ডিএনডি বাঁধের ইতিহাস ও বর্তমান ভবিষ্যত

gh01
ডিএনডি বাঁধের বর্তমান লেক। ছবিটি বার্মাস্ট্যান্ড থেকে তোলা।

প্রিয় পাঠক, আপনি জানেন কি ডিএনডি বাঁধের ইতিহাস? এবং কেন-ই-বা এই বাঁধ তৈরি করেছিলো? আর কি-ই-বা উদ্দেশ্য ছিলো তৎকালীন সরকারের? যদি আপনার জানা না থেকে, তো আমার এই লেখাটা শেষ পর্যন্ত পড়লে ডিএনডি বাঁধের ইতিহাস এবং বর্তমান হালহকিকত সবকিছু জানতে পারবেন, আশা করি। তো চলুন শুরু করা যাক!

ডিএনডি’র সারমর্ম:
ডি=ঢাকা, এন=নারায়ণগঞ্জ, ডি=ডেমর। মানে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ও ডেমরা, এই তিন জায়গার কিছুকিছু অংশ জুড়ে ডিএনডি বাঁধ। যা, বর্তমান ঢাকা-৪ ও ৫ এবং নারায়ণগঞ্জ-৩ ও ৪ সংসদীয় আসন নিয়ে ডিএনডি বাঁধের অবস্থান।

ডিএনডি বাঁধের ইতিহাস:
জানা যায়, ১৯৬৬ সালে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা এলাকার ৮ হাজার ৩শ ৪০ হেক্টর জমি নিয়ে ইরীগেশন প্রকল্প তৈরীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তৎকালিক পূর্ব পাকিস্তান সরকার। যা বাস্তবায়ন করা হয় ১৯৬৮ সালে। নামকরণ করা হয় ডিএনডি বাঁধ।

তৎকালীন সরকারের উদ্দেশ্য:
তখনকার সময় শুধু ইরিধান চাষের জন্যই সরকার এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে তৎকালীন সরকারের ব্যয় হয়েছিল, ২৩৩ কোটি ২৭ লক্ষ টাকা। এর অভ্যন্তরে জমির পরিমাণ ছিলো, ৫ হাজার ৬৪ হেক্টর। এই ৫ হাজার ৬৪ হাজার হেক্টর জমিই ছিলো সেচের আওতায়।

কি কি ছিলো এই ডিএনডি প্রকল্প অভ্যন্তরে?
ডিএনডি বাঁধ এলাকায় পানি সেচ দেয়া ও নিষ্কাশনের জন্য বড় ‘কংস নদ’ নামে একটি প্রশস্ত খাল ছিল। এ খালের সাথে আরো যুক্ত ছিল নয়টি শাখা খাল। ছাড়াও ২১০টি ছিল আউট লেক, ১০টি নিষ্কাশন খাল। এসব খালের দৈর্ঘ্য ছিল ১৮৬ কিলোমিটারের মতো।

এরমধ্যে নিষ্কাশন খালের দৈর্ঘ্য ছিলো ৪৪ দশমিক ৫ কিলোমিটার। আর ইরীগেশন খালের দৈর্ঘ্য ছিল ৫১ দশমিক ২০ কিলোমিটার। ডিএনডি এলাকায় যদি বৃষ্টিতে পানি জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়, সেজন্য পানি সেচের জন্য তৈরী করা হয় শিমরাইল এলাকায় ডিএনডি পাম্প হাউজ।

বসানো হয় জাপানের তৈরী করা ৪টি বড় পাম্প, যা প্রতি সেকেন্ডে ৫’শ১২ ঘনফুট পানি নিস্কাশনের ক্ষমতা সম্পন্ন ছিল। দুইটি প্রধান পানি নিষ্কাশনের খাল কাটা হয়েছিল প্রথম পর্যায়ে, তা ছিল ৫৫ পয়েন্ট ২০ ও দ্বিতীয় পর্যায়ে ৪৫ পয়েন্ট ৪০’ কিলোমিটার। এবং দুইটি প্রধান সেচ খাল কাটা হয় প্রথম পর্যায়ে ১৪’শ ১০ ও দ্বিতীয় পর্যায়ে ৪৪’ কিলোমিটার।

