একরকম শূন্য হাতে ভুটান ফ্রুন্টসলিং ভ্রমণ করেছিলাম

niii

ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় একবার আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাথে ভারত গিয়েছিলাম। সময়টা ছিল ১৯৯৩ সাল। যেদিন বেনাপোল বর্ডার পাড় হয়ে ওপার বনগাঁ পৌঁছেছিলাম, সেদিন ছিলো পহেলা বৈশাখ ১৪০০ বঙ্গাব্দ।

সেদিনের ওই যাত্রায় আমরা ছিলাম চারজন। আমি, আমার বন্ধু ও বন্ধুর দুই বোন। বনগাঁও থেকে রাত দশটার ট্রেনে চড়ে দমদম নামলাম। রাত তখন প্রায়ই বারোটা। তারপর আমার বন্ধুর ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুর বাড়িতে গেলাম, রাত কাটানোর জন্য। সেই বাড়িতে রাত কাটিয়ে পরদিন ভোরবেলা দমদম থেকে শিয়ালদা। শিয়ালদা নেমে একটা অটো চেপে সোজা বন্ধুর বাসায়।

ওই বন্ধুর বাড়িতে রাত যাপন করে খুবই ভোরবেলা আবার দমদম রেলস্টেশনে এলাম, শিয়ালদহ যাবার জন্য। যখন দমদম রেলস্টেশনে এলাম, তখনও শিয়ালদাগামী ট্রেন দমদম রেলস্টেশনে পৌঁছায়নি। এই ফাঁকে আমার বন্ধু স্টেশন থেকে চারটে টিকেট সংগ্রহ করে ফেলল। ট্রেন আসতে তখনও মিনিট কয়েক বাকি ছিল।

একসময় শিয়ালদাগামী ইলেকট্রনিক ট্রেন দমদম স্টেশনে এসে দাঁড়ালো। দমদম স্টেশনে নামার মতো যাত্রীরা ট্রেন থেকে নামলো আমরা চারজন শিয়ালদহ’র উদ্দেশে ট্রেনে ওঠে সিট নিয়ে বসলাম। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক পর যথাসময়ে ইলেকট্রনিক দ্রুতগামী ট্রেন শিয়ালদহ গিয়ে পৌঁছালো। আমরা ট্রেন থেকে নেমে চলে গেলাম রেলস্টেশনের বাইরে।

শিয়ালদহ রেলস্টেশনের বাইরে গিয়ে একটা অটো চেপে চলে গেলাম, বাঘা যতীন সংলগ্ন বন্ধুর ভাড়া বাসায়। বন্ধুর ওখানে ছিলাম, প্রায়ই একমাসের মতো। কিন্তু আমি যেই কাজের আশায় বাংলাদেশ থেকে ভারত গিয়েছিলাম, সেই কাজ আর হলো না। বাধ্য হয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম, বন্ধুর এখান থেকে জলপাইগুড়ি বড়দি’র বাড়ি চলে যাবো। শেষাবধি তা-ই হলো।

বন্ধুর ভাড়া বাসায় মাসেক খানি অবস্থান করার পর চলে গেলাম, পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে জলপাইগুড়ি জেলার বীরপাড়া। জলপাইগুড়ি বীরপাড়া আমার বড় দিদির বাড়ি। একসময় এই বীরপাড়া পুরোটাই ছিলো চা-বাগান। এই চা-বাগানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল ছোট্ট একটা বাজার। সেই বাজারের নাম হয়, “বীরপাড়া” বাজার। বীরপাড়া বাজার ঘেঁষেই তৈরি হয়েছিল, ভুটানের গুমটু যাবার রাস্তা।

ভুটান গুমটু যাবার রাস্তার এপাশ-ওপাশ দু’পাশে থাকা চা-বাগান ঘেঁষে জনবসতি গড়ে উঠেছিল তুলনামূলকভাবে। সেইসাথে যখন লোকসংখ্যা বাড়তে থাকে, তখন চা-বাগানের কিছু অংশ হয়ে পড়ে বেদখল।
আমি যখন সেখানে গিয়েছিলাম, তখন দেখলাম চা-বাগান ঘেঁষা বড় দিদির বাড়ি। যেখানে বড় দিদির বাড়ি, সেই জায়গার নাম, রবীন্দ্র নগর কলোনী। এই রবীন্দ্র নগর কলোনী ছাড়াও আরও কয়েকটা মহল্লা আছে। সবগুলো মহল্লাই একসময় চা-বাগান ছিলো।

