জন্মদিনে শ্রদ্ধা জানিয়ে —
আমার যে লেখাটি অনেকেই চুরি করে নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছে সেটিই আবার দিলাম।
রামকিঙ্কর বেইজের জন্ম ১৯০৬ সালের ২৫ মে। পিতা চণ্ডীচরণ, মার নাম সম্পূর্ণা। তাঁদের বাড়ি ছিল বাঁকুড়ায়। পারিবারিক পদবি ছিলো পরামাণিক। রামকিঙ্করই প্রথম বেইজ পদবি চালু করেন তাঁদের পরিবারে। ক্ষৌরকর্ম তাঁদের পারিবারিক পেশা। এই পরিবারে তিনিই সর্বপ্রথম শিল্পের পথে এলেন উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া পারিবারিক প্রথা ভেঙে।
রামকিঙ্কর বেইজের শিল্পের চৌহদ্দি ছিল অনেক প্রশস্ত। তেলরং, জলরঙ, ড্রইং, স্কেচ, ভাস্কর্য সহ বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করেছেন তিনি। তাঁর ছবি এবং ভাস্কর্য দুটোকেই তিনি নিয়ে গেছেন শিল্পসৌকর্যের চূড়ায়। প্রথমদিকে ছবি আঁকার প্রতিই রামকিঙ্করের মনযোগ ছিল বেশি। পরবর্তীতে পূর্ণোদ্যমে শুরু করেন ভাস্কর্য। কখনোই গতানুগতিক, বাঁধাধরা নিয়মে শিল্পসৃষ্টির পক্ষপাতি ছিলেন না তিনি। নিজের তৈরি পথেই চলেছেন সবসময়। প্রতিনিয়তই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। গড়েছেন ভেঙেছেন আবার গড়েছেন; এভাবেই এগিয়ে গেছে তাঁর শিল্প সাধনার পথ। দৃশ্যশিল্পের নতুন শৈলী, টেকনিক অথবা মাধ্যমের সন্ধানে সবসময় খোলা থাকত তাঁর দৃষ্টি।
রামকিঙ্করের গুরুত্বপূর্ণ ভাস্কর্যগুলোর বেশিরভাগ শান্তিনিকেতনে। ইউক্যালিপটাস গাছের সারির ভেতর ‘সুজাতা’ কিংবা কলাভবনের ‘সাঁওতাল পরিবার’, ‘বাতিদান” মিলেমিশে অন্যরকম এক দ্যোতনা সৃষ্টি করেছে। তবে শান্তিনিকেতনে করা ‘ধানঝাড়া’ ভাস্কর্যটির কথা উল্লেখ করা যায়। খোলামেলা শারীরিক প্রকাশের জন্য এই ভাস্কর্যটি অনেক গোঁড়া আশ্রমিকের সমালোচনার শিকার হয়েছিল। কিন্তু আশেপাশের সাঁওতাল গ্রামবাসীদের কাছে এটা ছিল খুব প্রিয়। কাজের প্রতি তাঁর একরোখা মনোভাব এবং রবীন্দ্রনাথ নন্দলালের প্রশ্রয়, বিনোদবিহারী সহ অন্যান্য সুহৃদ বন্ধুর সহযোগিতা আর সর্বোপরি তাঁর প্রতি ছাত্রদের শ্রদ্ধা ও সমর্থনের কারণে তাঁর কাজ ঠেকিয়ে রাখা যায় নি। শেষ পর্যন্ত সমালোচকরাই চুপ করে গিয়েছিলেন।
১৯২৫ সালে ছাত্র হিসাবে শান্তিনিকেতনে যোগ দেয়ার পর একই বছর লক্ষ্ণৌর নিখিল ভারত শিল্প প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করে রৌপ্যপদক লাভ করেন রামকিঙ্কর। ঐ প্রদর্শনীতে স্বর্ণপদক পান নন্দলাল বসু। ১৯২৭ সালে ভারতের বিভিন্ন প্রসিদ্ধ স্থানে ঘুরে বেড়ান তিনি। নালন্দা, জয়পুর, চিতোর, উদয়পুরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান ভ্রমণ করেন। ফলে প্রাচীন ভারতবর্ষের নানা স্থাপত্য এবং ভাস্কর্যের সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে।
