আমাদের পরিবারটি ছিল যৌথ পরিবার। বাড়িতে দাদুকে দেখেছি ভীষণ সাদামাটা জীবন যাপন করতে। কোনো এক অদ্ভুত উপায়ে সমস্ত বৈষয়িকতাকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন তিনি। দাদুর কাছ থেকেই আমার প্রথম রবীন্দ্রনাথকে চেনা। তিনি শুধু পড়তেন না, ব্যাখ্যাও করতেন অসাধারণভাবে। দাদু ছিলেন ঘোরতর রবীন্দ্রপ্রেমী, কত গান আর কবিতা যে তাঁর কণ্ঠস্থ ছিল! এখন ভাবলেও অবাক লাগে। কণ্ঠও ছিল উদাত্ত, ফলে তাঁর পাঠ বা আবৃত্তি আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। রবীন্দ্রনাথকে তিনি বলতেন – “poet of all poets “। আর তাই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল ছোটবেলাতেই, আমাদের বাড়ির কল্যাণে। পরবর্তীতে সেই ধারা আমার মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছে। এখনো যখন একা হয়ে যাই ভীষণ। এখনো যখন মুখ, মুখোশের রাজনৈতিক খেলায় পরাজিত হয়ে যাই, কাছে টেনে নিই গীতবিতান, সঞ্চয়িতাকে।
খুব ছোটবেলায় দেখতাম বাড়ির বইয়ের তাক থেকে মাঝেমধ্যেই ঠাম্মা কয়েকটা বই টেনে নিতেন। ‘কার বই ঠাম্মা ?’ একই জবাব, রবীন্দ্রনাথ। কী আশ্চর্য, স্কুলের ‘সহজ পাঠ’-ও তো রবীন্দ্রনাথেরই লেখা ! কে এই রবীন্দ্রনাথ ? ঠাম্মা বললেন, “জীবনের যে কোনও সময়ে, যদি সবাই হাত ছেড়ে দেন, যে কোনো অনুভূতি ভাগ করে নেওয়ার জন্য যদি কাউকে পাশে না পাও, ইনি সব সময় থাকবেন তোমার পাশে।” আর সেই থেকেই রবীন্দ্রনাথ আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী। আমার চিরসখা তিনি। তার পরে কী ভাবে যেন রবীন্দ্রনাথ আমার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন। কবিতার সঙ্গে গানের সঙ্গে অটুঁট বন্ধনে বেঁধেছেন যিনি, তিনি তো আমার রবীন্দ্রনাথই !
ছোটবেলা থেকে শুনেছি, রবীন্দ্রনাথের এক একটা লেখার অর্থ আমরা একেক সময়ে, একেক বয়সে একেক রকমভাবে উপলব্ধি করতে পারব। তখন সেভাবে বুঝিনি, কিন্তু এখন বড় হয়ে, চড়াই উতরাই পথে চলতে চলতে বুঝতে পারছি একটা বাক্য কতগুলো ভিন্ন অর্থ মেলে ধরতে পারে। এখন গীতবিতান খুলে বসলে মনে হয়, যেন আমার অনুভূতি গুলোকেই রবীন্দ্রনাথ ভাষা দিয়েছেন। হয়তো আমার জন্যই লেখা ওঁর গান। গ্রীষ্মের পর প্রথম বৃষ্টির আনন্দ হোক কিংবা কালবৈশাখী ঝড়, আবার কখনো ঝগড়া, কখনো অভিমান, সব কিছুই মেলানো যায় রবীন্দ্রনাথের কোনও না কোনো গানের সঙ্গে। খুব মন খারাপের দিনে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনলে মন ভাল হয়ে যায়। খুব আনন্দের সময়েও গুনগুনিয়ে উঠি রবীন্দ্রসঙ্গীত। তাই রবি ঠাকুর নোবেলজয়ী বিশ্বকবি হলেও তিনি আমার সবচেয়ে কাছের, সব সময়ের বন্ধু। তাঁর দৃঢ় ব্যক্তিত্ব দিয়েও তিনি আমাকে প্রভাবিত করেছেন। আমি তাঁর মানসিক দৃঢ়তার থেকে নিজেকে শক্ত করে নিতে পারি।
আমার জীবনে তিনি এমনভাবে মিশে আছেন যে, তাঁকে ছাড়া আমার চলেই না। যখন ভীষণ একা হয়ে যাই, যখন ভীষণ মানসিক যন্ত্রনায় থাকি, যখন সম্পর্কগুলো হাতের ফাঁক দিয়ে গলে পড়ে যায়, সব মিলিয়ে একটা প্রচণ্ড অস্থিরতা ভর করে, তখন রবীন্দ্রনাথের গানের ভিতরে ঢুকে পড়ি। প্রেম বা প্রার্থনা, স্বস্তি, শান্তি, আনন্দ বা আশ্রয় সবই মেলে তাঁর কাছে। আর তিনি তো একমাত্র, যিনি প্রেম ও প্রার্থনাকে অবলীলায় একাকার করে ফেলেছেন; দুটো বিষয়কে তিনি আলাদা করে তো দেখেন-ই নি, বরং সমার্থক করে তুলেছেন। যা কিছু প্রেম তা-ই প্রার্থনার যোগ্য, যা কিছু প্রার্থনা তা-ই প্রেমের যোগ্য। এরকম উদাহরণ আপনি আর কোথায় পাবেন, বলুন? আর তাই, রবীন্দ্রনাথকে ছাড়া দিনযাপন – এক অসম্ভব ব্যাপার আমার কাছে।
loading...
loading...
আমার জীবনে তিনি এমনভাবে মিশে আছেন যে, তাঁকে ছাড়া আমার চলেই না।




কবিগুরুকে শ্রদ্ধাঞ্জলি।


loading...
হ্যাঁ। কবিগুরুকে শ্রদ্ধাঞ্জলি। শুভেচ্ছা কবি
loading...
এভাবেই আমাদের অনেকের জীবনে রবীন্দ্রনাথ জুড়ে আছেন সারাবেলা। সুন্দর লিখা।
loading...
সত্য বলেছেন বন্ধু। শুভেচ্ছা নিন।
loading...
অনেক ভাল লাগল দিদি———
loading...