দাশগুপ্ত বাড়ির কালী প্রতিমার ছবি

দাশগুপ্ত বাড়ির কালী প্রতিমার ছবি।

“জয়ন্তী মঙ্গলাকালী ভদ্রাকালী কপালিনী
দুর্গা শিবা ক্ষমাধাত্রী স্বাহা স্বধা, নমোহস্তুতে”

‘কালী’ শব্দটি ‘কাল’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ রূপ, যার অর্থ “কৃষ্ণ, ঘোর বর্ণ” (পাণিনি ৪।১।৪২), মহাভারত অনুসারে, এটি দুর্গার একটি রূপ (মহাভারত, ৪।১৯৫), আবার হরিবংশ গ্রন্থে কালী একটি দানবীর নাম (হরিবংশ, ১১৫৫২)। ‘কাল’, যার অর্থ ‘নির্ধারিত সময়’, তা প্রসঙ্গক্রমে ‘মৃত্যু’ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। এর সমোচ্চারিত শব্দ ‘কালো’র সঙ্গে এর কোনও প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। কিন্তু লৌকিক ব্যুৎপত্তির দৌলতে এরা পরস্পর সংযুক্ত হয়ে গেছে। মহাভারত-এ এক দেবীর উল্লেখ আছে যিনি নিহত যোদ্ধা ও পশুদের আত্মাকে বহন করেন। তাঁর নাম কালরাত্রি বা কালী। সংস্কৃত সাহিত্যের বিশিষ্ট গবেষক টমাস কবার্নের মতে, এই শব্দটি নাম হিসাবে ব্যবহার করা হতে পারে আবার ‘কৃষ্ণবর্ণা’ বোঝাতেও ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে। তন্ত্র ও পুরাণে দেবী কালীর একাধিক রূপভেদের কথা পাওয়া যায়। তোড়ল তন্ত্র মতে কালী অষ্টধা বা অষ্টবিধ। যথা – দক্ষিণাকালী, সিদ্ধকালী, গুহ্যকালী, মহাকালী, ভদ্রকালী, চামুণ্ডাকালী, শ্মশানকালী ও শ্রীকালী। মহাকাল সংহিতা অনুসারে আবার কালী নববিধা। এই তালিকা থেকেই পাওয়া যায় কালকালী, কামকলাকালী, ধনদাকালী ও চণ্ডিকাকালীর নাম।

কালীকে দুর্গার ললাট থেকে উৎপন্না বলা হয়েছে। যথা—”দুর্গার ললাটে জাতা জলদবরণী।” —এই বাক্যের তাৎপর্য যে, ললাটের সংকোচনেই ক্রোধভাব প্রকাশিত হয় বলে সদা ক্রোধান্বিতা; রণরঙ্গিনী করাল-বদনা কালীকে ললাট-সম্ভবা বলা হয়েছে। বাস্তবিক কালীও দুর্গার রূপান্তর বিশেষ। ক্রোধাবস্থাপন্না শক্তিই কালী। ভয়ানক ভাবান্বিতা বিশ্বব্যাপিনী শক্তি—এই অর্থে ঈশ্বরের নাম কালী। কালীর মূর্তি ও সংগ্রামকর্ম—দুইই ভয়ংকর। কালীর বাসস্থান শ্মশান, হাতে খড়্গ, শরীর রক্তমাখা, গম্ভীর গর্জন করেন, যুদ্ধে মেতে থাকেন, গলায় মুণ্ডমালা, সংক্ষেপে বললে, কালীর ভয়ানক বেশ, কালীপূজার কাল অমাবস্যা তিথি ও ঘনঘোর অন্ধকার রাত। মৃতদেহের উপর বসে, শ্মশানে তাঁর সাধনা করতে হয়। পূজার বাদ্যযন্ত্র ঢাক ও উপহারের ফুল টকটকে লাল রঙের জবা। তান্ত্রিকেরা আবার পঞ্চ-মকার দিয়ে ভয়ানক সাধনপ্রণালীর বিধানও দিয়েছেন। মদ্য, মাংস, মৎস্য, মুদ্রা ও মৈথুন—এই পঞ্চ-মকারের প্রায় প্রত্যেকই বাইরে থেকে দেখলে এক এক ভয়ানক সাধন-প্রণালী। বাইরে থেকে—এই কথা বলার তাৎপর্য এই যে, ওই পঞ্চ-মকারের আধ্যাত্মিক ভাব অত্যন্ত নির্মল ও উচ্চ। লোকনাথ বসু তাঁর হিন্দুধর্ম মর্ম নামক বইয়ে পঞ্চ-মকার সম্পর্কে আগমসারের যে এক অংশ উদ্ধৃত করেছেন, তার তাৎপর্য এই যে, ঐ স্থানে মদ্য বলতে পানীয় মদ বোঝায় না, তা ব্রহ্মরন্ধ্র থেকে ক্ষরিত অমৃতধারা বা ব্রহ্মানন্দ; মাংস মানে দেহের মাংস নয়, তা হল জিভের সংযম; মৎস্য বলতে মাছ বোঝায় না, তা হল শ্বাসনিরোধ (প্রাণায়ম); মুদ্রা মানে টাকাপয়সা নয়, বরং আত্মাতে যে পরমাত্মা মুদ্রিত হয়ে আছেন, সেই তত্ত্বজ্ঞান এবং মৈথুন বলতে যৌনসংগম বোঝায় না, তা হল জীবাত্মাতে পরমাত্মার মিলন।

