মুহূর্তে দেখা মানুষ! [ জীবনের সুখ সুখ গল্প ]
আগামীকাল আমাদের ওয়ালমার্টে অ্যানুয়াল অডিট হবে। গত পনেরো দিন ধরে ওয়ালমার্টে সকল এসোসিয়েট, ডিপার্টমেন্ট ম্যানেজার, এসোসিয়েট ম্যানেজারগণ ইনভেন্টরি টিমের জন্য কাজ গুছিয়ে রাখার কাজে ব্যস্ত। আমিও ব্যস্ত ছিলাম, আগামীকাল অডিট হয়ে যাওয়ার পরেই আমাদের কাজের চাপ কিছু কমে যাবে।
আমি স্বভাবে চঞ্চল হলেও কাজের বেলায় খুবই সিরিয়াস। আমি কাজ করতে ভালোবাসি এবং কাজ করিও আন্তরিকতার সাথে। মানুষের সাথে গল্প করার সময়েও আন্তরিকতা নিয়েই করি। ওয়ালমার্টে প্রতিদিন কত মানুষ আসে, তাদের সবার দিকে তাকাই, অনেকের মুখের দিকে তাকিয়ে তাদের ভেতর পড়ার চেষ্টা করি। কাউকে আলাপী মনে হলে তার সাথে গল্প জুড়ে দেই। গত বারো বছরে এমনি কত শত মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে তাদের মনের কথা পড়েছি, কত জনের সাথে আলাপ জুড়ে দিয়ে তাদের জীবনের গল্প শুনেছি। সেসব টুকরো জীবনের টুকরো গল্প জড়ো করে ‘মুহূর্তে দেখা মানুষ’ নামে একখানা বইও লিখে ফেলেছি।
ইদানিং আমার কাজের ক্ষেত্র প্রায়ই বদল হচ্ছে। দশ বছর ছিলাম ফোন সার্ভিস ডিপার্টমেন্টে। ফোন বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছি। এখন আমাকে দেয়া হচ্ছে ফটো ল্যাবের কাজ, নাহলে ফ্যাব্রিক্স ডিপার্টমেন্টে কাজ। আমাকে যেখানেই কাজ দেয়, কাজ করি। সবই নতুন কাজ, ভাল লাগলে আগ্রহ নিয়ে শিখি। আমি খুব দ্রুত শিখতে পারি, এবং একবার শিখে ফেললে সেই কাজ নিখুঁতভাবে করার চেষ্টা করি। ফটো ল্যাবের কাজ আমার ভাল লাগতে শুরু করেছে। ফ্যাব্রিক্স ডিপার্টমেন্টের কাজ আগেও ভাল লাগতো, চারদিকে এত সুন্দর সুন্দর ফ্যাব্রিক্স! রঙের সমাহার দেখলে মনটাও রঙিন হয়ে ওঠে।
অডিট উপলক্ষে গত ক’দিন ফ্যাব্রিক্স ডিপার্টমেন্টের কাজে ব্যস্ত ছিলাম। এই ডিপার্টমেন্টের ম্যানেজার নাকি খুব খ্যাটখেটে ধরণের, আমাকে এই সতর্কবাণী অনেকেই দিয়েছিল। হ্যাঁ, ম্যানেজার মহিলা একটু পিটপিটে স্বভাবের ঠিকই, তবে আমার সমস্যা হচ্ছেনা। ভদ্রমহিলার বয়স বাষট্টি, খিটখিটে তো হতেই পারে। আমার সাথে সে খিট খিট করেনা কারণ আমি তার মনমত কাজ করি। সে দশবার আমায় থাংক ইউ থ্যাংক ইউ বলে।
