গণেশের আসল মাথা ও হাতির দেহ কোথায়? এবং সেগুলো কীভাবে পূজিত হচ্ছে?

images-2

আমি একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী। মানে আমি হিন্দু। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি আমার মা-বাবা, ভাই-বোন, কাকা-কাকী, মামা-মামী-সহ হিন্দু সমাজের সকলেই ধর্মীয় নিয়মনীতি মেনে বিভিন্ন দেবদেবীর পূজার্চনা করে আসছে। নিজেও নিজের এলাকায় প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হওয়া প্রায় সব কয়টা পূজায় অংশগ্রহণ করে ভক্তিভরে পালন করি। বেশি আনন্দ উপভোগ করি আমাদের হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ দূর্গা পূজায়। আর প্রতিবছর পহেলা বৈশাখের দিনটি শুরু করি গণেশ পূজা করে। বাংলা নববর্ষের এই দিনে অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে দেবতা গণেশের পূজা করার সময় নিজে নিজেকে প্রশ্ন করি, ❝আচ্ছা, এই দেবতা গণেশের হাতির মাথা কেন? তা যেভাবেই হাতির মাথা হয়েছে তো হয়েছেই, কিন্তু গণেশ দেবতার আসল মাথাটা কোথায় কীভাবে পূজিত হচ্ছে? আর হাতির দেহটি কোথায় আছে এবং কীভাবে পূজিত হচ্ছে?❞

এ শুধু নিজে নিজেকেই প্রশ্ন করি, কিন্তু উত্তর মেলাতে পারি না এবং কোনও পুরোহিতকে জিজ্ঞেস করলেও সদুত্তর পাই না। তারপরও থেমে থাকি না। এমনিতেই আমার জানার ইচ্ছেটা খুবই বেশি! সেই ইচ্ছে থেকেই শিব পুরাণ ঘেঁটে পেলাম গণেশ দেবতার দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন হওয়ার কাহিনী। কিন্তু গণেশ দেবতার আসল মাথা ও হাতির দেহের অবশিষ্ট কোনও কাহিনী খুঁজে পেলাম না। একদিন আমার বড় দাদা জীবিত থাকতে দাদাকে এবিষয়ে জিজ্ঞেস করলাম। (আমার বড় দাদা বর্তমানে স্বর্গীয়)। জিজ্ঞেস করার পর বড় দাদা বিস্তারিত ঘটনা বললেন। আমি শুনলাম! নিজের প্রশ্নের সাথে বড় দা’র কথা মেলালাম। মিলিয়ে দেখি বড় দাদার কথা আর আমার প্রশ্ন হুবহু মিলেছে।

তা কীভাবে মিললো, সেটা আমি আমার এই লেখার মাঝে প্রকাশ করছি। আগে শিব পুরাণ ঘেঁটে পাওয়া দেবতা গণেশের দেহ থেকে মাথা কীভাবে বিচ্ছিন্ন হলো এবং কীভাবে দেবতা গণেশের দেহে হাতির মাথা স্থাপন হলো, সে বিষয়গুলো তুলে ধরছি। আশা করি সবাই সাথে থাকবেন।

শিব পুরাণে উল্লেখ রয়েছে, একদিন নাকি কৈলাসে স্নানের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, দেবী পার্বতী। সে সময় তিনি দরজায় পাহারায় বসিয়ে রাখেন শিবের বিশ্বস্ত অনুচর নন্দীকে। আদেশ দেন, যতক্ষণ পার্বতী স্নানঘরে থাকবে ততক্ষণ কাউকে যেন ভিতরে প্রবেশ করতে না দেওয়া হয়। নন্দী পার্বতীর আদেশ পালন করতে পাহারায় বসলেন।

এদিকে সেই সময় সেখানে হাজির স্বয়ং মহাদেব। নন্দী ছিলেন শিবের ভক্ত ও অনুচর। নন্দী শিবের ভক্ত হওয়াতে শিবকে পার্বতীর স্নানঘরে প্রবেশ করতে বাঁধা দিতে পারে না। যখনই শিব পার্বতীর স্নানের সময় স্নান ঘরের সামনে আসে নন্দী শিবকে ভেতরে ঢুকতে দিতে বাধ্য হয়। এতে সময়সময় এরকম পরিস্থিতিতে পার্বতী খুবই বিরক্তিকর অবস্থায় পড়েন।

