একসময় ভারতের মাটিতে পা রেখেছিলাম, ১৪০০ বঙ্গাব্দ। তখন বৈশাখমাস। বাংলাদেশ থেকে বেনাপোল স্থলবন্দর হয়ে দালাল মারফত অতি কষ্টে সীমান্ত পেরিয়ে বনগাঁ রেলস্টেশন পৌঁছেছিলাম। আমার সাথে ছিল, আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও ওর দুই বোন। যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল, জীবনটাকে একটু পরিবর্তন করার। কিন্তু না, জীবন তো পরিবর্তন করতে পারি-ই-নি, বরং ওখানে প্রায় দেড়বছর অবস্থান করে শেষাবধি শূন্য হাতে আবার ফিরে আসতে হলো। এরমধ্যে লাভ হয়েছিল, বিশাল ভারত-সহ ভারত ঘেঁষা ভুটানের কয়েকটা জায়গা দেখা হয়েছিল। তো যাক সেকথা, আসা যাক পোস্টের মূল কথায়।
ভারত যাবার পর আমার বন্ধু বাসায় অবস্থানের পর, আমার যেন কিছুই ভালো লাগছিল না। ভালো না লাগার কারণ ছিল, বাংলাদেশে ফেলে রাখা স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে চিন্তা। সেই চিন্তা মনের ভেতরে রেখেই কাটিয়ে দিলাম চার-পাঁচদিন। চার-পাঁচদিন পর একদিন সকালবেলা আমার বন্ধু কানাই বলল, “চল দুইজনে টাউনে গিয়ে ঘুরে আসি।”
জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় যাবি?”
কানাই বলল, “আজ তোকে মেট্রো ট্রেনে চড়াব। আর সময় পেলে হাওড়া, তারামণ্ডলও দেখাবো।”
এ-তো খুশির খবর! কিন্তু খুশির বদলে আমার কান্না আসতে লাগল! চিন্তা শুধু একটাই, তা হলো এখানে আসলাম বেশ কিছুদিন হয়ে গেল। অথচ কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না, হচ্ছে শুধু টাকা খরচ! এভাবে ঘুরে বেড়ালে কি হবে? আমার তো কিছু একটা করতে হবে। ভাবছি, কানাইর সাথে যাব কি যাব না! না গেলেও হয় না। শেষমেশ জামাকাপড় পড়ে কানাইর সাথে বের হলাম।
কানাই’র বাসা থেকে একটা অটো (সিএনজি) চড়ে গেলাম ধর্মতলা। এই ধর্মতলায় কোলকাতা শহরের বড় একটি বাসস্ট্যান্ডও আছে। আছে কোলকাতার বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার ট্রাম ও বাস সার্ভিস। অটো থেকে নেমে একটা চা দোকানে গিয়ে চা-বিস্কুট খেলাম। দোকান থেকে বের হয়ে ফুটপাতের দোকান থেকে সিগারেট কিনলাম। সিগারেট জ্বালিয়ে ফুঁকছি, আর হাঁটছি। এদিক-ওদিক তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখছি। একসময় একটা রাস্তার ফুটপাত দিয়ে হাঁটছি দুইজনে। দেখছিলাম, দুইটা দোকানের মাঝখানে মাটির নিচে যাওয়ার জন্য অনেক চওড়া জায়গা। নিচে যাওয়ার সুন্দর সিঁড়িও আছে।
কানাইকে জিজ্ঞেস করলাম, “নিচে কী?”
কানাই বলল, ”এটি হচ্ছে কোলকাতা শহরের ভূগর্ভস্থ পাতাল রেলস্টেশন। যাকে বলে পাতাল রেল বা মেট্রো ট্রেন বা মেট্রোরেল। তাই অনেকে বলে, মেট্রো ট্রেনস্টেশন।
বললাম, “তা হলে আমরা কি এখন এই স্টেশনেই যাচ্ছি?” কানাই বলল, ”হ্যাঁ, তোকে তো বাসা থেকে বাইর হবার আগেই বলেছি। এখন চল, নিচে স্টেশনের ভেতরে যাওয়া যাক। গেলেই বুঝতে পারবি, পাতাল রেল কাকে বলে!”
সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে নিচে নামতে লাগলাম। যতই নিচে যাচ্ছিলাম, ততই স্টেশনের ভেতরকার সৌন্দর্য দেখে অবাকও হচ্ছিলাম! এই মেট্রো ট্রেন হলো, পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কোলকাতা পরিবহণ সেবার মধ্যে একটি। এটির পরিসেবা কোলকাতা শহরের পার্শ্ববর্তী উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা পর্যন্ত। দ্রুত পরিবহন সেবা প্রদানকারী পরিবহণ ব্যবস্থাও বলা যায়।
জানা যায়, কোলকাতা মেট্রো ট্রেনের পথ ২৭.২২ কিলোমিটার। এই ২৭.২২ কিলোমিটার পথে ২৩টি মেট্রো স্টেশন রয়েছে। যার মধ্যে ১৫টি স্টেশন ভূগর্ভস্থ আর বাদবাকিগুলো উড়াল। এই পরিবহন সেবা চালু হয়েছিল ১৯৮৪ সালে এবং এটিই ভারতের প্রথম মেট্রো রেল পরিসেবা। এরকম পাতাল রেল সার্ভিস নাকি ভারতের রাজধানী দিল্লিতেও আছে।
আমরা দু’জন নিচের দিকে নামছিলাম, যত নিচে যাচ্ছি ততই সুন্দর! ঝকঝকা আলো আর লোকে লোকারণ্য। স্টেশনের ভেতরে গার্ডের সাথে পুলিশও আছে। তাদের ডিউটি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখা। কে কী করছে, কোথায় যাচ্ছে এগুলো ফলো করা। মূল স্টেশনে প্রবেশ করতে হলে, চাই টিকিট।
কম্পিউটারে টিকিট শো করলেই গেইট খুলবে, যাত্রী প্রবেশ করবে। এ ছাড়া আর প্রবেশ করার মতো কারোর সাধ্য নেই। কানাই কাউন্টার থেকে দুটা টিকিট কিনে আনল। আমরা যাব, ধর্মতলা থেকে টালিগঞ্জ। টিকিটের দাম নিল, ৫ টাকা করে ১০ টাকা। দুটো টিকিটই একসাথে, মানে একটা টিকিট। টিকিটের গায়ে লেখা আছে টু ম্যান।
ট্রেন আসার সময় হয়েছে। হুইসেল শোনা যাচ্ছে। কানাই বলল, ”শিগগির আয়।”
আমরা কম্পিউটার সিস্টেম গেইটের সামনে গেলাম। কানাই গেইটের পাশে থাকা বক্সে টিকিট ঢুকাল। টিকিটখানা শোঁ করে বক্সের পেছনে চলে গেল। আমরা গেইট পার হলাম, টিকিটখানা হাতে নিলাম। গেইটখানা ধরে আমি একটু ট্রাই করে দেখলাম! গেইট আর একটুও নড়ে-চড়ে না। টিকিটের গায়ে দুইজন লেখা। ঠিক দুইজন পার হওয়ার পরই গেইট বন্ধ। ট্রেন স্টেশনে এসে থামল। যাত্রিরা ট্রেন থেকে নামল। আমরা ট্রেনে ওঠার জন্য রেডি হয়ে সামনেই দাঁড়িয়ে আছি।
ট্রেন থেকে মাইকে বলছে, “টালিগঞ্জ যাওয়ার যাত্রিগণ ট্রেনে ওঠে আসন গ্রহণ করুন।” আমরা-সহ সব যাত্রী ট্রেনে ওঠে সিটে বসার পর ট্রেন থেকে আবার মাইকিং। বলা হচ্ছে, “যাত্রীদের অবগতির জন্য বলা হচ্ছে যে, আপনারা ট্রেনের দরজা ও জানালা থেকে দূরে থাকুন।” এর পরপরই ট্রেনের সব দরজা ও জানালা একসাথে শোঁ করে লেগে গেল! বুঝলাম, দরজার সামনে যদি কেউ দাঁড়ানো থাকত, তা হলে মৃত্যু অনিবার্য। তাই আগে থেকেই যাত্রীদের হুশিয়ার করে দেওয়া হয়, যাতে কোনও দুর্ঘটনা না ঘটে।
ট্রেন ছুটল দ্রুতগতিতে! জানালা দিয়ে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ট্রেন যাচ্ছে মাটির নিচ দিয়ে। কিছু দেখা যাবে কী করে? শুধু একটু শব্দ শোনা যাচ্ছে, শোঁ শোঁ শব্দ। ১০ মিনিটের মতো বসে থাকার পর আবার মাইকিং।
বলা হচ্ছে, “আমরা টালিগঞ্জ পৌঁছে গেছি! ট্রেন থেকে নামার জন্য প্রস্তুত হোন।”
কানাই বসা থেকে ওঠে দাঁড়াল, সাথে আমিও ওঠলাম। ট্রেন থামল। ট্রেন থেকে আমরা নেমে স্টেশনের বাইরে আসলাম। কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে চা-বিস্কুট খেয়ে তৈরি হলাম, ধর্মতলা আসার জন্য। এবার ট্রামে চড়ে আসব ধর্মতলা। ট্রাম দেখা হবে আর চড়াও হবে। তারপর ট্রাম দেখা হলো, ট্রামে চড়াও হলো। মেট্রোরেল বা পাতালরেলে চড়ার গল্পও শেষ হলো।
loading...
loading...
অসাধারণ এক অভিজ্ঞতার স্মৃতিরোমন্থনে যেন আপনার পাশে ছিলাম। বাহ্।
loading...
সত্যি খুবই আনন্দের ভ্রমণ ছিল, দাদা। কতটা যে আনন্দের ভ্রমণ ছিল, তা পুরোপুরি লেখায় শেষ করতে পারিনি। তবুও মনেহয় যথেষ্ট বুঝাতে পেরেছি। পড়েছেন জেনে খুশি হলাম। শুভকামনা রইল।
loading...
ধন্যবাদ।
loading...
অসাধারণ, চমৎকার উপস্থাপন।
loading...