জীবনের গল্প-২৮

Image-64

জীবনের গল্প-২৭ এর শেষাংশ: তারপরও তার অভাব নেই! এই টাকা দিয়েই তার ছোট সংসার খুব সুন্দরভাবে চলছে। জানলাম রিকশাওয়ালার কাছ থেকে। প্রায় ১০ মিনিট হতে-না-হতেই রিকশাওয়ালা আমাকে বলছে, ‘ও-ই যে রবীন্দ্র নগর কলোনি দেখা যাচ্ছে, দাদা।’

রিকশা চড়ে যাচ্ছিলাম, রবীন্দ্র নগর কলোনির দিকে। রাস্তার দু’পাশে বড়বড় নানারকম পুরানো গাছ। সেখানে ইটপাটকেলের তৈরি দালানঘর খুব কম। যা দেখা যায়, তা প্রায় সবই বাঁশখুটি ও কাঠের তৈরি টিনের ঘর। মাঝে-মাঝে ভুটানিদের কাঠের টংঘর। টংঘরের নিচে শুকর, ভেড়া, মুরগির খামার। উপরে থাকে ভুটানিদের থাকার ব্যবস্থা। ঘরগুলো দেখতে খুবই সুন্দর! বাড়ির চারদিকে নানারকম ফুলগাছ লাগানো থাকে। থাকে সুপারি গাছ সহ নানারকম ফল-ফলারি গাছও। অন্যান্য গাছের মধ্যে সেখানে সুপারি গাছই বেশি। হঠাৎ রাস্তার পাশে থাকা একটা দোকানে আমার চোখ পড়লো। দোকানটি খুব সুন্দর! একটি মেয়ে দোকানে বসা। পরনে লাল জামা আর তোয়ালের মতন ঘাগরি। এই পোষাক ওদের ঐতিহ্যবাহী পোষক। একে তো সাদা চামড়ার মানুষ, তার উপর লাল জামা ঠাঁসানো। দেখে মনে হচ্ছে গোধূলি লগ্নের লাল টুকটুকে সূর্যটা। রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই এই দোকানে কি সিগারেট পাওয়া যাবে?’

রিকশাওয়ালা বলল, ‘আজ্ঞে দাদা আপনার সিগারেট দরকার? সামনে আরও অনেক দোকান আছে। সেখান থেকে নাহয় নিয়ে নিবেন?’ আমি একটু জোর করেই বললাম, ‘দাদা এই মেয়েটির দোকান থেকেই নিয়ে নেন। আমার খুব সিগারেটের নেশা পেয়েছে।’ কিছুক্ষণ আগে মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি খেয়েছি তো, তাই এখন সিগারেটের দরকার। না হলে আমার বমি বমি ভাব হচ্ছে। আমার কাছে একটি সিগারেটও নেই। যদি দয়া করে এই দোকানটার সামনে একটু রাখতেন, তাহলে আমি এক প্যাকেট সিগারেট কিনে নিতাম।’ আমার কথা শুনে রিকশাওয়ালা তার রিকশা থামিয়ে বললো, ‘আচ্ছা দাদা ঠিক আছে, দোকানের সামনে যাচ্ছি।’

রিকশাওয়ালা দোকান ছড়ে একটু সামনে গেলেও, আমার কথা শুনে আবার দোকানের সামনে আসলো। দোকানে থাকা মেয়েটিকে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করল, ‘দিদি আপকা কাছ সিগারেট হ্যায়? মেয়েটি বলল, ‘কিসকা সিগারেট চাইয়ে, ভাইয়া?’ সিগারেটকা নাম বাতাইয়ে?’ ওখানকার মানুষে ভারতের প্রায় সকল ভাষাই জানে। যখন যেই ভাষা দরকার, সেই ভাষাই তারা ব্যবহার করে। আমার যদিও হিন্দি ভাষা জানা নেই, তবু একটু আধটু বুঝি। তবে বলতে পারি না। রিকশাওয়ালা আর মেয়েটির কথা শুনে রিকশাওয়ালাকে বললাম, ‘দাদা দোকানদার মেয়েটি কি বাংলা জানে না?’ রিকশাওয়ালা বললো, ‘জানে দাদাবাবু, জানে। ওরা নেপালি। ওদের নিজস্ব ভাষা আছে। তারপরও আমাদের ইন্ডিয়ার সব ভাষাই ওদের জানা আছে। তবে দাদা ওরা বেশিরভাগ হিন্দি, নেপালি, আর ভুটানি ভাষাই ব্যবহার করে থাকে। এখন বলুন, আপনি কী সিগারেট কিনবেন?’ আমি রিকশাওয়ালাকে বললাম, ‘দাদা, এখানকার সিগারেটের নামতো আমার জানা নেই! আপনার পছন্দমতো ভাল এবং বেশি দামের এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে নেন।’

