অনুপমা যখন হাঁক ডাক করে অস্থির হয়ে যাচ্ছিলো তখন আমি ছিলাম স্বপ্নের ঘোরে। সেই স্বপ্নের ঘোরে আমি যেন ফিরে পেলাম আমার হারানো অতীত। যাকে আমি সযতনে পাথর চাপা দিয়ে রেখেছি দীর্ঘ অনেকগুলো বছর। যাকে আমি ভুলতে চেয়েছিলাম অনেক যত্ন করে। মাঝে মাঝে কোন কোন স্মৃতি ফিরে এলে বিব্রত হতে হয়, হৃদয় আহত হয়। আমিও তেমনি আহত হলাম আবারো। কিন্তু অতীতকে কি করে অস্বীকার করবো?
সাল তারিখ কত ছিল ঠিকঠাক মনে নেই এই মুহুর্তে, তবে ঘটনাগুলো একে একে মনে পড়ে গেলো স্পষ্ট। যেন কোন চলচ্চিত্রের ভাসমান চিত্রকথা।
আমাদের পরিবারটি ছিলো গতানুগতিক মধ্যবিত্ত পরিবার। যা উপার্জন তার বেশি ব্যয়। বাবার ছিলো প্রাইভেট কোম্পানির চাকরি। বেতন যা পান তাতে সংসার চলে না। মায়ের নিত্য ঘ্যানঘ্যান ,ঝগড়া ঝাটি চলতেই থাকে। নানান অশান্তিতে নিমজ্জিত পরিবার। মাঝে মাঝে মনে হয় এই পরিবার থেকে দূরে চলে যেতে পারলে ভালো হতো। তবে কখনোই চলে যাওয়া হয় না অবশ্য। কি এক অদৃশ্য টানে দিন শেষে ফিরে আসতাম বার বার।
বড় দুই বোনের বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। আমার লেখাপড়ার খরচ। বোনেদেরও লেখা পড়ার খরচ আছে। মায়ের ওষুধ বাবার চোখের চিকিৎসা খরচ। সাথে সংসারের খরচ তো আছেই। কি এক তালগোল অবস্থা। নুন আনতে পানতা ফুরায় আরকি।
তখন আমি বিয়ে অনার্সএ পড়ি। পড়াশোনার ফাঁকে কটা টিউশনি করি। এই সল্প টাকা থেকে আবার মাকে কিছু টাকা দেই আর নিজের বাজে খরচের জন্য রাখি বাকি টাকা। সেখান থেকে বোনেরা আবার কিছু ভাগ বসায়। আমিও না দিয়ে পারি না। হাজার হলেও বোন, ওদেরও চাওয়া পাওয়ার জগতটা অত্যন্ত সীমিত। অল্পতে খুশী থাকে সবসময়। খুব লক্ষী টাইপের মেয়ে। কিছু চাইলে আমি না করি না একটু আবদার মেটাই। অভাবের সংসারে তাদের কোন বায়না বা আবদার কোন দিনই পূরণ হয় না তেমন একটা।
এসবের মধ্যে মা প্রায় ঘ্যান ঘ্যান করে, একটা চাকরি বাকরি জুটাতে পারি কিনা। কিন্তু লেখাপড়া শেষ করাটা আমার জন্য জরুরী। মাকে সেটা বোঝালে ও মানতে চান না কিছুতেই। সংসারের হাল ধরতে তাগাদা দেন বারবার। অনুযোগের সুরে বলেন বাবার সাথে ঝগড়াঝাটি করতে করতে তিনিও ক্লান্ত, তিনি আর পারছেন না। আমার অনেক দায় দায়িত্ব আছে। বোনেদের বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে। আমার উচিত সংসারের হাল ধরা ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি শুনি আর অসহায় বোধ করি। দুচোখে অন্ধকার দেখি। মানুষের জীবনটা এতো কঠিন কেন? কেন এতো অভাব। এসব ভেবে ভেবে মাঝে মাঝে মাথা ধরে যায়। কুল ও পাই না সমাধান ও পাই না। অতিরিক্ত চিন্তায় পড়াশোনায় মন বসানো দায় যেতে লাগলো।
যাহোক নানা ঝামেলার মধ্যেও আমার পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলো। পরীক্ষাটাও মোটামুটি ভালো দিলাম। কিছুটা অবসর সময় এলো আমার জীবনে এবং হঠাৎ করে আশ্চর্য সুন্দর এক মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লাম।
