মোবাইলে খেয়েছে ডাকবাক্স-সহ আরও অনেককিছু

286

বছর তিনেক আগে একটা জরুরি কাজে নারায়ণগঞ্জ যাচ্ছিলাম। যাচ্ছিলাম অটো চড়ে। হাজীগঞ্জ ফেরিঘাট পেরিয়ে যখন কিল্লারপুলের দিকে অগ্রসর হচ্ছি, রাস্তার বাম পাশে ময়লা আবর্জনায় মধ্যে একটা ডাকবাক্স দেখতে পেলাম। ডাকবাক্সটি অনেক আগে থেকেই এখানে বসানো হয়েছিল। তবে আগে ডাকবাক্সটির সামনে এতো ময়লা আবর্জনা ছিল না, সবসময় পরিষ্কারই ছিল। বর্তমানে ডাকবাক্সটি পড়ে আছে অযত্নে অবহেলায়।

ডাকবাক্সটি ময়লার স্তুপের উপর ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। বাক্সের চারপাশে থাকা জঙ্গলে একাকার। দেখে মনে হয় হয়তো মাসে, নাহয় বছরে একবার এই ডাকবাক্সটির তালা খোলা হয়। ডাকবাক্সটির অবস্থান হলো হাজীগঞ্জ কিল্লারপুল সংলগ্ন ড্রেজার সংস্থার মেইন গেইট ঘেঁষা। ডাকবাক্সটি দেখে আগেকার কথা মনে পড়ে গেল।

একসময় এদেশের প্রতিটি মানুষের কাছে ডাকবাক্স ছিল খুবই সম্মানী বস্তু। এই ডাকবাক্স ছিল অগণিত মানুষের সুখ-দুঃখের সাথি। এসবের জ্বলন্ত সাক্ষী আমি নিজেই। দেখতাম একটা চিঠির অপেক্ষায় আমার মা ডাকপিয়নের বাড়িতেও দৌড়াতে। বাবার প্রেরিত চিঠি মা হাতে পেয়ে অস্বস্তির নিশ্বাস ফেলতো। চিঠি হাতে পেয়ে ডাকপিয়নকে কতনা অনুরোধ করতো, চিঠি পড়ে শোনানোর জন্য।

ছোটবেলার স্মৃতিগুলো এখনো মাঝে মাঝে মনে পড়ে। মনে পড়ে তখন, যখন একটা পোস্ট অফিসের সামনে অথবা রাস্তার ধারে ডাকবাক্স চোখে পড়ে। ছোটবেলা দেখতাম আমার মা চিঠির মাধ্যমে বাড়ির সুসংবাদ, দুঃসংবাদ বাবাকে জানাতেন। বাবা থাকতেন নারায়ণগঞ্জ। চাকরি করতেন সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন চিত্তরঞ্জন কটন মিলে। আমার মা লেখা-পড়া জানতেন না। চিঠি লেখাতেন গ্রামে থাকা পাশের বাড়ির শিক্ষিত মানুষ দিয়ে।

এখনকার মতন তো শিক্ষিত মানুষ তখনকার সময়ে এতো ছিল না। কোনও কোনও গ্রামে একজন মেট্রিক পাস মানুষও ছিল না। যদি একটা গ্রামে একজন মানুষ ভাগ্যক্রমে মেট্রিক পাস করতো, দু’একটা গ্রামের মানুষ তাকে দেখার জন্য ভিড় জমাতো। আমাদের গ্রামে একই বাড়িতে তিনজন শিক্ষিত মানুষই ছিলেন। তাঁরা তিনজনই ছিলেন স্কুলের মাস্টার। সেই কারণেই তাদের বাড়ির নাম হয়েছিল মাস্টার বাড়ি। এঁরা হলেন, দক্ষিণা মাস্টার, প্রমোদ মাস্টার ও সুবল মাস্টার।