তখন কিন্তু সিগারেট আমার কাছে ছিলো। সিগারেট থাকা সত্ত্বেও মেয়েটিকে একটু ভাল করে দেখার জন্য এই ভাণ করালাম। রিকশাওয়ালা আমাকে বলল, ‘আজ্ঞে দাদা, আপনি রিকশা থেকে নেমে দেখিয়ে দিন। এখানে অনেকরকম সিগারেট আছে। আপনি যেটা চাইবেন, ঠিক ওটাই আপনাকে দিবে।’ আমি রিকশাওয়ালার কথা শুনে রিকশা থেকে নেমে দোকানের সামনে গেলাম। দেখি দোকানে চায়ের ব্যবস্থাও আছে। দোকানে সাজানো আছে, ভারতি, নেপালি, আর ভুটানি মদের বোতল। তবে ওখানে ভুটানের মদ-ই বেশি চলে। সেখানে রাস্তা-ঘাটে, হাট-বাজারে সবখানে বসেই, মদপান করা যায়। এমনকি চলন্ত বাসে বসেও অনেকে মদপান করে থাকে। কেউ কাউকে কিছু বলার সাহস পায় না। তবে ওরা যতই মদ্যপ হোক না কেন, মাতলামি খুব কমই করে থাকে। আর যেকোনো পূজাপার্বণে মানুষের ফ্যামিলি বাসায়ও, সবাই মিলে-মিশে মদপান করে থাকে। কি ছেলে, কি বুড়ো। মদ যেন তাদের পূজার প্রসাদ। মদ ছাড়া ওখানকার মানুষের কোনকিছু শুদ্ধ হয় না।

নেপালী মেয়েটির দোকানে চায়ের কেতলি দেখে রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দাদা আপনার চায়ের অভ্যাস আছে?’ রিকশাওয়ালা খুশিমনে বললো, ‘হ্যা দাদাবাবু আছে! আপনি আমাকে চা খাওয়াবেন? ওখানে কেউ কাউকে সহজে এক কাপ চা, অথবা একটা পাতার বিড়িও দেয় না। নিজের পকেটে বিড়ি থাকতেও পরের কাছ থেকে বিড়ি চেয়ে নেয়। রিকশাওয়ালা তাই খুশিতে আমকে জিজ্ঞেস করছে, “দাদাবাবু আপনি আমাকে চা খাওয়াবেন?” আমি হেসে বললাম, ‘হ্যা, খাওয়াবো মানে? নিশ্চয় খাওয়াবো। মেয়েটিকে বলুন আমাদের দুই কাপ চা বানিয়ে দিতে।’ আমার কথা শুনে রিকশাওয়ালা দোকানী মেয়েটিকে বাংলায় বললো, ‘দিদি আগে আমাদের দু’কাপ চা বানিয়ে দিন। পরে নাহয় সিগারেট দিবেন।’ এবার রিকশাওয়ালা মেয়েটির সাথে বাংলা ভাষায় কথা বলার তার মানে হলো, রিকশাওয়ালা আমাকে বুঝিয়ে দিল যে, মেয়েটিও বাংলা কথা বোঝে বা জানে। জবাবে মেয়েটি বলল, ‘ঠিক আছে দাদা, একটু বসেন। আমি আপনাদের চা বানিয়ে দিচ্ছি।’

আমরা দুজনেই দোকানের ভেতরে একটা টেবিলের পরে বসলাম। মেয়েটি চা বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেখানকার চা বানানোর খুব সুন্দর সিস্টেম। যা হবে তা নগদনারায়ণ। মেয়েটি একটা পাত্রে কিছু পরিমাণ তরল দুধ একটা পাত্রে ঢেলে, কেরোসিনের জ্বলন্ত স্টোভের উপরে রাখলো। অল্পকিছুক্ষণের মধ্যেই দুধ গরম হয়ে গেল। তারপর সেই গরম দুধে চা-পাতা আর চিনি মিশিয়ে দিল। ছাকনি দিয়ে ছেঁকে দুই কাপ চা দুইজনকে দিল। আমরা চা পান করলাম। বেশ মজাদার চা। গরুর খাটি দুধ দিয়ে তৈরি চা। তাও কাঁচা চা-পাতার তৈরি। এই চায়ের স্বাদই আলাদা। প্রতি কাপ চায়ের দান ভারতীয় ৬০ পয়সা। এক প্যাকেট সিগারেট নিলাম, দাম মাত্র ১০টাকা। সিগারেটের নাম, চার্ম। ফিল্টার কিং সিগারেট। সেখানকার লোকেরা এতো দামি সিগারেট খুবই কম মানুষেই টানে। সবাই হিসেব করে চলে। অকারণে অযথা কেউ একটি কানাকড়িও খরচ করে না। তাদের ধূমপানের মধ্যে বেশি প্রিয় হলো, শাল পাতার বিড়ি। সে হোক ধনীর দুলাল! হোক সে ফকির। বেশিরভাগ মানুষেই পাতার বিড়ি টানে। কারোর সম্মান অসম্মানের দিকে কেউ ফিরে তাকায় না। সবাই সবার নিজের ধান্ধায় মশগুল থাকে।