আজ আমার কাজের শিডিউল ছিল দুপুর একটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত। গত ক’দিনে ওয়ালমার্টে আগত মানুষদের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকানোর ফুরসত পাইনি। আজও সেই সুযোগ ছিলনা আগ বেলায়। কিন্তু রাত সাড়ে ন’টার দিকে আমি যখন লাস্ট টি ব্রেক নিয়ে ফিরছিলাম, মনের মধ্যে ছিল রাজ্যের ক্লান্তি। কতক্ষণে দশটা বাজবে, বাড়ি ফিরবো। আজ আমার শিফট ছিল ফটো ল্যাবে। ফটো ল্যাব বন্ধ হয়ে যায় রাত আটটায়। এরপর হাতে তেমন কাজ থাকেনা তবুও রাত দশটা পর্যন্ত থাকতে হয়, কাজ ছাড়া এক মিনিটও আমার বাড়ির বাইরে থাকতে ভাল লাগেনা।
আমি যাচ্ছিলাম ফ্যাব্রিক্স ডিপার্টমেন্টের দিকে, আমার সামনেই এক মোবাইল শপিং কার্টের সামনে নড়বড়ে চেহারার ছোটখাটো এক বুড়িকে দেখলাম, ভাল করে হাঁটতে পারছেনা। মোবাইল শপিং কার্টে চড়ে ঘুরছিল, কোথাও হয়তো থেমেছিল। এখন আবার কার্টে উঠার জন্য কসরত করছে।
বুড়ি দেখতে দারুণ সুন্দরী, পোশাকেও আভিজাত্যের ছাপ। বুড়ির আশেপাশে কেউ নেই। আমি এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“তোমাকে কি হেল্প করতে পারি?”
এই একটা মাত্র প্রশ্ন করতেই যেন সোডার বোতল খুলে গেলো। বুড়ি কোনরকম সাহায্য ছাড়াই ক্যাতরে ক্যাতরে কার্টে উঠে বসলো। এবার বুড়ি হাঁফাতে হাঁফাতে বলতে শুরু করল,
“আমি ডাক্তারের কাছে গেছিলাম। পা দুটোতে প্রচন্ড ব্যথা, ডাক্তার যে সিবিডি ওষুধ দিয়েছিল ( মেডিসিনাল মারিজুয়ানা), সেটা অনেকদিন খেলে নাকি খারাপ প্রতিক্রিয়া হয়। তাই ওটা বাদ দিয়েছি। আমি এমনিতেও মেডিসিন কম খাই, কিন্তু আমার হাঁটুর রিপ্লেসমেন্ট হওয়ার পর যে ব্যথা, তা সহ্য করা কঠিন। তাই ডাক্তারের কাছে গেছিলাম নতুন কোন ওষুধের জন্য।
-তোমার knee replacement হয়েছে?
-হ্যাঁ। তার জন্যইতো এত ব্যথা। এজন্য ডাক্তারের কাছে গেলাম, বললাম মেডিসিন বদলে দিতে। তা বদলে দিল, আমি এলাম ওয়ালমার্টে। এসে দেখি ফার্মেসি বন্ধ।
-ফার্মেসিতো রাত আটটায় বন্ধ হয়ে যায়, এখন বাজে সাড়ে নয়টা।
-শোনইনা, ফার্মেসি বন্ধ হয়ে গেছে তা যাক। বাড়িতে আমার ওষুধ আছে। সিবিডিও আছে। আসলে আমার পরিচিতরা বলেছে সিবিডির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া খুব খারাপ। তবে আমার মনে হয়না আমার বেলায় তেমন খারাপ হবে।
আমি তো জীবনেও ড্রাগ নেইনি, মারিউয়ানা সেবন করিনি। আর সিবিডি তো মেডিসিনাল মারিউয়ানা, ডাক্তারের প্রেসক্রাইব করা, ক্ষতি হওয়ার কথা নয়। তবু বন্ধুদের কথাও ফেলে দিতে পারিনা।
আমি যেদিন প্রথম ওষুধ (মেডিসিনাল মারিউয়ানা) খেলাম, মনে হচ্ছিলো, আমি পাখির মত উড়ছি। শরীরটা হালকা হয়ে গেলো। আমার স্বামীকে বললাম, জানো মনে হচ্ছে আমি শূন্যে ভাসছি। আমার স্বামী তো ভয়ে আঁতকে উঠেছে।