মাকে যিনি সবসময় চিঠি লিখে দিতেন, তিনি ছিলেন সুবল মাস্টার। সম্পর্কে নিজেদের আত্মীয়। চিঠি লেখাও একটা বিরক্তের কাজ। চিঠি লিখতে হলে সময় লাগে, মন লাগে, ধৈর্য লাগে, তারপর হয় চিঠি লিখা। সব শিক্ষিত মানুষ চিঠি লিখে দেয় না। চিঠি লিখতে পারে না, জানেও না। সুবল মাস্টার আমার নিকটাত্মীয় জেঠা মশাই। আমার বাবার খুড়াততো ভাই (চাচাতো ভাই)। আমার বাবার বয়স থেকে সুবল মাস্টার অল্প কয়েক মাসের বড়। তাই আমার মা’র ভাশুর।

মা জেঠাদের বাড়িতে গিয়ে অনেকসময় ফিরে আসতেন, চিঠি না লেখাতে পেরে। এভাবে দু’তিনদিন যাবার পর একদিন শ্রদ্ধেয় জেঠা মশাই মাকে সময় দিতেন, চিঠি লিখে দিতেন। জেঠা-মশাই কাগজ কলম হাতে নিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করতেন কী ব্যাপারে চিঠি দিবে? মা বলতেন, ঘরে চাল নেই, ডাল নেই, তেল নেই, হাট-বাজার করার মতো টাকা-পয়সাও নেই। এই নিয়েই আপনি সুন্দর করে লিখে দেন, যাতে আপনার ভাই বুঝতে পারে।
তখনকার সময়ে শর্টকাট ( মানে কিছু লেখা) চিঠি লিখতে পোস্টকার্ডই বেশি ব্যবহার করতো। একটা পোস্টকার্ডের মূল্য ছিল মাত্র ১৫ পয়সা। আর একটা ইনভেলাপের মূল্য ছিল মাত্র চার আনা(২৫) পয়সা মাত্র। তখনকার সময়ে দশ পয়সার খুবই মূল্য ছিল। সহজে বিনা দরকারে কেউ পাঁচটি পয়সাও খরচ করতো না। পোস্টকার্ড আর ইনভেলাপের মূল্য দশ পয়সা এদিক সেদিক হওয়াতে মানুষ অল্প কথার জন্য পোস্টকার্ডই বেশি ব্যবহার করতো।

পোস্টকার্ডে জেঠা মশাই চিঠি লিখে মাকে পড়ে শোনাতেন, মা শুনতেন। পোস্টকার্ড বুকে জড়িয়ে বাড়ি চলে আসতেন। পরদিন সকালবেলা আমি স্কুলে যাবার সময় মা আমার কাছে পোস্টকার্ডটা দিয়ে বলতেন, “বাজারে গিয়ে চিঠিটা পোস্ট অফিসের সামনে থাকা বাক্সে ফেলে দিবি”। মায়ের কথামত পোস্টকার্ডটা খুব যত্নসহকারে বইয়ের ভেতরে রেখে বাড়ি থেকে রওনা হতাম।

আমাদের বাড়ি থেকে পোস্ট অফিসের দূরত্ব ছিল প্রায় এক কিলোমিটার। বাজারে যাবার রাস্তার পাশেই ছিল স্কুল। স্কুলে বই খাতা রেখে চিঠি নিয়ে সোজা বাজারে চলে যেতাম। ডাকবাক্সে পোস্টকার্ডটা ফেলে দিয়ে তারপর আসতাম স্কুলে। স্কুল ছুটি হবার পর বাড়ি আসার সাথে সাথেই মা জিজ্ঞেস করতেন, ‘চিটি বাক্সে ফেলেছিস’? বলতাম, ‘হ্যাঁ মা ফেলেছি’!

