প্রেম, ভালবাসা, ঝগড়া (প্রথম পর্ব)
ঝগড়া কিন্তু কয়েক রকমের আছে … কিছু কিছু ঝগড়া আছে যা সংসার কিংবা পরিবার তথা সমাজের জন্য ও অনেক মারাত্মক ক্ষতির কারণ হিসাবে দাঁড়ায়। তাই এমন কোনো ঝগড়া মনের মানুষের সাথে করা উচিত নয় যে ঝগড়া ভালবাসার পবিত্র বন্ধন থেকে শুরু করে পিতৃ-মাতৃক স্নেহের বন্দন পর্যন্ত ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার এমন কিছু ঝগড়া আছে যা ভালবাসার মানুষ কে আরো কঠিন করে ভালবাসতে বাধ্য করে। আর সেই রকম ঝগড়া কে ”স্নেহের কিংবা মায়া মমতার গভীরতার ঝগড়া” বলে উল্লেখ করতে চাই…। ঝগড়া যদি তীব্র থেকে তীব্রতর না হয় তাহলে ভালবাসার কোনো ক্ষতি হবে না। আরো একটা কথা বলি, মনে রাখবেন ঝগড়া যত কঠিন এই হোক না কেন সত্যিকারের প্রেম কিন্তু ঝগড়ার রেশ ধরে শেষ হয়ে যায়না। হয়তো কিছু সময়ের জন্য দুজনে মধ্যে একটু মান-অভিমান হতে পারে। বরং বলতে পারি ঝগড়া দু ধরনের।
একটি হলো ভালো লাগার, ভালোবাসার ঝগড়া। এই ধরনের ঝগড়া সাধারণত একটু খুনসুটি, একটু অভিমান এই ধরনের হয় তবে আপনার সেই মানুষটি যদি আপনার মনের অবস্থা বোঝে। মানে আপনাকে বুঝতে পারে তাহলে সেই ঝগড়া সোনায় সোহাগা। এতে ভালবাসা কমার তো কোনো আশঙ্কা বিন্দু মাত্র নেই বরং একে অপরের প্রতি টান বহু গুনে বেড়ে যায়। আবার ভালো বাসার মানুষটির সাথে একটু খুনসুটি বা তাকে হালকা একটু রাগিয়ে সময়টা উপভোগ্য করে তুলতে চাইছেন কিন্তু সে বিরক্তি বোধ করছে কিংবা যে কোনো কারণে মুড্ অফ থাকলে তার মন ভালো করার চেষ্টা না করে ঝগড়া কিংবা বিরক্ত হওয়ার মত কিছু করলে বিরূপ একটা প্রভাব তো সৃষ্টি হতেই পারে যার ফলাফল সম্পর্কের ফাটল। ছেলেরা প্রেমে পড়লে সহজেই বলে দেয়, পুরো পৃথিবীকে জানিয়ে দেয়। যদি সেই প্রেম সত্যি হয়। কিন্তু একটি মেয়ের ভালোবাসা সম্পূর্ণ আলাদা, তারা সহজে কাউকে ভালোবাসতে চায়না, ভালোবাসলেও নিজের ভিতরে রাখে মুখে প্রকাশ করেনা, একবার যদি কোন মেয়ে কোন ছেলেকে ভালোবাসে তাহলে সে তার আপ্রাণ চেষ্টা করে সেই ভালোবাসাটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য। মেয়েদের মন খুব নরম, সেই মন কারও প্রেমে পরলে আরও নরম হয়ে যায়, কিন্তু আমরা অনেক ছেলেরা তা দেখে না/বোঝে না। শুধু মেয়েদের বাহিরের রাগ, অভিমান, ঝগড়াটা দেখে, কিন্তু সেই রাগ, অভিমান আর ঝগড়ার আড়ালেই লুকিয়ে আছে গভীর ভালোবাসা।
মানব সভ্যতা ও বিজ্ঞানের এই চরম উৎকর্ষতার যুগেও ‘প্রেম’ নিয়ে কৌতূহল ও রহস্যময়তার শেষ নেই। ‘প্রেম কী’-এর অনুসন্ধান এখনো চলছে। মধুর স্বাদ যে ব্যক্তি কখনো লাভ করেনি, তাকে যেমন চিনি ও গুড়ের মিশেলে মধুর স্বাদ বোঝানো যাবে না, তেমনিভাবে ‘প্রেম কী’ জানতে হলে খোদ প্রশ্নকর্তাকেই প্রেমে পড়তে হবে। প্রেমের সত্যিকার উপলব্ধি অর্জন করা কেবল তখনই সম্ভব।তবে প্রেমের কোনো সংজ্ঞা না থাকলেও প্রেম নিয়ে নানা ধরনের মিথ ও ব্যাখ্যা প্রচলিত আছে। বিপরীত মানুষের অর্থাৎ নির্দিষ্ট একজনের প্রতি পূর্ণ আসক্তিকেই প্রেমের বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করেন মনোবিজ্ঞানীরা। সবকিছু ত্যাগ করে যে ভালবাসা রবীন্দ্রনাথ তাকেই ‘প্রেম’ বলেছেন। বিপরীত সত্তাকে মহার্ঘ্য অনুভব করে আপন সত্তাকে সমর্পণের আকুতিই মানব-মানবীর প্রেমের প্রথম ও প্রধান নির্দেশক।
