চকবন্দি চরাচর (৩)

দলে দলে গায়ে পড়া উপদেশদাতাদের অত্যাচারে, বাড়ির মানুষজন নিজেরা কোন আলাপ- আলোচনার সুযোগ পাচ্ছেনা। অথচ তা না হলে কার্যকরী কোন পদক্ষেপ নেওয়াও সম্ভব নয়।

আজ অসীমেশকে ছুটি নিতে বলা হয়েছিল। দুপুরে যে যেমন পারলো দুটি মুখে গুঁজে,বাইরের গেটে তালা দিয়ে আলোচনায় বসলো।

শুরু করলেন অসীমেশের দিদি। মায়ের মতো।শৈশবে মাতৃহারা অসীমেশ দিদির কাছেই মানুষ।
— আমি বলি কি অসীম, তুই কৃষ্ণাকে ঘরে তোল।

অসীমেশ মাথা নামিয়ে চুপ করে থাকেন।– উত্তর দেননা কোন। সেজদা বললেন,
— সে তো নিতেই হবে। কিন্তু কিভাবে কাজটা সুষ্ঠুভাবে করা যাবে, সেটা নিয়ে বরং ভাবো।

দিদি : ওদের দুজনকে ডেকে এনে আবার নতুন করে নারায়ন সাক্ষী রেখে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হোক।

সেজবৌদি : ঠিক এই কথাটাই আমি আগে রমাকে বলেছিলাম। বলেছিলাম আমার ওখানে, মানে চিত্তরঞ্জন থেকে ওদের বিয়ে দিয়ে দিতে, দায়িত্ব স-ব আমার। তো, রমা তো…

তাঁকে থামালেন সেজকর্তা :
–পুরনো কথা বাদ দাও তো। এখন আশু কর্তব্য স্থির করতে হবে। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে বড়।

অসীমেশ : নাহ্। এই স্টেজে এসে আর ওসব নারায়ন সাক্ষী – টাক্ষীর তামাশা করা যাবেনা।

দিদি : তামাশা বলছিস কেন? কিছু এমন দেরি হয়ে যায়নি। শুনতে পাচ্ছি তো এখনো ঘর ভাড়া পায়নি, সংসার পাতা হয়নি, তার আগেই যদি পারা যায়…..

অসীমেশ : তামাশা না করতে পারার আরো হাজারটা কারন আছে…..

দিদি : তুই জাতধর্মের কথা বলছিস তো! তো তাতে খুব কিছু আসে যায় না।অসবর্ণ বিয়ের বিধানও হিন্দুশাস্ত্রে রয়েছে……

অসীমেশ : বর্ণ কোথায়? বলো অসধর্ম….

দিদি : খুঁজলে তারও বিধেন পাওয়া যাবে। একটা ঘটনা ঘটবে মানুষের জীবনে, আর সেই সঙ্কটের সমাধান পাওয়া যাবে না শাস্ত্রে, তা কখনো হয়? তুই বরং কিছু শাস্ত্রীয় পন্ডিত- টন্ডিতের সঙ্গে…..

অসীমেশ : কোন্ শাস্ত্র? হিন্দু, না মুসলিম??

চুপ করে গেল সবাই। একপাশে রমা চোখে আঁচল চাপা দিয়ে কেঁদেই চলেছে নিঃশব্দে। গিরিবালা তাঁর হরিনামের ঝুলির ভেতর হাত ঢুকিয়ে জপমালা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নাম জপ করে চলেছেন। তাও নিঃশব্দে। মেয়েটার কীর্তিতে এই দুই মা-মেয়ের মুখের বুলি হ’রে গেছে এক্কেবারে। আপন- পর সবার চোখেই যেন একই কথা : “যেমন গাছ, তেমনি তো ফল হবে”।

সেজদা : আমাদের বাড়ির কাজ যখন, তখন হিন্দুশাস্ত্র অনুসারেই হবে।

অসীমেশ : কিন্তু কাজটা যাদের নিয়ে, তাদের একজন তো হিন্দু নয়। তাকে কি ভাবে হিন্দুশাস্ত্রের আওতায় আনা যাবে?

আবারও সবাই চুপ হয়ে গেল। ডাইনে- বাঁয়ে মাথা নাড়তে লাগলো অসীমেশ,… সমাধান সত্যি কিন্তু সহজ নয়। ভেবে দেখো তোমরা, কিভাবে সেই পরের ছেলেটাকে বলা যাবে, তোমার বাপ নেই, মা নেই, আত্মীয় – পরিজন – সমাজ- বন্ধু বলেও কেউ কোত্থাও নেই, আমার কন্যারত্নটিকে গ্রহন করার জন্য তুমি বাপু হিন্দু বনে যাও।…

কারুর মুখে কোন কথা নেই। অসীমেশই নাগাড়ে বলে যাচ্ছেন বুক হালকা করে,–
— এটা পিতৃতান্ত্রিক সমাজ। এখানে এখনো স্বামীর জাত-ধর্ম- কুল -পদবি সব স্ত্রীকে গ্রহন করতে হয়। কোন্ মুখে আমি ওর কাছে উলটোপুরাণ গাইবো? সমস্যাটা আমাদের, আর বলির পাঁঠা বানানো হবে ওকে? ধর্মের নামে এমন অধর্মে আমি নেই।….