চামুণ্ডাচর্চিকা কালীর পূজা বাংলা ও বাংলার বাইরে প্রাচীন উৎসব হলেও বর্তমান আকারে কালীপূজা আধুনিক কালের। ষোড়শ শতাব্দীতে নবদ্বীপের প্রসিদ্ধ স্মার্ত পণ্ডিত তথা নব্যস্মৃতির স্রষ্টা রঘুনন্দন কার্ত্তিক মাসের অমাবস্যায় লক্ষ্মীপূজার বিধান দিলেও, কালীপূজার উল্লেখ করেননি। ১৭৬৮ সালে রচিত কাশীনাথের কালী সপর্যাসবিধি গ্রন্থে দীপান্বিতা অমাবস্যায় কালীপূজার বিধান পাওয়া যায়। ডঃ শশীভূষণ দাশগুপ্তের মতে, “কাশীনাথ এই গ্রন্থে কালীপূজার পক্ষে যে ভাবে যুক্তিতর্কের অবতারণা করিয়াছেন, তাহা দেখিলেই মনে হয়, কালীপূজা তখনও পর্যন্ত বাঙলা দেশে সুগৃহীত ছিল না।” তবে খ্রিষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে বাংলায় কালীপূজার প্রচলনের কিছু কিছু প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে।

সপ্তদশ শতকের নবদ্বীপের প্রথিতযশা তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশকে বাংলায় কালীমূর্তি ও কালীপূজার প্রবর্তক মনে করা হয়। পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ স্বয়ং কালীমূর্তি গড়িয়া পূজা করিতেন। আগমবাগীশের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিয়া বাংলার সাধক সমাজ অনেকদিন চলেন নাই; লোকে ‘আগমবাগিশী’ কাণ্ড বলিয়া তাঁহার পদ্ধতিকে উপেক্ষা করিত।” অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কালীপূজাকে জনপ্রিয় করে তোলেন। এই সময় রামপ্রসাদ সেনও আগমবাগীশের পদ্ধতি অনুসারে কালীপূজা করতেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কৃষ্ণচন্দ্রের পৌত্র ঈশানচন্দ্র ও বাংলার ধনী জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় কালীপূজা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৮ টি মন্তব্য (লেখকের ৪টি) | ৪ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০৬-১১-২০১৮ | ১৯:৫৭ |

    রিয়া দাশগুপ্ত'র বাড়ির কালী প্রতিমার ছবি। অভিনন্দন প্রিয় শব্দনীড় বন্ধু রিয়া রিয়া। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • রিয়া রিয়া : ০৭-১১-২০১৮ | ১১:৫১ |

      ধন্যবাদ প্রিয় বন্ধু। শুভেচ্ছা আপনাকে। Smile

      GD Star Rating
      loading...
  2. মিড ডে ডেজারট : ০৬-১১-২০১৮ | ২২:০৬ |

    অনেক তথ্যসমৃদ্ধ লেখা। খুব ভালো লেগেছে।

    যাইই লিখুন না কেন পড়লেই বুঝা যায় বাংলা লেখালেখিতে আপনি কতো সাবলীল। 

    GD Star Rating
    loading...
    • রিয়া রিয়া : ০৭-১১-২০১৮ | ১১:৫৩ |

      সন্নিবেশিত অনেক তথ্যই সংগ্রহ করা মিড দা। অতো জানলে তো কথাই ছিল। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Shy.gif.gif

      GD Star Rating
      loading...
  3. নিতাই বাবু : ০৬-১১-২০১৮ | ২২:৩২ |

    যে কাল সর্ব জীবের গ্রাসকারী , সেই কালেরও যিনি গ্রাসকারীনি , মহানির্বাণ তন্ত্র বলেন তিনিই কালী – আদ্যাশক্তি ।

    কলনাৎ সর্বভূতানাং মহাকালঃ প্রকীত্তিরত ।
    মহাকালস্য কলনাৎ ত্বমাদ্যা কালিকা পরা ।

    দেবীভাগবতপুরাণে বলে-
    সদৈকত্বং ব ভেদোহস্তি সর্বদৈব মমাস্য চ ।
    যোহসৌ সাহম্ অহং যাসৌ ভেদোহস্তি মতিবিভ্রমাৎ ।।

    অর্থাৎ আমি ও ব্রহ্ম এক । উভয়ের মধ্যে ভেদ নাই । যিনি ব্রহ্ম তিনিই আমি । আমি যাহা, তিনিও তাহাই । ভেদ ভ্রমকল্পিত ( যারা ব্রহ্ম ও শক্তিতে ভেদ দেখেন। তাদিগের উদ্দেশ্যে বলা) , বাস্তব নহে ।

    GD Star Rating
    loading...
    • রিয়া রিয়া : ০৭-১১-২০১৮ | ১১:৫৪ |

      Smile ধন্যবাদ এবং দীপাবলী'র শুভেচ্ছা নিতাই দা।

      GD Star Rating
      loading...
  4. মুহাম্মদ দিলওয়ার হুসাইন : ০৭-১১-২০১৮ | ০:৫৯ |

    * শুভ কামনা প্রিয় কবি দি… https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • রিয়া রিয়া : ০৭-১১-২০১৮ | ১১:৫৫ |

      ধন্যবাদ কবি দা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

      GD Star Rating
      loading...