পনেরো মিনিটের মধ্যেই বিছানায় চলে গেলাম, সে কী ঘুম! যে আমি রাতের পর রাত ঘুমাতে পারতাম না, সেই আমি বাচ্চাদের মত বেঘোরে ঘুমালাম। ঘুম থেকে উঠেই টের পেলাম, কোথাও ব্যথা নেই।
বেশ ক’দিন খেলাম, ঘুমালাম। পরেই মনে হলো, যদি আসক্ত হয়ে পড়ি! তাই খাওয়া বাদ দিলাম।
আরে কী বলি, শুধু কি অন্যের কথায় বাদ দিয়েছি! আমার নিজের নাতি ডাক্তার, মস্ত বড় ডাক্তার আমার নাতি। ওরাল সার্জন, খুব ভাল ডাক্তার।
অনেক বাচ্চা জন্মায় ঠোঁট কাটা নিয়ে, অথবা মুখের ভেতরে মাড়ি কাটা নিয়ে, আমার নাতি সেসব কেইস খুব ভালোভাবে সার্জারি করে ঠিক করে দেয়। আমার নাতি কেমন ডাক্তার, একটা ঘটনা বলি, তাহলেই বুঝবে।
একদিন আমি আমার বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে প্রতিবেশির সাথে গল্প করছি, রাস্তায় একটা গাড়ি থামলো। সেই গাড়ি থেকে একটি তরুণী নেমে এলো। আমায় জিজ্ঞেস করলো, “ কিছু মনে করবেন না, আপনি কি মিসেস মর্গ্যান?”
-হ্যাঁ, আমি ফে মর্গ্যান।
-আমি আপনার নাতির কাছে আপনার কথা শুনেছি। আপনার নাতি আমার ডাক্তার। আপনার নাতি আমার দেখা সবচে সুদর্শন, সবচে ভাল ডাক্তার।
আমার চোয়ালে ক্যান্সার হয়েছিল, আমার মা, আমার ভাই এই একই রোগে মারা গেছে। সকলেরই চোয়ালে ক্যান্সার। আমারও বাঁচার কথা ছিলনা। কিন্তু আমার চোয়ালের সার্জারী হয়েছে অত্যন্ত দক্ষ একজন সার্জনের হাতে, তাই আমি বেঁচে গেছি। সেই দক্ষ সার্জনটি হচ্ছে আপনার নাতি”।
বলে তরুণী কাঁদতে শুরু করলো।
তরুণীর মুখের অনেকটাই বাঁকা হয়ে গেছে, তবুও সে খুশি যে সে ্ভাল হয়ে গেছে। মেয়েটি এসে আমায় জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো। বার বার বলল, আমি যেন আমার নাতিকে তার হয়ে একরাশ কৃতজ্ঞতা জানাই।
তাকে বললাম, আমি আজই ফ্রেডকে ফোন করে বলবো তোমার কথা।
আচ্ছা, এবার তুমিই বলো, গায়ে কাঁটা দেয় কিনা এমন ঘটনায়। আমি তো আমার নাতিকে ভালো বলবোই, সকলেই সকলের নাতিকে ভাল বলবে। কিন্তু যখন অচেনা কেউ এসে আমার বাড়ি বয়ে আমার নাতির প্রশংসা করে যাবে, সেটা একদম অন্যরকম, তাইনা?
-বাহ! তোমার এই অভিজ্ঞতার কথা শুনে আমারও খুব ভাল লাগছে। একটা ব্যাপার খেয়াল করেছি, তুমি যেমনি তোমার নাতিকে ভালোবাসো, নাতির গল্প অন্যের কাছে বলতে ভালোবাসো, তোমার নাতিও তোমাকে তেমনি ভালোবাসে, তোমার গল্প তার রোগীদের কাছে শোনাতে ভালোবাসে। তোমার নাতি সেই মেয়ের কাছে তোমার গল্প করেছে বলেইতো মেয়েটি তোমার সাথে দেখা করতে এসেছে।
-ঠিক তাই।
-তোমার নাতির বয়স কত?
