জীবনের গল্প-১৬

জীবনের গল্প-১৫-এর শেষাংশ: সত্যিই তো, মেয়েতো কয়েকবারই দেখেছি। কিন্তু ভালো করে তো দেখতে পারলাম না। আচ্ছা আবার আসুক! মনে মনে এই বলেই বেশ কিছুক্ষণ ঘাটে বসে থাকতাম, আবার দেখার আশায়। এরমধ্যেই কালাম বাজার থেকে এসে হাজির হল। কালাম পুকুর ঘাটে এসেই বললো, ‘ওস্তাদ বাড়ি চলেন খাবেন!’ কালামকে খুবই ব্যস্ত দেখাচ্ছিল।

সেসময় কালাম সত্যিই ব্যস্ত ছিলো, টেনশনও ছিলো। কালামের ব্যস্ততা আমাদের জন্যই। কারণ আমরা ওঁদের বাড়িতে উঠেছি অনেকক্ষণ হলো, অথচ এখনো আমাদের ভাত খাওয়া হচ্ছে না, তাই ওঁর যত ব্যস্ততা। তাই ও বাজার থেকে বাড়ি এসে ওঁর মা ভাবীর সাথেও কথা কাটা-কাটি করে তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে বলছে। আমরা ওর সাথে বাড়ি গেলাম। ওকে নিয়েই একসাথে খাওয়া-দাওয়া করলাম। খাওয়া-দাওয়ার পর কিছুক্ষণ কালামদের ঘরে বসেই দেরি করলাম। এরপর কালামকে সাথে নিয়েই ঘর থেকে বের হলাম, নিকটস্থ কোনও বাজারে যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে। তখন একেবারে সন্ধ্যা হয়ে চারদিক ঘুট-ঘুটে অন্ধকার। ঘর থেকে বের হয়েই কালামকে জিজ্ঞেস বললাম, ‘সামনা-সামনি কোনও হাট-বাজার আছে কিনা?’ কালাম বললো, ‘আছে ওস্তাদ! কেন, বাজারে যাবেন?’ বললাম, ‘হ্যাঁ, আমাদের বাজারে নিয়ে চলো।’ যেই কথা, সেই কাজ। নৌকা চড়ে তিনজন চলে গেলাম, একটা গ্রামের পরই গ্রাম্য বাজারে। বাজার থেকে চা-বিস্কুট খেয়ে আসার সময় আমার প্রয়োজন মতো সিগারেটও নিয়ে নিলাম।

ওদের বাড়ি এসে সোজা পুকুর ঘাটে গিয়ে বসলাম। তখন ঠাকুরবাড়ির নারায়ণ সরকারও ঘাটে বসা ছিলো। আমাদের দেখে কালামকে বললো, ‘তোর ওস্তাদকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে যা। বাড়িটা দেখা।’ এরপর কালাম আমার হাত ধরে টানা-টানি শুরু করলো, ঠাকুরবাড়ির ভেতরে যাওয়া জন্য। কালামের টানা-টানিতে আর থাকতে পারলাম না, ঠাকুরবাড়ির ভেতরে যেতেই হলো। ঠাকুরবাড়ির ভেতরে অনেক বড় উঠান। উঠানে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাতেই, আমাদের বসার জন্য একটা ছোটো ছেলে দুইটা পিড়ি একটা হাতল ভাঙা চেয়ার সামনে এনে দিলো। কালাম আমাকে হাতল ভাঙা চেয়ারে বসতে বলে, ওরা দুইজন বসলো, পিড়িতে। আমি চেয়ারেই বসলাম। একটু পরই বড় এক কাঁসার বাটিতে করে কিছু পাকনা পেয়ারা আমাদের সামনে এনে দিলো। আমরা তিনজনই পেয়ারা খাচ্ছিলাম।

