..
বিয়েরগানে জীবিকা সন্ধান (১)
______________________
গান কুড়োবার নেশায় জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টা পথে ছড়িয়ে এসেছি। তো, ওই নেশার খেই ধরেই একদিন পৌঁছে যাই মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জ – বালিঘাটায়। গলির গলি তস্য গলি দিয়ে, নবাবি আমলের পলেস্তরা- খসা, ইয়া মোটা মোটা দেওয়ালের মধ্যবর্তী ফাটলের মতো চুল-সরু রাস্তা ধরে পৌঁছে গেলাম আঞ্জুমানারা বেওয়ার কাছে। সতেরো বছর বয়েসে বিধবা হয়েছেন। পেটে তখন পাঁচ মাসের মেয়ে। স্বামী কিনু শেখ ‘বাংলা ইটভাটায়’ কাজ করতেন। মরে যেতেই আঞ্জুমানারা লোকের বাড়ির ঝি। তখনো রাইসমিল জন্ম নেয়নি। তাই,ধান সিজোনো, ধান শুকানো, ধান কোটা, চিঁড়ে কোটা, মুড়ি ভাজা– বিস্তর কাজ থাকত সম্পন্ন গেরস্তদের। সারাদিন পরের বাড়িতে খেটে বাড়ি ফিরে বিড়ি বাঁধতে বসতেন। বিড়ির কুলো কোলে করে বিড়ি পাকাতে পাকাতে তন্দ্রালু মাথা নেমে এসে ঠকাস্ করে পড়ত মশলার ওপোর। হেঁচে – কেশে একসা, কিন্তু ঘুৃম পালাত দুদ্দাড়। বেবশ চোখ জ্বেলে জ্বেলে এক হাজার বিড়ি বেঁধে মজুরি পেতেন চোদ্দ আনা( সেকালে)। …. “আল্লার কাছে কেতোই না ফরিয়াদ করিচি, হাজারে একটি ট্যাকা পাইয়ে দ্যাও গো আল্লা! হাতের আঙ্গুলের ডগাগুলান ক্ষইয়ে – টাটিয়ে বিষ হইয়ে গেলিউ একটি ট্যাকা আমরা প্যাতাম না, মা। সেই বিড়ি যেকুন এক টাকা হাজার হলো, পরানের খুশিতে গীদ্ বেঁধি আমরা বিয়ের আসরে গাইতে লাগলাম :
ট্যাকা হাজার ভাবনা কি আর
ঘরে বসি বেতন,
ওগো ডবকা ছুঁড়ি, পাকা বুড়ি
পয়সা কর উপায়জন (= উপার্জন)।
বিড়ির ব্যবসা ভাল, চলিত হইল
করো দিয়া মন,
ওলো ভাতারখাকি কপালপুড়ি
পয়সা করো উপায়জন।
চুলোশালে আখার উবরি (= উনুনের ওপর)
চাপিয়ে দিয়ে ভাত,
শাউড়ি-বৌয়ে যুক্তি করি
কাটবা বিড়ির পাত্।
ঘরের ছেলেপিলে জুটিয়ে লিয়ে
বাঁধো বিড়ি ময়না,
হাজার বিড়ি ষোল আনায়
এমুন সুযুগ হয়না।
ঘরের ইজ্জত ঘরে রইবে
ঘরেই বসি বেতন,
বিড়ির ব্যবসা ভাল, চলিত্ হইলো
করোগো দিয়া মন।……..
আঞ্জুমানারার গোটা জীবনটাই অনাথ জীবন। বাপ মরেছে বারো বছরে, স্বামী মরেছে সতেরো বছরে, একমাত্র ভাইয়ের আয়ু তিরিশ বছর। প্রাণে বাঁচতে কতরকম পেশাতেই যে হাত পাকিয়েছে সে! লোকের বাড়ির হরেক কাজ ছাড়াও করেছে কাঁচা সবজি কেনাবেচা,রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ, বিড়ি বাঁধা, তালাই – পাখা বোনা, এবং পাট উঠলে পাট কাচার কাজ। পাট কাচার কাজটি স্মরণে আসতেই পেট গুলিয়ে ওঠে আঞ্জুর। বললেন কাচতে কাচতে পচা দুর্গন্ধে হড়হড় করে বমি করতেন। ঘরে ফিরে উপোষ দিতেন। মুখে রুচতোনা কিছু বলে আগে খেয়ে তবে পাট কাচতে যেতেন। তো, খাদ্যের সদগতি সেই পাটপচা জলে।……
…… কথা বলতে বলতেই হঠাৎই আচমকা উল্টো করে আঁচড়ানো নিজের মাথার সামনেকার চুল দুহাত চেপে ফাঁপিয়ে আনলেন,—- স-ব কাজ করিচি মা, কিন্তুক্ এই ষাট বছর বয়েস হল, ই- গাঁ উ- গাঁ করে কেউ একটা বলুগ তো দিকি যে, মীরার (ওঁর মেয়ে) মায়ের কখুনো কুনো বেচাল দেকেচে! হাজার চাপ দিলিউ আমার সিঁথে ফাটবে না মা। কখুনো আরশি সামনে ধরিনি। সতেরো বছর বয়েস থেকিই মা থান পিঁদে আছি। কাউরির মুরোদ হয়নি আমার পানে হালকা চালে চায়।……
আশপাশের প্রত্যেকে সমর্থন করল সে কথা।
…… আমি মা আট পহর চব্বিশ ঘন্টা গতরপাত করিছি মেয়ের জন্যি, কিন্তুক হার মানিনি কক্ষুনো। না খেয়ি প্যাটে গামছা বেঁধি থেকিচি, কিন্তুক কাউরির কাচে হাত পাতিনি কখুনো, এক কাপ চা – ও কখুনো মেগে খাইনি।… আজ আমার বিটি সব্বোসুখি, ভাইপোকে জামাই করিচি, সে মা আল্লার দোয়ায় বিড়ির কারখানার ব্যাবসা দেকে।….
