“আমি ধনী আমি জ্ঞানী মানী রাজ্যপতি।
শ্মশানে সকলের দেখ একরূপ গতি।”
– কাঙাল হরিনাথ।
তাঁর আসল নাম হরিনাথ মজুমদার। কিন্তু প্রায় সবাই তাঁকে চেনেন কাঙাল হরিনাথ নামে। বাউল গানে নিজেকে কাঙাল বলে উপস্থাপন করতেন বলেই তাঁর এই পরিচিতি গড়ে ওঠে। বিখ্যাত বাউল সাধক লালনের শিষ্য ছিলেন তিনি। তবে কাঙাল হরিনাথ তাঁর বাউল গানের জন্য শুধু নয়- অন্য অনেক কাজের জন্য অমর হয়ে আছেন। তিনি ১৮৩৩ সালে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীতে জন্মগ্রহণ করেন। আর্থিক টানাপড়েনে বেশিদূর পড়াশোনা করতে পারেননি। কিন্তু তরুণ বয়সেই অসহায় মানুষের পক্ষে কাজ শুরু করেন।
সে সময় ব্রিটিশ শাসকদের নির্যাতনের শিকার গ্রাম-বাংলার গরিব-দুঃখী মানুষের কথা লিখতে থাকেন সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায়। পরে ১৮৬৩ সালে নিজেই ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ নামের একটি পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন। পরে পত্রিকাটি পাক্ষিক এবং তার কিছু পরে সাপ্তাহিক ভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। এক পয়সা মূল্যের এই পত্রিকাটিতে কাঙাল হরিনাথ অবিরাম নীলকর ও জমিদারদের নানা জুলুমের কথা প্রকাশ করতে থাকেন। পত্রিকাটি প্রকাশের সুবিধার্থে তিনি ১৮৭৩ সালে একটি ছাপাখানা স্থাপন করেন। কাঙাল হরিনাথের পত্রিকাটি সেই সময়ে নির্যাতিত কৃষক ও প্রজাদের পক্ষের একটি পত্রিকা হিসেবে পরিচিতি পায়। কিন্তু সরকারের কঠোর মুদ্রণনীতি ও নানা বিরোধিতায় ১৮ বছর প্রকাশের পর ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সেই উনিশ শতকে গ্রামের নির্যাতিত মানুষের পক্ষে এমন একটি পত্রিকা প্রকাশের কারণে কাঙাল হরিনাথ অমর হয়ে আছেন। নিজ গ্রামে তিনি বন্ধুবান্ধবের সহায়তায় একটি ভার্নাকুলার স্কুল খুলেছিলেন ১৮৫৫ সালে। সেখানেই অবৈতনিক শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন। পরের বছর তিনি কুমারখালীতে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৮৫৮ সালে এই বালিকা বিদ্যালয়ের নতুন ভবনের দ্বারোদ্ঘাটন করেছিলেন স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
এদেশে নারীদের শিক্ষার প্রসারেও হরিনাথের ভূমিকা অন্যতম পথিকৃতের।গ্রামবার্ত্তা প্রথমে প্রকাশিত হতো কলকাতার গীরিশ বিদ্যারত্ন প্রেস থেকে। বাংলা পিডিয়ায় বলা হয়েছে, ১৮৬৪ সালে কুমারখালীতে স্থাপিত হয় মথুরনাথ যন্ত্র। বিখ্যাত ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রের পিতা হরিনাথের বন্ধু মথুরনাথ মৈত্র এটি প্রতিষ্ঠা করেন। পরে তিনি মুদ্রণযন্ত্রটি হরিনাথকে দান করেন। ১৮৭৩ সাল থেকে এই যন্ত্রেই গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিত হতে থাকে। ১৮ বছর ধরে পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছিল। কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের কোনোদিন কোনো বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেখা হয়নি। পারিবারিক দৈন্যের কারণে বালক বয়সে কুমারখালী বাজারের এক কাপড়ের দোকানে কাঙাল হরিনাথ কাজ নিতে বাধ্য হন দৈনিক