মেয়েটির নাম সুলেখা। একদিন পার্কে বসে আছে একা একা সে। কেন বসে আছে তা অবশ্য জানিনা, কিন্তু কিছু উটকো ছেলে বিভিন্ন কমেন্ট করছে তাকে নিয়ে। সেটি আমার নজর এড়ালো না। মেয়েটি বেশ ভয় পাচ্ছে বোঝা গেলো। সময়টা যদিও বিকেল। আমি কি মনে করে এগিয়ে গেলাম। জানতে চাইলাম কেমন আছেন? এমনটা কেন করলাম নিজেই জানিনা। যদিও মেয়েটির আমার পূর্ব পরিচিত নয় তবু কেন যেন সানন্দে সাড়া দিলো পাশে বসতে আহ্বান করলো। উটকো ছেলেগুলো কেটে পড়লো শিঘ্রী। আমি চলে আসতে উদ্যত হলে মেয়েটি বললো চলে যাচ্ছেন যে বসুন। আজ আপনি আমার অনেক উপকার করলেন। সেই শুরু…..।
ইদানিং নিজের কাজ হয়ে গেলেও আমি কখনোই ঠিক সময়ে বাসায় যাই না। এদিক ওদিক থাকি। বিশেষ করে বাসার কাছাকাছি পার্কটাতে বসে সময় কাটাই না হয় গল্পের বই পড়ি। মায়ের ঘ্যান ঘ্যান অসহ্য মাত্রায় বেড়েছে।
সুলেখাও ও আমার মতো অভাবী পরিবারের। সৎবাবার সংসারে থাকে। অনেকগুলো ভাইবোন। বাবার বাজে ব্যবহার। তার নানা কষ্টের কাহিনী আমি শুনি আর আপ্লুত হই তার দুঃখ কষ্টে। আস্তে আস্তে তার প্রতি এক গভীর মমতা অনুভব করতে লাগলাম। তাকে না দেখলে। কথা না বললে মনের মধ্যে একটা অস্থিরতা অনুভব করলাম। তাকে নিয়ে নানা দুঃচিন্তা হতে লাগলো। তাকে ছাড়া অন্য সময়গুলোতে কিছু ভালো লাগতো না। কেন এমন হতো কে জানে? একে কি প্রেম বলে?
আমার মধ্যে উলটাপালটা কি জানি কি দেখলো জানি না। মায়ের ঘ্যান ঘ্যান আরো বেড়ে গেলো। বাসার পরিবেশ ক্রমশ আরো অসহ্য হয়ে উঠলো। আমাদের অবাক করে দিয়ে এর মধ্যে বড় বোন অজানা অচেনা এক ছেলের হাত ধরে পালিয়ে গেল। পাড়া প্রতিবেশিরা আমাদের প্রায় এক ঘরে করে দিলো। নানা কথা শোনাতে লাগলো উঠতে বসতে।নরকের মতো পরিবেশ তৈরি হলো বাসায়।
তারপরেও ভালোই চলছিলো একরকম যদিও মায়ের কানে আমার প্রেমের কথা পৌছে গেছে ইতিমধ্যে কিন্তু আমি ডোন্ট কেয়ার টাইপের ভাব দেখাই। এত সাহস কোথায় পেলাম জানিনা। সবকিছু সরাসরি অস্বীকার করি। আমি খুব খেয়াল করে দেখেছি আমার কপালে কোন সুখ স্থায়ী হয় না। কোন ভালো আমার জীবনে থাকে না। পোড়া কপাল আর যাকে বলে।
এবারও আমার এই ছোট্ট সুখটুকু স্থায়ী হলো না। এক সকালে সুলেখা জানালো তার বিয়ে ঠিক করেছে তার সৎবাবা। পাত্র বেশ বড় ব্যবসায়ী। আমি তো চিন্তায় পড়ে গেলাম। পালিয়ে বিয়ে করবো সে সাহস বা যোগ্যতা আমার নাই। আবার বাড়িতে এসেও দেখলাম আরেকটি দুঃসংবাদ আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম।
দুপুরে ভাত খেতে বসেছি যথারীতি মা খাবার বেড়ে দিতে লাগলেন। আমি মুখ বুজে প্রতিদিনকার মতো খাচ্ছি কারণ মায়ের সাথে ইদানিং আমার সম্পর্ক ভালো না। তাই আমি মায়ের সাথে খুব প্রয়োজন ছাড়া কথা বলি না। মা ই একতরফা ঘ্যান ঘ্যান করেন। আমি আগে মুখ চালালেও এখন আর কোন উত্তর দেই না খানিকটা গা সওয়া হয়ে গেছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো মা আজ আর কোন ঘ্যান ঘ্যান করছে না। খুবই মিষ্টি স্বরে কথা বলছেন। আরো অবাক হয়ে দেখলাম আমার প্রিয় সব তরকারী রান্না হয়েছে। মায়ের মন ভালো দেখে আমি সাহস করে বললাম,বাসায় কি কেউ আসবে?