এরপর থেকে মা অপেক্ষায় থাকতেন ডাকপিয়নের আশায়। মানে বাবার দেওয়া চিঠি হাতে পাবার আশায়। কখন আসবে বাবার চিঠি বা মানি অর্ডার করা টাকা? পোস্ট অফিস থেকে (ডাকপিয়ন) যিনি বাড়ি বাড়ি চিঠি পৌঁছে দিতেন, তিনি গ্রামের সবার নাম জানতেন এবং বাড়িও চিনতেন। ডাকপিয়ন আমাদের পাশের গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন।

পোস্ট অফিসে চিঠি বা মানি অর্ডার করা টাকা আসার পরপরই ডাকপিয়ন পৌঁছে দিতেন বাড়িতে। বকশিস হিসেবে ডাকপিয়নকে এক টাকা বা লাড়ু-মুড়ি দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। এতে ডাকপিয়ন সাহেব খুব খুশি হতেন। বাবা যদি মানি অর্ডার করে টাকা পাঠাতেন, তাহলে আমার মা বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেই টাকা রেখে দিতেন। আর যদি টাকার বদলে চিঠি আসতো, তাহলে হাতে পাওয়া চিঠি ডাকপিয়ন সাহেবকে দিয়ে পড়াতেন, না হয় চিঠি নিয়ে দৌড়াতেন মাস্টার বাড়ি।

মায়ের চিন্তা শুধু কী সংবাদ এলো চিঠির মাধ্যমে। জেঠা মশাই মাকে দুঃখ সুখ নিয়ে বাবার লেখা চিঠি পড়ে শোনাতেন, মা চুপ করে বসে শুনতেন। সেসময়ে আমার মায়ের মতো এমন আরও অনেক মা ছিল, যারা লেখা-পড়া জানতো না। তাঁরা ডাকপিয়ন থেকে চিঠি হাতে পেলে অনেকেই দুঃচিন্তায় পড়ে যেতো। ভাবতো সুসংবাদ এলো, না দুঃসংবাদ এলো?

এখন আর সেই দিন নেই। মানুষ এখন চিঠি বা পত্র লেখা প্রায় ভুলে গেছে। মানুষ এখন কলম দিয়ে একটুকরো কাগজে মনের কথা লিখতে চায় না। মানুষ এখন এন্ড্রোয়েড মোবাইলের কীবোর্ড ব্যবহার করে। মেইল আর মেসেজের মাধ্যমে প্রিয়জন আর স্বজনদের সাথে মনের ভাব আদানপ্রদান করে থাকে। তাই পোস্ট অফিসে আগের মতো তেমন ভিড় দেখা যায় না। ডাকবাক্সেও মানুষ এখন কেউ চিঠি ফেলতে চায় না, ফেলেও না। এখন চিঠির যুগ প্রায় শেষপ্রান্তে এসে গেছে। এখন মোবাইল ফোনের যুগ এসেছে।

একসময় দেশের প্রতিটি পোস্ট অফিসের সামনে, আর গ্রাম গঞ্জের হাট-বাজারের রাস্তার পাশে দেখা যেতো ডাকবাক্স। অনেক স্থানে গাছের ঢালেও ঝুলানো ছিলো ডাকবাক্স। তবে আগের মতো ডাকবাক্সের তেমন একটা কদর নেই। আগেকার সময়ে ডাকবাক্সে মানুষ চিঠি ফেলতো। ডাকপিয়ন সময়মত ডাকবাক্সের তালা খুলে চিঠি বের করতো। তারপর চিঠিগুলো একটা বস্তা ভরে নিকটস্থ পোস্ট অফিসের উদ্দেশে রওনা হতো।

রাতবিরেতে ডাকপিয়নের হাতে থাকতো একটা হারিকেন আর আর একটা বল্লম। পায়ে বাঁধা থাকতো নূপুরের মতন ঝুনঝুনি। ডাকপিয়ন চিঠির বস্তা কাধে নিয়ে ‘বস্তিওয়ালা জাগো, হুশিয়ার সাবধান’ বলে চিৎকার করতে করতে হেঁটে যেতো। খানিক পরপরই হামাগুড়ি দিয়ে চিৎকার করতো, আর লাফিয়ে লাফিয়ে গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে হাঁটতে থাকতো। ডাকপিয়নের গলার আওয়াজ আর পায়ে বাঁধা সেই ঝুনঝুনির শব্দে মানুষ ঘুম থেকে জেগে উঠতো।