বর্তমানে চা-বাগানের বেদখল হয়ে পড়া জায়গা ব্যক্তিমালিকানাধীন। মানে যিনি ওই জায়গায় দীর্ঘদিন যাবত বসবাস করছে, তিনিই ওই জায়গার মালিক। শোনা যায় প্রত্যেকেই চা- বাগান কোম্পানি হতে নামমাত্র মূল্যে দখলকৃত জায়গা দলিলের মাধ্যমে রেজিষ্ট্রেশন করে নেয়। সে হিসেবে বড় দিদির বাড়িটাও নিজেদেরই কেনা সম্পত্তি।

যাইহোক ৩০ বছর আগে যখন আমি বড় দিদির বাড়ি গিয়েছিলাম, তখন আমার বড় দিদি আমাকে চিনতে পারছিলেন না। কারণ আমার বড় দিদির যখন বিয়ে হয়েছিল, তখন আমি ছিলাম মাত্র দেড় বছরের এক কোলের শিশু। আমার বড়দি’র বিয়ে হয়েছিল ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে। আমার জামাই বাবু বড় দিদিকে নিয়ে সপরিবারে ভারতে চলে আসে ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে। সেই আসা-ই-আসা, আর কখনো তারা বাংলাদেশে যায়নি। সেই দেড় বছরের আমি বড় দিদির বাড়ি গিয়েছিলাম, ত্রিশ বছর বয়সে। না চেনার কারণই ছিলো ওটাই। অবশ্য পরিচয় দেওয়ার পর খুব ভালো করেই চিনেছিল।

বড় দিদির ওখানে গিয়ে মাসেক খানেক ঘুরে-ফিরে সাথে নেওয়া টাকা-পয়সা শেষ করে উপায়ান্তর না দেখে ভাগিনাদের সাথে গ্যারেজে কাজ করা শুরু করি। গাড়ির গ্যারেজে কাজ করার সুবাদে ওখানকারই অনেক ড্রাইভারে সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেছিলো।

যেখানে যাবার মন চাইত, ভাড়া ছাড়াই সেখানেই চলে যেতাম। গিয়েছিলাম ভুটান গুমটু, সামসি, শিলিগুড়ি, জল্পাইগুড়ি, সিকিম যাবার ভারত-সিকিম মেইন সংযোগস্থান সেবক’র মতো সুন্দর-সুন্দর জায়গায়।। কিন্তু যাবো যাবো বলেও কাজের চাপে যাওয়া হচ্ছিল না, ভুটান ফ্রুন্টসলিং।

ভুটানের ফ্রুন্টসলিং আমার বড় দিদির বাড়ি বীরপাড়া থেকে মাত্র বিশ টাকার ভাড়া। বীরপাড়া থেকে ফ্রুন্টসলিং যেতে সময় লাগতো, দু’ঘন্টার মতো। এতো সামনে থেকেও সেখানে যাওয়া হচ্ছিল না।

একদিন সকালে খাওয়া-দাওয়া করে আর গ্যারেজে যাইনি। এদিন সকালে জামা-কাপড় পড়ে কারোর কাছে কিছু না বলে বীরপাড়া বাসস্ট্যান্ডে চলে গেলাম। আমার সাথে টাকার অংক ছিলো মাত্র দুইশো টাকার মতো।
বীরপাড়া বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে একটু ঘুরা-ঘুরি করে দেখলাম পরিচিত কোন বাস আছে কি-নাই। ঘুরে-ফিরে খানিক পর দেখি আমারই পরিচিত একটা গাড়ি জয়গাঁও যাবার জন্য যাত্রী সংগ্রহ করছে। বাস কাউন্টার থেকে মাইকে বলা হচ্ছে, “জয়গাঁ জয়গাঁ”। আমি ভাবতে লাগলাম জয়গাঁ আবার কোথায়?

