ছোটবেলায় স্কুলে যাবার সময় কান্নাকাটি করেও দশ পয়সা তো দূরের কথা, পাচটি পয়সাও সময়তে পেতাম না। মায়ের কাছেও না, বড়দা ও বড় দিদিদের কাছ থেকে না। যা পেতাম, তা কেবল বাবা ও বড়দা বেতন পেলে। সবসময় না পাবার কারণ হলো, তখনকার সময়ে টাকার খুবই মান ছিলো। দামও ছিলো। সেসময়কার টাকার সাথে এসময়কার টাকা তুলনা করতে গেলে, সেসময়কার দশ টাকার সমান বর্তমান সময়ের ১০০/= টাকারও উপরে হতে পারে, তা আমি পুরোপুরিভাবে নিশ্চিত।
সেসময়ে টাকার ওইরকম দাম আর মানের জন্যই আমাদের ছোটবেলার সময়টাই ছিলো টাকার অভাব। টাকার সেই অভাবে দিনে লেখাপড়ার পাশাপাশি ফুটবল খেলার খুবই শখ ছিলো, আমার। কিন্তু আমাদের সমবয়সী কারোর কাছেই ফুটবল ছিলো না। চামড়ায় মোড়ানো ফুটবল তো ছিলো সোনায় মোড়ানো এক হরিণ। সেই সোনায় মোড়ানো ফুটবল ছিলো সবারই কল্পনার বাইরে। বর্তমান বাজারে কমদামি প্লাস্টিকের মোড়ানো ফুটবলও তখন সবার কাছে ছিলো না। যে ক’জনের কাছে থাকতো, সামান্য একটু ঝগড়াঝাটি হলেই সে তার শখের প্লাস্টিকের ফুটবলটা আর খেলতে দিতো না।
তো কেউ কারোর শখের ফুটবল মন খারাপ করে না দিলেও সমস্যা হতো না। আমার মতো কাঙাল সমবয়সীদের ফুটবল খেলাও আর বন্ধ হতো না। প্রতিদিন স্কুল পর বই খাতা মাঠের কোণায় রেখেই শুরু হতো খেলা। তো অনেকেই প্রশ্ন করতে পারে, তাহলে বল পেলে কোত্থেকে?
ফুটবল ছিলো কাপড়ের মিল থেকে ফেলে দেওয়া সূতার জুট দিয়ে মোড়ানো। ফুটবল তৈরি করা হতো দু’এক দিন পরপর। প্রতিদিন স্কুলে যাবার সময় আমরা কেউ-না-কেউ একজন নিজেদের বানানো একটা ফুটবল সাথে করে নিয়ে যেতাম। তা লুকিয়ে রেখে দিতাম স্কুলমাঠের এক কোণায়, জঙ্গলে। দুপুরবেলা টিফিনের সময়ও শুরু করে দিতাম খেলা। আর স্কুল ছুটির পর তো পুরোদমেই চলতে।
সেই বলগুলো বানানো হতো বিশেষ কায়দায়। সূতার জুটগুলো প্রথমে টেনিস বলের মতো করে দলা করা হতো। তারপর এর উপরে শক্ত রশি দিয়ে পেচানো হতো, আর পেচানোর সাথে সাথে আরও আরও বাতিল জুট ঐ টেনিস বলের সাথে পেচানো হতো। দীর্ঘসময় পেচাতে পেচাতে একসময় খেলার উপযুক্ত এক চামড়ায় মোড়ানো ফুটবল আবিস্কার হয়ে যেতো। তার উপরে জুট থেকেই পাওয়া নোংরা ছেঁড়া-ফাড়া কাপড়ের টুকরা সুন্দরভাবে আরও ভালো করে পেচানো হতো। তাই সেটাকে অনেকই বলতো, “তেনার বল”।
তা দিয়েই আমরা কয়েকজন কাঙালি সমবয়সী মনের আনন্দে প্রতিদিন স্কুল ছুটির পর স্কুলের মাঠেও খেলতাম, আদর্শ কটন মিলস্-এর মাঠেও খেলতাম। আমরা খেলতাম। আমাদের সেসময়কার খেলা মিলের শ্রমিকরা মাঠের চার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতো। খেলা দেখে তারাও আনন্দ উপভোগ করতো, আমরাও আনন্দ পেতাম।
একসময় মিল অভ্যন্তরে থাকা শ্রমিক-কর্মচারীদের কয়েকজন নেতা আমাদের একটা চামড়ায় মোড়ানো ফুটবল কিনে দিলো। কথা থাকে, এই বল তাঁরাও খেলবে, আমরাও খেলবো। খেলা শেষ হবার পর ফুটবলটা থাকবে শ্রমিদের ক্লাবে। তা-ই হতো।