খানিক দম নিয়ে আঞ্জু আবারও বাঙ্ময় :
… আর আমার মা এমুনি তকদির, যে মানুষটাই আমার পানে আহা- উহু করে চেয়েছে, অমনি আমি তার কল্ল্যা (= মাথা) চিবিইচি রাক্কুসি হইয়ে। বাপ- ভাই – সোয়ামীর কতা তো শুনলে, আমার জানের জান ভাবীজান– আমার গীতের জুটি বিয়ান, সেউ আমারে ছেড়ি গেল এই তিন বচ্ছর হল। কাকে নিয়ে আমি এখুন গীতের আসর জমাই, বলো দিনি! আমি হতাম শাম, তো সে হতো রাধা। আমি মজনু, তো সে লাইলা। আমি রাজা, তো সে রাণী। সে তো শুধুই আমার বিটির শাউড়ি লয়,আমার চেরডা কালের সখি। অকালে ভাই চলে যেতে ওই ভাবীই এতোডা কাল আমার মাথায় ছাতা হইয়ে ডেঁইরে ছেলো। আমার গলায় আর গীদ তেমুন আসেনা, মা।….
তবু আমাদের পিড়াপিড়িতে একটা ‘কাপ্’
করে দেখালেন :
ছাগল চরাইতে গ্যেলাম
কাঁকল নদীর ধারে মা,
মা আমার বিহা দিলি না। ( ধুয়া)
ছাগল- চরা পয়সা গুলা
এগলা বসি খেলি মা,
মা আমার বিহা দিলি না।
হাঁকুকু– হাঁকুকু
বাজনা এলো দ্যাশেতে,
মা আমার বিহা দিলি না।
ও মোড়ল ভাই, ও মোড়ল ভাই
আমার ছাগল ছাড়ো না,
মা কেনে বিহা দিলি না।
উ পাড়ার শোভান শ্যেখ
আমার পথ তো ছাড়ে না,
মা কেনে বিহা দিলি না…
শেষ হতেই আবার আক্ষেপ ভাবী – সখি- বেয়ান এলাতান বেওয়ার জন্যে….. আর আমার গলায় তেমুন সুর খেলেনি গো…. অবশ্য আক্ষেপ করতে করতেই নতুন আর এক গানে আবারও দাপুটে সুর অনায়াস খেলা করতে শুরু করেছে আঞ্জুমানারা বেওয়ার মহার্ঘ গলায়।
সংক্ষেপিত। খুব তাড়াতাড়ি দ্বিতীয় পর্ব আসবে।
________________________________
( গানটি “মেয়েদের কথাকল্প” বইতে গ্রন্থিত হয়েছে। এ ছাড়াও সন্ধ্যা ৬:৪৫ মি: এ একাডেমী অফ ফাইন আর্টস্ এ শুনতে পাবেন থিয়েটার ওয়ার্কশপের নাটক “বিয়ে গাউনি কাঁদন চাপা”তে।)
________________________________
বিয়েরগানে জীবিকা সন্ধান এর প্রথম খণ্ড পড়ে নিলাম। যেভাবে লিখাটি শুরু হয়েছে তাতে আমি বিশ্বাস করি … বাংলা সংস্কৃতির অপ্রচলিত সত্য যে দিকটি দৃশ্যমান না হলেও আমাদের আশেপাশেই বিরাজ করছে; তার সফল এক চিত্রের দেখা পাবো। ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ
বাস্তব প্রতিচ্ছবি। গ্রামীন জীবনের সরলতা ও শহর জীবনের জটিলতার সমন্বয়ে দারুণভাবে প্রকাশিত হয়েছে বিয়ের গান। আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে নতুনত্ব আনয়নে এবং অপসংস্কৃতি দূরীকরণে নিঃসন্দেহে বিপ্লব সাধন করবে।
আপনার মন্তব্যে প্রাণিত হলাম।
ইন্টারেস্টিং বিষয় দিদি ভাই। শেখার বিশেষ কিছু আছে। টুকে রাখলাম। নমষ্কার।
ভালবাসা।