জীবনের গল্প-১৭

জীবনের গল্প-১৬-এর শেষাংশ: কালাম নৌকা বেয়ে সুবচনী বাজার নিয়ে এলো। ঢাকার লঞ্চে না ওঠা পর্যন্ত লঞ্চ ঘাটেই ছিলো। একসময় লঞ্চ আসলে কানাই আর আমি লঞ্চে উঠলাম। লঞ্চ ঢাকার উদ্দেশে রওনা রওনা হলো। মাঝপথে ফতুল্লা লঞ্চঘাট নেমে নিজের বাসায় চলে গেলাম।

ঈদের ছুটি শেষ হতে একদিন বাকি। একদিন পরই মিল চালু হচ্ছে। হাত থাকা একদিন ছুটি কানাইকে সাথে নিয়েই ঘুরে-ফিরে শেষ করলাম। মিল চালু হলে মিলে গিয়ে কাজ করা শুরু করলাম। এর প্রায় দুইমাস পর কানাই আমার কাজ ছেড়ে অন্য এক জায়গায় কাজে লেগে যায়। কারণ ওর তখন সামান্য বেতনে পোষাচ্ছি না, তাই। কানাই আমার এখান থেকে আরও বেশ কিছু টাকা বেশি বেতনে নারায়ণগঞ্জ দেওভোগে থাকা একটা মিনি গার্মেন্টসে কাজ নেয়। আমি তখন একরকম একা হয়ে পাড়ি। এরপর আমি মিলের সেক্রেটারি হাসেম মিয়ার ভাতিজাকে আমার সাথে হেলপার হিসেবে রেখে দেই। নতুন হেলপার নিয়েই কোনরকমভাবে কাজ করতে থাকি।

এর কিছুদিন পর টাকা-পয়সা নিয়ে আমার বড় দাদার সাথে আমার মনোমালিন্য হয়। সেই মনোমালিন্য থেকে জেদ করে মাকে নিয়ে বড় দাদা থেকে আমি আলাদা হয়ে যাই। কিন্তু বড় দাদার বাসা আর আমার বাসা ছিলো একই মহল্লায় পাশা-পাশি বাড়ি। তখন আমার মায়ের অবস্থাও বেশি একটা ভালো ছিলো না। বসার রান্না-বান্না করতে পারছিল না। রান্না-বান্না করে দিতো আমার এক বোন। যেই বোনকে ফেনী ফুলগাজী বিয়ে দিয়েছিলাম। সেই বোন তখন একই মহল্লায় পাশা-পাশি বাড়িতে ভাড়া থাকতো। মায়ের ওই অবস্থায় আমার বড় বোনও আমাকে বলছিল, ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করতে।

কিন্তু আমি কিছুতেই রাজি হচ্ছিলাম না। ওইভাবেই চলতে লাগলো মা ছেলের ছোট সংসার। বাসা ছিলো নারায়ণগঞ্জ নন্দীপাড়া। নন্দিপাড়া ভাড়া বাসা থেকে পায়ে হেঁটে ফতুল্লা ওয়েল টেক্সটাইল মিলে গিয়ে নিয়মিত কাজ করতে থাকি। একদিন মিলে কাজ করতে গিয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে যায়! সেদিন এক তাঁত মেশিনে নতুন স্যাম্পল কাপড় তৈরির ভীম উঠানো হয়েছিল। সেই কাপড়ের পাইরে “ওয়েল টেক্স ফেব্রিকস” নাম লেখা থাকবে। ওই ভীম আমি মাস্টারের দেওয়া হিসাবমতে ড্রয়ার করে তাঁতে পাঠিয়ে দেই। তাঁতে ভীম উঠানোর পর কাপড়ের পাইরে নামের সুতাগুলো আমাকে ভরে দিতে হবে।

