বিয়ের গানে জীবিকা সন্ধান (৩)

বিয়ের গানে জীবিকা সন্ধান (১)
বিয়ের গানে জীবিকা সন্ধান (২)
বিয়ের গানে জীবিকা সন্ধান (৩)
___________________

জেনেনা জগতের কথা যখন, বিশেষে এই উপমহাদেশের বাংলাভাষী মেয়েদের, তখন ‘বিবাহ’ বা কথ্যে বিয়েকে তো অন্যতম জীবিকা হিসাবে মান্যতা দিতে আমরা বাধ্য। বিভিন্ন জায়গায় তথ্য জানাবার ফর্মে তো লিখতেও হয়, পেশা- গৃহকর্ম বা গৃহস্থালি। ইদানীং ওই একই ব্যাপারকে একটু এদিক ওদিক করে বলার রেওয়াজ হয়েছে ‘হোম মেকার’। তো, তেমনি এক হোম-মেকারের বৃত্তান্ত আজ।

নাম : গোলেমান বিবি
বয়েস : ৪৫ বছর
ঠিকানা : বর্তমানে নির্দিষ্ট কিছু নেই, তবে
আদত বর্ধমান জেলার মেয়ে।
স্বামীর নাম : ??
…..যাঃ ব্বাবা! কি গো পতি পরম গুরুর নাম মুখে আনবে না নাকি!

আর দুয়েকবার একটু বেশ চেপেচুপে
জিজ্ঞেস করতেই টুক্ করে খুলে দিল চোয়ালের খিল :
…. কোনডার নাম এগুতে বলবো?

আমার থতমত ভাব তুড়িতে উড়িয়ে দিয়ে আবারো তুবড়ি ছোটালো :
…..বাপ বিহা দেছেলো বারো বছরে ( ভাত – কাপড়ের অনুষ্ঠান বাঙালী মুসলমানদেরও একই ভাবে হয়, অর্থাৎ কিনা মেয়ের জীবন ও জীবিকা নিশ্চিত হলো)। নেকা জানিনা, পড়া জানিনা,ঘর জানিনা, পর জানিনা, শুদু ‘মা’ জানি, আর পোড়ার প্যাট জানি। পোঁদের কাপড় তুলি মাতায় দিয়ি ভাসুর- শ্বশুরকে শরম দ্যাকাই। নাকে শিগনি ঝরা বয়েস, ড্যানা ধরি বিড়াল – পার করি দেল সোদর বাপ – মায়ে ( বাবা – মা তো কোন ভাবেই মেয়ের সহোদর হতে পারেনা,অত্যন্ত নিকট ও রক্তের সম্পর্ক বোঝাতে গাঁ – ঘরের মেয়েরা সোদর কথাটা ব্যবহার করে। রক্তের সম্বন্ধও লাগে না, খুব পরিচিত পছন্দের মানুষজনকেও গুরুত্ব দিতে সোদর সম্ভাষণ করে। আমরা যখন তৃতীয়বার গেছি, আমাদের আহ্বান করলো, … এসো বুবু এসো, আমার সোদর এসো….)। তো, সেই ভাতার মিনসে আমার থেকি বিশ বছরকার বড়ো। আগের দু- দুটো বিবি ভাত খায়নে ( অর্থ নিজেরা স্বামীত্যাগ করেছে। আর স্বামী যদি বৌকে ত্যাগ করে, তখন বলা হবে – ভাত দ্যায়নে), পেলিয়েছে। ধুমসো ধুমসো ব্যাটা- বিটিরা মন হলিই কিল- চড় কষায় আমারে। তেবু, স-ব সয়ি ভাত খেয়িছি পাঁচটি বচ্ছর। নিত্যি রেতে পালা করি তিন ভেয়েতে মিলে ধাসতো মোরে। একজন যেখুন ধাসতো,আর দুজনায় পাহারা দেতো। আর, ওই দিশ্য দেকতি দেকতি নিজেদের শরীল গরম করতো। ন্যাংটো হয়ি জাং দোলাতো। গরম হয়ি শক্ত হলিই ফের ঝাঁপাতো। বুবু গো,
‘ফর্দাফাঁই’ হয়ি ছিঁড়ি যেতো মোর ‘অস্থানের শরীল’। ওই করি করি পাঁচ বছরে ছ’টা ছেলে। কে যে কার বাপ আমি লিজেও বুজিনি। তেখুন আমার এমুনি দুদ্দশা যে একটো কাগ পেলিউ তারে ধরে উড়ি পড়ি।”……