এই ভেবে বাসের সামনে যেতেই বাস ড্রাইভারের সাথে দেখা। ড্রাইভার জিজ্ঞেস করলো, “মামা তুমি কোথায় যাবে?”
বললাম,“ফ্রুন্টসলিং ঘুরতে যাবো, মামা!”
ড্রাইভার বললো, “আমি-ও-তো গাড়ি নিয়ে জয়গাঁ যাচ্ছি, মামা। তো যাবে যখন গাড়িতে উঠে আমার সিটের পেছনের সিটে বসে থাকো। কিছুক্ষণ পরই গাড়ি নিয়ে জয়গাঁ’র উদ্দেশে রওনা দিবো।”
বললাম, “আমিতো ফ্রুন্টসলিং যাবো মামা।”
ড্রাইভার বললো, “আরে মামা জয়গাঁ আর ফ্রুন্টসলিং একই জায়গায়। জয়গাঁ হলো ভারত-ভুটান বর্ডার। জয়গাঁ ভারতের আর ফ্রুন্টসলিং হলো ভুটানের একটা শহর। যাও যাও গাড়িতে উঠে আমার পেছনের সিটে বসো।”

ড্রাইভারের কথা শুনে আমি তা-ই করলাম। গাড়িতে উঠে ড্রাইভারের পেছনের সিটে বসলাম। একটু পরই গাড়ি ফুন্টসলিঙের উদ্দেশে ছুটে চললো।
বিরতিহীন গাড়ি। কোথাও থামা-থামি নেই। গন্তব্য ছাড়া যাত্রীও ওঠা-নামা করতে পারে না। গাড়ি চলছে-তো-চলছেই। প্রায়ই দু’ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম, ভারত-ভুটান সীমান্ত ঘেঁষা জয়গাঁও ফ্রুন্টসলিং বর্ডার।

বাস থেকে নেমে ভুটান ফ্রুন্টসলিং প্রবেশের সুবিশাল গেইটের সামনে একটা চা’র দোকানে গেলাম। আমার সাথে বাসের ড্রাইভার হেলপারও ছিলো। সবাই মিলে আমরা ছিলাম চারজন। চারজনেই চা-বিস্কুট খেলাম। দাম দিলাম আমি। কারণ বাসে তো ফ্রি এসেছি, তাই।

চা-বিস্কুট খাওয়ার পর ড্রাইভার তার হেলপারকে বললো, ‘“গাড়িতে বীরপাড়ার যাত্রী ওঠাও!”
আমাকে জিজ্ঞেস করলো, “মামা তুমি কখন যাবে?” বললাম, “একটু ঘুরা-ঘুরি করে জায়গাটা দেখে বিকেলে রওনা দিবো, মামা।”

আমার কথা শুনে বাসের ড্রাইভার আমাকে সেখানকার আইন-কানুন সম্বন্ধে বুঝিয়ে বললো, “যা-ই করো, আর ফ্রুন্টসলিঙের ভেতরে যেখানেই যাও, সন্ধ্যার আগে আগে ভুটানের গেইট পাড় হয়ে ভারতের ভেতরে চলে আসবে। কারণ সন্ধ্যার সাথে সাথে ভুটানের বর্ডার গার্ড ফোর্স এই সুবিশাল গেইটটা বন্ধ করে দেয়। গেইট বন্ধ হয়ে গেলে তুমি যদি ফ্রুন্টসলিঙের ভেতরে থেকে যাও, তাহলে তোমাকে আটক করে জেলে ভেরে রাখবে। তাদের আইনে যে-ক’দিন সাজা হয়, তা-ই ভোগ করে বের হতে হবে। কাজেই সন্ধ্যার কথাটা তুমি মাথায় রেখে ঘুরা-ঘুরি করবে।”

আমি বাস ড্রাইভারের নির্দেশাবলী মাথায় রেখে বললাম, “ঠিক আছে মামা, তা-ই হবে। আমার জন্য চিন্তা করবেন না।”
বাস ড্রাইভার কয়েকজন যাত্রী সংগ্রহ করে বীরপাড়ার উদ্দেশে রওনা হলে, আমি আস্তেধীরে ভুটান ফ্রুন্টসলিঙের সুবিশাল গেইট পাড় হয়ে সোজা ফুন্টসলিঙের ভেতরে চলে গেলাম। গেইটে চার-পাচজন সিপাহী ছিলো। কিন্তু আমাকে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করেনি যে, আমি কোথাকার এবং কোথা-ই-বা যাচ্ছি।

দেখলাম তারা এপার-ওপার হওয়া কাউকে কিছুই জিজ্ঞেস করছে না। গেইট দিয়ে অনবরত ভারত ভুটানের লোক আসা-যাওয়া করছে, নির্ভয়ে নির্বিঘ্নে যার-যার নিজের মতো করে। এতে কারোর জন্য কোনও জেরার সম্মুখীন হতে হয় না। জিজ্ঞাসা আর চেক থাকে তখন, যখন ভারত থেকে গাড়িগুলো ফ্রুন্টসলিঙের ভেতরে ঢুকে।

মাঝে-মাঝে ভারত থেকে বিভিন্ন মালা-মাল বোঝাই বড়-বড়ে (লড়ি) ট্রাক ফ্রুন্টসলিং দিয়ে ভুটানে প্রবেশ করে। এই গাড়িগুলোর দিকেই থাকে সুবিশাল গেইটে সিপাহিদের তীক্ষ্ণ নজর!