খড়া মৌসুমে জমিতে পানি সেচ দিতে ও বর্ষা মৌসুমে পানি নিষ্কাশন করতে সরকার এ খাল গুলো তৈরী করেছিল। সেসব খালগুলো এখন প্রায় সবই অকেজো। তার প্রমাণ পাওয়া যায় চিটাগাং রোড সংলগ্ন সেচ পাম্পের সামনে গেলে। শীতলক্ষ্যা নদী থেকে সুবিশাল প্রশস্ত খাল এই পাম্পের সাথে সংযোগ, আছে সুইচ গেইট।

ডিএনডি বাঁধের বর্তমান:
সুখ-দুঃখ নিয়েই ভবসংসারে মানুষের জন্ম। বেঁচে থাকার জন্য মানুষ যেমন সুখ খোঁজে, একদিন নিদারুণ কষ্ট জীবনে আসতে পারে সেই চিন্তাও মানুষ করে। তাই বলে বছর বছর লাগাতার কষ্ট করে জীবন চলবে এটা কোন ধরনের কষ্ট? এটা একটা বেড়িবাঁধ এলাকার স্থায়ী জলাবদ্ধতার কষ্ট।

যাদের প্রতিবছরই নিদারুণ কষ্টে থাকতে হয় জলাবদ্ধতার করণে। তারাই হলেন এক সময়ের ২৩৩ কোটি ২৭ লক্ষ টাকা ব্যয়ের প্রকল্প, ডিএনডি বেড়িবাঁধ এলাকার বসবাসকারী মানুষ।

বৈশাখ মাস থেকে শুরু হয় ডিএনডি বাঁধের ভেতরে জলাবদ্ধতা। থাকতে হয় তাদের বর্ষাঋতুর শেষ পর্যন্তই পানিবন্দী হয়ে। সামান্য বৃষ্টিতেই ১২ লাখ (বর্তমান এর সংখ্যা ২০ লাখেরও বেশি) ডিএনডিবাসী পানিবন্দি হয়ে পড়ে মুহূর্তের মধ্যেই। একনাগাড়ে দুই-তিনদিন বৃষ্টি হলেই তাদের কষ্টের আর সীমা থাকে না। সেই কষ্টের চিত্র দেখা যায় সরেজমিনে গিয়ে। কীভাবে পানিবন্দি হয়ে ডিএনডিবাসী জীবনধারণ করছে।

এর কারণ শুধু একটাই, তা হলো, চাষের জমির সংখ্যা দিনে দিনে অনেক কমে যাচ্ছে। সাথে পানি নিষ্কাশনের খালগুলো ভরাট হয়ে গেছে। সাথে বেড়েছে জনবসতি ও নীট গার্মেন্টস-সহ নানারকম কলকারখানা।

এই গড়া আর জমি কেনা শুরু হয়েছিল ১৯৮৮-১৯৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পর থেকে। তখন ঢাকার আশেপাশের মানুষ মনে করেছিল, একরকম ভয়াবহ বন্যা এই বঙ্গদেশে ধারাবাহিকভাবেই হতে থাকবে। সেই ভাবনা থেকেই মানুষ উঠেপড়ে লেগে যায়, ডিএনডি বেড়িবাঁধের ভেতরে একটি বাড়ি তৈরি করার জন্য। এখনও অনেক টাকাওয়ালা মানুষ মনে করে ডিএনডি বাঁধের ভেতরে একটি বাড়ি করা, আর চাঁদের দেশে বাড়ি করা সমান কথা।

কিন্তু এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের মহৎ উদ্দেশ্য ছিল, এ প্রকল্পে বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নিষ্কাশন ও সেচ সুবিধা সৃষ্টির মাধ্যমে ও অতিরিক্ত ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যেই প্রকল্পটির বাস্তবায়ন। একই সাথে রাজধানী ঢাকায় অবস্থানকারীদের জন্য সতেজ রবি শষ্য সরবরাহ করা। বর্তমানে এর ফল দাঁড়িয়েছে উল্টো। ভবিষ্যৎ হতে পারে হবে আরও ভয়াবহ, আর না-হয় আরও তৈরি হতে পারে সৌন্দর্যের লীলাভূমি।

