উস্তাদ বিলায়েৎ খাঁ ... অন্তরের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা

উস্তাদ বিলায়েৎ খাঁ জন্মে ছিলেন বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার গৌরী পুরে ২৮ শে অগাস্ট ১৯২৮ সালে। বাবা সেতার ও সুরবাহার বাদক এনায়েৎ খাঁ, মা বশিরন বেগম। ওনার ঠাকুর্দা বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ইমদাদ খাঁ। তাই ওঁর শিক্ষা ইমাদাদখানী বা এটাওয়া ঘরানায়।

বিলায়েৎ খাঁ বহু বছর কলকাতায় কাটিয়েছেন। এক সময়ে তিনি ও তাঁর ছোটভাই ইমরাত খাঁ (সুরবাহার) একসঙ্গে বহু অনুষ্ঠানে বাজাতেন। দুবার বিয়ে করেছিলেন বিলায়েৎ খাঁ। প্রথম পক্ষের তিনটি সন্তান দুই পুত্র এক কন্যা। দুই পুত্র হলেন ইমন খাঁ, কন্যা জিলা খাঁ একজন প্রতিষ্ঠিত সুফি গায়িকা এবং সুপ্রতিষ্ঠিত সেতার বাদক সুজাত খাঁ। দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর একটি পুত্র হিদায়ৎ খাঁ। তিনিও সুপ্রতিষ্ঠিত সেতার বাদক।

বিলায়েৎ খাঁ প্রথম জীবনে বেশ শৌখিন মানুষ ছিলেন। অর্থ যেমন উপার্জন ব্যয়ও করেছেন সেইভাবে। দামী গাড়ি, দামী বেশভুষা, দুষ্প্রাপ্য অ্যান্টিক জিনিস সংগ্রহ ইত্যাদিতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছেন। ঘোড়ায় চড়তে ভালো বাসতেন; পুল খেলা, সাঁতার, বলরুম ডান্স – সবকিছুতেই উৎসাহ ছিল। শেষের জীবনে এসব জিনিসের প্রতি আগ্রহ কমতে থাকে। বিলায়েৎ খাঁর সেতারের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। সাধারণ সেতারের যা গঠন তাতে অনেকগুলি উচ্চ-স্বর পর্যন্ত মীড় দিতে গেলে তারের টানে অন্যান্য তারগুলির সুর হারানোর সম্ভাবনা থাকে, বাজনার ফাঁকেই তাদের নতুন করে বাঁধতে হয়। এই সমস্যা দূর করার জন্য বিলায়েত্ খান বাদ্যযন্ত্র-নির্মাতাদের সাহায্য নিয়ে সেতারের গঠনকে মজবুত করেন। তবলী (নিচের গোলাকৃতি তুম্বার-এর কাঠের ঢাকনা) এবং তারগহনকে (দণ্ডের উপরে সেতারের কান থেকে বার হয়ে তারগুলি যেখানে বসে নিচে নেমে আসে) সুদৃঢ় করেন।

এছাড়া সেতারের ঘাটগুলোতে (ফরএতস) তিনি আরও বক্রতা দেওয়ান এবং তার ও ঘাটের মধ্যে দূরত্বটা বাড়ান যাতে তারকে টেনে পাঁচ-স্বর পর্যন্ত মীড় দেওয়া সম্ভব হয়। সেতারের সাতটি প্রধান তারের বদলে তিনি ছয় তারের সেতার চালু করেন। অন্যান্য কিছু তারকে এমন ভাবে বাঁধেন, যাতে রাগের ফাঁকে ফাঁকে সেগুলো বাজিয়ে ভরাট করা যায় – তানপুরার সহযোগিতা ছাড়াই বাজানো যায়।

বিলায়েৎ খাঁকে অনেক পুরষ্কার বা সম্মান দেবার চেষ্টা করা হয়েছে, যার বেশির ভাগই তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। ভারত সরকারের দেওয়া পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ, পদ্ম-বিভূষণ সবকিছুই তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন। ‘আর্টিস্টস অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া’ পক্ষ থেকে তাঁকে ‘ভারত সেতার সম্রাট’ উপাধি দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ তাঁকে ‘আফতাব-ই-সিতার’ বা ‘সান অফ দ্য সিতার’ আখ্যা দেন। অনেক প্রতিকুলতার মধ্যে কোনও বড় ওস্তাদের স্নেহচ্ছায়ায় না থেকে নিজের অক্লান্ত চেষ্টাতেই তিনি বড় হয়েছিলেন। এনায়তখানই কানাড়া, সাঁঝ সারাবলি, কলাবন্তী ও মান্দ ভৈরব রাগের উদ্ভাবক ছিলেন তিনি।

