়ে যেত।

দুধের আশা ছেড়ে কলার আশাতেই মার কাছ থেকে ঘ্যান ঘ্যান করে চার আনা পয়সা নিতাম, এক দৌড়ে চলে যেতাম আর কে পালের মোড়ে। সেখানে কলার কাঁদি নিয়ে বসতো এক বুড়া, কত রকমের কলা। আমি চার আনা দিয়ে দুইটা চাম্পা কলা কিনতাম। বাসায় এসে সেই চাম্পা কলা আর মুড়ি, চিনি আর জল দিয়ে মেখে খেতাম। মনে হতো দুধ কলা মুড়ি খাচ্ছি, সেটাই অমৃত মনে হতো।

অনেক পরে বুঝতে পেরেছি, ছোটবেলায় কেন আমাদের এত কষ্টের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। ৭৪ পর্যন্ত নাহয় মেনে নেয়া যেতো, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অবস্থা এমনই হয়, কিন্তু ৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে আমাদের ছোটবেলাটা চিরকালের জন্য সাদা কালো করে দেয়া হয়েছিল।

শিশু বয়সে দুধকলা ভাত খেয়েছি কিনা তা মনে পড়েনা, তবে কৈশোরের জেদ দেখানো বয়সে আশ মিটিয়ে দুধ কলা ভাত আমি খাইনি। তবে দুধ কলা ভাত খাইয়েছি আমার তিন কন্যাকে ছোটবেলায়। রাতের খাবার ওদের জন্য বরাদ্দ ছিল দুধ কলা ভাত। আমি সুর করে ছড়া কাটতাম, ” মামণি মামণি করে মায়, মামণি গেলো কাদের নায়, আয়রে মামণি ঘরে আয়, দুধ মাখা ভাত কাকে খায়”।

আমার বড় কন্যা খুবই বাধ্যের ছিল, আমি যাই খেতে দিতাম নীরবে খেয়ে নিত, কিন্তু মেজো কন্যার চরিত্র আমার মত হওয়ায় সে ছোট বয়সেই জেদ দেখাতো, “আমি দুধকলা ভাত খাব না, আমি মাছ দিয়ে খাব”। রাতের বেলা কে মাছের কাঁটা বেছে খাওয়াতে যাবে, উলটা ঝাঁঝিয়ে বলতাম, “তুই দুধকলা ভাত খাবিনা, তোর ঘাড়ে খাবে”।

মা হাসতো আর বলতো, “তুই জ্বালাইছিলি আমারে, এখন তোর মেয়ে তার শোধ দেয়”।

অনেকটা পথ চলে এসেছি, দুধ সাগরে ডুব দেয়ার মত অবস্থা হয়েছে, কিন্তু দুধ সাগরে ডুব দেয়ার কথা ভুলে যাই। যেই বয়সে দুধ মাখা ভাত খাওয়ার কথা ছিল, সেই বয়সটা আমরা সদ্য স্বাধীন দেশের স্বার্থে জল কলা মুড়ি খেয়ে পার করেছি, তবুও দেশটা আজও দাঁড়াতে পারলোনা! দুধ কলা ভাত কি আর এই বুড়ো বয়সে খাওয়া যায়!

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১০ টি মন্তব্য (লেখকের ৫টি) | ৫ জন মন্তব্যকারী

  1. ইলহাম : ২১-০৭-২০১৮ | ২০:২৬ |

    লেখটি পড়ে একদিকে যেমন নষ্টালজিক পেয়ে বসেছে অন্যদিকে তেমন দুঃখজনক নীচের কোটেড অংশটুকু।

    "অনেকটা পথ চলে এসেছি, দুধ সাগরে ডুব দেয়ার মত অবস্থা হয়েছে, কিন্তু দুধ সাগরে ডুব দেয়ার কথা ভুলে যাই। যেই বয়সে দুধ মাখা ভাত খাওয়ার কথা ছিল, সেই বয়সটা আমরা সদ্য স্বাধীন দেশের স্বার্থে জল কলা মুড়ি খেয়ে পার করেছি, তবুও দেশটা আজও দাঁড়াতে পারলোনা! দুধ কলা ভাত কি আর এই বুড়ো বয়সে খাওয়া যায়!"

    GD Star Rating
    loading...
  2. মুহাম্মদ দিলওয়ার হুসাইন : ২১-০৭-২০১৮ | ২১:২৭ |

    * লিখার শিরোনামই নস্টাজিক করে দেয়…

    ভলো থাকুন নিরন্তর। 

    GD Star Rating
    loading...
  3. মুরুব্বী : ২১-০৭-২০১৮ | ২২:০১ |

    আপনার উপস্থাপনা এতো সহজ এবং সাবলীল যে, মনে হয় আমারই ছায়া আমাতে কথা বলে। এক জীবনের কথা বলে। অভিনন্দন প্রিয় বন্ধু। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_smile.gif

    GD Star Rating
    loading...
  4. চারু মান্নান : ২২-০৭-২০১৮ | ১১:৪৪ |

    সেখানে কলার কাঁদি নিয়ে বসতো এক বুড়া, কত রকমের কলা। আমি চার আনা দিয়ে দুইটা চাম্পা কলা কিনতাম। বাসায় এসে সেই চাম্পা কলা আর মুড়ি, চিনি আর জল দিয়ে মেখে খেতাম। মনে হতো দুধ কলা মুড়ি খাচ্ছি, সেটাই অমৃত মনে হতো।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif ইতিহাস হয়েই আমরা বাঁচি,,,,,,,আর জীবন ফিরে পাই প্রজ্নম ধারায়

    GD Star Rating
    loading...
  5. রিয়া রিয়া : ২২-০৭-২০১৮ | ২১:৩৫ |

    হৃদয় ছোয়া লিখা। আবেগাপ্লুত হলাম দি ভাই।

    GD Star Rating
    loading...