খাগড়াছড়ি ভ্রমণ – আলুটিলা গুহা

২৫ তারিখ রাতে ““খাগড়াছড়ির পথে…”” রওনা হয়ে ২৬ তারিখ সকালে পৌছাই খাগড়াছড়িতে। দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে রেস্ট নিয়ে আমাদের “খাগড়াছড়ি ভ্রমণ – শুরু” হয় আলুটিলা গুহা দিয়ে। আজ এই অংশে বলবো আলুটিলা গুহার ভ্রমণ কথা।


খাগড়াছড়ি থেকে আলুটিলা ও রিসং ঝর্নার ম্যাপ

খাগড়াছড়ি শহর থেকে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে আলুটিলা পাহাড় চূড়ায় পৌছতে খুব বেশি সময় লাগেনা। আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্রের সামনে নেমে কিছুটা নস্টালজিকে আক্রান্ত হই। সময়টা খুব সম্ভবত ২০০০ বা ২০০১ সাল, আমরা চার বন্ধু এসেছিলাম এখানে। সেই চার জনের দু’জন আমি আর ইস্রাফীল আবার আসলাম।

গেটের পাশেই থাকে মশাল তৈরির কারিগররা। আমাদের দেখে মশাল ওয়ালারা মশাল তৈরি করতে শুরু করে দিলো, যদিও আমরা একটা মশালও কিনিনি। প্রথম বার যখন এসেছিলাম তখন মনে হয় তিনটা মশাল কিনে ছিলাম, লোকজন বলা-বলি করতে ছিল- “গুহার ভিতরে টর্চ লাইট জ্বলে না”। আসলে কথাটা ঠিক না। ২০০০ সালের দিকে পত্রিকাতে এই গুহা সম্পর্কে একটা প্রতিবেদন পড়ে প্রথম এটার কথা জানতে পারি। প্রতিবেদনে বলা ছিল –

প্রাকৃতিক এই গুহাটা বিশাল বড়, প্রায় আধা ঘণ্টা সময় লাগে পুরটা পেরুতে। ভেতরে আছে অনেক জোক আর বাদুর, আর দেখা মিলতে পারে ব্যাঙ আর সাপেরও। ভেতরে বরফ শীতল পানি কোথাও কোথাও অনেক বেশি। তাই সাবধানে যেতে হবে। এই সব…..।

আমাদের এবারের ভ্রমণের ট্রেজারার বসির। সমস্ত টাকা জমা দেয়া হয়েছে ওর কাছে, সমস্ত লেনদেন করবে ও, তাই বসির গেলো টিকেট কাটতে। বসির টিকেট কাটতে কাটতে আমরা ভিতরে চলে যাই। গেটের বাম দিকে যে রাস্তাটা গিয়েছে সেটাই গেছে আলুটিলা গুহাতে। ঢালু এই রাস্তা ধরেই এগিয়ে যেতে হবে আপনাকে।

যারা আগে যাননি এখানে তাদের বলি এই রাস্তা ধরে কিছু দূর এগিয়ে গেলেই দেখতে পাবেন একটি বিশ্রামের জন্য বসার স্থান। এখান থেকে দূরের খাগড়াছড়ি শহর আপনার চোখের সামনে বিছিয়ে আছে দেখতে পাবেন।

বিশ্রামাগারের বাম দিকে একটা সিঁড়ি নেমে গেছে, খুব বেশি হলে ৪০/৪৫ ধাপ। এটা দিয়ে নামবেন না। সোজা সামনের দিকে আরেকটা সিঁড়ি দেখতে পাবেন। এই সিঁড়িতে ধাপ আছে প্রায় ২৮০টির মত। আপনি যদি প্রথম বাম দিকের সিঁড়ি দিয়ে নামেন তাহলে আপনাকে দ্বিতীয় সিঁড়ির ২৮০ টি ধাপ টপকে উঠতে হবে।


সাহস করে নামতে শুরু করুন, যার শুরু আছে তার শেষও আছে


প্রথমবার যখন আমরা গিয়েছিলাম তখন কিন্তু এই সিঁড়ি ছিলো না

যাইহোক দ্বিতীয় এই সিঁড়ি দিয়ে নেমে দেখতে পাবেন একটি বটগাছ। এখানে একটু বিভ্রান্তি লাগতে পারে- কোন দিকে যাবো!!