রবীন্দ্রনাথের সাথে পরিচয়ের সূত্রে ভিয়েনার ভাস্কর লিজা ভনপট ১৯২৮ সালে ভারত আসেন। রামকিঙ্কর তাঁর কাছে ভাস্কর্যের বিভিন্ন বিষয়ে পাঠ নেন। এর কিছুদিন ভারতে আসেন বিশ্বখ্যাত ভাস্কর রঁদ্যার শিষ্য বুর্দেলের ছাত্রী মাদাম মিলওয়ার্দ। মিলওয়ার্দের সাহচর্য রামকিঙ্করকে নানাভাবে উপকৃত করে। তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক উভয় দিকে তাঁর কাছে শিক্ষালাভ করেন। এরপর বিখ্যাত ইংরেজ ভাস্কর বার্গম্যানের কাছে রিলিফের কাজ শেখেন রামকিঙ্কর।
রামকিঙ্কর এমন একজন শিল্পী যাকে কোন দলে ফেলে মাপা যায় না। তাঁর জীবন ইতিহাস অন্যান্য শিল্পীর চেয়ে একেবারেই অন্যরকম। বাঁকুড়ার এক অখ্যাত পল্লীর দারিদ্র্যক্লিষ্ট পরিবারের সন্তান রামকিঙ্কর, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দৌঁড়ও তেমন কিছু নয়। যার পারিবারিক পেশা ছিল ক্ষৌরকর্ম। আর শৈশব কাটতো পাশের কুমোর পাড়ায় ঘুরে ঘুরে। কী অদ্ভুত এক নিবিষ্টতায়, শিল্পের প্রতি ভালোবাসায় তিনি হয়ে উঠলেন ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বিশ্বের অগ্রগণ্য এক শিল্পী। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘যাঁরা প্রতিভাশালী তাঁদের কেউ লুকিয়ে রাখতে পারবে না’। আর শান্তিনিকেতনের সাথে তাঁর যোগাযোগটাও নিশ্চয় তাঁর জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। যদি ঘটনাক্রমে তাঁর সাথে শান্তিনিকেতনের যোগাযোগ না ঘটতো তবুও হয়ত শিল্পী হিসাবে আত্মপ্রকাশের পথ তিনি খুঁজে পেতেন, খুঁজে নিতেন। কিন্তু যে রামকিঙ্করকে আজ আমরা জানি, ঠিক সেই রামকিঙ্করকে পেতাম না আমরা। শান্তিনিকেতনে তাঁর শিল্পী সত্ত্বা মুক্তির যথার্থ পথ পেয়েছে। এক্ষেত্রে সবার মাথার ওপরে রবীন্দ্রনাথতো ছিলেনই, সহায়ক হিসাবে আরও ছিলেন গুরু নন্দলাল বসু ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রামকিঙ্করের অন্যান্য বিখ্যাত ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে আছে:
প্লাস্টারে করা মা ও ছেলে (১৯২৮), কচ ও দেবযানী (১৯২৯), মিথুন-১ (১৯৩১), মিথুন-২ (১৯৩১), মিথুন-৩ (১৯৩১), সাঁওতাল-সাঁওতাল রমণী (১৯৩৫), সাঁওতাল দম্পতি (১৯৩৫), আলাউদ্দিন খাঁ (১৯৩৫), কংক্রীটে করা সাঁওতাল পরিবার (১৯৩৮), প্লাস্টারে করা রবীন্দ্রনাথের বিমূর্ত ভাস্কর্য (১৯৩৮), সিমেন্টে করা রবীন্দ্রনাথের আরও একটি ভাস্কর্য (১৯৪১), হার্ভেস্টার (১৯৪২), ফেমিন (১৯৪৩), সাঁওতাল নাচ (১৯৪৩), অবনীন্দ্রনাথ (১৯৪৩), সিমেন্টে করা কুলি মাদার (১৯৪৩-৪৪), বিনোদিনী (১৯৪৫), বুদ্ধ (১৯৪৬-৫০ ?), সিমেন্টের দ্য মার্চ (১৯৪৮), ডাণ্ডী মার্চ (১৯৪৮), লেবার মেমরী (১৯৪৮), মা ও ছেলে (১৯৪৯), স্পীড এন্ড গ্রাভিটি (১৯৪৯), শুয়োর (১৯৫২), পিতা-পুত্র ( ১৯৫২), মিলকল (১৯৫৬), গান্ধী (১৯৫৭), শার্পেনার (১৯৫৮?), ম্যান এন্ড হর্স ( ১৯৬০), সুভাসচন্দ্র বসু (১৯৬০-৬১), হর্স হেড (১৯৬২), মহিষ-১ (১৯৬২) কাক ও কোয়েল (১৯৬২), আগুনের জন্ম (১৯৬৩), যক্ষী-১১(১৯৬৩?) মহিষ ও ফোয়ারা (১৯৬৩), মাছ (১৯৬৪), তিমি মাছ (১৯৬৫), নৃত্যরতা নারী (১৯৬৫), লালন ফকির (১৯৬৫), যক্ষ যক্ষী (১৯৬৬), প্রেগন্যান্ট লেডি (১৯৬৭-৬৯), বলিদান (১৯৭৬), রাজপথ (১৯৭৭), রেখা, কলেজ গার্ল, গণেশ, সিটেড লেডি, মা ও শিশু, কুকুর, মা, সেপারেশন, রাহুপ্রেম, প্যাশন, ত্রিভুজ, দ্য ফ্রুট অফ হেভেন, হাসি, বন্ধু ইত্যাদি।