ঘাট থেকে বাড়ির মুরুব্বি আমাদের সামনে এসে আরেকটা পিড়িতে বসলো। আমাকে খেটে-খুটে অনেককিছুই জিজ্ঞেস করলো, আমি উনার কথার জবাব দিলাম। তারপর উনি আগামীকাল কালাম-সহ আমাদের তিনজকে ঠাকুরবাড়িতে দুপুরে খাবারের নেমন্তন্ন করলো। আমি না করে বললাম, ‘আগামীকাল সকালেই আমরা এখান থেকে বালি গাঁও চলে যাবো। বালিগাঁ থেকে সন্ধ্যার আগেই আবার নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা হবো।’ কালাম আমার কথা শুনে বালি গাঁও যেতে বারণ করে বললো, বালি গাঁও যাওয়ার দরকার নেই, ‘ওস্তাদ। আগামীকাল আমাদের বাড়িতে থাকবেন।’ কালামের কথা শুনে কানাইও কেমন যেন আমতা-আমতা করতে লাগলো, কিন্তু কিছু বলছিল না। বুঝলাম, কানাইও বালি গাঁও না গিয়ে এখানেই থাকতে চাচ্ছে। তারপর আমি বললাম, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, থাকি-না-যাই তা সকালে দেখা যাবে, এখন চলো পুকুর ঘাটে গিয়ে বসি।’ পুকুর ঘাটে কিছুক্ষণ বসে কালামদের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া সেরে তিনজন একইসাথে ঘুমালাম।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই কানাইকে বলছি, ‘তাড়াতাড়ি করে হাতমুখ ধুয়ে রেডি হয়ে নে।’ কানাই আমতা-আমতা করতে লাগলো। ওর ভাব দেখে বুঝতে পারলাম, ও আজকে এখানে বেড়াতে চাচ্ছে। কালামের মা আমার সামনে এসে বললো, ‘আজকের দিনটা এখানে থেকে যাও। কালকে আর জোর করবো না।’ কালামের ভাই ভাবীও বলতে লাগলো। কানাইও বললো ‘আজকে এখানে থাকি। কালকে চলে যাবো। বন্ধ তো হাতে আরও একদিন থাকবেই। আজকে থাকলে আর সমস্যা হবে না।’ বললাম, ‘ঠিক আছে, থাকলাম। আমার কথা শুনে কালামের মা ভাই ভাবী সবাই খুশি হলো। আমি আর কানাই মুখ ধুতে পুকুর ঘাটের দিকে রওনা দিলাম। আমাদের সাথে-সাথে কালামও ঘাটে আসলো। আমরা একটা আমগাছের ঢালা ভেঙে দাঁত মাজতে মাজতে পুকুর ঘাটে গিয়ে বসলাম। কালাম ঠাকুরবাড়িতে গিয়ে নারায়ন সরকারকে বললো, ‘ওস্তাদ আজকে এখানে থাকবে।’ ওমনি ঠাকুরবাড়ি থেকে দুইটা মেয়ে হাসতে হাসতে কয়েকটা থালাবাসন হাতে নিয়ে পুকুর ঘাটে আসলো। আমি আর কানাই বসে বসে দাঁত মাজতে ছিলাম।

মেয়ে দুইটা দেখে বুঝা যাচ্ছিল না যে, কোনটা বড় আর কোনটা ছোট। দু’জনকে একই বয়সের মনে হলো। আসলে ওরা ছোট-বড় দুই বোন। কিছুক্ষণ পর কালাম ঘাটে এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘ওস্তাদ মুখ ধুয়েছেন?’ বললাম, না, এখনও ধোয়া হয়নি।, মেয়ে দুইটা তখনও পুকুর ঘটে থালাবাসন ধুইতে ছিলো। কালাম ওদের বললো, ‘তোরা ওস্তাদকে সাইট দেয়, মুখ ধোবে।’ আমি কালামকে ধমক দিয়ে বললাম, ‘ওদের কাজ ওরা করুক। আমরা পরেই ধুই।’ কালাম আমাকে বললো, ‘ওস্তাদ, ওরা দুই বোন। এইযে, ওর নাম জোসনা, ওর নাম আর্চনা। জোসনা বড়, আর অর্চনা ছোট।’ নাম জানা হলো। দেখাও হলো। কিন্তু এখনো কথা হয়নি।