নিচের পাহাড়ি সৌন্দর্য দেখছে সবাই।

বাম দিকে একটু সামনে আর কয়েক ধাপ সিঁড়ি দেখতে পাবেন, এর নিচেই আছে গুহার নিচের দিকের মুখ। অন্ধকার রহস্যময় হাতছানি দিয়ে ডাকবে আপনাকে আলুটিলা গুহা।


সিঁড়ি শেষ হয়ে গেছে এই আনন্দেই সবাই

আমরা স্যান্ডেল খুলে তৈরি হতে থাকি গুহায় ঢুকার জন্য। তখনই লক্ষ্য করি আমাদের গ্রুপের দুইজন মিস্টেক অব দা সেঞ্চুরি করে বসে আছে।
প্রথম জন স্বপন – বেচারা পরে এসেছে জুতা মুজা, এখন খুলতে সমস্যা নাই কিন্তু পরে নোংরা পায়ে পরবে কি করে?
দ্বিতীয় জন আমি নিজে – পরে এসেছি সেমি নেরো জিনস প্যান্ট। হাঁটু পর্যন্তই প্যান্ট গুটিয়ে উঠাতে পারছি না।

সকলের জুতা-স্যান্ডেল খুলে আরেক সমস্যার সম্মুখীন হলাম। এগুলি নিবো কি করে। পাশেই কলা গাছ থেকে একটা ফিতার মত অংশ ছিঁড়ে নিয়ে সেটার ভিতরে সবগুলি জুতা-স্যান্ডেল ঢুকিয়ে বেঁধে ধরিয়ে দেয়া হল স্বপনের হাতে। এবার শুরু হল গুহা অভিযান।

গুহার মুখের সামনে দাঁড়ালে আপনার মনে হবে আপনি দাঁড়িয়ে আছেন আপনার বাসার ফ্রিজ খুলে তার সামনে। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা সময় যেটাই হোক গুহার ভেতর থেকে শীতল হাওয়ার রহস্যময় স্পর্শ আপনার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে।


সবার আগে গুহার প্রবেশ মুখে ইস্রাফীল

উপরে গুহা সম্পর্কে পত্রিকার প্রতিবেদনে যা বলেছে আসলে এসব কিছুই না। প্রথম বারেই দেখেছি গুহাটা খুব বেশি বড় কিছু না, ১০ মিনিটের মধ্যেই পার হয়ে আসা যায়।


সবাই গুহার ভেতরে এখন

ভেতরে অনায়াসে টর্চ লাইট জ্বালান যায়। তেমন কোন জোক দেখিনি, সাপ-ব্যাঙের প্রশ্নই আসে না। কারণ গুহার ভেতরটা প্রায় ফ্রিজের মত ঠাণ্ডা, আর আমি যতদূর জানি সাপ-ব্যাঙ ঠাণ্ডা এড়িয়ে চলে। ভাগ্য ভালো থাকলে বাদুরের দেখা পেতেও পারেন। পানি এক যায়গায় হাঁটুর কাছাকাছি, আর এক যায়গায় হাঁটুর উপরে উঠে যাবে। তবে যেখানে পানি বেশি সেই যায়গাটা দু’দিকে পা দিয়ে অনায়াসে পার হয়ে যাওয়া যায়। ভেতরটা ঠাণ্ডা-অন্ধকার, খুব সুন্দর। কোথাও পাহাড়ের গা চুইয়ে জল ঝরছে, তাই ভিজে স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে সেই যায়গাগুলি।


আলুটিলা গুহা অভ্যন্তরে

আপনাকে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটার প্রতি মনোযোগ দিতে হবে তা হচ্ছে আপনার মাথা। কারণ কিছু দূর গেলেই গুহার ছাদ ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসবে। এক সময় আপনাকে কুঁজো হয়ে এগুতে হবে। ছাদের উচ্চতার দিকে লক্ষ্য না রাখলে ১০০% নিশ্চয়তা সহকারে আপনি মাথায় ব্যথা পাবেন।

বসিরের মেয়ে বুসরা ছিল ওর বাবার কোলে, অসাবধানতার কারণে বুসরার মাথা লেগে যায় গুহার ছাদে, ব্যথা পেয়ে কাঁদতে থাকে বেচারি।


বুসরার মাথা ঠুকে গিয়েছিল গুহার ছাদে

গুহার মাঝা-মাঝি অংশ পর হয়ে কিছু দূর এগোলেই মনে হবে গুহাটা দুদিকে দুটি টানেলের মত গিয়েছে। আসলে বাম দিকেরটা ছোট্ট একটা কানা গলি। ডান দিকের টা বেরিয়েছে বাইরের আলোতে। এইখানটাতে কিচ্ছুক্ষণ বসে বিশ্রাম নিতে পারেন, তুলতে পারেন ছবি। ডান দিকে আগাতে গেলেই বড় বড় পাথর আপনার পথ আগলে রুখে দাঁড়াবে। ভয় নেই অনায়াসেই এদের টপকে বেরিয়ে আসতে পারবেন।