ঐরকম বিরক্তি থেকেই পার্বতী অন্তত স্নান করার সময় নন্দীর পরিবর্তে একজন বিশ্বস্ত পাহারাদার কামনা করলেন। সেই কামনা থেকেই পার্বতী নিজের শরীরে মাখা হলুদ থেকে সৃষ্টি করলেন এক মূর্তি। সেই মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে নাম রাখলেন ‘গণেশ’।‘গণেশ’ হলো পার্বতীর আজ্ঞাবহ পুত্র। আর এই আজ্ঞাবহ পুত্রই গণেশ হলেন পার্বতীর স্নান ঘরের বিশ্বস্ত পাহারাদার। পার্বতী স্নানঘরে ঢোকার আগে স্নান ঘরের দরজায় গণেশকে পাহারায় বসিয়ে রাখতো, আর গণেশের প্রতি আদেশ থাকতো স্নানঘরেকেউ স্নানঘরে প্রবেশ করতে না পারে। ঠিক তা-ই হতো। পার্বতীর আদেশ তাঁর আজ্ঞাবহ পুত্র গণেশ অক্ষরে অক্ষরে পালনও করতেন।

একদিন পার্বতী স্নানঘরে ঢোকার কিছুক্ষণ পর মহাদেব স্নান ঘরের সামনে এসে দেখে তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর নন্দী নেই! অপরিচিত এক বালক স্নান ঘরের দরজার দাঁড়িয়ে আছে। মহাদেব স্নানঘরে প্রবেশ করতে চাইলে গণেশ মায়ের আদেশ রক্ষার্থে বাঁধা দেয়। গণেশ বাঁধা দিলে মহাদেব ভীষণ রেগে যায়। মহাদেব রেগেমেগে গণেশকে মহাদেব বলল, ‘জান আমি কে?’। গণেশ বলল, ‘আপনি যে-ই হোন-না-কেন আমি অন্তত আপনাকে মা পার্বতীর স্নানঘরে ঢুকতে দিব না’।

গণেশ’র এই কথার পরই মহাদেব ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁর হাতে থাকা ত্রিশূল নিক্ষেপ করে গণেশের মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। তারপর স্নানঘর থেকে পার্বতী দৌড়ে এসে দেখে মাটিতে পরে আছে গণেশের দেহ ও মাথা । তা দেখে পার্বতী রেগে অগ্নিশর্মা। পার্বতী মনস্থির করলেন, প্রলয় নিত্য করে পৃথিবী মুহূর্তেই ধ্বংস করে ফেলবেন। পার্বতীর এই অবস্থা দেখে মহাদেব পড়লেন বিপাকে! মহাদেব পার্বতীর রাগ থামানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু কিছুতেই পার্বতীর রাগ থামাতে না পেরে মহাদেব ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন। ব্রহ্মা ঘটনাস্থলে আসলেন। ব্রহ্মা গণেশের ছিন্ন মস্তক জোড়া লাগিয়ে পুনরায় সেই আগের গণেশ করে দিবেন বলে পার্বতী ব্রহ্মা কথা দেন। ব্রহ্মার কথায় পার্বতী স্থির হলে ব্রহ্মা মহাদেবকে আদেশ দিলেন, ‘উত্তর দিকে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকা যেকোন প্রাণী বা পশুর মাথা কর্তন করে এনে গণেশের দেহের সাথে স্থাপন করতে। তা যেন হয় অতি তাড়াতাড়ি। দেরি হলে বিপাকে পরতে হবে। ব্রহ্মার কথামতো মহাদেব একজন বিশ্বস্তকে পাঠালেন, কোথাও উত্তর মুখী শুয়ে থাকা কোনও প্রাণী বা পশু পাওয়া যায় কিনা। পাওয়া গেলেই সেই প্রাণী বা পশুর মাথা কর্তন করে আনতে।