যশলোক হাসপাতালে ১৩ মার্চ রাত ১১ টা ১০ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সারা জাগানো এই সেতার শিল্পী। তাঁর মরদেহ কলকাতায় আনা হয় সঙ্গে আসেন স্ত্রী জুবাইদা (এলিজাবেথ)। সুন্দর কারুকাজ করা কাঠের শবাধার, তিনি যে আজীবন শৌখিন মানুষ ছিলেন। শিল্পীর নিজস্ব রুচিমাফিক তৈরি করা হলো কাঠের শবাধার। তাতে পিতলের প্লেটে লেখা। উস্তাদ বিলায়েত খাঁ। প্রিয় শিল্পীকে শেষ বারের মতো শ্রদ্ধা জানাতে আসেন স্বনামধন্য সরোদিয়া আমজাদ আলি খান।

বিলায়েত খাঁকে ‘সেতারের কিংবদন্তি’ আখ্যায় স্মরণ করে আমজাদ বলেন, তিনি নিজের পরিচয় দিতেন ইমদাদখানী ঘরানা, ইনায়েতখানী ঘরানা বা কখনো ইটাওয়া ঘরানার সেতারবাদক বলে। খাঁ সাহেব ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী। আসলে তিনি তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে নিজেই একটা ঘরানা হয়ে উঠেছিলেন। সেতারের দুনিয়া তাঁকে স্মরণ করবে উস্তাদ বিলায়েত খাঁ ঘরানা হিসেবেই। পার্ক সার্কাসে পিতা মহানশিল্পী ইনায়েত খাঁর সমাধির পাশে সমাহিত করা হয় সেতার সাধক বিলায়েত খাঁকে, তাঁর ইচ্ছানুসারে।শিল্পীর কোন জাত নেই, শিল্পীকে কখনো সীমান্তের কাঁটাতারে আটকে রাখা যায় না। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত এমন দক্ষতার সাথে ব্যবহার করেছেন যা এক কথায় অসাধারণ। তাঁর অসংখ্য বাজনা আমাদের চিরকাল আনন্দ দেবে। আজ তাঁর মৃত্যু দিনে তাঁকে জানাই আমার অন্তরের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১২ টি মন্তব্য (লেখকের ৬টি) | ৬ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১৩-০৩-২০১৯ | ২১:৪৯ |

    ‘সেতারের কিংবদন্তি’ উস্তাদ বিলায়েৎ খাঁ … মৃত্যু দিনে অন্তরের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।

    GD Star Rating
    loading...
    • রিয়া রিয়া : ১৪-০৩-২০১৯ | ২০:৫০ |

      আপনাকেও আমার শ্রদ্ধা প্রিয় বন্ধু। 

      GD Star Rating
      loading...
  2. নিতাই বাবু : ১৪-০৩-২০১৯ | ১:৩১ |

    উস্তাদ বিলায়েৎ খাঁ নিয়ে অজানা অনেককিছু জানা হলো। আমার শ্রদ্ধেয় রিয়া দিদিকে অজস্র ধন্যবাদ। 

    GD Star Rating
    loading...
    • রিয়া রিয়া : ১৪-০৩-২০১৯ | ২০:৫১ |

      ধন্যবাদ নিতাই দা। 

      GD Star Rating
      loading...
  3. লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী : ১৪-০৩-২০১৯ | ১৯:০৪ |

    ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই। তুমি বেঁচে রবে অন্তর…
    মরণের পরে যে সুর বাজে চোখ আসে জলে ভরে।

    সুন্দর কবিতা পাঠে মুগ্ধ হলাম। প্রিয়কবির জন্য অভিনন্দন রইল।।
    প্রিয়কবিকে আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাই।

    সাথে থাকুন, পাশে রাখুন।
    জয়গুরু!

    GD Star Rating
    loading...
    • রিয়া রিয়া : ১৪-০৩-২০১৯ | ২১:১২ |

      শুভেচ্ছা অভিনন্দন প্রিয় কবি দা। 

      GD Star Rating
      loading...
  4. অর্ক : ১৪-০৩-২০১৯ | ২০:৩০ |

    বাহ দারুণ লাগলো লেখাটি। শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন।       

    GD Star Rating
    loading...
    • রিয়া রিয়া : ১৪-০৩-২০১৯ | ২১:১৩ |

      ধন্যবাদ অর্ক দা। 

      GD Star Rating
      loading...
  5. শাকিলা তুবা : ১৪-০৩-২০১৯ | ২৩:০৭ |

    অন্তরের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।

    GD Star Rating
    loading...
    • রিয়া রিয়া : ১৫-০৩-২০১৯ | ১৮:০০ |

      ধন্যবাদ শাকিলা তুবা দি।

      GD Star Rating
      loading...
  6. হাসনাহেনা রানু : ১৬-০৩-২০১৯ | ৯:১৬ |

    সুন্দর উপস্থাপন কবি রিয়া দি''ভাই। শুভেচ্ছা নিন।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • রিয়া রিয়া : ১৬-০৩-২০১৯ | ২৩:০৫ |

      ধন্যবাদ প্রিয় রানু দি। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

      GD Star Rating
      loading...