এছাড়া সিপাহিরা মানুষজন আসা-যাওয়ায় কাউকে কিছুই বলে না। আমাকেও কিছু বলেনি। আমি হাঁটতে-হাঁটতে ফ্রুন্টসলিঙের বেশখানিক ভেতর চলে গেলাম, নির্ভয়ে নির্বিঘ্নে!

ফ্রুন্টসিলিং, ভুটানের একটা বানিজ্যিক শহর। এই ফ্রুন্টসিলিং শহরটা পাহাড়ের উপরে অবস্থিত। ভারতের অংশ জয়গাঁও। এই জয়গাঁও আর ফ্রুন্টসলিং সমান উঁচু দেখা গেলেও, ফ্রুন্টসলিং জয়গাঁও’র চেয়ে অনেক উঁচু!
ফ্রুন্টসলিং আর জয়গাঁ একসাথেই মিলে-মিশে পাশা-পাশি। জনবসতি আর ছোট-বড় বিল্ডিং, শপিংমল থাকার কারণে জয়গাঁ আর ফ্রুন্টসলিং পাহাড় মনে হয় না। কিন্তু সমতল ভূমি থেকে জয়গাঁ আর ফ্রুন্টসলিং অনেক উঁচুতে। সমতল ভূমি থেকে জয়গাঁ আর ফ্রুন্টসলিং কতখানি উঁচুতে, তা বোঝা যায় ফ্রুন্টসলিঙের ভেতরে গেলেই।

ফ্রুন্টসলিঙের ভেতরে একটা বড় বৌদ্ধবিহার আছে। বৌদ্ধবিহারের সামনেই বড় ড্রামের মতো আছে। এই ড্রামটাকে বলা হয়, প্রার্থনা ড্রাম বা প্রার্থনা চাকা বা ঢোল। সেই ড্রামে বৌদ্ধদের ধর্মীয় শাস্ত্র-গ্রন্থের মন্ত্র ❝ওম মানি পদমে হুম❞ লেখা থাকে।

এই প্রার্থনা ড্রামের সামনে গিয়ে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা মাথা নিচু করে দু’হাত জোড় করে ভক্তি করে। তারপর প্রার্থনা ড্রাম কয়েকবার ঘুরায়, আর মুখে মন্ত্রপাঠ করে।

বৌদ্ধ ধর্মে প্রার্থনা ড্রাম ঘুরানোর মানে হলো, ❝মানুষের হৃদয়কে করুণা ও ভালবাসায় পূর্ণ করতে সহায়তা করা। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা বিশ্বাস করে যে, নিজের হৃদয়ে আন্তরিক বিশ্বাসের সাথে ঢোল ঘোরানো মানে প্রভুর হৃদয়ের সাথে নিজের হৃদয় স্থাপন করা। তাদের ধারণা এই প্রার্থনা ড্রাম বা চাকা বা ঢোল ঘুরানোর ফলে প্রভুর আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে এই ধরাধামে বেঁচে থাকা যায়।❞

এই বৌদ্ধবিহারের সামনে দিয়েই ভারত থেকে ভুটানের রাজধানী থিম্পু পর্যন্ত হাইওয়ে। ভারত-ফ্রুন্টসলিং টু থিম্পু হাইওয়ে ঘেঁষে একটা খালের মতো আছে। এটা আসলে খাল বা নর্দমা নয়! এটা ভুটানের কোনোএক পাহাড়ের ঝর্ণা। খালের মতো দেখতে সেই ঝর্ণা দিয়ে দিনরাত যেভাবে পানি নামে আসে, তা দেখেও মনে ভয় হয়!

