আজ জন্মাষ্টমী ... হ্যাপি বার্থডে টু কৃষ্ণ

হ্যাপি বার্থডে টু কৃষ্ণ, আর হ্যাঁ আজ কিন্তু যোগমায়ারও বার্থ ডে। ওর জন্য কিছু পুজো করার নিয়ম নেই? আসলে, যুগ যুগ ধরে কন্যা সন্তানের বলি দেওয়ার ওপরেই পুত্র সন্তানের ইমারত গড়ে ওঠে। তর্কের খাতিরে নয়, আমরা সবাই অল্প বিস্তর আমাদের হিন্দু মাইথলজি পড়েছি। তাদের কেউ কেউ দেবতা হিসেবেও পূজিত হন।

এদের মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয়, আন্তর্জাতিক ভাবেও তাঁর নাম কৃষ্ণ। তাঁকে আমরা পুজো করি। ‘‘প্রাচীন প্রথা অনুসারে জন্মাষ্টমী উৎসব শুরু হয় চাঁদ দেখে সন্ধ্যায়। পুজো চলে গভীর রাত পর্যন্ত। আমরা যখন পড়ি শ্রীরাধিকা কৃষ্ণ প্রেমে বিভোর। চিরসখা তার কৃষ্ণ। এখানেও শেষে দেখা যায় রাধার sacrifice, কারণ প্রাণের বন্ধুটি এক সময় তার থেকে অনেক দূরে চলে যায়। তারপর রাধার শেষ পর্যন্ত কি হলো সেই খবর কিন্ত আমরা রাখিনি। বরং বলা ভালো জানিনা।

আজ জন্মাষ্টমী, আমাদের যেসব বাড়িতে আজ তিনি পূজিত হবে সেইসব বাড়িতে সকাল থেকেই নানা আয়োজন। তিনি কি খেতে পছন্দ করেন। সেইসব রান্নার ধুম পড়ে গেছে। তালের বড়া, মালপোয়া, আহা! জিবে জল আনা সেইসব খাবার।

এইবার একটু জন্মাষ্টমী ব্যাপারটা আর একবার ঝালিয়ে নিই।

হাজার হাজার বছর আগের কথা। তখনকার সময়কে বলা হতো দ্বাপর যুগ। কথিত আছে যে অসুর রাজারা ছিলো খুবই অত্যাচারী (যদিও এটা নিয়েও সন্দেহ আছে যে সত্যিই অসুর রাজারা অত্যাচারী ছিলেন কিনা।) তাদের অত্যাচারে সকলেই অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। এতই বেশী হয়ে উঠে যে দেবদেবীগণ ক্ষীর সমুদ্র তীরে গিয়ে ভগবানের কৃপা প্রার্থনা করতে লাগে। তাদের প্রার্থনায় সন্তুষ্ট হয়ে শুধুমাত্র ব্রহ্মাকে অবগতির জন্য দৈববাণীতে বলে, “হে ব্রহ্মা, আমি খুব তাড়াতাড়ি যদুবংশীয় রাজাদের রাজধানী মুথরা রাজা সুরসেনের পুত্র বসুদেবের সন্তান রূপে দেবকীর অষ্টম গর্ভে আবির্ভূত হবো। ধরিত্রী দেবসহ তোমরা আমার নির্দেশ অনুসারে দ্বারকা, মথুরা এবং ব্রজের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে জন্মগ্রহণ করবে।”