এরপর দোকানী নেপালী মেয়েটিকে ১১ টাকা ২০ পয়সা দাম দিয়ে, আবার ওঠলাম রিকশায়। আসার সময় দোকানদার মেয়েটি রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাই আপনার রিকশায় লোকটির বাড়ি কোথায়?’
রিকশাওয়ালা জবাব দিল, ‘বাংলাদেশ দিদি বাংলাদেশ।’
নেপালী মেয়েটি মুচকি হেসে বললো, ‘হুম, বহ্যত আচ্চা। এখন যাবে কোথায়?’ রিকশাওয়ালা জবাব দিলো, ‘উনি রবীন্দ্র নগর কলোনি যাবে। ওনার বড়দিদির বাড়িতে। কোলকাতা থেকে এসেছে কেবল।’ আমি রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি বাংলাদেশ বললেন? আপনি কীভাবে জানেন যে, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি?’ রিকশাওয়ালা বললো, ‘দাদা, আপনার বাড়ি বাংলাদেশে তা আমি জেনেছি, ঐ মিষ্টি দোকানদারের কাছ থেকে। তিনি আমাকে বলেছে, আপনার বাড়ি বাংলাদেশ। তাই বললাম দাদাবাবু। আমি রিকশাওয়ালাকে আর বেশি কিছু বলিনি। রিকশা চলছে, মেইন রোড ছেড়ে মহল্লার আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে। যাচ্ছে রবীন্দ্র নগর কলোনির দিকে। আমার মনের ভেতরে অনেক চিন্তা। শুধুই ভাবছি, আমার দিদি, জামাইবাবু ও ভাগিনা ভাগ্নিদের নিয়ে। দিদির সামনাসামনি গিয়ে, কীভাবে পরিচয়টা দিলে ভাল হবে, সেই চিন্তাই আমার মনের ভেতরে ঘুরপাক বেশি খাচ্ছিলো।

দুপুর শেষে বিকালের আগমন। দিদি’র ঘেঁষা চা-বাগান। চা-বাগান থেকে চা-পাতা তোলার মহিলারা আসছিল সারিবদ্ধভাবে। সেখানকার মানুষে তাদের বলে বাগানী। এদের সবার পেছনে ঝুলানো আছে, চা-পাতার ঝুড়ি। চা-বাগানে চা-পাতা সংগ্রহে নিয়োজিত থাকে বিহারের আদিবাসী মানুষগুলো। সেসব জনগোষ্ঠীদের সেখানকার ভাষায় বলে, মদোসিয়া। এদের গায়ের রঙ কালো কুচকুচে কালির মতন। দেখতে হুবহু নিগ্রোদের মতন। যা দেখলাম, রিকশা দিয়ে আসার সময়। আমার চোখে তারা কালো বর্ণের হলেও, তাদের চোখে তারা খুবই সুন্দর। এই কালো বর্ণের মাঝেও নাকি সুন্দরী মেয়ে অনেক আছে। এরা বেশিভাগ সময়-ই নেশার তালে মগ্ন থাকে। পথে-ঘাটে, পূজা-পার্বণে, হাটা চলায় সবসময়, সবখানে এরা মদপান করবেই। মদ ছড়া ওদের যেন উদ্ধার নেই। এরা রাস্তার পাশ দিয়ে সারিবদ্ধভাবে লাইন ধরে তাদের গন্তব্যে যাচ্ছে। আগে যাবে হয়তো তাদের কারখানায়। সারাদিনের সংগ্রহ করা চা-পাতা কারখানায় বুঝিয়ে দিয়ে, পরে হয়তো নিজেদের ঘরে যাবে। এসব দৃশ্য দেখতে দেখতে একসময় পৌঁছে গেলাম রবীন্দ্র নগর কলোনিতে।

