প্রতিভাবান ব্যক্তিদের মানসিক সমস্যা – পর্ব ৩
এখন আরও কিছু প্রতিভাবান ব্যাক্তিদের কথা বলবো যারা এই রকম রোগের শিকার হয়েছেন। মায়াকোভিস্ক, আইজাক নিউটন, মারিনা স্ভেতায়েভা, এমিলি ডিকিনসন।
শতাব্দির শুরুতে রুশ বিপ্লবের অন্যতম পথিকৃত মায়াকোভস্কিকে বলা হয় রাশিয়ান কবিতার ‘raging bull’. ওভারকোট আর হ্যাট মাথায় দীর্ঘদেহী এক মানুষ। যিনি পুঁজিবাদী সমাজের শোষণ, মানুষে মানুষে ঘৃণা, অসাম্যের কথা বলেছেন তাঁর কবিতায়। অসাধারণ সুন্দর আবৃত্তি করতেন মায়াকোভস্কি, তাঁর কবিতায় রয়েছে এক ধরনের বিমর্ষ চিৎকার। মায়াকোভস্কির জীবনের শেষ বছরটি ছিল খুবই ঝঞ্ঝাময়। তাঁর স্ত্রী লিলি ব্রুকের মতে সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি তার স্বভাবজাত ছিল। তিনিও নানান কারনে মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন। ১৯২৯ সালে তিনি তাতিয়ানা নামের এক মডেলের প্রেমে পড়েন, তাতিয়ানা একজন ফ্রেঞ্চকে বিয়ে করায় তিনি মানসিক অবসাদে ভোগেন। এছাড়াও যে আদর্শের জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন তার অবনমন তাঁকে ব্যাথিত করে তুলেছিল। এসব বিবেচনা করে অনেকে মনে করেন যে তিনিও সম্ভবত বাইপোলার ডিসঅর্ডারে ভুগেছিলেন। ১৯৩০ সালের ১৪ এপ্রিল সকাল ১০:১৭ তে মায়াকোভস্কি নিজের রিভলবারের গুলিতে আত্মহত্যা করেন।
মারিনা স্ভেতায়েভা কবির ইংরেজি প্রতিবর্ণীকরনে কবির পূর্ণ নাম – Marina Ivanovna Tavetaeva. এটি মূল রুশ উচ্চারণের প্রায় কাছাকাছি। বাংলায় রুশ উচ্চারণ অনুসারে পদবীর উচ্চারণ করলে সেটি বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। মারিনা স্ভেতায়েভার শহর ছিল মস্কো। এটা যেন তাঁর শহর, একান্ত নিজের। এই শহর যেন তাকে কোন জাদু করেছিল। এই ভাললাগা ছিল তাঁর নিজস্ব ও ব্যাক্তিগত। রাশিয়ার বিখ্যাত কবিদের মধ্যে তিনি একজন। আখমাতোভা, মায়াকোভস্কি, ও অন্যান্য কবিদের সাথে তাঁর নাম ও সমান ভাবে উচ্চারিত হতো। তথাপি তাঁর ব্যাক্তিগত জীবন সুখের ছিল না। বহুবার ধ্বংসের মুখোমুখি হয়েছেন। খুব দারিদ্রের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করেছেন। এতো প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মারিনা স্ভেতায়েভার কোনোদিনই নিজেকে ভাগ্যের হাতে সঁপে দেন নি। অসহায়তায়, অক্ষম সমর্পণে ছিল তাঁর তীব্র অনীহা। এই সবের বিরুদ্ধে লড়াই ছিল তাঁর সৃষ্টির প্রেরণা। একটু শান্তির জন্য তিনি এদেশ থেকে ওদেশ ঘুরে বেরিয়েছেন। দু’বেলা অন্নের জন্য তিনি লড়াই করেছেন। হয়ত পুরোপুরি সফল হন নি। সেটা বড় কথা নয়। দুঃখভার সইবার শক্তি ছিল তাঁর অসীম। কিন্তু আমাদের এই প্রিয় কবিও মানসিক যন্ত্রণার শিকার হয়েছেন। ১৯৪১ সালের ৬ই অগস্ট কামা নদীর তীরে এলাবুগা নামক একটি জীর্ণ, পোড়ো এক শহরে তিনি আত্মহত্যা করেন। ফাঁসের জন্য ব্যাবহার করেছিলেন শণের দড়ি।
