রাগ করিস না প্লিজ!
জানিস আমি কিন্তু কখনোই কথা দিইনি পরিপাটি সংসার, মন জুগিয়ে চলা আর সুখি গৃহকোণের। কিংবা ধর রান্নায় নিখুঁত নুন-ঝাল-মিষ্টি, অথবা তোয়াজি চা-এর কাপ। লিকার না দুধ, আসাম না দার্জিলিং তাও জানতে চাইনি। তাই রাগ করিস না প্লিজ!
আমার তখন কলেজ বেলা, বন্ধুদের সাথে দুরন্ত আড্ডা, তুমুল তর্ক। বন্ধুরা ডাকতো “কমরেড”বলে। না কোন রাজনীতির গন্ধ মিশিয়ে ফেলিস না। তখনও এই শব্দটায় কোনো বাদানুবাদের গন্ধ মেশেনি। তখন সদ্য পড়েছি গোর্কির মাদার। তখনও পাভেল, ইভান আর তাতিয়ানা আমাদের ঘরের নাম হয়ে ওঠেনি। তখনও রদ্ধশ্বাসে পড়ে ফেলেছি, “ইস্পাত”। আমার কাছে কমরেড মানে জীবনে জীবন বাজি রেখে, একগুঁয়ে লড়াই-এর গল্প। বন্ধুরা বলতো “সবাই কেন এমন হতে পারেনা, ঠিক যেমন তুই”।
আমি তখন ঘুলঘুলিতে ছলকে আসা সকাল রোদ। তপ্ত দুপুরে জানলার খড়খড়িতে লুকিয়ে থাকা দস্যি চোখ। আমি তখন বিকেল বেলার এক্কাদোক্কার ছক। আমি তখন লম্বা চুলের খোঁপায় গোঁজা চন্দ্রমল্লিকার গন্ধ। আমি তখন জিন্স টিশার্ট। আমি তখন শখের শাড়ি। আমি তখন ঠাম্মার থেকে নেওয়া মিঠে-পানের রাঙা ঠোঁট। আমার তখন কফি হাউজ, আমার তখন আলসেমিতে বেজায় সুখ।
রাগ করিস না প্লিজ! আমি কিন্তু কখনোই আবদার করিনি বাঁধনহারা সুখের, প্রশ্নহীন বাধ্যতার, আর আমাকে অগাধ ভালোবাসার। অথবা, লোক দেখানো তোয়াজ, মায়াবী ব্যবহার।
দাদু ডাকতো, “অভিমানী” বলে।এই শব্দটায় তখনও কোন মশলা সাঁতলানো আর পাঁচফোড়ন পড়েনি। পান থেকে চুন খসলেই ঠোঁট ফুলিয়ে ঘরের কোনে। জানতাম দাদু ঠিক এসে আমাকে জড়িয়ে নেবে। অভিমান তো এখনো হয়। এখনও ঠোঁট ফুলিয়ে চুপচাপ হয়ে যাই। যেমন কালও হয়েছিল। তারপর হঠাৎ ভাবি কেউ তো নেই। আমার দাদুই তো নেই! তারপর দাদুর ছবির দিকে তাকিয়ে থাকি চুপচাপ কিছুক্ষণ। হয়তো দু ফোঁটা জলও গড়িয়ে পড়ে চোখ থেকে। তারপর নিজেকেই বলি “পাগল মেয়ে! অভিমান কি সবাইকে মানায়!” যাদের কেউ নেই তাদের অভিমান করতে নেই। অথচ দেখ এই ছোট্ট কথাটাই ভুলেই যাই মাঝে মাঝে।
রাগ করিস না প্লিজ! বল দেখি, বদলে যাওয়া নিয়মগুলোয় নিজেকে বদলে নেওয়া সহজ? তবুও রোজ বদলাই আমি,নিজেকে একটু একটু করে। সেইদিনের সেই দস্যি মেয়ে ভীষণ শান্ত আজ। স্বপ্ন দেখার বিলাসিতা থেকে অনেক দূরের সে। কথার সঙ্গে কথার মাঝে গুটিয়ে নেবে আর, গল্প করার সময়টুকু, হ্যাঁ এর পিঠে হ্যাঁ।
আমি তখন শীতের দুপুরে রোদ পোহানো ছাদের দোলনা চড়া মন। আমি তখন গাছের ডালে পা দুলিয়ে পেয়ারা ভাঙা আঙুল। আমি তখন গুলি খেলার ছক কাটা উঠোন। আমি তখন ঠাকুরঘরের একান্ন আলোর প্রদীপ। আমি তখন বাড়ির খাঁজে চড়ুই পাখির পালক। আমি তখন বৃহস্পতি বারের আলতা রাঙা পা। আমি তখন শখের মেহেন্দী পড়া হাত, আমি তখন ঘরে পাতা-কাজল। আমি নাকের ছোট্ট হীরের ফুল। আমি তখন সন্ধ্যেবেলা তুলসি মঞ্চ, আকাশ প্রদীপ, হাজার তারার রাত।
রাগ করিস না প্লিজ! আমি কখনো ইচ্ছেগুলো চাপিয়ে দিইনি তোর ওপরে। স্বৈরাচারী হতেই শিখিনি কখনো। কখনো বলিনি উচ্ছ্বলতা মেনে নে তুই। কখনো বলিনি কেন এতো অবহেলা আমার প্রতি। কখনো বলিনি আমায় কষ্ট দিয়ে তুই কি সত্যিই আনন্দ পাস!