ভয় হয় এই কারণে যে, ওই পানিতে নেমে কেউ দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। পানিতে নামার সাথে-সাথে তীব্র স্রোতে মুহূর্তেই টেনে নিয়ে যাবে, অন্য কোথাও। এই পাহাড়ি ঝর্ণা ভুটানের কোন পাহাড় থেকে উৎপন্ন, তা-ও আমার অজানা থেকে যায়। শোনা যায় এই ঝর্ণার প্রবাহিত খালের পানি থেকে ভারত-ভুটান যৌথভাবে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করেছে, এই ফ্রুন্টসলিঙে।

ঝর্ণার পানি প্রবাহিত হওয়া খালটা ফ্রুন্টসলিং টাউন থেকে অনেক নিচে। এই ঝর্ণা খালের ওপারে যেতে ছোট একটা ব্রিজ আছে। খাল পাড় হয়ে যাওয়ার পর চোখে পড়লো, একটা কুমিরের খামার। কুমিরের খামারটাও অনেক বড়। দিনের বেলা খামারের চারপাশ দর্শনার্থীদের ভীড় থাকে।

দেখলাম, সেই খামারে কুমিরগুলো কিন্তু পানিতে থাকে না। থাকে শুকনো জায়গায়। পানির সামান্য ব্যবস্থা শুধু ছোটো একটা পুকুরের মতো। সেই কুমিরের খামারে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কুমিরগুলো দেখতে প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এখানে এই ফ্রুন্টসলিঙে ছুটে আসে। লোকের ভীড় থাকে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত।

আর অনেক দর্শনার্থীদের সাথে আমিও ঘুরে-ফিরে খামারের সামনে অনেকক্ষণ সময় কাটালাম। তারপর ঝর্ণার খালটা পাড় হয়ে ফ্রুন্টসলিং টাউনের উপরে উঠে গেলাম। মনের আনন্দে ঘুরতে থাকলাম, ফ্রুন্টসলিং টাউনের এপাশ থেকে ওপাশ।

ফ্রুন্টসলিং টাউন খুবই সুন্দর! আমি যতক্ষণ সময় ফ্রুন্টসলিং টাউনে ছিলাম, ততক্ষণ আমার মনে হয়েছিল আমি গণচীন অথবা হংকঙের কোনোএক শহরে ছিলাম। উঁচুনিচু রাস্তা। রাস্তার পাশেই ছোট-বড় শপিংমল, বার, নামি-দামি হোটেল, আর বাহারি ফুল ও ফলের দোকান। ফ্রুন্টসলিং টাউনের এক কোণে প্রতিদিন বিকেলবেলা স্থানীয় বাসিন্দাদের সুবিধার্থে সন্ধ্যাকালীন বাজারও মেলে।

সেই বাজার রাত আটটা অবধি চলে। রাত আটটার পরপরই টাউনের সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। আর ভারত-ভুটান বর্ডার গেইট বন্ধ হয় সন্ধ্যার একটু পরই।

ফ্রুন্টসলিং টাউনের বাইরেও জয়গাঁও সপ্তাহে দু’দিন স্থানীয়দের হাট মেলে। সেই হাটের বেশিরভাগ ব্যবসায়ী ভারতীয়। সপ্তাহিক এই হাটে ভুটানি ব্যবসায়ীও আছে। তাদের ব্যবসা নিজের জায়গায় ফলানো তরিতরকারি, নিজেদের গাছের সুপারি, পাহাড়ের ঝোপঝাড় থেকে নানারকম শাকসবজি আর তরতাজা ফলের।

হাটবারে ভুটানিরা জয়গাঁও আসে অনেক দূরদূরান্ত থেকে। ফ্রুন্টসলিঙে গাড়ি চলাচলের জন্য একটামাত্র রাস্তা যা, ভারত-ভুটান হাইওয়ে নামে পরিচিত। এছাড়া ফ্রুন্টসলিং টাউনের আশ-পাশ দিয়ে ভুটানি স্থানীয়দের চলাচলের জন্য আর কোনও রাস্তা চোখে পড়েনি। তারা হাটবারে যার-যার বাড়ি-ঘর থেকে পায়ে হেঁটেই আসে।

ফ্রুন্টসলিঙে আর জয়গাঁও ঘুরে-ফিরে বুঝেছি, তাদের দেশে প্রচুর পরিমাণে ফল জন্মায়। ফলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফলন হয় কমলা। এর সাথে আপেল, আঙুর-সহ আরও নানারকম ফলও দেখা যায়। বেশিরভাগ বিক্রেতা ভুটানি মহিলা।