-এই তো ৩৪ পূর্ণ হলো। আমার বড় মেয়ের ঘরের নাতি। ছয় ফিট তিন ইঞ্চি হাইট, দেখতে যা সুন্দর।
-বললাম, তুমি নিজেইতো দারুণ সুন্দর, তোমার নাতি তো সুন্দর হবেই।
-আমার কথায় বুড়ি লাজুক হাসি দিলো, এত সুন্দর লাগলো বুড়িকে সেই হাসিতে। এখনও দেখলে বুঝা যায়, বুড়ি তরুণী বয়সে মারদাঙ্গা টাইপ সুন্দরী ছিল।
– জানো তো, আমার নাতি বিয়ে করেছে দুই বছর আগে, ওর বউও ডাক্তার। ওর বউ খুব সুন্দরি। হাফ আমেরিকান, হাফ ইতালিয়ান। ওর নাম ভিভিয়ান, আমার নাতির নাম ফ্রেডেরিক। দুজনের গভীর প্রেম।
ভিভিয়ান খুবই মেধাবী স্টুডেন্ট ছিল, ইউনিভারসিটি অব মিশিগানে নাম্বার ওয়ান স্কলারশিপ পেয়েছে। ওরা দুজন দুজনকে এত ভালোবাসে, দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকে। মজার কথা বলি, ভিভ আর ফ্রেড প্ল্যান করেছিল, এ বছর ওরা ওয়ার্ল্ড ট্যুর করবে। সব কিছু পাকাপাকি করে ফেলার পর কি হলো জানো, ভিভ জানতে পারলো যে ও মা হতে চলেছে। হা হা হা! মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। আরও মজার কথা, ভিভের বাচ্চা হওয়ার তারিখে ফ্রেডের জন্মদিন। কী মজা না!
-আমি কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বুড়ির গল্প শুনতে ভাল লাগছে, বুড়ি আমার কাছে তার সুখের গল্পগুলো করতে পেরে খুব খুশি। অথচ ওয়ার্কিং আওয়ারে এভাবে কারো সাথে গল্প জমিয়ে বসানোটাও ঠিক নয়। বুড়িকে থামাই কি বলে!
এবার বুড়ি বলল, এই যে আমি তোমার সাথে এত কথা বলছি, তোমাকে দেখেই আমার ভাল লেগেছে। মনে হচ্ছে, তোমার সাথে বসে সারাদিন গল্প করা যায়।
মনে মনে প্রমাদ গুনি, কী বলছে রে! আমার সাথে গল্প করতে ভালো লাগলে আমার চলবে কি করে!
বললাম, তোমার নাতিকে জিজ্ঞেস করে দেখেছো, হাঁটুর ব্যথার জন্য মেডিসিনাল মারিউয়ানা দীর্ঘদিন খাওয়া ঠিক না বেঠিক?
আমার নাতি তো অনেক বড় ডাক্তার হলে কি হবে, গডের উপর অগাধ বিশ্বাস। সে আমায় বলে, জানো তো গ্র্যান্ডমা, যখন ছোট্ট বাচ্চাদের ( ঠোঁট কাটা, মাড়ি কাটা) নিয়ে আসে, অপারেশান টেবিলে বাচ্চাটা শোয়ানো থাকে, সবার প্রথমে আমি বাচ্চার হাতটা ধরি। বাচ্চার হাত ধরে চোখ বন্ধ করে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, ঈশ্বর, আমি যেন পারি। আমি যেন এই ছোট্ট শিশুকে সুন্দর স্বাভাবিক জীবন উপহার দিতে পারি। অপারেশান শেষে দুই সপ্তাহ পর যখন বাবা মায়ের কোলে চড়ে বাচ্চাগুলো আসে পরবর্তি চেক আপে, বাচ্চাগুলো আর সব বাচ্চাদের মত হাসি দেয়, আমি তখন ডাক্তারি ভুলে গিয়ে মোমের মত গলে যেতে থাকি। কতদিন এমন হয়েছে যে সবার সামনে আমি কাঁদছি”।
-বুঝলাম, বুড়ি কথার খেই হারিয়ে ফেলছে। যা জানতে চেয়েছি তা বলতে ভুলে যাচ্ছে। তবে বুড়ির মুখে তার নাতির কথা শুনে খুবই ভাল লাগছে আমার। হয়, এমন অনেক তরুণ তরুণীদের আমি দেখেছি, মনে মননে তারা অতি চমৎকার। এই যে বুড়ির নাতি সার্জারি শুরুর আগে বাচ্চাদের হাত স্পর্শ করে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে, গল্পের এই অংশটুকু শুনে আমার নিজের চোখেই জল আসার উপক্রম!