সামান্য দম্ নেয়। নিয়ে আবারও বেদম হয়ে পড়লো গোলেমান।…. পাথরচাপুরির একটো ফকির ভিক্ করতি আসতো ওই গাঁয়ে, আর তদ্দিনে আমি পুরুষের বদ নজর চিনায় এসপাট্।…. তো, দিনে-দুপুরে
তার সাথে এক বস্তরে বেইরে গ্যেলাম। দুপুর ভোর ঘর- গেরস্তি ঘুমে কাদা। রেতে তো আবার তিন মরদের পাহারা। তো, সেই ফকিরই আমার পেত্থম প্রেম বলো, আর ভাব- ভালবাসা বলো, স-ব। সবই। কিন্তুক উ ফকিরও তো বুবু( =দিদি) বিটাছেলে। পুরুষ জেতের কখুনো এক মেয়েমানষে শানায়? আর, আমি যেতি আমার বিছেনে নোংরা কাজ সইতিই পারবো, তালি কলমা পড়া ভাতার ছেড়ি আশমানের নিচোয় বিছেন্ পাড়ি কখুনো? …..
বড়ো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, কেমন একটা হারিয়ে যাওয়া অবসন্ন গলায় বলতে থাকলো গোলেমান,… আমি ফিরেফিট্টি বুবু আবারও শ্যাষম্যাশ ওই না- হিল্লে হয়ি ভেসি বেড়াতি লাগলাম। তারপর থে, আজ মাছ বেচি – তো কাল শাগ বেচি। পরশু চাল বেলাক্ করি- তো তরশু শুঁকটি বেচতে বেরুই। তা যিখানিই যাই না কেনে বুবু, —-
থিতোবার সুযুগ পাইনে। কেউ না কেউ আমায় ঠিলে বার করবেই- করবে :

কালা বেরুলি বেরুলি ভত্তি দুকুর বেলা,
কালারে, তুই আমার গলার মালা—– (ধুয়া)
কালা তুর লেগে ঘর ছাড়লাম ওরে,
কালারে, তুই
আমার গলার মালা।
কালা বাপের ঘর, ভেয়ের ঘর,ভাতার ঘরে
তালা,

কালারে, তুই আমার গলার মালা।
কালা শাগ তুলে বেচতে গেলাম নতুনহাটের
মেলা,
কালারে, আমার গলার মালা।
কালা নতুনহাটের মেলায় খেলাম
ব্যপারীদের ঠ্যালা,
কালারে, তুই আমার গলার মালা।

কালা শুঁকটি লিয়ে বেচতে গ্যেলাম
মঙ্গলকোটের মেলা,
কালারে, তুই আমার গলার মালা।
কালা, মঙ্গলকোটের মেলায় খেলাম
পাইকেরদের ঠ্যালা,
কালারে, তুই আমার গলার মালা।

কালা বেতের ঝুরি লিয়ে গ্যেলাম
সদরঘাটের মেলা,
সদরঘাটের মেলায় খেলাম
মদোমাতালের ঠ্যালা,
কালারে, তুই আমার গলার মালা।

কালা আন্ডা লিয়ে বেচতে গ্যেলাম
বিজয়রামের মেলা,
কালা বিজয়রামের মেলায় খেলাম
বুড়োমিনষের ঠ্যালা,
কালারে, তুই আমার গলার মালা

কালা ডিংলি লিয়ে বেচতে গ্যেলাম
নবাবহাটের মেলা,
কালারে, তুই আমার গলার মালা,
কালা, নবাবহাটের মেলায় খেলাম
লালুস্টিদের ঠ্যালা,
কালারে, তুই আমার গলার মালা।

কালা তোর লেগে ঘর ছেড়ে এ্যলাম
তিন সন্ধে বেলা,
কালারে, তুই আমার গলার মালা
কালা, কুন্ দোষেতে ছেড়ে গেলি
জান্ করলি আলাছালা,
কালারে, তুই আমার গলার মালা।

কালা, তুর লেগে মাথা দুবো
চলতি রেলের তলা,
কালারে, তুই আমার গলার মালা।
কালা, তুর লেগে গলায় লুবো
কেস্তে, ছুরির ফলা,
কালারে, তুই আমার গলার মালা।
কালা, তুর লেগে ডুবে মরবো
অস্তদিঘীর তলা,
কালারে, তুই আমার গলার মালা।….

