অনেকদিন ধরে শোনা যাচ্ছিল পুরোনো রেলপথ নতুন করে মহাসড়ক হওয়ার কথা। কথাটি কারোর মুখের কথা নয়, খোদ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশ করা। জারিকৃত প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয় গত ২৫ মে (মঙ্গলবার) ২০২১ইং। এদিন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, নারায়ণগঞ্জ জেলার খানপুর হতে হাজীগঞ্জ গোদনাইল হয়ে ইপিজেড পর্যন্ত আঞ্চলিক মহাসড়কটি ভাষা সৈনিক “বেগম নাগিনা জোহা সড়ক” নামকরণ করা হয়েছে।
এই সড়কটি আগে ছিলো রেলপথ বা রেললাইন। রেললাইনটি দেশ স্বাধীন হবার আগে শুধু নারায়ণগঞ্জ গোদনাইলস্থ বর্তমান নাম বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থা (সী.) বা সংক্ষেপে “কো-অপারেটিভ” জুট প্রেসের জন্যই রেললাইন স্থাপন করা হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এখানে সরকারের খাদ্যসামগ্রী মজুদ রাখার কাকগুলো গোডাউন ছিলো। কোনও দুর্যোগের কারণে দেশে খাদ্যসংকট দেখা দিলে এখানকার গোডাউন থেকে দেশের বিভিন্ন জেলা-শহরে জরুরি খাদ্য সরবরাহ করা হতো।
ছবিটি গোদনাইল চৌধুরীবাড়ি আদর্শ বাজারের একাংশ।
বলে রাখা ভালো যে, “বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থা (সী.) জুট প্রেসে বর্তমানে সরকারের কোনও খাদ্য মজুদ রাখার গোডাউন নেই। এখন এখানে পাট মজুদ রাখার অনেকগুলো গোডাউন আছে এবং পাট বেলিং করার জুট প্রেস আছে। তবে এমন সরকারি মালামাল মজুদ রাখার গোডাউন শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব পাড়ে আরও দুটি আছে। একটি সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় ‘বিশ্ব গোডাউন’ নামে পরিচিত। কেউ কেউ বলে ‘সাইলো’। আরেকটি নারায়ণগঞ্জ নগর খানপুর সংলগ্ন বরফকল নামক স্থানে।”
তো যাইহোক, মূল কথায় ফিরে আসি!
তখনকার সময়ে এখানে (কো-অপারেটিভ বা বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থা (সী.)-এ থাকা গোডাউনে মজুদ থাকা খাদ্যসামগ্রীও আনা হতো দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে। সেসময়ে এখানে থাকা গোডাউন গুলোতে খাদ্য ও বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী আনা-নেওয়া করার একমাত্র উপায় ছিলো নৌপথ। নৌপথ ছাড়া আর অন্য কোনও পথে এখানকার এসব গোডাউন থেকে কোনও মালামাল আনা যেতো না, মালামাল নেওয়াও যেতো না।
এতে সরকারের খরচ হতো অনেক এবং মালামাল সরবরাহের কাজেও লেগে যেতো দীর্ঘ সময়। তাই তৎকালীন সরকার সময় ও খরচ বাঁচতে এখানে খাদ্যসামগ্রী মজুদ রাখা ও দ্রুত সময়ে ডেলিভারি দেয়ার জন্য নারায়ণগঞ্জ চাষাঢ়া রেলস্টেশন থেকে খানপুর, তল্লা, হাজীগঞ্জ, পাঠানটুলির ভেতর দিয়ে “বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থা (সী.)” পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন করে রেলপথে খাদ্যসামগ্রী-সহ বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী আনা-নেওয়া শুরু করে।
তারপর এই সংস্থার সন্নিকটে থাকা গোদনাইলস্থ “বিজেএমসি” জুট প্রেস কর্তৃপক্ষও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দ্রুত সময়ে কম খরচে পাট আনা-নেওয়ার জন্য রেল সংযোগ স্থাপন করে। পরবর্তীতে এশিয়ার সেরা আদমজী জুট মিলস কর্তৃপক্ষও তাদের সুবিধা মাথায় রেখে রেল কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করলে, রেল কর্তৃপক্ষ আদমজী জুট মিলেও রেল সংযোগ দিয়ে দেয়।
তারপর স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকার “সাইলো” বা “সেলো” বা ‘বিশ্ব গোডাউনে’র জন্যও রেল সংযোগ স্থাপন করা হয়। এরপর থেকে অনেক বছর পর্যন্ত ‘বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থা (সী.), বিজেএমসি, আদমজী জুট মিলস ও সাইলো বা সেলো বা বিশ্ব গোডাউন’এ পণ্যবাহী রেল নিয়মিত যাতায়াত করতো।
দেশ স্বাধীন হবার পরও ১৯৮৬-৮৭ সাল পর্যন্ত এই রেলপথে পণ্যবাহী রেল চলাচল করতে নিজেও দেখেছি। ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার পর আর এই রেলপথে পণ্যবাহী রেল চলাচল করতে আর দেখা যায়নি। কিন্তু রেললাইন ঠিকই থেকে যায়।