অবশ্য এই কাজটা কানাই থাকতে ও-ই করতো। কানাই চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে ওই কাজ আমাকেই করতে হচ্ছিল। তাই তাঁতে ভীম বাঁধার পর মিস্ত্রি আমাকে নামের সুতাগুলো ভরে দিতে বললো। আমি মেশিনের সামনে গেলাম। কাপড়ের ডান পাইরের সুতাগোলে ভরছিলাম। এমন সময় দেখি ডান পাশে থাকা মেশিনের মাক্কু বা স্যাডেল আসা-যাওয়া করার সময় কেমন যেন বাউলি দিচ্ছে। আমি ওই মেশিনের তাঁতিকে মেশিনটা বন্ধ রাখতে বললাম। কিন্তু ওই মেশিনের তাঁতি আমার কথা না শুনে, আমাকে আমার কাজ করতে বলে। তারপরও আমি বললাম, ‘দেখ, মেশিনের মাক্কু কিন্তু ফ্লাইং করবে। মানে মেশিন থেকে মাক্কু বের হয়ে যাবে। আর মেশিন থেকে মাক্কু বের হলেই কারো-না-কারোর শরীরের লাগলে মারাত্মক অ্যাক্সিডেন্ট হবে।’ কিন্তু না, আমার কথা ওই তাঁতি আমলে নিলো না। তাঁতি আমার কথা না শুনে মেশিন চালুই রেখেছিল।

আমিও পাশের মেশিনের উপরে বসে কাপড়ের পাইরের নামের সুতাগুলো ভরছিলাম। হঠাৎ পাশের চালু মেশিনের মাক্কু ফ্লাই করে আমার ডান সাইটের কানে লাগে। এরপর আমি মেশিন থেকে নিচে পড়ে গেলাম। তারপর কী হয়েছিলো তা আমি একদিন পর জানতে পারলাম। “সেদিন মেশিন থেকে পড়ে যাবার পর মিলে থাকা মালিকের টেক্সি করে সাথে সাথে আমাকে ফতুল্লা বাজারে থাকা এক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তার ডান কানের উপরিভাগে তিনটে সিলি দিয়ে ছেড়ে দেয়। তারপর ফতুল্লা থেকে সেই গাড়ি দিয়েই আমাকে বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়।” কিন্তু তখনও আমার জ্ঞান ফিরছিল না। আমার জ্ঞান ফিরেছে রাতে। জ্ঞান ফেরার পর আমি মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘মা আমি এখানে কীভাবে আসলাম?’ তখন আমার মা সবকিছু খুলে বললো। আমি শুনলাম!

দুইদিন বাসায় থাকার পর আমি মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠলাম। দুই দিনের দিন বিকালবেলা ওয়েল টেক্স মিলের মালিক ম্যানেজার-সহ শ্রমিক নেতারাও আমার বাসায় এসে উপস্থিত হলো। মা সবাইকে যথাসাধ্য আপ্যায়ন করলো। ওনারাও মাকে কোনপ্রকার চিন্তা করতে বারণ করে চলে গেলো। তারপর আমার অ্যাক্সিডেন্টের খবরটা মুহূর্তেই চলে গেলো কিল্লার পুল ফাইন টেক্সটাইল মিলে। তখন কালাম-সহ আরও কয়েকজন আমার বাসায় এসে শান্তনা দিয়ে গেলো। কানাইও এসেছিল। এই খবর পৌঁছে গেলো সুবচনী সংলগ্ন নয়াবাড়ি কালামদের বাড়িতে। তখন কালামের মা ভাই-ভাবী-সহ ঠাকুরবাড়ির সবাই আমার জন্য নাকি খুব দুঃখ করলো। জানলাম কালামের কাছ থেকে। এরপর তিনদিন বাসায় থাকার পর একসময় মিলে গিয়ে অসুস্থ শরীর নিয়েই কাজ করতে লাগলাম, তাঁতিদের কথা মাথায় রেখে। কারণ, ওয়েল টেক্স মিলে যেসব ডিজাইন কাপড় তৈরি হতো, সেসব কাপড়ের দক্ষ ড্রয়ার ম্যান তখন আশে-পাশে খুবই কম ছিলো।

তাই অন্যকোনো ড্রয়ার ম্যান দিয়ে সেসব ডিজাইন ভীমের ড্রয়ার তঁতিরা করাতে চাইতো না। মেশিন খালিই পড়ে থাকতো। আর মেশিন খালি থাকলে তাঁতিদের সপ্তাহিক বেতন কম হতো, মিলের প্রোডাকশনও কম হতো। সেই চিন্তা মাথায় রেখেই পুরোপুরিভাবে সুস্থ না হয়েও আমি মিলে গিয়ে কাজ করা শুরু করি। এতে মিলের মালিক ম্যানেজার হতে শুরু করে সবাই খুশি হয়ে গেলো। এর বিনিময়ে তাঁতিদের সাপ্তাহিক বেতনের দিন ম্যানেজার সব তাঁতিদের বেতনের পর আমাকে ডেকে নিয়ে বেশকিছু টাকা বকসিসও দিয়ে ছিলো। সাথে চিকিৎসা-সহ যাবতীয় খরচও মিল মালিক বহন করতে লাগলো।