জিজ্ঞেস করলাম, তোমার বয়স কত?
-আমার বয়স ৭৯, আমার স্বামীর বয়স ৮১। জানো তো, আমার মা বাবা দুজনেই জীবিত, দুজনেই নার্সিং হোমে থাকে।
-তাই নাকি? তোমার মা বাবা বেঁচে আছেন? এতো অসাধারণ কথা!
-হ্যাঁ, আমার বাবার বয়স ১০১, মায়ের বয়স গতকাল ৯৯ পূর্ণ হলো।
-উনারা কি একই নার্সিং হোমে থাকেন? দুজনেই হাঁটা চলা করতে পারেন?
-একই নার্সিং হোমে থাকেন। বাবা হাঁটতে পারেন, কিন্তু মা হুইল চেয়ারে চলেন। আরে, ওরা তো আগে রুম মেট ছিল। এখন আলাদা রুমে থাকে। কি হয়েছে জানো!
যখন ওরা রুমমেট ছিল, একদিন আমার আন্টি একটা পুতুল নিয়ে মা’কে দেখতে গেছিল। পুতুলটা দেখে মা খুব খুশি। যখন শুনলো, পুতুলটা মায়ের জন্যই নিয়ে গেছে আন্টি, মা পুতুলটাকে সত্যিকারের বাচ্চা ভেবে কোলে নিয়ে দোল দিল। বিছানায় নিজের পাশে শোয়ালো।
আমার বাবা তো মা’কে খুব ভালোবাসে। সব সময় খেয়াল রাখে। রাতে বাবা বলল, পুতুলটাকে সাইড টেবিলে রেখে দাও। নাহলে ঘুমের মধ্যে তুমি যখন এপাশ ফিরবে, পুতুলটা তোমার হাতের বা পিঠের নীচে চলে গেলে তুমি ব্যথা পাবে। তোমার হাড়গোড় এখন খুব নরম, বলা যায়না পুতুলের চাপে তোমার হাড় ভেঙ্গেও যেতে পারে।
বাবার কথা মা শুনলো না। জেদ করে পুতুল বুকে চেপে ধরে রাখলো। আর বাবা কি করলো, নিজের বিছানা থেকে নেমে এসে পুতুলটাকে হ্যাঁচকা টান দিল। মা ধরে রেখেছিল শক্ত করে, ফলে টাল সামলাতে না পেরে বাবা দুম করে মাটিতে পড়ে যায়। সেই থেকে নার্সেরা দুই জনকে আলাদা করে দেয়। দুজনেই তো অবুঝ। এখন মায়ের রুমমেট যে, সে মায়ের থেকে ১৫ বছরের ছোট, হলে কি হবে, সে কোন কথা বলেনা, ভ্যাবলার মত পড়ে থাকে।
মায়ের সময় কিভাবে কাটে বলো! নার্স বলল, মায়ের নিজস্ব একটা প্যাটার্ন আছে। মা নাকি সারা দিন সারা রাত কথা বলে, ঘুমায়না একবারের জন্যও। এভাবে তিন চার দিন কেটে যায়, এরপর মা ঘুম দেয়। সেই ঘুমও একটানা তিন দিন ঘুমায়। তিন দিনে এক মিনিটের জন্যও জাগেনা। কী অদ্ভুত না?