তাঁদের কথা মেনেই প্রতিদিন খেলা হতো। যেদিন কোনও কারণবশত সময়মতো ক্লাব থেকে ফুটবল বের করতে না পারতাম, সেদিন আমাদের নিজেদের তৈরি “তেনার বল” দিয়ে যথাসময়ে খেলা শুরু করে দিতাম।
তখন একটা সময় ছিলো, শুধু ফুটবলেরই সময়। বাংলাদেশে যে ক’টা সরকারি বড়বড় প্রতিষ্ঠান ছিলো, সব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব খেলার টিম ছিলো। শীতলক্ষ্যা নদীর এপারওপার থাকা প্রতিটি মিল ইন্ডাস্ট্রিরও নিজস্ব ফুটবল খেলার টিম ছিলো। আদর্শ কটন মিলেরও টিম ছিলো। তা-ও আবার মাসিক বেতনভোগী খেলোয়াড়। এখন আর সেসব মিল ইন্ডাস্ট্রিও নেই, ফুটবল খেলাও তেমনটা নেই। তখনকার সময়ের মতো ফুটবল প্রেমীও নেই। এখন শুধু ঘরে ঘরে ক্রিকেট প্রেমী।
মনে পড়ে, ঢাকা স্টেডিয়ামে যখন মোহামেডান আবাহনী খেলা হতো, তখন সেই খেলার উত্তেজনা আমাদের চারপাশেও বিরাজ করতো। যেদিন খেলা হতো, সেদিন সেই খেলা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রেডিওতে সম্প্রচার করা হতো। সেই উত্তেজনাকর খেলা উপভোগ করতাম রেডিওতে সম্প্রচার শুনে। সেসময় ঘরে ঘরে টেলিভিশন ছিলো না। রঙিন টেলিভিশন তো দূরের কথা, দশ গ্রাম খুঁজে একটা সাদা-কালো টেলিভিশন পাওয়া যেতো না। দেশ-বিদেশের খবর, খেলার খবর শোনা হতো, একমাত্র রেডিওতে।
সে সময়ের সেই ফুটবল খেলা যেন দিনদিন পশ্চিমাকাশের সূর্যাস্তের মতো ডুবেই যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো একদিন একসময়ের জনপ্রিয় ফুটবল খেলা হয়তো দেশ থেকে চিরতরে বিদায় নিবে। সেদিন হয়তো আর বেশি দূরে নেই। তো আমার মতো যারা আছে, তারা সবসময়ই সেসময়কার জনপ্রিয় ফুটবল খেলাকে মনে গেঁথে রাখবে বলে বিশ্বাস করি।
আজ আমি প্রায় বুড়ো। খেলার জো নেই ঠিক, কিন্তু ফুটবল খেলা দেখার স্বাদ মনে ঠিকই রয়ে গেছে।
তাই প্রতিদিন বিকেলবেলা গোদনাইল চৌধুরীবাড়ি চিত্তরঞ্জন ফুটবল খেলার মাঠে অন্তত একবার হলেও চুপি দিই। সময়তে কিছুক্ষণের জন্য হলেও মাঠের কোণে দাঁড়িয়ে খেলা দেখি। আমার চাকরির অফিসের মালিক দু’জনও ভালো খেলোয়াড়। উনারাও প্রতিদিন এই মাঠেই ফুটবল খেলে। তাই মাঠ ঘেঁষে যেতে আরও ভালো লাগে। তাই প্রতিদিনই যাওয়া হয়। যখনই মাঠের দিকে তাকাই, তখনই মনে পড়ে আমাদের সময়কার ‘তেনার বল’-এর (ফুটবল) কথা। বেঁচে থাকুক “সোনালী অতীত ক্লাব”, বেঁচে ফুটবল, বেঁচে থাকুক বিশ্বের ফুটবল ভক্ত বৃন্দরা। ফুটবল ও ‘সোনালী অতীত ক্লাব’র জন্য রইলো শুভকামনা।
ছবিটি আজ ৩০-০৬-২০২১ ইং, চিত্তরঞ্জন কটন মিলস্ ঐতিহাসিক ফুটবল খেলার মাঠ থেকে তোলা।
ছবিতে ‘সোনালী অতীত ক্লাব’র কয়েকজন খেলোয়াড় (ফুটবলার)।
ছবি উঠাতে উৎসাহদানে: “সোনালী অতীত ক্লাব”, গোদনাইল সিদ্ধিরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ।
loading...
loading...
সোনালী অতীত ক্লাবের সবার জন্য আমাদের সকলের শুভকামনা রইলো।
loading...
শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সাথে অজস্র ধন্যবাদ জানাচ্ছি। শুভকামনা সবসময়।
loading...