– না কেন?
-এতো রকম রেধেছো?
-বাহ আমি কি তোর জন্য একটু ভালো কিছু রাঁধতে পারিনা! আমি এতোই খারাপ।
-সে কথা বলছি না মা। অনেকগুলো টাকা খরচ করলে তো তাই মাসের শেষ।
-আজ তোর জন্মদিন। মনে আছে?
-ও তাই বুঝি এতো আয়োজন।
-তোরা মনে করিস আমি তোদের কোন খেয়াল খবর রাখিনা। তোদের প্রতি আমার কোন দায় দায়িত্ব নাই। আমি তোদের দেখতে পারিনা। সেই একজন তো কার না কার হাত ধরে কেটে উঠলো, একবারো আমদের কথা ভাবলো না। আমাদের সম্মানের কথা ভাবলো না। মানুষ এখন যা নয় তাই বলাবলি করে। আমার আর ভালো লাগে না। এই সংসার আমার কাছে বিষের মতো। শুধু অভাব আর অভাব। তোর কবে যে একটা চাকরি হবে সেদিন যদি একটু অভাবটা কমে। মায়ের চোখ ভিজে আসে। মায়ের কথায় আমার ও মনটা হু হু করে ওঠে।
– আমি চেষ্টা করছি মা।
-খোকা, আমি বলি কি আমার একটা কথা ছিলো। তুই যদি আমার একটা কথা মানিস।
-কি কথা?
-আমি তো সব বুঝি তোর একটা চাকরি দরকার। বিয়ের বয়সও হয়ে গেছে। ঘরে এখনো একটা বোন, তোর চাইতে আমার চিন্তা বেশি। তোর জন্য একটা ভালো প্রস্তাব আসছে। খুব ভালো প্রস্তাব। তোর চাকরি বিয়ে ছোটবোনের বিয়ে সব সমাধান হয়ে যাবে। যদি তুই হ্যাঁ বলিস।
আমার লজ্জা পাওয়া উচিত কিন্তু আমি লজ্জা পেলাম না। জানতে চাইলাম কে প্রস্তাব দিলো্।
–তুই কি আমার কথা শুনবি? তুই নাকি কার সাথে ঘুরে বেড়াস। এক চোখ না অনেক চোখেই দেখেছে। একজন বললে আমি বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু এতজনের কথা অবিশ্বাস করবো কেমন করে।
-মা সুলেখা খুব ভালো মেয়ে।
আমি এক দমে বলে ফেললাম। আমি জানি এখন না বললে আর কোনদিন বলতে পারবো না।
মা আমার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে রইলো। তার মুখে একরাশ হতাশা ও অসহায়ত্বের ছাপ স্পষ্ট। মাকে কোনদিন এমন রূপে আমি দেখিনি। আমি খানিকটা ভয় পেয়ে গেলাম। মা মুখ শক্ত করে বলল,
-তুই যদি অন্য কোন চিন্তা মাথায় আনিস তবে আমি বিষ খাবো। বিষ আনিয়ে রাখছি।
মায়ের কথায় আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমার গা হাত পা কাঁপতে লাগলো।
loading...
loading...
শেষে এসে যেন শক্ খেলাম। তারপরও জীবন সংশ্লিষ্ট অণুগল্পটি ভালো লিখেছেন মি. ইসিয়াক। এমনি করেই শব্দনীড়ের পাশে থাকুন, আমাদের ভালো লাগবে। ধন্যবাদ।
loading...