জীবনের গল্প-১৯

Image-6411-8

জীবনের গল্প-১৮-এর শেষাংশ: একসময় আড়াইউল্লা নিয়ম করে কানাই, কালাম-সহ নতুন বউয়ের সাথে তার ছোট ভাইকে নিয়ে আমি চলে আসি নারায়ণগঞ্জ নন্দিপাড়া নিজের বাসায়। এর দুইদিন পরই বৌভাত অনুষ্ঠান। বউভাত অনুষ্ঠানে দুই মিলের লোক-সহ প্রায় ১০০ জন লোকের আয়োজন করা হয়। এরপর থেকে চলতে লাগলো, স্বামী-স্ত্রীর সাংসারিক জীবন।

তারপর থেকে মা আর বোন মরা ভাগ্নি-সহ স্বামী স্ত্রীর সংসার খুব সুন্দরভাবে চলতে লাগলো। আমি ওয়েল টেক্স মিল থেকে মাসে যেই টাকা বেতন পেতাম, খেয়ে-দেয়ে তা থেকে বেশকিছু টাকা আমার আয় থাকতো। নন্দিপাড়া যেই বাড়িতে ভাড়া থাকতাম, সেই বাড়িতে আরও কয়েকটা ভাড়াটিয়া ছিলো। তাদের মধ্যে কয়েকজন ভাড়াটিয়া ছিলো ব্যাবসায়ী। আর কয়েকজন ছিলো আমার মতন দিনমজুর। সেসব ভাড়াটিয়াদের সেথে পাল্লা দিয়েই চলছিলো আমাদের ছোট সংসার। সংসারে কোনও কিছু নিয়ে তেমন কোন কথা কাটা-কাটিও হতো না। থাকলে খেতো, না থাকলে পেট মাটিতে চাপে শুয়ে থাকতো। কিন্তু ঝগড়াঝাটি আর নাই নাই হতো না।

সময়টা তখন ১৯৮৬ সালের শেষদিকে। সেসময় বাংলাদেশি শাটিং শ্যুটিং কাপড়ের অনেক চাহিদা ছিলো। মিলেও তেমনই ছিলো প্রচুর কাজ। কাজের এতো চাপ ছিলো যে, অনেক সময় সারারাত আমাকে মিলে ওভারটাইম করতে হতো। ওভারটাইম করতে গিয়ে সারারাত মিলেই থাকতে হতো। ওভারটাইমের টাকা পেতাম সপ্তাহে। আর মূল বেতন পেতাম মাসের ১০ তারিখে। হঠাৎ এক সময় শ্রমিকদের দাবিদাওয়া নিয়ে মিল মালিকের সাথে স্থানীয় শ্রমিক নেতাদের মনোমালিন্য হতে থাকে। মিল মালিক নিয়াজ সাহেবের সামনে স্থানীয় নেতারা টেবিলে থাপ্পর মারে কথা বলে। এতে মিল মালিক নিয়াজ সাহেবের মন খারাপ হয়ে যায় যায়। এই মন খারাপ থেকে আস্তে আস্তে মিল মালিকের মিলের প্রতি অনীহা বাড়তে থাকে। মিলেও আসতো খুবই কম! মিলে সুতাও ঠিকমতো দিতো না। এতে তাঁতিদের যেমন পেটে পড়লো আঘাত, তার চেয়ে বেশি ব্যাঘাত সৃষ্টি হলো আমার এবং আমার সংসারের।

কয়েকমাস খুবই কষ্টে সংসার চলতে লাগলো। নতুন করে এক মিলে গিয়ে যে কাজ করবো, সেই সুযোগও পাচ্ছিলাম না; ওয়েল টেক্স মিলের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হওয়ার করণে। এদিকে সবেমাত্র নতুন বিয়ে, নতুন বউ সংসারে। কাজকর্মের অবস্থাও বেশি ভালো যাচ্ছিল না। টেনে-টুনে সংসার চালাতে গিয়ে দেনা ঋণগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। এভাবে চলতে চলতে এক সময় মিল মালিক চূড়ান্তভাবে মিল লে – আপ ঘোষণা করলো। শ্রমিকদের দেনা পাওনা বুঝে নিতে নোটিশ টাঙিয়ে দিলো। কিন্তু আমরা কেউ দেনা পাওনার হিসাবের জন্য মাথা ঘামাচ্ছিলাম না। আমরা একজোট হলাম, মিল পুনরায় চালু করার জন্য। কিন্তু না, মিল মালিক প্রয়োজনে মিলে বিক্রি করে দিতে প্রস্তুত, কিন্তু মিল চালু করবে না। আমি পড়ে গেলাম বিপাকে।