এমিলি ডিকিনসনকে যুক্তরাষ্ট্রের সেরা কবিদের একজন হিসেবে গণ্য করা হয়। ছোটবেলায় এমিলি নিজেকে মেধাবী ছাত্রী ও বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন হিসেবে প্রমাণ করেন। ছড়ায় ছড়ায় গল্প লিখে তিনি তার সহপাঠীদের আনন্দে মাতিয়ে রাখতেন। সমাজ জীবন থেকে স্বেচ্ছায় নিজেকে একাকিত্বের ঘেরাটোপে আটকে রেখে এক অস্বাভাবিক জীবনযাপন করেছেন তিনি, একেবারেই সাদামাটা ও নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়েছেন। ডিকিনসন এক অজানা রোগে আক্রান্ত ছিলেন। এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই, সম্ভবত রোগটি ছিল মানসিক বা বাইপোলার ডিসঅর্ডার’ বা স্থায়ী বিষাদগ্রস্ততা। তিনি নানদের মতো সাদা পোশাক পরতেন। তিনি মৃগী রোগে মাঝে মাঝেই অজ্ঞান হয়ে যেতেন। এবং এই মৃগী রোগের কারনেই তিনি মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করেন।
সেরা বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের ব্যক্তিত্ব ও কিছু ব্যবহার ছিল বেশ অদ্ভূত এবং পাগলাটে। নিউটনের সময়ে আলো নিয়ে বেশি পরীক্ষা নিরীক্ষা হয় নি। চোখ কি নিজে আলো তৈরি করে, না কি সংগ্রহ করে এ বিষয়টা স্পষ্ট ছিল না মানুষের কাছে। সেই কারনে তিনি নিজের ওপরই একটা পরীক্ষা করে দেখেন। অপটিক্স নিয়ে নিজেই নিজের গিনিপিগ হন এবং তার নোটবুক থেকে একটা পরীক্ষার কথা পাওয়া যায়, যেখানে তিনি তার দুই চোখের মাঝখানের হাড়টিতে একটা ভোঁতা সুঁচ দিয়ে খোঁচা মেরে দেখেছিলেন রংয়ের অনুভূতিটা কেমন। ১৬৭৮ সালে তাঁর আলোকবিদ্যার (থিওরি অব অপটিক্স) বিভিন্ন দিক নিয়ে এক বিতর্কে জড়ানোর পর, তিনি মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছিলেন। ১৬৯৩ সালে দ্বিতীয়বার এমন হয়েছিল তিনি আবারও মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েন তারপর তিনি বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে অবসর নিয়েছিলেন। দ্বিতীয়বারের মানসিক ভেঙে পড়ার পেছনে কম ঘুমকে দায়ী করেছেন নিউটন। কিন্তু মনোবিজ্ঞানীরা অন্যান্য সম্ভাব্য কারণের কথা বলেছেন। গবেষণার সময় রাসায়নিক দ্রব্যাদির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং দীর্ঘকালীন মানসিক দুর্বলতা ও বিষন্নতার সম্মিলিত কারণে এটা ঘটতে পারে বলে মনে করেন তাঁরা।
আমাদের আশেপাশে এমন অনেক মানুষকেই লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যারা এই অসুখে ভুগছেন। ২০০৭ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষক উইলিয়ামস দেখেন মেডিটেশন বাইপোলার ডিসঅর্ডারের ক্ষেত্রে কাজ করেছে। কেমিব্রিজ ইউনির্ভার্সিটির জন টিসডেল ক্রনিক বিষন্নতা গ্রস্ত রোগীদের ওপর মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশনের প্রভাব নিয়ে সমীক্ষা চালিয়ে দেখেন, এদের মধ্যে পুনরায় বিষন্নতায় আক্রান্ত হওয়ার হার অর্ধেক কমেছে। ২০০৮ সালে বিজ্ঞানী প্রোলাক্স দেখেন মেডিটেশনের ফলে এই ৪০% রোগীর উন্নতি হয়েছে। ১৯৯৯ সালে সানডিয়েগোর ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার বিজ্ঞানী সানহফ খালসা দেখেন, অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রেও মেডিটেশন কার্যকরী প্রমাণিত হয়েছে। আমাদের ধৈর্যশীল হতে হবে, হতে হবে সংযমী। আমরা আমাদের মন কে পুরোপুরি জয় করতে না পারলেও তাতে লাগাম দেয়ার চেষ্টা তো অবশ্যই করতে পারি। আর এই চেষ্টার ফলে যদি আমাদের কিছু অন্যায় ইচ্ছে বা মুড প্রশমিত হয় তাহলে আমরাই উপকৃত হবো। আমাদের জীবন তখন হয়ে উঠবে সুখী-সুন্দর ও নির্মল। এর ফলে মন-প্রাণ সুন্দরের সৌরভে ভরে যাবে জীবনে ছড়িয়ে পড়বে শান্তি।
(সমাপ্ত)
loading...
loading...