কে -কি -কথা বা বলে! সব যেন জন্মবোবা সেজে বসে আছে।

….. তাহলে তোমরা সব গুরুজনেরা বরং আমায় অনুমতি দাও, আমিই সপরিবারে খ্রিষ্টান ধর্ম নিই। তখন বরং আমি বলতে পারার জায়গায় যেতে পারি যে, দ্যাখোবাবা-
তোমার জন্য আমরা খ্রিস্টান হয়েছি, এখন তুমিও খ্রিষ্টান হলে যথাবিহিতভাবে তোমাকে জামাই করে নিতে পারি।….

অসীমেশের শেষ বাক্যে আর চুপ থাকতে পারলো না তার সমবয়সী ভাগ্নে রঞ্জন,…….
..তুলে রাখো মামু তোমার ওসব বিপজ্জনক পরিকল্পনা। যাও বা বোনটার আমার স্বামী নিয়ে সুখী হবার সম্ভাবনা রয়েছে, ভেস্তে যাবে পুরো ব্যাপারটাই। না পাবে শ্বশুরবাড়ীর আশ্রয়, আর বাপের বাড়ির তো এই চিত্র।..

সবার সপ্রশ্ন চাউনির জবাবে রঞ্জন আরো খোলসা করলো বিষয়টা,…. তোমাদের তো কুয়োর বাইরে উঁকি মারারও দরকার পড়েনা, মেশোনি তো কখনো মুসলমান সমাজে। তাই বৃত্তের মধ্যে একজন মুসলমান পা রেখেছে কি ঘরগুষ্টি মিলে এমন ভাব দেখাচ্ছ যেন কীর্তনের আসরে আস্ত একটা ষাঁড় ঢুকে পড়েছে। ….ওরা কী বলে জানো? হিন্দুদের বাড়িতে খানাপিনায় আমাদের কোন বাধা নেই। কিন্তু খৃষ্টান বাড়ির খাদ্য আমাদের ধর্মনাশ করে দেয়। ওরা হারাম খায়– শুয়োর। এখন খৃষ্টান হলে তুমি তো দূরত্ব আরোই বাড়িয়ে দেবে গো!… তারচে বরং ধর্মটা ধর্মের জায়গায় থাক, ওটা সরিয়ে রেখে আমাদের মেয়ে – জামাইকে আমরা ঘরে তুলে নেবো। এনে সমস্ত আত্মীয় স্বজনকে ডেকে এনে স্রেফ একটা সত্যনারায়ণ।

এতক্ষনে, এই এতো এতো দিনের মৌনী ভেঙ্গে রমা বললো, — কিন্তু ওই পুজোর ব্যাপারে যদি ওদের আপত্তি থাকে?

….. নাগো মামী, না। আমাদের সত্যনারায়ণ আর ওদের সত্যপির, হলো গে টাকার এপিঠ -ওপিঠ। কথায় আছে, “হিন্দুর দেবতা হৈল মুসলমানের পির, দুই কুলে সেবা লয় হইয়া জাহির।”

তাঁর যে একহাতে কোরাণ, অন্যহাতে পুরাণ।

অসীমেশ : তোরা সেই ঘুরে ফিরে সত্যনারায়নেই এসে থামলি? গন্ডীর বাইরে বেরোনো খুব শক্ত, বল??

রঞ্জন: আাচ্ছা বেশ। ওদের নিয়ে তো আসি। তারপর দুপক্ষের আত্মীয়স্বজন নিয়ে না হয় একটা ওয়েডিং পার্টিই হবে’ খন। এবার তোমরা আর মুখ গোমড়া করে থেকোনা।

(আসবে আরো)
——————–

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৬ টি মন্তব্য (লেখকের ০টি) | ৬ জন মন্তব্যকারী

  1. কাজী রাশেদ : ১১-০৮-২০১৮ | ১০:১৬ |

    সুন্দর এক গল্প। মনের মধ্যে বাকীটা পড়ার জন্য একটা আগ্রহ থেকে গেলো

     

    GD Star Rating
    loading...
  2. রিয়া রিয়া : ১১-০৮-২০১৮ | ১০:১৮ |

    আরও খানিকটা পড়া হলো। অভিনন্দন দিদি ভাই। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
  3. মুরুব্বী : ১১-০৮-২০১৮ | ১১:২০ |

    পড়লাম বন্ধু। মনে করি এভাবেই প্রকাশিত হোক। ধন্যবাদ আপনাকে।

    GD Star Rating
    loading...
  4. ইলহাম : ১১-০৮-২০১৮ | ১২:৪৭ |

    “হিন্দুর দেবতা হৈল মুসলমানের পির, দুই কুলে সেবা লয় হইয়া জাহির।”

    তাঁর যে একহাতে কোরাণ, অন্যহাতে পুরাণ https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
  5. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ১১-০৮-২০১৮ | ২০:৩৯ |

    চলমান লিখাটির আগের পর্ব পড়েছি এবং অপেক্ষা রাখলাম পরের কিস্তির।

    GD Star Rating
    loading...
  6. রীতা রায় মিঠু : ১১-০৮-২০১৮ | ২২:০৫ |

    সংক্ষিপ্ত হলেও পড়ে চলেছি দিদি।

    GD Star Rating
    loading...