বেশ কিছু প্রতিকৃতি এঁকেছেন রামকিঙ্কর। এগুলো ফরমায়েশি প্রতিকৃতি চিত্রের মত নয়। শুধু ব্যক্তির অবয়বকে ধরে রাখার জন্য এই ছবিগুলো আঁকা হয়নি। এই ছবিগুলোর প্রত্যেকটিতেই ব্যক্তির চেহারার সাথে মিলে মিশে গেছে চরিত্র-প্রকৃতি এবং শিল্পীর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। তাঁর প্রতিকৃতি চিত্রগুলোর মধ্যে ‘স্বপ্নময়ী’, ‘ সোমা যোশী’, ‘বিনোদিনী’, ‘নীলিমা দেবী’ উল্লেখযোগ্য। চারপাশের পরিবেশ প্রকৃতি, মানুষ ও তাদের জীবনযাত্রা নিয়ে বেশকিছু ছবি আছে রামকিঙ্করের। এই ছবিগুলোতে বিষয়ের চিত্ররূপের সাথে শিল্পীর বৈশিষ্ট্য স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। ছবিগুলোর কোনটিতে যুক্ত হয়েছে মিথের প্রতীক কোনটিতে বা এসেছে বিমূর্ত চারিত্র। এই ধরণের ছবির মধ্যে ‘ঘরামি’, ‘ঝড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা গ্রাম’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
রামকিঙ্করের সারা জীবনের কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৭০ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ উপাধিতে সম্মানিত করেন। ১৯৭৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি.লিট সম্মাননায় ভূষিত করে।
তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। চিকিৎসার জন্য তাঁকে কলকাতায় নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কলকাতা যাওয়ার ব্যাপারে তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। যাহোক ১৯৮০ সালের ২৩ মার্চ রামকিঙ্করকে কলকাতার পিজি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাঁর চিকিৎসার খরচের দায়িত্ব নেয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার। বিশ্বভারতীর পক্ষ থেকেও কিছু টাকা দেয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয় মস্তিষ্কে জমে থাকা জল বের করার। ধারণা করা হয় এতে তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। ২৬ জুলাই তাঁর মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করা হবে। তার আগের দিন মাটি দিয়ে বানালেন ছোট্ট একটি ভাস্কর্য। এটিই তাঁর জীবনের সর্বশেষ শিল্পকর্ম। পরের দিন অস্ত্রোপচার হল। দু‘একদিন সুস্থ ছিলেন। তারপর শুরু হলো মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ।
১৯৮০ সালের ২ আগস্ট তাঁর মৃত্যু হয়। জীবনের , সৃজনের দীর্ঘ সময় তিনি যেখানে কাটিয়েছিলেন সেই শান্তিনিকেতনেই রচিত হলো তাঁর শেষ শয্যা।
loading...
loading...
আপনার লিখাটি না পড়লে রামকিঙ্কর বেইজ সম্পর্কে হয়তো অজানাই থেকে যেতো। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে শব্দনীড়ে এই পোস্টটি শেয়ার করার জন্য।
loading...