একসময় আমি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠলেও, আমার ডান কানে কিছুই শুনতে পেতাম না। তারপর কানের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারও দেখানো হলো। ডাক্তার কানের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখলো যে, আমার ডান কানের মনিরগ নিস্তেজ হয়ে গেছে। শতরকম চেষ্টা করলেও তা আর ঠিক হবে না বলে ডাক্তার জানিয়ে দেয়। ডাক্তারের শেষ চেষ্টার পর মিল মালিক নিয়াজ সাহেব বলেছিল, ‘আমি সময় সুযোগ করে নিতাই’কে পাকিস্তান নিয়ে ভালো ডাক্তার দেখাবো। এখন ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়ে কাজ করতে থাকুক।’ এরপর থেকে মালিকের কথামতো নিয়মিত মিলে কাজ করতে থাকি।

একদিন মিলে কাজ করতেছিলাম। কিছুক্ষণ পরই দুপুরের খাবারের সময় মিল একঘন্টা বন্ধ থাকবে। এর কিছুক্ষণ আগে ফতুল্লা পোস্ট-অফিস থেকে ডাকপিয়ন মিলের গেইটে এসে আমাকে তালাশ করে। আমি তখন মিলের ভেতরে কাজ করছিলাম। মিলের দারোয়ান জিন্নাহ ভাই ডাকপিয়নকে মিলের গেইটের বাইরে রেখে আমাকে ডেকে আনে। আমি ডাকপিওনের সামনে আসলে আমার হতে একটা চিঠির খাম ধরিয়ে দিয়ে একটা রেজিষ্টার খাতায় সই নিয়ে চলে যায়। চিঠির খামের উপরে আমার নাম লেখা। প্রেরকের নাম ছিলো অর্চনা রানী সরকার। গ্রাম নয়াবাড়ি। তা দেখে আমি কিছুক্ষণ বিচলিত ছিলাম। সাথে সাথে চিঠির খামটা খুললাম না। চিঠি হাতে নিয়েই মিলের বাইরে চায়ের দোকানে গেলাম। চা-সিগারেটেই টানলাম। তারপর মিলে আসলাম। দারোয়ান জিন্নাহ ভাই, বারবার জিজ্ঞেস করছিলো, ‘কার চিঠি, কে দিয়েছে, কী খবর!’ আমি কিছু না বলেই সোজা আমার কাজের জায়গায় চলে গোলাম। তারপর আমি খাম ছিড়ে চিঠিটা খুললাম।

চিঠির খাম থেকে চিঠি বের করে পড়লাম। আমার অ্যাক্সিডেন্টের খবরে তাদের বাড়ির সবাই চিন্তিত। আমার সুস্বাস্থ্য কামনা-সহ আরও বিস্তারিত লেখা পড়লাম। চিঠির নিচে লেখা ছিলো, ‘আপনার ঠিকানা কালাম ভাইয়ের বড় ভাবী থেকে সংগ্রহ করা।’ কালামের বড় ভাবীকে যে ঠিকানা লিখে দিয়েছিলাম, তা ঠিক। আমি কালামদের বাড়িতে যখন বেড়াতে গিয়েছিলাম, তখন আসার দিন সকালবেলা কালামের বড় ভাবীকে একটা কাগজে ঠিকানা লিখে দিয়ে বলেছিলাম, ‘ভাবী, মেয়েটি যদি আমাকে পছন্দ করে থাকে, তাহলে এই ঠিকানায় চিঠি দিয়ে জানাতে বলবেন।’ তাই হয়তো আমার অ্যাক্সিডেন্টের খবর পেয়ে ঠাকুরবাড়ির ছোট মেয়ে কালামের ভাবীর কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে, স্কুলের সাথে থাকা পোস্ট-অফিস থেকে রেজিস্ট্রিকৃত চিঠি পোস্ট করে। চিটি পড়ে মনটা কেমন যেন হয়ে গেলো! মন চাচ্ছিল মিলের কাজ ফেলে রেখে পরদিনই নয়াবাড়ি গ্রামে চলে যাই। কিন্তু না, তা আর করিনি।