তারপর আস্তে আস্তে যখন দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে আর নারায়ণগঞ্জ শহরে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান হুহু করে বাড়তে থাকে, তখনই দেশের বিভিন্ন জেলা-শহর থেকে কর্মজীবী মানুষ কাজের সন্ধানে নারায়ণগঞ্জ জেলার বিভিন্ন জায়গায় আসতে শুরু করে। আসতে থাকা কিছু মানুষ থাকতে শুরু করে ভাড়া বাসায়, কিছু মানুষ থাকতে থাকে রেল লাইনের পাশে বস্তি বানিয়ে।
বিভিন্ন জেলা-শহর থেকে আসা মানুষের সাথে কিছু স্থানীয় বাসিন্দারাও যার যার বাড়ির সামনে রেল লাইনের পাশে পরিত্যক্ত জায়গা ও জলাশয় দখলে নিয়ে যারযার মতো করে ঘরবাড়ি দোকানপাট গড়ে তুলতে শুরু করে। এভাবে একসময় নারায়ণগঞ্জ চাষাঢ়া হতে সিদ্ধিরগঞ্জ বিশ্ব গোডাউন পর্যন্ত পুরো রেললাইনের দুই পাশ বেদখল হয়ে পড়ে এবং রেল লাইনের পাশে গড়ে ওঠা ঐসব বস্তি ঘরগুলো পরিনত হয় একেক জনের একেকটা বাড়িতে। সেসব ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট নিজেদেরই মনে করে থাকতে থাকে বছরের পর বছর।
এতো বছর পর যখন গত ২৫ মে (মঙ্গলবার) ২০২১ইং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় থেকে নতুন সড়কের নামকরণ-সহ প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়, তখনই রেল লাইনের জায়গা দখল করা ব্যক্তি মালিকদের মাথায় পড়ে বজ্রপাত। কারো কারোর আগামী দিনের সমস্ত স্বপ্ন মুহূর্তে হয়ে যায় ধূলিস্যাৎ। কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়ে। কাউকে আবার বলতে শোনা যায়, “এ দেশে ভিনদেশ থেকে আসা মানুষেরা বাসস্থান পায়, অথচ আমরা দেশের ভূমিহীন নাগরিকরা হচ্ছি উচ্ছেদের শিকার। যেখানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভূমিহীনদের মাঝে শতশত বাড়ি বিতরণ করছে, সেখানে আমাদের উচ্ছেদ করে ভাসিয়ে দেয়া হচ্ছে সাগরে।”
তো যে যা-ই বলুক, এতে কারোর তো কিছুই করার নেই। কারণ, গতবছর থেকে অর্থাৎ ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময় থেকেই রেল কর্তৃপক্ষ চাষাঢ়া হতে সিদ্ধিরগঞ্জ আদমজী ইপিজেড পর্যন্ত রেললাইনের দুপাশ মাপ-জোপ করে লাল চিহ্ন দিয়ে দেয়। তারপর মাইকিং করে লাল চিহ্নিত জায়গা ও জলাশয় খালি করতে বলা হয়। এর কিছুদিন পরপরই খানপুর সংলগ্ন চাষাঢ়া চাঁনমারি থেকে হাজীগঞ্জ পর্যন্ত শুরু হয় উচ্ছেদ। অপরদিকে আদমজী ইপিজেড থেকে ২নং ঢাকেশ্বরী বাজার সংলগ্ন পর্যন্তও শুরু হয় উচ্ছেদ। উচ্ছেদের পরপরই দুই সাইটে দ্রুতগতিতে চলতে থাকে নতুন সড়কের নির্মাণ কাজ। বাদ থেকে যায় গোদনাইল চৌধুরীবাড়ি, পাঠানটুলি, রসূলবাগ পর্যন্ত।
নতুন সড়কটির নির্মাণ কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে প্রথমে করা হয় মাইকিং। তারপর হাতে হাতে বিলি করা হয় নোটিশ। বেঁধে দেয়া হয় ২২/০৩/২০২২ইং তারিখ পর্যন্ত সময়সীমা। গত ২৩/০৩/২০২২ ইং তারিখ উচ্ছেদ অভিযান শুরু হওয়ার কথা থাকলেও উচ্ছেদ করতে পারেননি। আবার দেয়া হয় ৭দিনের সময়। তারপরও অনেকেই যার যার দখল করা জায়গার মায়া ছাড়তে পারছিলেন না।এরপর গত ০১/০৪/২০২২ইং তারিখ বেলা তিনটা থেকে শুরু হয় উচ্ছেদ অভিযান। এখন পুরো রেল লাইনের দুপাশে বসবাস করা অনেকেই বলছে, “কী আর করা! সরকারের জায়গা তো সরকার নিবেই, এটাই তো নিয়ম!”
আর সেই নিয়মেই চলছে দ্রুতগতিতে উচ্ছেদ অভিযান ও ভাষা সৈনিক “বেগম নাগিনা জোহা সড়ক” এর নির্মাণ কাজ। আশা করা যায় আগামী বছরই এই সড়ক দিয়ে দিন-রাত যানবাহন চলাচল করতে পারবে বলে মনে হয়।
উল্লেখ্য, ভাষা সৈনিক “বেগম নাগিনা জোহা” ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং প্রাক্তন গণপরিষদ ও সংসদ সদস্য, স্বাধীনতা (মরণোত্তর) পদকপ্রাপ্ত এ কে এম শামসুজ্জোহার সহধর্মিণী এবং নারায়ণগঞ্জের গণমানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা এ কে এম শামীম ওসমান’র মা।
loading...
loading...
শুভ কামনা মি. নিতাই বাবু।
যেভাবে যে কারণেই যা ঘটুক তা যেন হয় মানুষের কল্যাণে।
loading...
সু-খবরটা সবার মাঝে শেয়ার করলাম, দাদা। আশা করি সরকারের এই মহা পরিকল্পনা জনসাধারণের উপকারে আসবে।
শুভকামনা থাকলো, দাদা।
loading...
সুন্দর খবর প্রিয়!
নিশ্চয় তা হবে কল্যাণকর।
আন্তরিক শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা জানবেন সতত।
loading...
সুন্দর খরব প্রিয়!
নিশ্চয় তা হবে কল্যাণকর!
আন্তরিক শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা জানবেন সতত।
loading...