টুকরো টাকরা
রোজকার মতোই মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে বাস স্ট্যান্ডে অনেক্ষণ দাঁড়ানোর পরে আমার গন্তব্যে যাবার বাসটি এলো। খুব বেশি ভীড় নেই। উঠেই জানলার পাশের সিটও পেয়ে গেলাম। পরের স্টপেজে এক মধ্যবয়স্কা ভদ্রমহিলা উঠলেন। বসলেন আমার পাশেই। ততক্ষণে আমি আমার অত্যন্ত প্রিয় লেখক পাওলো কোয়েলহোর ব্লগে ডুবে গেছি। আর বাসে চলছে “মেরা কুছ সামান্, তুমহারে পাস হ্যায়”। এই গানটা আমার অত্যন্ত প্রিয় গান। এই গানটির জন্য আমি আশাজির প্রেমে বারবার পড়ি। আর খেয়াল করছি পাশে বসা মহিলাও মাঝে মাঝে আমার মোবাইল স্ক্রিনে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন। হঠাৎ একটা আওয়াজ, তারপর আমাকে একটা হ্যাঁচকা টানে কেউ সরিয়ে নিলো। খেয়াল হল যখন, কাচ ভাঙার আওয়াজে। আমার কোলের মধ্যে টুকরো টুকরো কাচ। দুটো বাসের দৌড় প্রতিযোগিতায় ধাক্কা। বাসের যাত্রীরা কেউ ড্রাইভার কে মারতে যায় তো কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে, “আপনার কোথাও লাগে নি তো? আর একটু হলেই তো কাচ আপনার গলায় বসে যেতো”। আমার পাশের বসা মহিলা বলছেন “আমি দেখলাম উনি ভীষণ মন দিয়ে গল্প পড়ছেন, accident দেখেই আমি ওনাকে আমার দিকে টেনে নিই, নাহলে আজ ওনার অবধারিত মৃত্যু”। বাস কিছুক্ষণ পরে আবার চলতে শুরু করলো। কাচের টুকরো গুলো নীচে নামিয়ে রাখলাম। জানলার কাচ একেবারেই ভেঙেছে। পাশে বসা মহিলা আমায় বারবার জিজ্ঞেস করছেন কোথাও কেটেছে কিনা। না, কোথাও কাটেনি। জীবনদাত্রীকে ধন্যবাদ জানাতে নেই। হেসে বললাম আপনার জন্য এইযাত্রা বেঁচে গেলাম, একটু মিষ্টি মুখ হয়ে যাক, বলে ব্যাগ থেকে একটা চকলেট ওনাকে দিলাম। হাসতে হাসতে বাসের কিছু যাত্রীর সাথে শেয়ার করে খেলেন। না, আর গল্প পড়ায় মন বসাতে পারছিলাম না।
কখনোই কোন ডিপ্রেশন বা ট্রমা আমাকে ছুঁতে পারে না। জীবনের ক্ষেত্রে নিজের বানানো কিছু নিয়ম আমি মেনে চলি। কোনকিছুই আঁকড়ে ধরি না, হাতের মুঠি খোলাই রাখি, সাময়িক মন খারাপ হয় ঠিকই, তারপর আবার নতুন নিয়ম বানিয়ে নিই। আর ট্রমা! প্রিয় কবি আনা আখমাতোভার কবিতার মতোই বলতে হয় মৃত্যুকে যে কোন মুহুর্তে আলিঙ্গন করতে প্রস্তুত। নানা রকম চিন্তা এসে ভীড় করতে লাগলো মনে। বাসটা যে স্পীডে চলছিলো, কাচটা তীব্রবেগেই আমার গলায় নলি কেটে বেড়িয়ে যেতে পারতো। আর সাথে সাথেই আমার মৃত্যু। স্থানীয় কোন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হতো। স্থান হতো সেই হাসপাতালের মর্গে। আর যেটা হতো, আমার ব্যাগ থেকে মোবাইল চুরি, সিমকার্ড খুলে ফেলে দিতো, পার্সও চুরি হতো। তাই বাড়ির লোকজন জানতেও পারতো না কিছু। ছুটির পরে মেয়েটা স্কুলে অপেক্ষা করবে, জানতেও পারবে না ওর মা কোন হাসপাতালের মর্গে শুয়ে আছে। ফোনেও যোগাযোগ করতে পারবে না। শেষে মেয়েটা কেঁদে ফেলবে মাকে না দেখে। স্কুল থেকেই হয়তো বাড়িতে দিয়ে যাবে। বাড়ি এসে দাদা দিয়াকে ফোন করবে কাঁদতে কাঁদতে, “মা কি তোমাদের বাড়ি গেছে দিয়া? ” … আমার মা অস্থির হয়ে উঠবে, বাবা চিন্তায় পড়ে যাবে। দুজনেই অসুস্থ। তারপর হয়তো খুঁজে পাবে কোন এক মর্গে।বাড়ি ফিরে ভীষণ অস্থির লাগছিলো, কিছু কণ্ঠস্বর শুনতে ইচ্ছে করছিল। বাড়ি ফিরেই তাদের ফোন করলাম। প্রথমেই বাবাকে ফোন, বাবা ফোন রিসিভ করেই “কি রে তোর গলাটা এমন কাঁপছে কেন? কি হয়েছে?”
চিরকাল গুরুতর কিছু না হলে নিজেকে লুকিয়েই রাখি। বললাম “কই, কিছুতো হয়নি বাবা”। এমনিই ফোন করলাম, তুমি, মা কেমন আছো, … বাবার উত্তর সোমবার চলে আয়। বাবারা বুঝি এমনই হয়, ঠিক বুঝে যায় কিছু একটা হয়েছে। আরও একটা কণ্ঠ শুনতে ইচ্ছে করছিলো। অনেক অনুরোধ এর পরে দশ মিনিট কথা বলার সময় পেলাম। আর মেয়ের জন্য সারাদিন মন খারাপ হয়ে রইলো। আজ যদি আমার কিছু হতো, সবথেকে বেশী ক্ষতি হতো মেয়েটার। তারপর আমার বাবা, মা। আর কেউ নেই এই পৃথিবীতে আমার মৃত্যুতে যার ক্ষতি হবে।
যমদা, তোমার সাথে ডেটিং একটু তাড়াতাড়িই হয়ে যাচ্ছিলো আজ। কিন্তু একটা ইচ্ছে যে ভীষণ ভাবে লালন করি, মেয়েটাকে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে যাওয়া। আমি না থাকলে, আমার বাবা, মায়ের ওপরে ভীষণ চাপ পড়ে যাবে, এটা বোঝো না? আমার মেয়ের দায়িত্বটুকু আমাকে পালন করতে দাও। আর পাঁচ থেকে সাত বছর। তারপর তুমি এসো। হাসতে হাসতে তোমার সাথে অভিসারে যাবো যমদা। এতো উতলা হলে হয়? ততক্ষণ একটু ধৈর্য্য ধর প্লিজ।
loading...
loading...
হৃদয়ছোঁয়া লিখা। এমন লিখা বারবার পড়া যায় বন্ধু।
loading...
জীবনস্মৃতি। ভালো লেগেছে।
সবাই আপনাকে ভালোবাসে। শুধু একজন নয় কেন?
loading...
খুব সহজ স্বীকারোক্তিতে ও প্রাঞ্জল বর্ণনায় জীবন স্মৃতি । অসাধারণ কিন্তু মর্মপীড়াদায়ক দিদি । আর মাত্র পাঁচ থেকে সাত বছর নয় । দীর্ঘজীবি হোন । শুভকামনা আপনার জন্য ।
loading...