-হ্যাঁ, অদ্ভুত। এভাবেই মানুষ নিজের নিয়মে বেঁচে থাকে।
-আমরা গতকাল নার্সিং হোমে গেছি মায়ের ৯৯তম জন্মদিন পালন করতে। মা’কে ডাইনিং রুমে বসিয়ে আমরা কত কিছু খাওয়াচ্ছি। এক সময় মা হাত উঁচু করে বলল, আর খাবোনা। বলেই মা ঘাড় হেলিয়ে দিল। মা ঘুমিয়ে পড়লো, আমরা ডেকেও আর সাড়া পেলামনা।
আমার বাবা মায়ের ৮১ বছরের বিবাহিত জীবন। আর আমাদের বিবাহিত জীবন ৫৫ বছর। আমাদের দুই মেয়ে। বড় মেয়ের বয়স ৫৭, ছোট মেয়ের বয়স ৪৭। আমার ছোট মেয়ে বিয়ে করেছে ৩৫ বছর বয়সে। তার বর ছিল হলিউডের বিখ্যাত সিনেমা প্রযোজক। এখন অবশ্য প্রযোজনা করেনা। এখনও পুরনো দিনের আন্তর্জাতিক অনেক চলচ্চিত্রে প্রযোজক হিসেবে তার নাম দেখায়।
আমার মেয়ে সঙ্গিত শিল্পী, সে কান্ট্রি মিউজিক নিয়ে ব্যাচেলর ডিগ্রি করেছে। তার নিজস্ব স্টুডিয়ো আছে। সে গান বাজনা নিয়ে থাকে।
তার স্বামীর হঠাত করেই খেয়াল হয়, সিনেমায় প্রযোজকদের নাম কেউ জানেনা, কেউ চিনেওনা। যত নাম ডাক হয় সিনেমার নায়ক নায়িকাদের, নায়ক নায়িকাদের যারা স্টার বানায়, সেই প্রযোজকদের কথা কেউ জানতেও চায়না। তাই সে সিনেমা লাইন ছেড়ে চলে আসে।
আর বড় মেয়ের কথা কি বলবো। তুমি তো শুনলেই, আমাদের বিয়ের বয়স ৫৫, কিন্তু আমার মেয়ের বয়স ৫৭।
এরপরের বর্ণনা থেকে জানলাম, বুড়ির নাম ফে। ফে প্রথম জীবনে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল যে তরুণকে, বিয়ের কিছুদিন পর সেই তরুণ স্বামী বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়ে মদ খাওয়া শুরু করে। এবং ধীরে ধীরে অ্যালকোহলিক হয়ে যায়। অ্যালকোহলিক হওয়ার পর সে প্রায়ই স্ত্রীর সাথে দূর্ব্যবহার করতো। তরুণী স্ত্রী স্বামীকে অনেক বুঝিয়েছে, চেষ্টা করেছে অ্যালকোহল থেকে দূরে সরিয়ে আনতে, কিন্তু পারেনি। একদিন স্বামী মদ্যপ অবস্থায় স্ত্রীর গায়ে হাত তুলেছে। সেদিন তরুণী স্ত্রী এতটাই হতভম্ব এবং অপমানিত বোধ করেছে যে তার বাবাকে ফোন করে বলেছে যেন তাকে এসে নিয়ে যায়।
ফে তার বাবা মায়ের আদরের কন্যা, কন্যার এতটুকু অপমান তারা হতে দিবেন কেন। বাবা কথা বলল একজন ল’ইয়ার বন্ধুর সাথে। ল’ইয়ার কথা বলল ফে’র সাথে। ফে বলল, সে ডিভোর্স চায়। হয়ে গেলো ডিভোর্স, এক বছরের কন্যাশিশুকে কোলে নিয়ে ফে চলে এলো বাবার কাছে। তারও এক বছর পর ফে’র দ্বিতীয়বার বিয়ে হয় বর্তমান স্বামীর সাথে, এবং বর্তমান স্বামীই তার প্রথমা কন্যার বায়োলজিক্যাল ড্যাড না হলেও ‘রিয়েল ড্যাড’। ওদের বিয়ের সময় ফে’র মেয়ের বয়স ছিল দুই বছর, বিয়ের পর ফে’র কন্যাটি ফে’র নতুন স্বামীর মাঝেই তার সত্যিকারের পিতাকে খুঁজে পায়।