মহাদেব’র আদেশে ওই বিশ্বস্ত সহচর সাথে সাথে রওনা দিলেন, সোজা উত্তর মুখী। অনেক দূর যেতেই উত্তর মুখী শুয়ে থাকা একটা হাতি দেখতে পেলেন। সাথে সাথে মহাদেবের ঘনিষ্ঠ সহচর হাতির দেহ থেকে মাথা কর্তন করে এনে ব্রহ্মার হাতে দিলেন। ব্রহ্মা তন্ত্রমন্ত্র যোগে ওই হাতির মাথা পার্বতীর আজ্ঞাবহ পুত্র গণেশের দেহে স্থাপন করলে। গণেশ হাতির মাথায় পুনঃজীবন লাভ করলেন। গণেশের জীবন ফিরে পাবার পর দেবতা ব্রহ্মা গণেশের দেহ থেকে ছিন্ন হওয়া মাথা আর হাতির দেহ একসাথে নির্দিষ্ট একস্থানে মাটিচাপা দিয়ে রাখতে বললেন। দেবতা ব্রহ্মার কথামতো ঠিক তা-ই হলো, তাই করলো।

তারপরও যখন পার্বতীর মনোকষ্ট তখনো দূর হচ্ছিল না। তা দেখে ব্রহ্মা পার্বতীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখনও রাগ কেন?’। উত্তরে পার্বতী বললেন, ‘গণেশ তো পুনঃজীবন লাভ করলো ঠিকই। কিন্তু গণেশের আসল মাথার বিহিত কী হবে, আর নিরীহ অবুঝ প্রাণী হাতির দেহের বিহিত কী হবে, তার একটা সুরাহা দরকার। আর গণেশের হাতির মাথা দেখে দেবকুলে ঘৃণার প্রাত্র যাতে না হয়, এই বিষয়গুলোর সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত কিছুতেই আমার রাগ থামবে না।’
পার্বতীর কথা শুনে ব্রহ্মা ওই তিনটে বিষয়ের বিধান দিলেন, এরকম: (১) ❝গণেশের হাতির মাথা দেখে কেই ঘৃণা করতে পারবে না। গণেশ হবেন গণপতি। (২) সকল দেবতার পূজার আগে গণেশের পূজা করতে হবে। আর গণেশের আসল মাথাও বিফলে যাবে না। আসল মাথাও সকল দেবতার পূজার আগেই থাকবে। (৩) হাতির দেহও গণপতি গণেশের সাথেই থাকবে এবং সকল দেবদেবীর পূজার আগে গণেশের সাথেই পূজিত হবে।❞ সেই থেকে দেবকুলে আর সৃষ্টিকুলে সেভাবেই সেই বিধান মেনেই সকল দেবদেবীর পূজার আগে গণেশের পূজা হয়ে আসছে। একইভাবে দেবতা গণেশের আসল মাথা ও হাতির আসল দেহ পূজিত হচ্ছে।

গণেশ দেবতার মাথা নিয়ে এরকম আরও কাহিনী সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মাঝে প্রচলিত আছে। তারমধ্যে একটি কাহিনী হলো, এরকম ↓↓↓

যেমন: ❝শনিদেব হলেন পার্বতীর ভাই। সেইমতে গণেশ হলেন শনিদেবের ভাগিনা। গণেশকে একনজর দেখে আশীর্বাদ দেয়ার জন্য পার্বতী ভাই শনিদেবকে কৈলাশে আসতে বললে, শনিদেব বললেন, ‘আমি ভাগিনাকে দেখলে ভাগিনার দেহ থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তাই আমি ভাগিনাকে দেখতে যাবো না।’ এরপরও পার্বতীর বিশেষ অনুরোধে শনিদেব গণেশকে দেখতে কৈলাশে গেলেন, বোন পার্বতীর বাড়ি। বোনের বাড়ি গিয়ে ভাগিনাকে দেখামাত্র ভাগিনা গণেশের দেহ থেকে সাথে সাথে মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অতঃপর উপরোল্লিখিত ব্রহ্মার আদেশের মতোই শনিদেব একই আদেশ দিলেন। সেই আদেশ মতে উত্তর মুখী শুয়ে থাকা একটা হাতির মাথা কর্তন করে দেবতা গণেশের দেহে স্থাপন করা হয়।❞

এখন লাখ টাকার প্রশ্ন হলো, গণেশের আসল মাথা কোথায়, আর হাতির দেহ-ই-বা কোথায় এবং কীভাবে সকল দেবদেবীর পূজার আগে এই দুটোর (১) গণেশের আসল মাথা (২) হাতির দেহ’র পূজা হচ্ছে?