ডিএনডি বাঁধের ভবিষ্যৎ :
প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতার কারণে নানা দুর্ভোগ আর বিড়ম্বনার শিকার হয় ডিএনডির ২০ লাখেরও বেশি বাসিন্দা। এসময় জলাবদ্ধতার সঙ্গে যুক্ত হয় বিভিন্ন কল-কারখানার বিষাক্ত কেমিক্যালযুক্ত পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের পানি। ফলে বছরের প্রায় ৫ মাস জলাবদ্ধতার মধ্যেই অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয় ডিএনডি বাঁধবাসীদের।

02
ডিএনডি বাঁধের বর্তমান লেক। ছবিটি বার্মাস্ট্যান্ড থেকে তোলা।

এসব পরিস্থিতির উন্নয়নে ২০১৬ সালের ৯ আগস্ট একনেক সভায় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা (ডিএনডি) সেচ প্রকল্প এলাকায় নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়নে এবং জলাবদ্ধতা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে ৫৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘ডিএনডি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন (ফেইজ-২)’ শীর্ষক প্রকল্প অনুমোদিত হয়। ২০১৭ সালের ৮ ডিসেম্বর ডিএনডি এলাকার পানি নিষ্কাশনের উন্নয়নে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করে সেনাবাহিনী।

হাতিরঝিলের আদলে সাজবে ডিএনডি এলাকা:
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ডিএনডি এলাকার আর্থ-সামাজিক অবস্থা, পরিবেশগত মান ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন-সহ ডিএনডি বাঁধের জনগণের স্বাভাবিক জীবনমান নিশ্চিত হবে বলে সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে।

হাতিরঝিলের প্রকল্পের কাজকে মাথায় রেখেই এগিয়ে চলছে প্রকল্পের কাজ। এখানকার খালগুলো দখলমুক্ত করার পর এর পাড়গুলো বাঁধাই করে দেওয়া হচ্ছে। দুই পাশে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে। খালগুলোয় চলবে ওয়াটার ট্যাক্সি। ওই ওয়াটার ট্যাক্সিতে চড়ে ঢাকায় আসা-যাওয়া করা যাবে। এছাড়া ইটিপির (ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট) মাধ্যমে পানি নিষ্কাশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্লান্ট নিয়েও পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

প্রকল্পটি ‘রাষ্ট্রীয় জরুরি প্রয়োজনে’র কথা উল্লেখ করে এটি সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে বাস্তবায়নের জন্য ২০১৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রস্তাব পাঠায় পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়। প্রস্তাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অথবা সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়।

বর্তমানে প্রকল্পের কাজ পায়ই শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে। আশা করা যায় আর এক থেকে দেড়বছরের মাথায় শেষ হবে। প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শেষ হলে ডিএনডি বাঁধবাসী তাদের আগামী দিনের সুখের দিন হয়তো দেখতে পারবে।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
ডিএনডি বাঁধের ইতিহাস ও বর্তমান ভবিষ্যত, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৬ টি মন্তব্য (লেখকের ৩টি) | ৩ জন মন্তব্যকারী

  1. আলমগীর সরকার লিটন : ২১-০৫-২০২৩ | ১২:০৮ |

    ডিএনডি বাঁধের সম্পর্কে জানলাম অনেক কবি দা

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ২১-০৫-২০২৩ | ১৮:৪৮ |

      সুন্দর মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি, কবি দাদা।

      GD Star Rating
      loading...
  2. মুরুব্বী : ২১-০৫-২০২৩ | ১৭:২১ |

    আশা করা যায় আর এক থেকে দেড়বছরের মাথায় শেষ হবে। প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শেষ হলে ডিএনডি বাঁধবাসী তাদের আগামী দিনের সুখের দিন হয়তো দেখতে পারবে। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ২১-০৫-২০২৩ | ১৮:৪৯ |

      সুন্দর মন্তব্যের মধ্যে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি, প্রিয় দাদা।

      GD Star Rating
      loading...
  3. ফয়জুল মহী : ২২-০৫-২০২৩ | ১০:৪৮ |

    সুন্দর ভাবনার প্রকাশ
    শুভকামনা অবিরত।

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ২৫-০৫-২০২৩ | ৯:৫৬ |

      সুন্দর মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি, দাদা।

      GD Star Rating
      loading...