দ্বিতীয় বিয়ের আট বছর পর ওদের সংসারে আরেকটি কন্যাশিশুর জন্ম হয়। ফে’র স্বামী মেয়েদের পরিচয় দেয়ার সময় সবসময় বলেন, আমার বড় মেয়ে, আমার ছোট মেয়ে।
বুড়ি ব্যাগ থেকে তার ফোন বের করলো। ফোন থেকে সে কিছু খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। বুঝলাম, সে তার নাতির ছবি দেখাতে চায়। বুড়ো মানুষ, মেসেজ বক্স হাতড়াচ্ছে, নাতির অফিস রুমের ছবি আছে, আরও হড়ং বড়ং ছবি আছে নাতির ছবি পাচ্ছেনা। বিরক্ত হয়ে বলল, এই টাচ স্ক্রিন ফোন আমার অসহ্য লাগে। কিছুই খুঁজে পাওয়া যায়না। আমার মেয়ে বলে, এই ফোনের দোষ যদি হয় ১০%, তোমার দোষ ৯০%। তুমিই ফোন ব্যবহার করতে জানোনা। হা হা হা
-তুমি কি ফেসবুক করো?
-আরে সর্বনাশ! ফেসবুক করবো আমি? মরে গেলেওনা। আমার বন্ধুদের সবার ফেসবুক আছে, শুধু আমার নেই। জানো কি হয়েছে, আমার এক বন্ধু দুই সপ্তাহের জন্য ক্রুজে গেছিল, এই কথা ফেসবুকে সে জানিয়েছে। ওমা, ফিরে এসে দেখে , তার বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে। ফেসবুকে বলেছে বলেইতো এটা হয়েছে। আমার মেয়ে বলেছে, ফেসবুক করলে নাকি হ্যাকাররা আমার সমস্ত ইনফরমেশান বের করে ফেলবে। যদিও আমি কোন ইনফরমেশান দেবোনা, তবুও। মেয়ে বলল, কারা নাকি হ্যাক করে দুইশ মিলিয়ন আইডির ইনফরমেশান বের করে ফেলেছে?
-হা হা হা! হতে পারে।
-এইজন্য ফেসবুকে আমি নেই। আমার আত্মীয় বন্ধু সবাই আমার উপর বিরক্ত ফেসবুকে নেই বলে। একবার ভাবি, ফেসবুক খুলি, আবার ভাবি থাক।
-থাক, ফেসবুক একাউন্ট খুলো না। অনেক রাত হলো, তুমি বাড়ি যাবেনা?
-সেই ভাল, কি বলো।
ঠিক এমন সময় বুড়ির ফোন বেজে উঠলো, কিন্তু বুড়ি আমার সাথে ফেসবুকের অপকারিতা নিয়ে বলেই চলেছে।
-বললাম, ফোন বাজছে। দেখো তোমার স্বামী ফোন করেছেন হয়তো।
-হ্যাঁ হ্যাঁ, দেখছি। ঠিক বলেছো, আমার স্বামী। হাই ডার্লিং, এই তো আমি চলে আসছি। কথা বলছি সুইট একটা মেয়ের সাথে। [ ‘সুইট মেয়ে’ শোনার সাথে সাথে আমার বিষম খাওয়ার অবস্থা। সুইট মহিলা বললে বিষম খেতাম না] বলে ফোন রেখে দিল। ফোন রেখেই বলল, এবার যাব। আমি প্রায়ই ওয়ালমার্টে আসি, এখানে এলে কিছু মানুষের দেখা পাই যাদের সাথে কথা বলতে আমার ভএল লাগে। এই যেমন আজ তোমাকে পেলাম, তোমাকে দেখার সাথে সাথেই গল্প করতে ইচ্ছে করলো।
-মিস ফে, ভাগ্যিস তোমার সাথে দেখা হয়েছে। মানুষের জীবনের সুন্দর গল্প শুনতে আমার খুব ভাল লাগে। জীবনের গল্পগুলো তো এমনি এমনি সুন্দর হয় না, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, অনেক কষ্ট সহ্য করে তবেই জীবনের গল্প সুন্দর করে বলা যায়, লেখা যায়, তাইনা?