দুই পয়সা বেতনে। এরপর ৫১টি কুঠির হেড অফিস কুমারখালীর নীলকুঠিতে শিক্ষানবিস হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু মানবদরদী ও সত্যনিষ্ঠ হরিনাথের পক্ষে সেখানেও বেশিদিন কাজ করা সম্ভব হয়নি। নীলকুঠিরে স্বল্পকালীন কর্মজীবনে হরিনাথ রায়ত-প্রজার ওপর কুঠিয়ালদের অত্যাচার ও শোষণের স্বরূপ নিজ চোখে দেখেন। কাঙালের জীবনীকার অধ্যাপক আবুল আহসান চৌধুরীর মতে, এই শোষণের প্রতিকারের চিন্তা থেকেই পরে হরিনাথ মজুমদার ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ সম্পাদনা করেন। গণসঙ্গীতশিল্পী কমরেড হেমাঙ্গ বিশ্বাস তার এক লেখায় উল্লেখ করেন, ‘রবীন্দ্রনাথের আগে ঠাকুর পরিবারের যেসব সদস্য জমিদার হিসেবে শিলাইদহে এসেছিলেন, তারা প্রজাবৎসল ছিলেন না’, তাদের অত্যাচারের কথা হরিনাথ গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকায় সাহসের সঙ্গে লিখতেন।
গ্রামবার্ত্তা পত্রিকায় হরিনাথ সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ প্রকাশের পাশাপাশি অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে জমিদার ও ব্রিটিশ নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনী প্রকাশ করেন। একটা পর্যায়ে জমিদাররা তাঁর ওপর হামলার পরিকল্পনা করেন। তখন লালন সাঁই অনুসারীদের নিয়ে হরিনাথের বাড়িতে এসে পাহারা দিয়ে তাঁকে রক্ষা করেন।ফকির লালন সাঁইয়ের সঙ্গে হরিনাথের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা ছিল। এছাড়া বিষাদ সিন্ধু ও জমিদার দর্পণের রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেন, প্রখ্যাত সাহিত্যিক-সাংবাদিক জলধর সেন, অক্ষয় কুমার মৈত্র, দীনেন্দ্র কুমার রায় ছিলেন তাঁর শিষ্যতুল্য এবং গ্রামবার্ত্তার লেখক।
হরিনাথ নিজেও ছিলেন আধ্যাত্মিক সাধক। ‘কাঙাল ফকির চাঁদ বাউল’ নামেও তিনি পরিচিত ছিলেন। বহু গান লিখেছেন। প্রকাশিত গ্রন্থ ১৮টি। এর মধ্যে ‘বিজয় বসন্ত’ নামের উপন্যাসটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। এর ২০টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর জীবদ্দশাতেই।নিজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ করতে পারেননি বলে লোকশিক্ষার প্রতি হরিনাথের বিশেষ আগ্রহ ছিল। কলকাতার বাইরে দূরে মফস্বলে সংস্কৃতিচর্চার একটি অনুকূল আবহাওয়া রচনা করতে পেরেছিলেন তিনি। কিন্তু উপার্জনের নির্দিষ্ট উৎস না থাকায় আর গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা প্রকাশের জন্য চরম ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ায় আক্ষরিক অর্থেই তিনি প্রায় কাঙাল হয়ে পড়েন। তারপরও কৃষক-প্রজা, রায়ত শ্রমজীবী মানুষ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর স্বার্থের অনুকূলে নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মাসিক, পাক্ষিক ও সাপ্তাহিক হিসেবে গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা বিভিন্ন পর্যায়ে প্রায় ২৫ বছর চলেছিল। তখনও তিনি তার প্রাপ্য মর্যাদা পাননি। ১৮৯৬ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
loading...
loading...