ডাকপিয়ন কতো বাধা আর ঝড়বৃষ্টি, চোর ডাকাতের ভয় উপেক্ষা করে চিঠির বস্তা পৌঁছে দিতো হেড পোস্ট অফিসে। হেড পোস্ট অফিসের মাধ্যমে চিঠি চলে যেতো দেশের বিভিন্ন জেলাশহরে। পৌঁছে যেতো ডাকবাক্সে ফেলা প্রেরকের চিঠি প্রাপকের হাতে। সেসময় এই ডাকবাক্সের অনেক আদর ছিল, কদর ছিল, যত্ন ছিল। মানুষ চিঠি প্রেরণের জন্য, টাকা পাঠানোর জন্য ছুটে যেতো নিকটস্থ পোস্ট অফিসে। আবার অনেকেই অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে থাকতো ডাকপিয়নের আশায়। কখন হাতে এসে পৌঁছবে প্রিয়জন আর স্বজনদের চিঠি, সে আশায় লেখাপড়া না জানা মানুষেরা চিঠি হাতে পেয়ে কেউ আবার হাউ-মাউ করে কাঁদতো। মনে করতো কী যেন দুঃসংবাদ এসেছে। অনেকে আবার খুশিতে হয়ে যেতো আত্মহারা। এখন মোবাইলের জগতে ডাকপিয়ন আর ডাকবাক্স যেন মোবাইলে খেয়েই ফেলেছে।

শুধু ডাকবাক্সই খায়নি, খেয়েছে আরও অনেককিছুই। যেমন: আগে মানুষে রেডিওর গান শুনতে একটা মনোমত রেডিও কিনে ঘরে রাখতো। সেই রেডিও চালু করে গান শুনতো। খবর শুনতো। নাটক শুনতো। আবহাওয়া বার্তা শুনতো। আর এখন? একটা কমদামি মোবাইলেও থাকে এফএম রেডিও। মিউজিক প্লেয়ার। ভিডিও প্লেয়ার। ঘড়ি। বার্তা প্রেরণেরও অত্যাধুনিক সিস্টেম। এক মোবাইল থেকে আরেক মোবাইলে টাকা প্রেরণের সহজ সুবিধা। মোবাইলে পানির বিল পরিশোধ করা। বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করা। যেকোনো ব্যাংক থেকে নিজের হাতে থাকা মোবাইল টাকা আদানপ্রদান করা-সহ আরও যে কয় কী বাহারি সুবিধা, তা আর লিখে শেষ করা যাবে না। তাই আর কথা আর লেখার শব্দ সংখ্যা না বাড়িয়ে বলতে চাই, বর্তমান যুগের মোবাইলে অনেককিছুর মধ্যে ডাকবাক্সটাকে ভালো করে খেয়েছে।

বি:দ্র: এই লেখাটা আরও অনেক আগে কয়েকটা ব্লগে পোস্ট করেছিলাম। আজকে আবার লেখার কিছু ঘষামাজা করে পোস্ট করলাম। ছবিটি আরও তিন বছর আগের তোলা।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
মোবাইলে খেয়েছে ডাকবাক্স-সহ আরও অনেককিছু, 5.0 out of 5 based on 1 rating
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

২ টি মন্তব্য (লেখকের ১টি) | ১ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ২৪-০৭-২০২২ | ৯:৪১ |

    কখন হাতে এসে পৌঁছবে প্রিয়জন আর স্বজনদের চিঠি, সে আশায় লেখাপড়া না জানা মানুষেরা চিঠি হাতে পেয়ে কেউ আবার হাউ-মাউ করে কাঁদতো। মনে করতো কী যেন দুঃসংবাদ এসেছে। অনেকে আবার খুশিতে হয়ে যেতো আত্মহারা। এখন মোবাইলের জগতে ডাকপিয়ন আর ডাকবাক্স যেন মোবাইলে খেয়েই ফেলেছে। ___ ঠিক তাই। Frown

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ২৪-০৭-২০২২ | ১৮:৩৩ |

      হ্যাঁ, দাদা। তা নিয়ে সময় সময় খুবই ভাবতে হয়, আমাকে। সুন্দর মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। 

      GD Star Rating
      loading...