রবীন্দ্র কলোনির মাঝখান দিয়ে রাস্তা। রিকশা যাচ্ছিল রবীন্দ্র নগর কলোনির গলি দিয়ে। পুরো রবীন্দ্র নগর কলোনিতে দুইটা গলি। গরমের দিন, কিন্তু আকাশ পরিষ্কার। বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা নেই। ভুটান সংলগ্ন এলাকা। দিদির বাড়ির সন্নিকটে ভুটানের সুউচ্চ পাহাড়। সেখানে বৃষ্টির দিনে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। রবীন্দ্র নগর কলোনি বীরপাড়া বাজার থেকে সামান্য একটু দূরেই ভুটান। এই রবীন্দ্র নগর কলোনিতে আগে চা-বাগানের কিছু উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের বাসভবন ছিল। হয়তো কারোর নাম রবীন্দ্র ছিল। তাই এর নামকরণ হয়েছে রবীন্দ্র নগর কলোনি। অনেক আগে থেকেই চা-বাগানের ওইসব কর্মকর্তাদের বাসভবনের আশে-পাশে বহিরাগতের বসবাস শুরু হয়েছিল। আমি যখন বড়দি’র বাড়ি গিয়েছিলাম, তখন চা-বাগানের সেসব কর্মকর্তাদের দেখা মেলেনি। দেখেছি উড়ে এসে জুড়ে বসা মানুষের বসবাস। আমার বড়দিদিও এখানে উড়ে আসা এক বাসিন্দা। তবে এই রবীন্দ্র নগর কলোনিতে বর্তমানে যারা বসবাস করছে, তাদের সবাই নিজস্ব জায়গার মালিক বনে গেছে। সরকারকে ট্যাক্স দিচ্ছে। পানির বিল প্রতিশোধ করছে। বিদ্যুৎ বিল দিচ্ছে। নিজেদের জায়গা কেনাবেচাও করছে, এই রবীন্দ্র নগর কলোনিতে থাকা মানুষগুলো।

রবীন্দ্র নগর কলোনির পশ্চিম পাশে চা-বাগান। ঠিক আমার দিদির বাড়ি থেকে ৪০-৫০ হাত দূরে বিশাল চা-বাগান। এই চা-বাগানটির শেষ খুঁজে পাওয়া বড়ই মুশকিল। বিশাল আওতা জুড়ে এই চা-বাগানটি। পূর্বদিকে বীরপাড়া টু ভুটান (গুমটু) মেইন রোড। উত্তরে বীর পাড়া বাজার অভিমুখী পথ। দক্ষিণে শিলিগুড়ি টু মিজোরাম মেইন রোড়। এই শিলিগুড়ি টু মিজোরাম মেইন রোডের দুপাশে রয়েছে, মাইলের পর মাইল চা-বাগান। রিকশা থামলো আমার বড়দি’র বাড়ির গেইটে। গেইট তখন লাগানো ছিলো। হয়তো বাড়ির ভেতরে সবাই ঘুমিয়ে ছিলো। রিকশাওয়ালা গেইটে টোকা দিয়ে বলছে, ‘কে গো, বাড়ির গেইট খুলুন। দেখুন বাংলাদেশ থেকে আপনাদের অতিথি এসেছে।’ বাংলাদেশ বলতে দেরি, আর গেইট খুলতে দেরি নেই। গেইট খুলেছে আমার বড়দি। আমি তখনো রিকশায় বসে বসে এদিক-ওদিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি। আমার বড়দি রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করছে, ‘কে? কার বাড়ির অতিথি গো?’ রিকশাওয়ালা বললো, ‘আজ্ঞে দিদি, উনি বাংলাদেশ থেকে এসেছে। মনে হয় আপনার ভাই।’

আমি তখন আমার বড়দি’র দিকে তাকাইলাম। আমার মায়ের চেহারা আর আমার বড়দি’র চেহারা একইরকম। আমার মনে হচ্ছিল যে, স্বয়ং আমার মা-ই সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি রিকশা থেকে নেমেই, বড় দিদিকে নমস্কার করলাম। আমার বড়দি’র নাম: রাধা রানী। সবাই রাধু রাধু বলেই ডাকতো। বড়দি আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম, ‘রাধু দিদি, আমি আপনার ছোটভাই নিতাই। এই কথা বলার সাথে সাথেই, দিদি আমাকে ধরে অঝোরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। মুহূর্তেই বাড়ির সামনে পিছনের সকল নারী-পুরুষ জড়ো হয়ে গেল। ঘর থেকে জামাইবাবু বাইর হয়ে আসলেন। ভাগিনা আসলো। অবিবাহিত একটিমাত্র ভাগ্নিও বের হলো। দিদি জিজ্ঞেস করলো আমার বড়দা’র কথা। বললাম, ‘বড়দা ভালো আছে দিদি। দাদাতো আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় একবার আপনাদের বাড়িতে এসেছিলো।’