কবির ভাষায়— “আমি তোমাকে ভালবাসি অস্থিমজ্জাসহ।” সত্যিকারের প্রেমের প্রকাশ এটাই।
‘প্রেম’ না ‘ভালবাসা’
সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘প্রেম’ না ‘ভালবাসা’ —এমন প্রশ্নও উঁকি দেয় অনেকের মনে। একজন পুরুষ কিংবা নারী যখন বিপরীত লিঙ্গের কাউকে বলেন, ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’; তখন সেটা আসলে প্রেমেরই নির্দেশক।
তবে ‘ভালবাসা’ শব্দটির ব্যাপ্তি অনেক। এখানে বহুজনকে জায়গা দেওয়া সম্ভব। ভালবাসা যদি হিমালয়ের পাদদেশ হয়, প্রেম হলো এর চূড়া। যদি আরেকটু সহজ করে বলি— তাহলে বলা যায়, ভালবাসা হচ্ছে, রেলের একটি কম্পার্টমেন্টের মতো, এখানে বহু লোক একসঙ্গে বসতে পারে। আর প্রেম হচ্ছে, রিকশায় চড়ার মতো, এখানে দু’জন নর-নারী স্বাচ্ছন্দ্যে বসতে পারে। ভালবাসা নিঃস্বার্থ ও শর্তহীন হতে পারেনা। অন্যদিকে সত্যিকারের প্রেম নিঃস্বার্থ ও নিঃশর্ত হয়।
“ভালবাসা এক তীব্র অঙ্গীকার, যেন মায়াপাশ/সত্যবদ্ধ অভিমান … ” (সত্যবদ্ধ অভিমান/সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)
অনেককেই ভালবাসা যায়, কিন্তু সবার সঙ্গে প্রেম হয় না। ভালবাসার সবচেয়ে গভীরতম স্তরটি হচ্ছে প্রেম। প্রেম হয় শুধু একজনের সঙ্গে। এ প্রসঙ্গে কেউ কেউ একাধিক প্রেমের কথা বলেন। কারো জীবনে একাধিকবার প্রেম আসতেই পারে। কিন্তু একই সঙ্গে একাধিক প্রেমে যারা বিশ্বাসী— সেই সম্পর্কগুলো অবশ্যই প্রেম নয়, অন্যকিছু। কারো কারো কাছে এটা নেশা বা খেলার বস্তু।
প্রেমে পড়ার কি কোনো বয়স আছে? এক কথায় এর জবাব হচ্ছে— ‘না’। একজন মানুষের ভেতর প্রেমের অনুভূতিগুলো যখন প্রথম জাগ্রত হয় কিংবা যখন সে এ ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠে; তখন থেকেই সে অবচেতন মনে নিজের প্রিয় মানুষটিকে খুঁজে বেড়ায়।
লাবণ্য’র সঙ্গে দেখা হওয়ার পর অমিত রায় বলছে, “সেই শৈশব থেকে সমস্ত দিন যেন অবচেতন মনে তোমার পায়ের শব্দ শুনে আসছি। মনে হয়েছে, কত অসম্ভব দূর থেকে যে আসছো —তার ঠিক নেই। শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছুলে তো আমার জীবনে।” (শেষের কবিতা/রবীন্দ্রনাথ)
অন্যদিকে কবিতায় যদি দেখি, বনলতা সেনের দেখা পাওয়ার জন্য হাজার বছর পথ হেঁটেছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। তিনি লিখেছেন- “হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে/সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে/অনেক ঘুরেছি আমি … /… দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন’?/পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।” (বনলতা সেন)
গ্রিক উপকথা অনুযায়ী, প্রেমের দেবী আফ্রোদিতির ছেলে কিউপিড যখন কাউকে লক্ষ্য করে তীর ছোঁড়েন বা কাউকে তীরবিদ্ধ করেন তখন ওই মানব কিংবা মানবীর ভেতর প্রেমের ক্রিয়া শুরু হয়। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, মানুষ যখন প্রেমে পড়ে, তখন সে একটা ঘোরের মধ্যে থাকে। এটাকে বলা হয় ‘অবসেশন পিরিয়ড”।
যে কোনো প্রেমের সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ বা দেখা হওয়াটা একটা জরুরী। ‘প্রথম দর্শনেই প্রেম’ বলে একটা কথা চালু আছে। তবে এটাকে ঠিক প্রেম বলা যায় না; এটা আসলে এক ধরনের মুগ্ধতা। আগেকার দিনে একজন আরেকজনকে না দেখে শুধু চিঠিপত্রের (পত্র-মিতালী) মাধ্যমে বা লেখালেখির সূত্র ধরে প্রেমে পড়েছেন— এমন নজির আছে। তবে এসব প্রেমের স্থায়িত্ব কিংবা পরিণতি বা সফলতার ইতিহাস খুব বেশি নয়।