তারা ভারতের ভেতরে জয়গাঁও এসে ফল বিক্রি করে। আবার সন্ধ্যার আগে তাদের গন্তব্যে ফিরে যায়। কেউ কেউ ভারতের জয়গাঁও হাটে এসে বাজার-সদাইও করে নেয়।

এছাড়াও ভুটানের জনগণ সবসময়ের জন্যই ভারতে আসা-যাওয়া করতে পারে। আবার ভারতের জনগণও একইভাবে আসা-যাওয়া করে থাকে। ভুটানিরা শুধু আসা-যাওয়াই নয়, ভুটানিরা ভারতে এসে কাজকর্ম করে জীবিকা নির্বাহ করে প্রতিদিন।

অনেক ভুটান নাগরিককে ভারত এসে স্থায়ীভাবে বসবাসও করতে দেখেছি। ভারতের ভেতরে তাদের বসবাস সবচেয়ে বেশি ভারত-ভুটান সীমান্ত ঘেঁষা এলাকাগুলোতে। তবে তুলনামূলকভাবে বেশি বসবাস গুমট আর ফ্রুন্টসলিং ঘেঁষা জয়গাঁও এলাকায়।

ভুটানি জনগণ খুবই মিশুক। তারা খুব সহজেই একজন মানুষকে আপন করে নিতে পারে। তাদের আচার-ব্যবহারও মনে রাখার মতো। তা বোঝা গেলো দুপুরবেলা ফ্রুন্টসলিঙের ভেতরে থাকা একটা খাবারের হোটেলে ঢুকে।
হোটেলটা বেশি একটা বড়সড় নয়। কিন্তু এই হোটেলে দিনের সারাটা সময় থাকে কাস্টমারের ভীড়। হোটেলের ক্যাশে বসা একজন যুবতী মহিলা। হোটেল বয় বলতে যাদের দেখলাম, তারা সবাই মহিলা। হোটেলের মালামাল সংগ্রহ করে আনার জন্য হয়তো পুরুষ কর্মচারী থাকতে পারে। কিন্তু হোটেলের ভেতরে কোনও পুরুষ দেখা যায়নি।

হোটেলের ভেতরে গিয়ে বসার জন্য আমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম, কিন্তু বসার সুযোগ হচ্ছিল না। একজন মহিলা কর্মচারী আমাকে ফলো করে সামনে এসে তাদের ভাষায় কি যেন জিজ্ঞেস করছিল। তার কথার উত্তর যখন আমি দিতে পারছিলাম না, তখন হোটেলের মহিলা বুঝতে পারলো আমি তার ভাষা বুঝিনি। তারা শুধু তাদের ভাষাই নয়, তারা ভারতের সবকটা প্রদেশের ভাষা জানে এবং যখন যেই ভাষার দরকার-সেই ভাষায় কথা বলে।

তাই আমি যখন তার কথার উওর দিতে পারছিলাম না, তখন ওই মহিলা আমাকে বাংলায় জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কি ভাত খাবেন?”
আমি বললাম, “ইচ্ছে ছিলো ভাত খাওয়ার। কিন্তু কী করে খাবো? লোকের ভীড়ের জন্য তো ভেতরে যেতে পারছি না।”
আমার কথা শুনে ওই মহিলা বললো, “একটু অপেক্ষা করুন, আমি ব্যবস্থা করছি।”

দশ মিনিট পরই হোটেলের ভেতর থেকে ওই মহিলা আমাকে হাতে ইশারা দিয়ে ভেতরে ডেকে নিয়ে একটা সিটে বসিয়ে দিয়ে বললো, “কী খাবেন? মাছ না সবজি?” বললাম, “মাছ ভাত খাবো!”

দুই মিনিটের মধ্যেই একটা স্টিলের থালায় করে খাবার নিয়ে এসে আমার সামনে দিয়ে চলে গেলো। আমি খাবার দেখে অল্পক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম! থালার মাঝখানে অপ্ল দুমুঠো চিকন চালের ভাত। ভাতের চারদিকে সাজানো আছে সবজি কাটা আর তরকারির ছোট-ছোট বাটি।

এ-সবের মাঝে ডাল ছিলো তিন রকমের তিনটে বাটি, ভাজি এক বাটি। আর রুই মাছের তরকারি এক বাটি।

এসব দেখে আমি খাওয়ার ভা-ও পাচ্ছিলাম না। পাশে বসা কাস্টমারদের খাওয়া দেখে তাদের মতো করে খেলাম। তাদের রান্না করা তরকারিগুলো খেতে খুবই ভালো লেগেছিল।