এবার আমার বড়দিদি আমাকে পুরোপুরি ঠিকঠিক চিনতে পেরেছে। যদিও এতক্ষণ মনের ভেতরে একটু-আধটু গড়মিল ছিলো, বড়দা এখানে আসার কথা শুনে মনের গড়মিল দূর হয়ে গেলো। দিদির মনের ভেতর গড়মিলের কারণ হলো, আমার বড়দি’র যখন বিয়ে হয়, তখন আমার বয়স ছিল মাত্র দেড় বছর। আর আমি যখন দিদির সামনাসামনি, তখন আমি ৩০ বছরের একজন জবরদস্ত যোয়ান। আমি বুঝের হয়ে আমার বড় দিদিকে কোনও দিন দেখিনি। আর দেখবো-ই-বা কেমন করে? বড়দি’র বিয়ে হবার ১৫ দিন পরই, তারা সপরিবারে ভারত চলে আসে। এই আসাই এপর্যন্ত। আর আমি বড়দি’র সামনে এসেছি প্রায় ২৯ বছর পর।

এরপর দিদি বলছে, ‘আয়, বাড়ির ভেতরে আয়। কীভাবে আসলি, কবে আসলি তা পরে শুনবো। আগে ঘরে গিয়ে বোস। বড়দি’র বাড়ির ভেতরে যাবার আগে রিকশাওয়ালাকে ভারতের দুটো ১০ টাকার নোট হাতে দিলাম। রিকশাওয়ালা বললো, ‘সে কি দাদা! ভাড়া তো আমাকে মিষ্টির দোকান থেকে একবার দিয়েছে। আবার আপনিও দিচ্ছেন?’ আমি বললাম, ‘আ-রে দাদা, ওটা থাকুক। আমি এখন যা দিচ্ছি, তা আপনি নিয়ে নিন।’ আমার কথা শুনে রিকশাওয়ালা খুশি হয়ে বললো, ‘জয়বাংলার লোক গো দিদি। তাই এতো বড় আত্মা। বীরপাড়া বাজার থেকে এখানে এসে, কেউ দুই টাকার বেশি দেয় না। আর উনি আমাকে রাস্তায় চা সিগারেট খাওয়াইয়েছে। আবার কুড়ি টাকা দিয়ে দিলো। এতে আমার সারাদিনের কামাই, ওনাকে দিয়েই হয়ে গেলো।’ রিকশাওয়ালার কথা শুনে সবাই আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমার বড়দি বললো, ‘আমার ভাইতো এখানকার ভাড়া জানে না, তাই তোমাকে এতো টাকা দিয়েছে। ক’দিন পর যখন সব জানাশুনা হয়ে যাবে, তখন হয়ত আর দিবে না। বুঝেশুঝেই দিবে। আমি বড়দি’র কথা শুনে মুচকি হেসে দিদির বাড়ির ভেতরে গেলাম। আর মনে মনে বলতে লাগলাম, ‘দিদি আমরা বাংলাদেশি লোকেরা এরকমই। খরচের কাছে আমরা কখনোই হার মানি না।’

চলবে…

জীবনের গল্প-২৯ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৪ টি মন্তব্য (লেখকের ২টি) | ২ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০৬-০১-২০২১ | ১২:৪২ |

    আজকের পর্বটি ভীষণ স্নিগ্ধতায় পূর্ণ। মিস্টির দোকান, সিগারেট ক্রয় আর বড়দি'র সাথে সাক্ষাত; ধারাবাহিকের এই পর্যায় পর্যন্ত ভীষণ রকমের সার্থক করে গড়ে তুলেছে। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ০৭-০১-২০২১ | ৯:৪০ |

      আর মাত্র দুই পর্ব বাকী আছে। আশা করি সাথে থাকবেন, দাদা। শুভকামনা থাকলো। 

      GD Star Rating
      loading...
  2. ফয়জুল মহী : ০৬-০১-২০২১ | ১৪:০২ |

    জীবনের গল্প নয় ইতিহাস পাতা জীবন দাদা। 

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ০৭-০১-২০২১ | ৯:৪১ |

      সাথে থাকার জন্য অজস্র ধন্যবাদ জানাচ্ছি, দাদা। আশা করি শেষ পর্ব পর্যন্ত সাথে থাকবেন। শুভকামনা থাকলো। 

      GD Star Rating
      loading...