আবার কিল্লার পুল ফাইন টেক্সটাইল মিলে গিয়ে ঘোরা-ফেরা করতে লাগলাম। আমার ঘোরা-ফেরা ফাইন টেক্সটাইল মিলের ম্যানেজার সাহেব ফলো করলো। আমার বড় দাদার কাছে জানলো যে, আমার কাজ নেই! ম্যানেজার সাহেব কিছু দিনের জন্য আপনাকে তাঁতের কাজ করতে বললে। তারপর সংসারের অভাব দূর করার জন্য ফাইন টেক্সটাইল মিলে তাঁতের কাজ করতে থাকি। বেশ কয়েকমাস তাঁতের কাজ করার পর ঢাকা মিরপুর চিড়িয়াখানা সংলগ্ন একটা মিল থেকে খবর এলো। খবর পাঠিয়েছিল সাত্তার ওস্তাদ। যার সাথে বিয়ের আগে একবার ফরিদপুর গঙ্গাবর্দী আলহাজ্ব আব্দুল হামিদ টেক্সটাইল মিলে গিয়েছিলাম। তিনিই আমার কাছে লোক মারফত খবর পাঠায়। মিরপুর মিলে জর্জেট সুতার ওড়না তৈরি হবে। কিন্তু মিলটি ছিল একেবারে নতুন। মেশিন সব বসানো হলেও মেশিনে কাপড় উৎপাদন শুরু হচ্ছিল না।তখন ১৯৮৭ সালের মাঝামাঝি সময়।

সিদ্ধান্ত নিলাম, ফাইন টেক্সটাইল মিলের তাঁতের কাজ ছেড়ে মিরপুর সাত্তার ওস্তাদের ওখানেই চলে যাবো। বড় দাদা, মা ও নিজের স্ত্রীর সাথে আলাপ করলাম। রায় পেলাম, ‘ভালো মনে হলে যাও!’ তখন স্ত্রীকে কিছুদিনের জন্য বাপের বাড়িতে থাকার জন্য পরামর্শ দিলাম। স্ত্রী আমার পরামর্শে রাজি হলো। তাকে বাপের বাড়িতে নিয়ে গেলাম। সে-বছর ছোটখাট একরম বন্যাও দেশে দেখা দিয়েছিল। শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে দেখি তাদের অবস্থাও বেশি ভালো নেই। বন্যার কারণে কাজকর্মে নেই। তারপরও আমার সমস্যা দেখে আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি মেয়েকে তাদের বাড়িতে রেখে দেয়। আমি দুইদিন শ্বশুরবাড়ি থেকে নারায়ণগঞ্জ চলে আসি।

এর পরদিনই মিরপুরের ঠিকানায় চলে যাই। ওখানে গিয়ে সাত্তার ওস্তাদের সাথে কাজ করতে থাকি। বেতন প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার। শুক্রবার বেতন হতে পেলেই নারায়ণগঞ্জ চলে আসতাম, মাকে বাজার সদাই করে দেওয়ার জন্য। এভাবে মিরপুর ওই মিলে দুই মাসের মত কাজ করেছিলাম। তারপর ওখানে তেমন পোষাচ্ছিল না। তাই একসময় মিরপুর মিলের কাজ ছেড়ে দিই।