পরদিন বিকালবেলা কিল্লার পুল ফাইন টেক্সটাইল মিলে গিয়ে কালামের সাথে দেখা করলাম। চিঠির কথা জানালাম। কালাম খুশি হয়ে আমাকে বললো, ‘আর কদিন পর দুর্গাপূজা শুরু হলে, পূজা উপলক্ষে কানাইকে সাথে নিয়ে ওদের বাড়িতে যেতে।’ কালামের কথামতো আমি একদিন কাইনার কাছে গেলাম। কানাইকে বললাম, ‘পূজার বন্ধ পেলে আমার সাথে নয়াবাড়ি যেতে।’ পূজা উপলক্ষে কাজের খুব চাপ থাকায় কানাই আমার সাথে যেতে পারবে না বলে জানিয়ে দেয়। তাই আর কানাইর আশায় থাকলাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম, কালামও যদি সাথে না যায়, তাহলে পূজার ছুটি পেলে আমি একাই নয়াবাড়ি চলে যাবো। একসময় দুর্গাপূজা আরম্ভ হলো। মিল থেকে দুইদিনের ছুটি পেলাম। কালামকে আমার সাথে যেতে বললাম। কালামও যেতে পারবে না জানালে, আমি একাই চলে গোলাম সুবচনী সংলগ্ন নয়াবাড়ি গ্রামে।

নয়াবাড়ি গ্রামে গিয়ে সরাসরি ঠাকুরবাড়িতেই উঠলাম। সাথে দুইভাগে কিছু মিষ্টি, পান-সুপারিও নিলাম। একভাগ কালামদের বাড়ির জন্য, আর একভাগ ঠাকুরবাড়ির জন্য। ঠাকুরবাড়িতে একভাগ মিষ্টি পান-সুপারি রেখে আরেক ভাগ মিষ্টি পান-সুপারি কালামদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে, আমি জামাইর মতো বিছানা শরীর লেলিয়ে দিলাম। সেসময় ঠাকুরবাড়ির নারায়ণ সরকারের যেই মেয়েকে কুমিল্লা বিয়ে দিয়েছিল, সেই ময়েও বাড়িতে ছিলো। আমি সরাসরি ঠাকুরবাড়িতে ওঠার পর বাড়ির সবাই হতভম্ব হয়ে গেলো। না পারে থাকতে বলতে, না পারে আমাকে তাড়িয়ে দিতে। তখন ঠাকুরবাড়ির সবাইর এমনই থমথমে অবস্থা ছিলো। কিন্তু না, সেদিন তেমন কোন খারাপ পরিস্থিতিতে আমার পড়তে হয়নি। খুব সুন্দরভাবে আমি একাই নয়াবাড়ি গ্রামের ঠাকুরবাড়িতে জামাই-আদরে দুইদিন থেকে নারায়ণগঞ্জ ফিরে আসি।
চলবে…

জীবনের গল্প-১৮ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৭ টি মন্তব্য (লেখকের ৩টি) | ৩ জন মন্তব্যকারী

  1. ফয়জুল মহী : ০৯-১০-২০২০ | ২১:৩০ |

    বড়ই ভালো লোক । স্যালুট আপনাকে। ভালো লোকের আল্লাহ সহায়। 

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ১০-১০-২০২০ | ২০:০৩ |

      আপনাদের আশীর্বাদ আমার জীবন চলার গতি। শুভকামনা থাকলো দাদা।

      GD Star Rating
      loading...
  2. রিয়া রিয়া : ০৯-১০-২০২০ | ২১:৪৬ |

    সার্থক ভাবেই জীবনের গল্প তুলে ধরছেন। পড়লাম কবি দা।

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ১০-১০-২০২০ | ২০:০৫ |

      গল্পটা ৩০ পর্ব পর্যন্ত চলবে, দিদি। আশা করি সাথে থাকবেন। শুভকামনা থাকলো। 

      GD Star Rating
      loading...
  3. মুরুব্বী : ০৯-১০-২০২০ | ২১:৫৬ |

    কানাই চরিত্রটি সম্ভবত এই এপিসোড সহ তিনটি পর্বে পেলাম। দারুণ চিত্রায়ণ। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ১০-১০-২০২০ | ২০:০৬ |

      আপনাদের অনুপ্রেরণায় আমার লেখালেখি, শ্রদ্ধেয় দাদা। শুভকামনা থাকলো। 

      GD Star Rating
      loading...