হ্যাঁ, হচ্ছেও ঠিক তা-ই। দেবতা ব্রহ্মার বিধান ঠিকঠাকমতো বলবত আছে। তা কীভাবে আছে? আছে এভাবে! উপরোল্লিখিত ↑↑↑ দেবতা ব্রহ্মা বিধান দিয়ে পার্বতীর রাগ থামিয়ে আরও বললেন, ‘এখন গণেশের আসল মাথা ও হাতির দেহ একসাথে একটা নির্দিষ্ট স্থানে মাটিচাপা দিয়ে রাখতে হবে। সেখান থেকে একটা নারিকেল গাছ সৃষ্টি হবে। সেই নারিকেল গাছের নারিকেল হবে গণেশের আসল মাথা। আর হাতির দেহও যখন মাটির সাথে মিশে যাবে, তখন পৃথিবীর সব স্থানের মাটির সাথেই মিশে যাবে। ওই মাটি দিয়ে মানুষ তৈরি করবে ঘট। এই ঘটই হবে হাতির দেহ। প্রত্যেক পূজার আগে দেবদেবীর মূর্তির সামনে ঘট স্থাপন করতে হবে।

images-3

সেই ঘটে থাকবে জল। এর উপরে থাকবে একটা আম্রপল্লব। তার উপরে থাকবে নারিকেল। তার উপরে থাকতে হবে একটা বস্ত্র। এই ঘট আর নারিকেল মিলেই হবে গণেশের মাথা আর হাতির দেহ। এই ঘটকে আগে পূজা দিয়ে প্রত্যেক দেবদেবীর পূজা শুরু করতে হবে । এছাড়াও বছরের প্রথম দিন যেমন:পহেলা বৈশাখ। এই দিন শুরু হবে গণেশ দেবতার পূজার মধ্যদিয়ে। সেই থেকে এখনও বছরের প্রথম দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এইদিন বা বছর শুরু করে গনেশ পূজা দিয়ে।

তাহলে আমরা কী বুঝতে পারলাম? আমরা বুঝতে পারলাম যে, দেবতা গণেশের আসল মাথা হলো “নারিকেল”, আর হাতির আসল দেহটি হলো “ঘট”। নারিকেল, আম্রপল্লব, আর মাটির তৈরি ঘট মিলিয়ে হলো যেকোনো পূজার “মঙ্গলঘট”।

আশা করি এখন গণেশের আসল মাথা আর হাতির দেহ নিয়ে কারোর প্রশ্ন থাকতে পারে না।

ঘট, ঘটের উপরে আম্রপল্লব তার উপরে নারিকেল এবং বস্ত্রেরও একটা বিধান আছে। তা আর এই লেখায় আমি উল্লেখ করলাম না লেখার শব্দ সংখ্যা অধিকতর বেড়ে যাবার কারণে। আজ এখানে এ-পর্যন্তই।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
গণেশের আসল মাথা ও হাতির দেহ কোথায়? এবং সেগুলো কীভাবে পূজিত হচ্ছে?, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৪ টি মন্তব্য (লেখকের ২টি) | ২ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ১৯-০৪-২০২৩ | ১৩:৩৭ |

    বেশ ভালো মনযোগ দিয়ে পড়লাম, বুঝে নিতে চেষ্টা করলাম।

    প্রশ্ন গুলোন আমার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে মাথায় ঘুরপাক খেলেও সদুত্তর কারু কাছে চাইনি কারণ পাছে কেউ ভুল বুঝে ফেলেন এই সংকোচে।

    আজকের পোস্ট জ্ঞান পরিধি বাড়াতে আমাকে অন্তত সাহায্য করেছে। ধন্যবাদ বাবু। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ২০-০৪-২০২৩ | ১২:০৪ |

      এবিষয়ে আমি অজ্ঞ ছিলাম, দাদা। যদি বড় দা'কে জিজ্ঞেস না করতাম, তাহলে আর শবনীড়ে এই পোস্ট লেখা হতো না। 

      GD Star Rating
      loading...
  2. ফয়জুল মহী : ২০-০৪-২০২৩ | ৮:৫৭ |

    পড়লাম জানলাম । ভালো থাকবেন

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ২০-০৪-২০২৩ | ১২:০৫ |

      সুন্দর মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি, দাদা।

      GD Star Rating
      loading...