প্রেমের ক্ষেত্রে দেখা হওয়াটা যেমন জরুরী , তেমনি প্রেমের বহিঃপ্রকাশ তথা ভালবাসার মানুষটিকে মনের কথাটা বলতে পারা কিংবা তাকে জানানোটাও খুব জরুরী। শুধু নিজের ভালবাসার কথাটি প্রিয়জনকে বলতে না পারার কারণে অতীতে বহু প্রেমের মৃত্যু ঘটেছে। এমন ঘটনা হয়তোবা এখনও ঘটছে।
প্রেমকে যেমন সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞায় ফেলা যায় না, তেমনি বিপরীত মানুষের নির্দিষ্ট একজনের প্রতি কেন আরেকজনের প্রবল আকর্ষণ— এরও কোনো সঠিক ব্যাখ্যা নেই।
কবি বলেছেন, “কেন তাকে ভালবাসি/এ প্রশ্নের মিলবে না কোনো সদুত্তর/এমন কোনো জাল নেই —যা দিয়ে আটকে রাখা যায় তাকে …”
একজন মানুষ কখন, কোথায় ও কীভাবে প্রেমে পড়বে এটা আগে থেকে কেউই বলতে পারে না। কখনো কখনো প্রেম হয়ে ওঠে মানুষের নিয়তি ও পরিণতি।
একজন মানুষ যখন প্রেমে পড়ে তখন তার চলার জীবনধারা বদলে যায়। প্রেম একক কোনো অনুভূতি নয়, অনেক অনুভূতির সমন্বয়ে প্রেম। প্রেমে যেমন বিশ্বাস, ভালোবাসা ও আস্থা থাকে, তেমনি হারানোর ভয় থাকে, থাকে ঈর্ষাও।
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় দেখি— কবি বলছেন, “সুরঞ্জনা ওই খানে যেয়ো নাকো তুমি/বলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে/কী কথা তাহার সাথে/তার সাথে…” (আকাশ লীনা)
আবার এমন ঘটনাও আছে, প্রেমে সফল হতে পারবে না জেনেও কেউ কেউ ভালোবাসে। এসব কারণে ‘একতরফা’ সম্পর্ককে ‘প্রেম’ বলতে অনেকেরই আপত্তি আছে। তাদের মতে, প্রেম কখনো একতরফা হয় না। ওটা আসলে ‘ভালোবাসা’, প্রেম নয়।
loading...
loading...
সব কিছুই যে ঠিক তা নয় কিছু বিষয় তো অন্য ভাবেও ভাবা যায় ,প্রতিটি মানুষ নিজের চিন্তা চেতণা বুদ্ধি বিবেক দিয়ে যেমন তার ভালোবাসা বা প্রেম প্রকাশ করে তেমনি প্রেম বা ভালোবাসা সঠিক সঙ্গা পাওয়াটাও কঠিন। একটি বিষয় একটু খটকা লাগলো ভালবাসা নিঃস্বার্থ ও শর্তহীন হতে পারেনা। অন্যদিকে সত্যিকারের প্রেম নিঃস্বার্থ ও নিঃশর্ত হয়।
আমার কাছে মনে হয় প্রেম বা ভালোবাসা দুটোতেই চাওয়া পাওয়া থাকে, নিঃস্বার্থ ও নিঃশর্ত বলে কিছু নেই, হয়তো চাওয়া পাওয়া সব ক্ষেত্রে পূরণ হয় না কিন্তু থাকবেই এবং আছে। নিঃস্বার্থ ও নিঃশর্ত কোন বিষয় শুধু পাগলেরই থাকে।
*** লেখা ভালো লাগলো ***
loading...
“একজন মানুষ কখন, কোথায় ও কীভাবে প্রেমে পড়বে এটা আগে থেকে কেউই বলতে পারে না। কখনো কখনো প্রেম হয়ে ওঠে মানুষের নিয়তি ও পরিণতি।
একজন মানুষ যখন প্রেমে পড়ে তখন তার চলার জীবনধারা বদলে যায়। প্রেম একক কোনো অনুভূতি নয়, অনেক অনুভূতির সমন্বয়ে প্রেম। প্রেমে যেমন বিশ্বাস, ভালোবাসা ও আস্থা থাকে, তেমনি হারানোর ভয় থাকে, থাকে ঈর্ষাও।”
___ অসাধারণ ব্যাখ্যায় পূর্ণ একটি নিবন্ধ। শুভেচ্ছা রইলো বন্ধু।
loading...
ভালবাসা নিঃস্বার্থ ও শর্তহীন হতে পারেনা। অন্যদিকে সত্যিকারের প্রেম নিঃস্বার্থ ও নিঃশর্ত হয়।
//আমারতো মনে হয় ব্যাপারটা পুরোই উল্টা। আর একবার ভেবে দেখতে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
অন্য সব ব্যাপারে একমত না হলেও উপস্হাপনা ভালো লেগেছে ।
loading...