কাঙাল হরিনাথের জীবন সম্পর্কে অনেক কিছু জানা হলো। চমৎকার পোস্ট দিভাই।
loading...
অশেষ কৃতজ্ঞতা বোন রুকশানা হক।
loading...
অনেক ভালো একটা বিষয় পড়লাম দিদি। ধন্যবাদ আপনাকে
loading...
আপনাকে ধন্যবাদ কবি দা।
loading...
কাঙাল হরিনাথ উরফে হরিনাথ মজুমদার এর আমাদের বিনীত শ্রদ্ধা। ভালো থাকুন।
loading...
শ্রদ্ধা আমারও প্রিয় বন্ধু।
loading...
অনেক শুভেচ্ছা নিবেন দিদি
loading...
ধন্যবাদ কবিবাবু।
loading...
এমন অনেক গুনীজন আআমাদের অন্তরালে রয়েছেন যাদের কথা আমরা অনেকেই জানিনা। এমনি একজনকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ দিদি।
শুভকামনা।

loading...
ধন্যবাদ খালিদ দা।
loading...
বাহ ! সাংবাদিক, কবি ও বাউল গায়ক হরিনাথ মজুমদার সম্পর্কে জানলাম।
ধন্যবাদ দিদিভাই
loading...
পড়ার জন্য আপনাকেয়ো ধন্যবাদ কবি জাহিদ দা।
loading...
হরিনাথ মজুমদার (কাঙাল হরিনাথ) লালন সাঁই এর সাথে একটা দল করেছিলেন। উনার ১৮ টা বই প্রকাশিত হয়েছিল। “হরি দিন তো গেলো সন্ধ্যা হলো পার করো আমারে” উনার এই গানটি শুনে নাই এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে।
খুব দামি পোস্ট দিদি।
loading...
বিনীত হলাম মিড দা। ধন্যবাদ।
loading...
হরিনাথ মজুমদারের বই গুলির পিডিএফ পাওয়া গেলে বেশ হতো।
loading...
হ্যাঁ। এটা যদি কেউ করে থাকেন তাহলে তো ভালই হয়।
loading...
তথ্যপুর্ণ লেখা
loading...
মিলিয়ে টিলিয়ে গুছিয়ে লেখা। তথ্য সব গুগলেই আছে।
loading...
কাঙ্গাল হরিনাথ সম্পর্কে জানার আগ্রহ ছিলো । আপনার এই তথ্যবহুল লেখা সমৃদ্ধ করলো আমাদের । ভালো থাকবেন আপু ।
loading...
পাঠের ধন্যবাদ আপনাকে দিদি ভাই। অনুপ্রাণিত হলাম এককথায়।
loading...
“আমি ধনী আমি জ্ঞানী মানী রাজ্যপতি।
শ্মশানে সকলের দেখ একরূপ গতি।”
– কাঙাল হরিনাথ।
* অনেক ভালো একটা পোস্ট। ধন্যবাদ কবি দি…
loading...
ধন্যবাদ কবি দা।
loading...
হরিনাথের জীবনের ঘ্টনা পড়ে এবং তাঁর ব্যাক্তিত্বের বর্ননা পড়ে অনেক বিষয় জানা গেল। আর্থিক বাঁধা, সামাজিক বাঁধা অতিক্রম করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কি করে সমাজকে সংস্কার করেছেন —-তাঁ সত্যি অবাক হওয়ার মত!
loading...
আপনার মনযোগের জন্য অজস্র ধন্যবাদ ইলহাম দা।
loading...
ব্যক্তিত্বের প্রতি শুভেচ্ছা।
loading...
ধন্যবাদ দিদি।
loading...
অনেক তথ্য জানতে পারলাম। কোনটি ঠিক? '১৮ বছর' নাকি '২৫ বছর'? ধন্যবাদ।
loading...
১৮ বছর দাদা। মুদ্রণ ভুল ছিলো। ধন্যবাদ আপনাকে।
loading...