তখন উগ্রসেন নামে মথুরার এক রাজা ছিলো। রাজা ছিলো প্রচণ্ড রকমের ধার্মিক। কিন্তু রাজা ধার্মিক থাকলে কি হবে, তার ছেলে কংস ছিল খুবই অত্যাচারী। কংসের অত্যাচারের মাত্রা এতটাই বেশী ছিল যে নিজের পিতা উগ্রসেনকেও সিংহাসনচ্যুত করে কারাবন্ধী করে নিজেই মথুরায় রাজত্ব করতো। আবার এই কংসই আরাধনা করে বর লাভ করেছিল, তার বোন দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান ছাড়া অন্য কোন ভাবে তার মৃত্যু হবে না। আর এ জন্যই কংসের অত্যাচারের মাত্রাটাও এত বেশী ছিলো। দেবকীর বিবাহ হয় বসুদেবের সঙ্গে। রথের উপর বসানো হয়েছে এবং রথের সারথী হচ্ছে কংস। রথ চলছে এমন সময় হঠাৎ করে সেই দৈববাণীটি কংসের কানে বেজে উঠলো, “ওরে নির্বোধ যাকে তুমি রথে করে নিয়ে যাচ্ছো তার গর্ভের অষ্টম সন্তান তোমার প্রাণ হরণ করবে।” দৈববাণী শুনে কংস সঙ্গে সঙ্গে দেবকীকে হত্যা করার জন্য উদ্যোত হলো। এ দেখে বসুদেব কংসকে অনেক সবিনয় অনুরোধ করে রাজী করালো এই বলে যে, তাদের সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার পরই কংসের হাতে দিতে দেওয়া হবে। একথা শুনে কংস শান্ত হলো ঠিকই কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দেবকী ও বসুদেবকে কারাগারে নিক্ষেপ করলো।

মাঝখানে কেটে গেল অনেক বছর। একে একে জন্ম নিলো ছয়টি সন্তান। সন্তান জন্ম নেওয়ার পর পরই কংস আসে এবং বসুদেব পূর্ব প্রতিশ্রতিমতো নিজেদের সন্তানকে কংসের হাতে তুলে দেয়। আর কংস সঙ্গে সঙ্গে পাথরে আছাড় দিয়ে সন্তানটিকে মেরে ফেলে। সপ্তম গর্ভের সন্তান যখন বলদেব অধিষ্ঠিত হয়েছিলো তখন ভগবানের নির্দেশে যোগমায়া দেবী দেবকীর গর্ভ হতে তাকে স্থানান্তরিত করে নন্দালয়ে রোহিনীর গর্ভে স্থাপন করে এবং প্রচার করা হয় দেবকীর গর্ভপাত হয়েছে। এবার অষ্টম গর্ভের সন্তান অর্থাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মগ্রহণ করার পালা।

কারাগারের বাইরে পূর্বের চেয়ে কংস এবারও আরও বেশী পাহারার ব্যবস্থা করলো। মাস ছিলো ভাদ্র, তিথি ছিলো অষ্টমী এবং রজনী ছিলো ভীষণ দুর্যোগময়। প্রবল ঝড় বৃষ্টিতে প্রকৃতি ধারণ করে এক অন্যরকম মূর্তি, বিদ্যুৎ উচ্ছ্বলিত ঠিক এমন সময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দেবকীর গর্ভে আবির্ভূত হন এবং দৈববানী শোনা যায় “বসুদেব, তুমি এখনই গোকুলে গিয়ে নন্দের স্ত্রী যশোদার পাশে তোমার ছেলেটিকে রেখে এসো এবং এই মুহূর্তে তার যে কন্যা শিশুটি জন্মগ্রহণ করেছে তাকে এনে দেবকীর কোলে রেখে দাও। আমার মায়ায় পৃথিবীর সমস্ত মানুষ এখন গভীর ঘুমে অচেতন, যার ফলে কেউ কিছুই জানতে পাবে না।” সঙ্গে সঙ্গে শিশুটিকে নিয়ে বসুদেব ছুটতে লাগলো নন্দের বাড়ীর দিকে। পথে যমুনা নদী। বর্ষাকাল তাই যমুনা কানায় কানায় পরিপূর্ণ ছিলো। তখন বসুদেবের নিরুপায় মনে হলো। হঠাৎ করে বসুদেব দেখলো যমুনার জল শুকিয়ে গিয়েছে এবং একটা শৃগাল যমুনা নদী পার হয়ে যাচ্ছে। বসুদেব তখন ঐ রূপধারী শৃগালকে পথ প্রদর্শক মনে করে তার পিছনে পিছনে হাঁটতে লাগলো। এমন সময় প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল। বসুদেব ও শ্রীকৃষ্ণকে বৃষ্টি থেকে রক্ষা করার জন্য নাগরাজ তার বিশাল ফণা বিস্তার করলো তাদের মাথার উপরে। কিছু সময়ের মধ্যে বসুদেব তার ছেলেকে যশোদার কোলে রেখে যশোদার কন্যা যোগমায়াকে নিয়ে কংসের কারাগারে ফিরে এল।