আমি নিজেই ডাকি “বৃষ্টিবিলাস” বলে। বৃষ্টির সাথে আমার বড্ডো বন্ধুতা। এখন আমি গভীর আঁধারে হারিয়ে যাওয়া নদী। এখন একলা আমি এক আকাশ জুড়ে। এখন আমি মেঘের হতাশা।কবেকার শুকিয়ে যাওয়া জলের ফোঁটা। নীল বেদনায় চুপসে যাওয়া দুরের পাখি। এখন আমি অহেতুক প্রলাপ বকা বাচাল এক মেয়ে। এখন আমি উদাস ভোরের বিদায়ী রাতের গান। এখন আমি বৃন্ত থেকে ঝরে যাওয়া ফুল।তপ্ত দুপুরের ঝলসে যাওয়া এক দীর্ঘশ্বাস। হঠাত্ দমকা হাওয়া কেঁদে ওঠা বৃষ্টি। এখন আমি ঝাপসা স্মৃতির এক ধুলি ধূসর প্রেম উপাখ্যান।
এইতো, শুধু এইটকুই আমি। যে রোজ রোজ চলার পথে সামলে নেয় নিজেকে যখন তখন সন্ধ্যে কিংবা রাত। মনটা না হয় লুকিয়ে নেবো। মেঘবিলাসি, যদিও চোখ। মন খারাপের মেঘের জলে একাই ডুব স্নান। তবু, রাগ করিস না প্লিজ!
তারচেয়ে, বরং প্রার্থনা কর চিরঘুম আমার হোক।
কোনো একভোরে বন্ধ হোক এই তারাগোনা চোখ!
loading...
loading...
"রাগ করিস না প্লিজ! আমি কিন্তু কখনোই আবদার করিনি বাঁধনহারা সুখের, প্রশ্নহীন বাধ্যতার, আর আমাকে অগাধ ভালোবাসার। অথবা, লোক দেখানো তোয়াজ, মায়াবী ব্যবহার।" ___ চিরঘুম চাই না আপনার। সদা থাকুন জাগ্রত।
loading...
শিরোধার্য্য প্রিয় বন্ধু। নমষ্কার। আপনার কথায় অনুপ্রাণিত হই।
loading...
অনেক ভাল লাগল দিদি
loading...
আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন কবিবাবু।
loading...
দারুণ তো
loading...
ধন্যবাদ বেরা দাদা।
loading...
"এইতো, শুধু এইটকুই আমি। যে রোজ রোজ চলার পথে সামলে নেয় নিজেকে যখন তখন সন্ধ্যে কিংবা রাত। মনটা না হয় লুকিয়ে নেবো। মেঘবিলাসি, যদিও চোখ। মন খারাপের মেঘের জলে একাই ডুব স্নান। তবু, রাগ করিস না প্লিজ!
তারচেয়ে, বরং প্রার্থনা কর চিরঘুম আমার হোক।
কোনো একভোরে বন্ধ হোক এই তারাগোনা চোখ!"
অসাধারণ! শেষের কটা লাইন হৃদয়ে দাগ কেটে যায়!!!!
loading...
আনন্দিত হলাম ইলহাম দা। ধন্যবাদ।
loading...
একেবারেই ভিন্ন স্বাদের লেখা! তৃপ্ত না হয়ে পারা যায়না।
দারুণ!
loading...
আজ আপনার মন্তব্যের ফন্ট সাইজ ঠিক আছে। ধন্যবাদ আপনাকে।
আপনার লেখা কিন্তু পেলাম না। নিয়মিত না লিখলে থেমে যাবেন। থামবেন না প্লিজ।
loading...
তারচেয়ে, বরং প্রার্থনা কর চিরঘুম আমার হোক।
কোনো একভোরে বন্ধ হোক এই তারাগোনা চোখ!
* বিষয়, ভাব কল্পনা, উস্থাপনা কৌশল এবং নিজস্ব দৃষ্টি ভঙ্গির অপূর্ব সমন্বয়…
বেশ চমৎকার হয়েছে।
শুভ কামনা কবিদি…
loading...
ধন্যবাদ কবি দা। নমষ্কার।
loading...