প্রায় বেরিয়ে এসেছে গুহা থেকে, সামনেই আলোর বন্যা


গুহার উপরের দিকের বেরুবার মুখ

গুহার ভেতরে ধারালো কোন পাথর নেই যাতে লেগে আপনার পা কাটতে পারে। তাই খালি পায়েই যেতে পারেন। তবে অবশ্যরই পা কোথায় ফেলছেন সে দিকে লক্ষ্য রাখবেন। কারণ ধারালো পাথর বা সাপ-জোক না থাকলেও কিছু অসচেতন পর্যটকের ফেলে যাওয়া বাঁশের মশালে পা পরলে আপনার পা কাটতেই পারে।


আগেই বলেছি সবার জুতা-স্যান্ডেল ধরিয়ে দেয়া হয়েছে স্বপনের হাতে


গুহা থেকে বেরিয়ে একটু উপরে উঠলেই একপাশে নিচে ছোট্ট এই পুকুর, এখান থেকে পানি আনছে পা ধোয়ার জন্য


পানি আসার অপেক্ষায় আছে

দুই অংশের অল্প কয়েক ধাপ সিঁড়ি টপকে উঠেপরা যাবে আবার সেই বিশ্রামাগারের কাছে। এবার বুঝবেন আসলেই এই যায়গাটায় বিশ্রামাগার রাখা কতটা ভালো হয়েছে। এখানে বসে ঠাণ্ডা বাতাসে যেমন গাঁ জুড়বে তেমনি দূরে শহরের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য আপনার দৃষ্টিকেও শান্তি দিবে।


আবার সেই ঢালু পথ ধরেই উপরে উঠা শুরু

এখানে কিছুক্ষণ বসে বিশ্রাম নিয়ে আমরা আবার ঢালু পথ ধরে এগিয়ে উঠতে থাকি উপরের দিকে। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য রিসাং ঝর্না। ছুটে চলছি তার দিকেই……


এবার চলেছি রিসাং ঝর্নার দিকে…..

আগামী পর্বে দেখা হবে রিসাং ঝর্ণার ধারে।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১০ টি মন্তব্য (লেখকের ৫টি) | ৫ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০২-১২-২০১৮ | ১৩:৪৫ |

    ভ্রমণের পোস্টটি এতোটাই সহজ বর্ণনার যে, যাদের ইচ্ছে আছে তাদের উপকার হবে। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • মরুভূমির জলদস্যু : ০৩-১২-২০১৮ | ৯:৩৮ |

      ভ্রমণ লেখাগুলিতে ভ্রমণ সংক্রান্ত তথ্যগুলি দিয়ে দিতে চেষ্টা করি।

      GD Star Rating
      loading...
  2. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ০২-১২-২০১৮ | ১৮:৫৭ |

    আলুটিলা গুহা ভ্রমনের আদ্যপান্ত পড়লাম। দুদফা করে পড়লাম মুরুভূমি ভাই। ছবি আর বিশদ বর্ণনা সুন্দর এসেছে। পরের ভ্রমনের অপেক্ষা নিয়ে থাকলাম। ধন্যবাদ আপনাকে। Smile

    GD Star Rating
    loading...
    • মরুভূমির জলদস্যু : ০৩-১২-২০১৮ | ৯:৪১ |

      আমি ভ্রমণ সংক্রান্ত লেখাগুলিতে প্রচুর ছবি দেই। এতে করে বর্ননটা চোখের সামনে এসে যায়।
      পরের পর্বে যাবো রিছাং ঝর্ণায়। নিমন্ত্রণ। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

      GD Star Rating
      loading...
  3. রিয়া রিয়া : ০২-১২-২০১৮ | ১৯:০৬ |

    কি অসাধারণ অভিযাত্রা। মুগ্ধ হলাম ছবি দা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • মরুভূমির জলদস্যু : ০৩-১২-২০১৮ | ৯:৪৩ |

      পরের পর্বে আছে রিছাং ঝর্ণার কথা, সেটা আরো চমৎকার।
      তবে যতটা দেখতে চমৎকার ততোটা লেখায় তুলে ধরার সামর্থ আমার নেই।

      GD Star Rating
      loading...
  4. মুহাম্মদ দিলওয়ার হুসাইন : ০২-১২-২০১৮ | ২১:২৯ |

    * প্রাকৃতিক নৈসর্গের তীর্থস্থান বাংলাদেশ… https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

    GD Star Rating
    loading...
  5. মুনা : ০৩-১২-২০১৮ | ১২:২০ |

    লেখার মাঝেই ঘুরে এলাম আলুটিলা গুহা।

    সত্যিই অসাধারণ।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

    GD Star Rating
    loading...