……খানিক দম নিয়ে, যন্ত্রণা -জর্জর গলায়
স্বগতোক্তি করে,…. তা বুবু, ই পুড়া প্যাটটোর লেগে কি কামই না ক্যরলাম বুবু, তাউ ই খবিশ প্যাটটো পুরতে জানেনা। স্বভাব ইচ্ছেয় কক্ষুনো কারুক্কে শরীল দেই নি বুবু। কিন্তুক মিছা বলবোনা বুবু, ভাত অভাবে আমার সে দ্যেমাক ও আর রইলোনি। তিনদিন — চারদিন — সিরিফ্ পানি পিয়ে পিয়ে যেখুন নিমতিতা পিত্তিপানি বেরোয় গলা দিয়ি, প্যেটের আঁতুড়ি বেইরে আসতি চায় উপবান( বমি) হয়ি,প্যেটের ভিতরি গরম আগুন লকলক্ করি জ্বলতি থাকে,বুবুগো ত্যেখুন, মিছা বলইবু না, আমার সতীয়ালী ছুঁচিবাইগিরি ওই দূর আকাশে কপ্পুর হয়ি মিলোয়ে যায়।..

… জানিনা কখন, ক-বেই, কোন্ নিশ্ছিদ্র তমসায় ডুবে গেছি। হাতে ধরে সাড় – এ ফিরিয়ে আনলো গোলেমানই।…..

…….. স- ব কাম নেড়ি- চেড়ি – করি – দেকি
এক্কেরে ‘সিদ্দোপিট’ বনি গেয়ি আমি বুবুু এখুন মেরাসিনী- গীদ্ গাউনীর দল গড়িচি।

…….. তা আয়- পত্তর হয় কেমন?

……..খেয়ি – পরি টিঁকে তো আছি বুবু। শরীল দিতি হয়নে কারুক্কে। দশ – বিশটা গাঁয়ের মানুষ কদর করে। আগাম করি বায়না দেয় গীদ্ গাবার। ই- দ্যাশ উ- দ্যাশ ঘুরি বেড়াই ঢোলটো বগলে লিয়ি। আর, তার চাইতিউ বড়ো বেত্তান্ত কি জানো বুবু,
আমার লিজস্ব একটো নাম হইয়েছে। আর অমুকের বেটি, তমুকের বিবি, ফলনার মা লয়কো। এক ডাকেই তল্লাটের প্রেত্যিকিই চিনে আমারে, ‘গোলেমান গীদ্ গাউনি।’ তুমাদের মা- বাপের দোয়াতে বুবু, এই গোলেমান বিবির মেরাসিনী দলে নয়- নয় করে বাইশটা মেয়ে গীদ্ গায়। তাদের লিয়িই আমি চাঁদের হাটে এই বেশ আছি। বুবুগো, এখুন গোলেমালে গোলেমালে পিরীত না করিউ, প্যাট আমার দিব্যি চলে যায়।……

…. আমি হাবার মতো স্থাণু হয়ে বসে থাকলাম। গলা অনেক -অনেকক্ষণ শব্দ বার করতে ভুলে বসে রইলো।
_______________

..

( সাক্ষাতকারটি ‘ নতুন চিঠি ‘ ৩৩ বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত )

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৮ টি মন্তব্য (লেখকের ৪টি) | ৪ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০৩-০৭-২০১৮ | ১৩:৪০ |

    নিঃসন্দেহে অসাধারণ একটি ফিচার। তিনটি খণ্ড পেরুলো। সব কয়টি খণ্ড শব্দনীড় এর আর্কাইভে সম্মান হয়ে থাকবে। ধন্যবাদ বন্ধু। অনেক অনেক ভালো থাকুন। 

    GD Star Rating
    loading...
  2. রিয়া রিয়া : ০৩-০৭-২০১৮ | ১৪:২১ |

    মুরুব্বী বন্ধু ঠিক কথা বলেছেন। মৌলিক এই লেখা সমূহ শব্দনীড় এর অলঙ্কার হয়ে থাকবে। নমষ্কার দিদি ভাই। অসাধারণ লেখা।

    GD Star Rating
    loading...
  3. সাইদুর রহমান১ : ০৩-০৭-২০১৮ | ১৭:০০ |

    প্রথম পর্বটি পড়ে নিলাম। পরবতী পর্বগুলোর আশায় রইলাম।

    GD Star Rating
    loading...
  4. ইলহাম : ০৩-০৭-২০১৮ | ১৯:৪৩ |

    নমষ্কার দিদি! আপনার এই লেখা শব্দনীড়ের অলঙ্কার!https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

    GD Star Rating
    loading...
  5. রত্না রশীদ ব্যানার্জী : ০৪-০৭-২০১৮ | ১২:০১ |

    ধন্যবাদ ।

    GD Star Rating
    loading...