মিরপুর মিলের কাজ ছেড়ে আবার নারায়ণগঞ্জ এসে ওয়েল টেক্স মিলের খবরাখবর সংগ্রহ করতে থাকি। কারণ, ওয়েল টেক্স মিলে পাওনা সার্ভিসের টাকার জন্য। তখন জানতে পারি যে, মিল মালিকের ইসলামপুর দোকানে গেলেই সার্ভিসের পাওনা টাকা দিয়ে দিবে। আমাদের সাথের অনেক শ্রমিকরা সেখান থেকে সার্ভিসের টাকা তুলেও এনেছিল। গেলাম ঢাকা ইসলামপুর ওয়েল টেক্স মালিকের দোকানে। রিজাইন দরখাস্তে সই করলাম। সার্ভিসের টাকা পেলাম ৪০০/=টাকা। এরপর মিল মালিক নিয়াজ সাহেব আমার কানের অবস্থা জানতে চাইলেন। বললাম, ‘সেই আগের মতই আছে।’ আমার কথা শুনে ওয়েল টেক্স মিলের মালিক নিয়াজ সাহেব আমাকে আরও ২০০০/=টাকা হাতে দিয়ে বললেন, ‘নিতাই আমি তোমার কাজ খুবই পছন্দ করতাম। তোমাকে আমি পাকিস্তান নিয়ে চিকিৎসা করতাম। যদি মিল চালু থাকতো। কিন্তু তা আর হলো না, তোমাদের নেতাদের কারণে।’

শ্রমিক নেতাদের ব্যাপারে আরও অনেক কথাবার্তা ও বললো। দোকান থেকে আসার সময় আবার ডেকে নিয়ে এক পিস প্যান্টের কাপড় আর এক পিস শার্টের কাপড়ও আমাকে দিয়ে দিলো। আমি সেগুলো নিয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে নারায়ণগঞ্জ নিজের বাসায় ফিরে আসি। বাসায় এসে ৬০০০/= টাকা মায়ের হতে দিয়ে বললাম, ‘মা, এই টাকা আমার কপাল বিক্রির টাকা। মা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো, ‘কিসের টাকা?’ বললাম, ‘মিলের সার্ভিসের টাকা। মানে ওয়েল টেক্স মিলের চাকরি শেষ!’ তখন আমার মা বুঝতে পেরেছিল। এর একদিন পর আবার শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে গিন্নিকে নিয়ে আসি নিজের বাসায়। এরপর নারায়ণগঞ্জ সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন গোদনাইল এলাকায় মহীউদ্দীন স্পেশালাইজড টেক্সটাইল মিলে কাজ নেই। মিল মালিক ছিলেন, শেখ আব্দুল হাকিম সাহেব। উনার বাড়ি ছিলো কুষ্টিয়া জেলার কয়া গ্রামে। মহিউদ্দিন স্পেশালাইজড টেক্সটাইল মিলে ছাতার কাপড় তৈরি হতো। সেই মিলে মাত্র ১,৭০০/= টাকা বেতনে কাজ নেই। তখন নারায়ণগঞ্জ নন্দি পাড়ার বাসা ছেড়ে মহিউদ্দিন স্পেসালাইজড টেক্সটাইল মিলের সাথেই বাসা ভাড়া নিলাম। বাসা ভাড়া মাত্র ১২০/= টাকা।

সময়টা তখন ১৯৮৮ সালের মাঝামাঝি। কয়েক মাস কাজ করার পরই শুরু হলো সারা দেশব্যপী ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার তাণ্ডব। বন্যার পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য আবার গিন্নীকে নিয়ে রেখে আসি শ্বশুরবাড়িতে। তখন কানাইর কাজ ছিলো না। তাই কানাই সারাদিন আমার সাথেই থাকতো। আমি মিলের সাথে যেই বাস ভাড়া করেছিলাম, সেই বাসা বন্যার পানিতে ডুবে গিয়েছিল। তখন মাকে নিয়ে উঠলাম নিকটস্থ পাঠানটুলি ভোকেশনাল টেকনিক্যাল ট্রেনিং স্কুল এ্যাণ্ড কলেজে। আমি আর কানাই সারাদিন যেখানেই থাকতাম-না-কেন, দুইজনে রাতে ভোকেশনাল স্কুলে এসে ঘুমাতাম। তখন সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদের আমল। প্রচুর রিলিফ পেতাম। আবার মিলের বেতনও পেতাম। সেই ভয়াবহ বন্যার সময় খুবই ভালোভাবে চলছিলাম। একসময় বন্যার আলামত শেষ হলো। সবকিছু স্বাভাবিক হলো। মিলের কাজকর্ম চালু হলো। কানাইও আবার ওর নিজের কাজে চলে গেলো। আমি অন্য একজন হেলপার নিয়ে কাজ করতে থাকি। সময় ১৯৮৯ সাল। আমার প্রথম মেয়ের জন্ম হলো। নাম, অনিতা রানী পাল। এর কিছুদিন পর কানাই ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে যায়, ওর এক মামার কাছে।