সকাল বেলা কংস খবর পেল দেবকীর অষ্টম সন্তান ভূমিষ্ট হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে কারাগারে চলে এসে দেবকীর কোল থেকে মেয়েটিকে ছিনিয়ে নিয়ে একই ভাবে পাথরের উপরে আঁছাড় মারতেই মেয়েটি শূন্যে উঠে যেয়েই যোগমায়া মূর্তি ধারণ করে। মহাশূন্যে মিলিয়ে যাওয়ার পূর্বে কংসকে বলে গেলো, “তোমাকে বধিবে যে গোকূলে বাড়িছে সে”।

এই দেখুন এক্ষুনি আপনারা বলবেন এইসব গল্পতো আমরা জানি। এতে আর নতুন কী? কিন্তু আমরা কেউ মনে রাখিনি যোগোমায়ার কথা। আমরা ভুলেই গেছি আজকের দিনে একই সময়ে যোগমায়াও জন্মেছিলেন। আজকের এই জন্মাষ্টমী তো তারও। তাঁর জন্য পুজো, অর্চনা আজ নেই কেন? তাঁর খবর কি আমরা কেউ রেখেছি? তিনিই তো নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে কৃষ্ণের জীবন বাঁচিয়েছিলেন।

কি অদ্ভুত না! তখনও একটা পুত্র সন্তানের প্রাণ বাঁচাতে সেই কন্যা সন্তানকেই বেছে নেওয়া হতো বলির জন্য। আজকের দিনে তো কন্যাদের বলি দিতে নব নব পন্থা আনা হয়েছে। তাঁর শরীরের ভেতরে সূচ, ইঁট, পাথর, লোহার রড কতকিছু! অথচ আমরা জানি প্রকৃতি ও পুরুষ এই দুই নিয়েই সৃষ্টি।

আমরা সুন্দরী বান্ধবী চাই, সুন্দরী স্ত্রী চাই, কিন্তু কন্যা সন্তান চাই না। আর দেখুন না দেশের জন্য বিদেশের মাটিতে খেলতে গিয়ে সেই কন্যা সন্তানরা কিন্তু সোনার পদক নিয়ে আসছে।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১৬ টি মন্তব্য (লেখকের ৭টি) | ৮ জন মন্তব্যকারী

  1. খেয়ালী মন : ০২-০৯-২০১৮ | ১৩:৪৭ |

    ”আমরা যখন পড়ি শ্রীরাধিকা কৃষ্ণ প্রেমে বিভোর। চিরসখা তার কৃষ্ণ। এখানেও শেষে দেখা যায় রাধার sacrifice, কারণ প্রাণের বন্ধুটি এক সময় তার থেকে অনেক দূরে চলে যায়। তারপর রাধার শেষ পর্যন্ত কি হলো সেই খবর কিন্ত আমরা রাখিনি।”

    রাধিকা কৃষ্ণের প্রেমে বিভোর কথার র্অথ এক মুখো প্রেম। আসলে আমি যা ইতিহাস জানি তা হলো কৃষ্ণ রাধিকার প্রেমে বিভোর হয়েছিলো, আর রাধিকা ছিলো অন্য কারো সহধর্মিনী, মানে একটা পরকীয়া বিষয়। কৃষ্ণ; কোন ভগবান টাইপের কিছু ছিলো না, সে ছিলো কলি যুগের প্রথম দিকে একজন ভালো রাজনীতিবিদ এর বাইরে কিছু না। কারন

    ১/ ভগবান কোন দিন পরকীয়া করেন না

    ২/ ভগবান কোন দিন যুদ্ধ করে কিছু অর্জনের চেষ্ঠা করেন না

    ৩/ ভগবান কোন দিন নিজেকে রক্ষা করতে পালিয়ে বেড়ায় না

    ৪/ ভগবান কোন দিন কারো গর্ভজাত সন্তান হবেন না

    ৫/ ভগবানের কোন দিন মৃত্যু হবে না

    আরো আছে……..