খাওয়া-দাওয়া সেরে ক্যাশের সামনে যেতেই ওই মহিলা ক্যাশের সামনে গিয়ে তাদের ভাষায় খাবারের মূল্যের পরিমাণ বলে দিয়ে চলে গেলো। আমি আমার পকেট থেকে ভুটানি একশো টাকার একটা নোট বের করে ক্যাশে দিলাম। ক্যাশে বসা মহিলা আমাকে আশি টাকা ফেরত দিলো। আমি টাকা হাতে নিয়ে হোটেল থেকে বের হয়ে সোজা ফ্রুন্টসলিং ত্যাগ করে জয়গাঁও চলে এলাম।

জয়গাঁ এসে দেখি চারটে বাজতে লাগলো। পকেটে টাকা ছিলো প্রায়ই একশো ষাট টাকার মতো। বীরপাড়া যেতে বাস ভাড়া বিশ টাকা খরচ হলেও আরও বেশ ক’টা টাকা আমার কাছে থাকে।

এই ভেবে এক ভুটানি ফল বিক্রেতার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “এক ঝুরি কমলার দাম কত?”
মহিলা ফল বিক্রেতা বললো, “একশো টাকা।”
আমি আশি টাকা দিতে চাইলে ফল বিক্রেতা মহিলা আমাকে আশি টাকায় এক ঝুরি ফল দিয়ে দিলো। এক ঝুরি ফল মানে ষোল হালি কমলা।

ফলের ঝুরি নিয়ে বাস কাউন্টারে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। স্ট্যান্ডে একটামাত্র বাস দাঁড়িয়ে আছে। বাস ড্রাইভার আমার পরিচিত ছিলো না। এই বাস-ই বীরপাড়ার শেষ বাস। যাত্রী সীমিত! বাসে উঠে সিটে বসলাম। আরও কিছু যাত্রী উঠলো। এর কিছুক্ষণ পরই বাস বীরপাড়ার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলো। সন্ধ্যার পরপরই পৌঁছে বীরপাড়া। সেখান থেকে কমালার ঝুরি হাতে নিয়ে চলে গেলাম দিদির বাড়ি।

বড় দিদি ফলের ঝুরি দেখে মাথায় হাত রেখে বললো, “এতো, কমলা খাবে কে-রে? কোত্থেকে এনেছিস, শুনি?” বললাম, “ফ্রুন্টসলিং গিয়েছিলাম, দিদি। হাতে কিছু টাকা ছিলো। তাই ঝুরি-সহ কমলাগুলো নিয়ে এলাম। এগুলো আশ-পাশের বাড়ির ছেলে-মেয়েদের হাতে কিছু দিয়ে নিজেরা খাবেন।”

আমার কথামতো বড়দি তা-ই করলো। নিজেদের জন্য কিছু কমলা রেখে, আমার বেয়াই বাড়ি-সহ আশেপাশে থাকা আরও বাড়িতে বাদবাকি কমলা বিতরণ করলো। এভাবেই শেষ হলো ফ্রুন্টসলিং থেকে আনা এক ঝুড়ি কমলা, আর শেষ হলো আমার শূন্য হাতে ভুটান ফ্রুন্টসলিং ভ্রমণের গল্প।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
একরকম শূন্য হাতে ভুটান ফ্রুন্টসলিং ভ্রমণ করেছিলাম, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৩ টি মন্তব্য (লেখকের ১টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০২-০৭-২০২৩ | ৯:৫১ |

    যাপিত জীবনের বহু চড়াই উৎরাই এর প্রকাশ- বিশ্লেষণ আপনার কলমে অসাধারণ উঠে আসে। কথা-শৈলীর বিচারে আমি যতবারই আপনার লিখা পড়ি …. মুগ্ধ হই। একরাশ শুভেচ্ছা মি. নিতাই বাবু। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ০৫-০৭-২০২৩ | ২৩:১০ |

      আপনার মন্তব্যে লেখালেখির আগ্রহ আরও বেড়ে যায়, শ্রদ্ধেয় দাদা। 

      আশা করি ভালো থাকবেন সবসময়। 

      GD Star Rating
      loading...
      • মুরুব্বী : ০৬-০৭-২০২৩ | ৬:৩৪ |

        ধন্যবাদ। Smile

        GD Star Rating
        loading...