-বাহ, কী সুন্দর কথা বললে। হ্যাঁ, অনেক কষ্ট করতে হয়, তবেই জীবনের গল্প সুন্দর হয়। আমার এখন সুখের সময়। আমার বড় মেয়ের ঘরে তিন ছেলেমেয়ে, তিনজনই সেরা। আর বড় নাতির গল্প তো করলামই, সে একদিন মস্ত বড় সার্জন হবে।
-নিশ্চয়ই হবে। আজ তাহলে গল্প এখানেই শেষ করি? অনেক রাত হয়ে গেছে, রাত ১০টা বাজে, তোমাকে তো ফিরতে হবে।
-আবার দেখা হবে রিটা, ভালো থেকো।
loading...
loading...
দীর্ঘ বিরতির পর শব্দনীড়ে আপনার আগমন-এর কারণে চমৎকার একটি স্মৃতিকথা পড়েছিলাম বাবাকে নিয়ে। আজকেও দারুন একটি শিরোনাম নিয়ে স্মৃতি মন্থর করেছেন- চমৎকার আপনার শব্দশৈলী–
বুড়ি দেখতে দারুণ সুন্দরী, পোশাকেও আভিজাত্যের ছাপ। বুড়ির আশেপাশে কেউ নেই। আমি এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমাকে কি হেল্প করতে পারি?”
আপনার লেখায় পড়ে বেশ সাহিত্য রস খুজে পাই। আশা করি অবিরাম লিখে যাবেন আমাদের জন্য।
loading...
হাহাহা। আমার লেখা পড়ে অনেকে আবার বিরক্তও হয় সাইদুর ভাই। বেশী বকর বকর করি বলে। এনিওয়ে থ্যাঙ্কস।
loading...
বিরক্ত হৃদের পাঠকের চাইতে আপনার লেখায় নির্যাস খুজে নেয়ার পাঠক অনেক বেশি। সুতরাং আমাদের জন্য লিখুন, পাঠকের তরে লিখুন, সমাজ পরিবর্তনের জন্য লিখুন সবশেষে আমাদের হৃদয়ের খোরাকির জন্য হলেও লিখুন। সাথেই থাকবো। স্বল্প সংখ্যার বিরক্ত ভাবাপন্ন সিজোনাল্লি পাঠকের জন্য পরাজিত হবেন না। জোরালোভাবে এ আশা রাখি।
loading...
আসলে সময় পাই না ভাই। লিখবো তো অবশ্যই।
loading...
বাহ দারুন অনেক দিন পর আপুর গল্প,,,,,,,,বেশ লাগল

loading...
দুই দুইটা ইমোতে খুশি হয়েছি কবিভাই। শুভেচ্ছা রইলো।
loading...
কী এক অসাধারণে জাদুমাখা আপনার শব্দ প্রক্ষেপণ। যত পড়ি মুগ্ধ হই দিদি বন্ধু।
loading...
আপনার ভালো লাগলে আমিও খুশি হই আজাদ ভাই। কৃতজ্ঞ।
loading...
কোন ভাষা নেই দিদি ভাই। এই লেখাটির যেন তুলনা হয় না। অসাধারণ।
loading...
আরে নাহ্ কথা বলুন। কথা বললেই না বুঝবো লেখা ভালো লেগেছে। ধন্যবাদ রিয়া।
loading...