"আমাদের আশেপাশে এমন অনেক মানুষকেই লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যারা এই অসুখে ভুগছেন। আমাদের ধৈর্যশীল হতে হবে, হতে হবে সংযমী। আমরা আমাদের মন কে পুরোপুরি জয় করতে না পারলেও তাতে লাগাম দেয়ার চেষ্টা তো অবশ্যই করতে পারি। আর এই চেষ্টার ফলে যদি আমাদের কিছু অন্যায় ইচ্ছে বা মুড প্রশমিত হয় তাহলে আমরাই উপকৃত হবো। আমাদের জীবন তখন হয়ে উঠবে সুখী-সুন্দর ও নির্মল। এর ফলে মন-প্রাণ সুন্দরের সৌরভে ভরে যাবে জীবনে ছড়িয়ে পড়বে শান্তি।"
নিবন্ধটি থেকে শিক্ষা নিজ জীবনে প্রয়োগ করে দেখা যেতে পারে। বিশ্বাস করি কাজ হবে। তিনটি খণ্ডে আপনার এই প্রয়াশ শব্দনীড় আর্কাইভকে সমৃদ্ধ করবে।
অভিনন্দন কবি বন্ধু রিয়া রিয়া। আপনাকে ধন্যবাদ।
loading...
আমি সম্মানিত বোধ করছি প্রিয় বন্ধু। আশীর্বাদ চাই।
loading...
তিনটি পর্ব আমি পড়েছি। ব্যক্তিগত ভাবে আমার নিজেরও কিছু সমস্যা আছে বা হয়; আপনার লেখাটিতে আমার মনোপ্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলাম। পেয়েছি লেখক রিয়া রিয়া। ধন্যবাদ আপনাকে। লিখায় উপকৃত হলাম।
loading...
অনেক খুশি হলাম জেনে শাকিলা তুবা দি। ভাল থাকুন।
loading...
আপনার তিনটি পর্ব আমি কপি করে রাখছি। যদি অনুমতি দেন।
loading...
নিশ্চিন্তে নিয়ে নিন দিদি ভাই। খুশি হবো।
loading...
সময় স্বল্পতার কারণে ভেবেছিলাম, আজ না কাল পড়বো এই লেখাটা। আরেকটা কারণ বা কনফাউন্ডিং ফ্যাক্টর এর সাথে ছিলঃ এই অসুখগুলি আমার সিলেবাসে ছিল।
কিন্তু পড়ে মনে হল, না পড়লে আজ এর স্বাদ থেকে বঞ্চিত হতাম। প্রতিভাবানদের বিষয়ে এসব রোগ নিয়ে দারুণ কিছু তথ্য আপনি অসাধারণভাবে উপস্থাপন করেছেন।
আমার একান্ত নিজস্ব একটা মতবাদ আছে, যারা ক্রিয়েটিভ না তারা অর্ধমানব। আবেগহীন মানুষ সাধারণতঃ ক্রিয়েটিভ হয়না। আর ওসব রোগের সাথে আবেগ জড়াজড়ি করে অবস্থান করে। লেম্যানের মত তাই ভাবি, "আবেগ-প্রতিভা-ওইসব রোগ" কোথায় যেন কিছু একটা আছে!
loading...
খুবই ভালো ভাবে পড়েছেন বেশ বুঝতে পারছি মিডদা। আপনি আমার লেখার অন্যতম প্রিয় পাঠক।
স্বল্প পরিসরে অনেক আলোচনাকেই উহ্য রেখে দিতে বাধ্য হতে হয়। আমার পাঠকদের অতো সময় নেই যে, খুঁটিনাটি পড়বে। এফবিতে শেয়ার করেও দেখেছি সবারই কেমন জানি আলগা আলগা ভাব। এমটাই হয়। হয়তো। সম্ভবত।
loading...
আপনার লেখা পড়ে অনেককিছু জানা হলো, শ্রদ্ধেয় রিয়া দিদি। শেষ পর্বটি পড়ে আগের দুটি পর্ব পড়ার ইচ্ছে জাগছে। তা সময় করে একসময় পড়ে নিবো আশা করি। আপনার জন্য শুভকামনা সবসময়ই থাকবে।
loading...
আপনার জন্যও শুভকামনা প্রিয় নিতাই দা।
loading...
তিনটা পর্বই পড়লাম রিয়া । খুব ভালো লেগেছে ।
সামনে নতুন কোনো বিষয় তোমার কাছে পাবো মনে হচ্ছে ।
সে আশায় থাকলাম ।ভালো থেকো ।
loading...
চেষ্টা থাকবে দিদি ভাই। ফাগুন শুভেচ্ছা রইলো।
loading...