কানাই ভারত চলে যাবার কয়েক মাস পর আমার মা-ও চলে গেলো পরপারে স্বর্গের দেশে। মা স্বর্গীয় হবার কিছুদিন পর মহিউদ্দিন স্পেশালাইজড টেক্সটাইল মিলের মালিকের সাথে আমার বেতন নিয়ে লেগে গেলো হট্টগোল। তারপর চাকরি ছেড়ে গ্রাম মহল্লায় লেইস ফিতা বিক্রি করতে লাগলাম। লেইস ফিতা বিক্রি করলাম কয়েক মাস। সময় তখন ১৯৯১ সাল। আমার দ্বিতীয় ছেলে সন্তান জন্ম হলো। নাম, অনিল চন্দ্র পাল। একদিন ওয়েল টেক্স মিলের রফিক নামে একজন ঘনিষ্ঠ তাঁতি আমাকে নিয়ে যায় নারায়ণগঞ্জের অদূরে মুন্সিগঞ্জ মুক্তারপুর ফেরিঘাট সংলগ্ন এক মিলে। তখন মুক্তারপুর ব্রিজ ছিলো না। ওই মিলের তাঁত মেশিন ছিলো কোরিয়ার। সেই মিল ভাড়া নিয়ে চালাতেন বিক্রমপুরের এক মালিক। মালিকের নাম মোয়াজ্জেম সাহেব। উনার দোকানের নাম ছিলো এলিগেন্ট ফেব্রিকস। দোকানের নামেই তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম এলিগেন্ট ফেব্রিকস।

সেখানে দুইমাস কাজ করার পর উনি মোয়াজ্জেম সাহেব আমাকে নিয়ে গেলেন ঢাকা সদরঘাটের ওপারে। জায়গাটা হলো কালীগঞ্জ শুভাঢ্যা ইউনিয়ন এলাকা তেলঘাট। মিলের নাম রশিদ স্লিক। সেই মিলেও কোরিয়ান মেশিন। সেই মিলে হেলপার সহ ৫,০০০/= টাকা বেতনে কাজ করতে থাকি। আবার গোদনাইল এলাকা থেকে বাসা ছেড়ে চলে গেলাম কালীগঞ্জ শুভাঢ্যা ইউনিয়ন এলাকায়। সেখানে দীর্ঘদিন কাজ করেছিলাম। সময়টা তখন ১৯৯২ সালের শেষ দিকে। একসময় হঠাৎ ভারতের অযোধ্যায় শুরু হলো বাবরি মসজিদ ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা। আমি তখন কালীগঞ্জ শুভাঢ্যা ইউনিয়ন এলাকায় রশিদ স্লিক টেক্সটাইল মিলেই কাজ করি। বাসা ছিলো মিলের সাথেই এক হিন্দু বাড়িতে। দুই তিন দিন খুবই থমথমে অবস্থা ছিলো। তখন কালীগঞ্জ শুভাঢ্যা ইউনিয়ন এলাকার পরিস্থিতি এতটাই খারাপ ছিলো যে, ভাড়া বাড়ি থেকে প্রাণভয়ে বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে মিলের ভেতরে থাকতাম। মিলের ভেতরে অন্তত তিন-চার দিন সপরিবারে অবস্থান করেছিলাম।
চলবে…

জীবনের গল্প-২০ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৪ টি মন্তব্য (লেখকের ২টি) | ২ জন মন্তব্যকারী

  1. ফয়জুল মহী : ২৩-১০-২০২০ | ১১:৩০ |

    আপনাকে আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ২৪-১০-২০২০ | ২:২১ |

      সুন্দর মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদের সাথে থাকলো,  শারদীয় দুর্গোৎসবের শুভেচ্ছা। 

      GD Star Rating
      loading...
  2. মুরুব্বী : ২৩-১০-২০২০ | ১৭:৫০ |

    ডিটেইল স্মৃতি বা যাপিত জীবনের সরল স্বীকারোক্তি। শুভেচ্ছা মি. নিতাই বাবু। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ২৪-১০-২০২০ | ২:২৪ |

      সুন্দর মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদের সাথে থাকলো, শারদীয় দুর্গোৎসবের শুভেচ্ছা। আশা করি ভালো থাকবেন শ্রদ্ধেয় দাদা।

      GD Star Rating
      loading...