    GD Star Rating
    loading...
    • রিয়া রিয়া : ০২-০৯-২০১৮ | ১৪:২৫ |

      আপনার সব প্রশ্নের একটাই উত্তর কৃষ্ণ ছিলেন ভগবান বিষ্ণুর অবতার। পরবর্তী সময়ে তিনি ঈশ্বর রূপে পূজিত হন। আপনি সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন যদি মহাভারতের ১৮ খণ্ড পড়ে থাকেন। তাছাড়া এই ক্ষুদ্র পরিসরে উত্তর দেয়া অসুবিধে, অনেকটাই লিখতে হবে তবে আপনার এই প্রশ্ন নিয়ে আমি পরে নিশ্চয়ই লিখে শব্দনীড়ে পোস্ট দেবো।

      GD Star Rating
      loading...
      • খেয়ালী মন : ০২-০৯-২০১৮ | ১৪:৪০ |

        পড়েছি।

        সব কিছুর পরে একটা কথা বলি হিন্দু ধর্মের বেদ কে জন সমক্ষ থেকে দূরে ঠেলে দেবার জন্য মহাভারত রচিত হয় পরবর্তীতে গীতা। এটাও কৃষ্ণের একটি চাল, ধর্মীয় দিক বিবেচনায় না এনে ইতিহাস থেকে জানা যায় কৃষ্ণ একজন ভালো যোদ্ধা ছিলেন। যা হোক, শুভকামনা থাকলো।

        GD Star Rating
        loading...
      • রিয়া রিয়া : ০২-০৯-২০১৮ | ২২:২৪ |

        আপনার জন্যও শুভকামনা।

        GD Star Rating
        loading...
  2. মুরুব্বী : ০২-০৯-২০১৮ | ১৪:৪৯ |

    আদি যুগ থেকে এই পথ পরিক্রমায় আমাদের চেতনা এবং মননে অনেক কিছুরই পরিবর্তন এসেছে; তবে বেশীর ভাগে রয়ে গেছে সনাতন ভাবনার ছিঁটেফোঁটা। ধন্যবাদ।

    GD Star Rating
    loading...
    • রিয়া রিয়া : ০২-০৯-২০১৮ | ২১:০৮ |

      ঠিকই বলেছেন প্রিয় বন্ধু।

      GD Star Rating
      loading...
  3. সুজন হোসাইন : ০২-০৯-২০১৮ | ১৭:৪৫ |

    অনেক কিছু জানলাম,,,,

     

    শুভেচ্ছা জানবেন শ্রদ্ধেয় দিদি♥♥♥

    GD Star Rating
    loading...
    • রিয়া রিয়া : ০২-০৯-২০১৮ | ২১:০৮ |

      ধন্যবাদ কবি সুজন হোসাইন।

      GD Star Rating
      loading...
  4. শাকিলা তুবা : ০২-০৯-২০১৮ | ২০:১৭ |

    আজ জন্মাষ্টমী … হ্যাপি বার্থডে টু কৃষ্ণ।

    কী সহজ আর সরল উপস্থাপনা। কত কিছু জানার আছে। আমি মুগ্ধ হয়েছি বোন।

    GD Star Rating
    loading...
    • রিয়া রিয়া : ০২-০৯-২০১৮ | ২১:০৯ |

      প্রণাম কবি দিদি ভাই শাকিলা তুবা।

      GD Star Rating
      loading...
  5. মিড ডে ডেজারট : ০২-০৯-২০১৮ | ২০:৫৪ |

    মাইথোলজিতে ভীষণ আগ্রহ থাকায় মন দিয়ে পড়লাম।

    দারুণ উপস্থাপনা! মুগ্ধ!

    GD Star Rating
    loading...
    • রিয়া রিয়া : ০২-০৯-২০১৮ | ২১:১০ |

      অনুপ্রাণিত হলাম মিড দা। ধন্যবাদ আপনাকে। 

      GD Star Rating
      loading...
  6. শংকর দেবনাথ : ০২-০৯-২০১৮ | ২১:৪৯ |

    দারুণ লেখা

    GD Star Rating
    loading...
    • রিয়া রিয়া : ০২-০৯-২০১৮ | ২২:২৪ |

      ধন্যবাদ দাদা।

      GD Star Rating
      loading...
  7. মুহাম্মদ দিলওয়ার হুসাইন : ০৩-০৯-২০১৮ | ২:৪০ |

    * শুভ জন্মাষ্টমী… https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

    GD Star Rating
    loading...
  8. মোঃ সফি উদ্দীন : ০৩-০৯-২০১৮ | ১১:২২ |

    কেউ কেঊ কিন্তু কন্যা সন্তান চায়!

    GD Star Rating
    loading...