মেয়ে দুইটা ওদের কাজ সেরে আমাদের সামনে দিয়ে হেঁটে বাড়ির ভেতরে গেলো। আমারা ঘাটে নেমে হাতমুখ ধুয়ে অস্তেধীরে কলামদের বাড়ি গেলাম। নাস্তা করলাম। এমন সময় কালাম এসে ওর মাকে বললো, ‘মা ওস্তাদ দুপুরে ঠাকুরবাড়ি খাবে। আমারও ওস্তাদের সাথে যেতে হবে।’ আমি থমকে গেলাম! জিজ্ঞেস করলাম, ঠাকুরবাড়িতে খাবো কেন?’ কালাম, হাসতে-হাসতে বললো, ‘ওস্তাদ নারায়ন সরকার খুব অনুরোধ করছে। তাই আমি বললাম।’ কালামের কথা শেষ হতে-না-হতেই কালামের মা বললো, ‘হ্যাঁ বাবা, আজ খুব ভোরবেলা নারায়ন সরকার আমাদের বাড়ি এসে আপনাকেও অনুরোধ করেছে, যাতে দুপুরবেলা তোমরা ঠাকুরবাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করো। অমত করো না বাবা। বুড়ো মানুষ বলেছে যখন, আজকে দুপুরবেলা ঠাকুরবাড়িতেই খেও।’ কালামের মায়ের কথা শুনে আমি চুপ করে ঘর থেকে বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরালাম। সিগারেট টানছি আর চিন্তাও করছি! খালি হাতে নেমন্তন্ন খেতে যাবো না!

কালামকে ডাকলাম। কালাম সামনে এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘ওস্তাদ কিছু বলবেন?’ বললাম, নৌকা রেডি আছে? কালাম বললো, ‘হ্যাঁ ওস্তাদ, নৌকা ঘটলায় বাঁধা আছে। কোথাও যাবেন?’ বললাম, বাজারে যেতে হবে। কালাম বললো, ‘ঠিক আছে যাবো। আগে নাস্তা খেয়ে নিন, তারপর।’ তাড়াতাড়ি নাস্তা খেয়ে কানাই সহ নৌকা চড়ে সুবছনী বাজারে গেলাম। বাজারে গিয়ে তিনজনে চা-বিস্কুট খেলাম। তারপর মিষ্টি দোকান থেকে দুই কেজি মিষ্টি কিনলাম। সাথে পান সূপারিও কিনলাম। কালাম রাগ হয়ে বললো, ‘এতকিছুর দরকার কী ওস্তাদ?’ বললাম, ‘দরকার আছে কালাম। নেমন্তন্ন খালি হাতে মানায় না। তাছাড়া তোমাদেরও তো মানসম্মান আছে। আমিতো তোমাদের অতিথি।’ কালাম আর কিছু বললো না, চুপ করে থাকলো।

সুবচনী বাজার থেকে কালামদের বাড়ি যেতে যেতে প্রায় দুপুর হয়ে গেলো। কানাই মিষ্টির প্যাকেট-সহ পান সুপারি নিয়ে কালামের মায়ের হাতে দিলো। মিষ্টি দেখেই কালামের মা বুঝতে পেরেছে, মিষ্টি কেন অনা হলো! কালাম তাড়াহুড়ো করতে লাগলো, স্নান করার জন্য। গামছা সাবান নিয়ে কালাম-সহ ঠাকুরবাড়ির ঘাটে গেলাম, স্নান করার জন্য। স্নান করতে যাওয়ার সময়ই কালাম আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ওস্তাদ, আপনার কাছে কোন মেয়েটা ভালো লাগে?’ আমি একরকম রাগ-রাগ ভাব নিয়েই বললাম, ‘আরে তোমাদের মাথা কি সত্যি খারাপ হয়ে গেলো নাকি? আমি কি বিয়ে করতে এসেছি? নাকি মেয়ে দেখতে এসেছি!’ কালাম মুখটা কালো করে ফেললো। তা দেখে আমি নিজেই লজ্জায় পরে গেলাম! তারপর কালামের মনটা ভোলো করার জন্য কালামকে বললাম, ‘আচ্ছা, তোমার কাছে কোনটা ভালো লাগে?’ কালাম বললো, ‘ওস্তাদ, মেয় দুইটাই তো দেখার মতো।এখন কোনটা রেখে কোনটার কথা বলি?’ কালাম আবার কানাইকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কানাই ভাই, আপনার কাছে কোন মেয়েটা ভালো লাগে?’ কানাই বললো, আমার কাছে দুইটাই ভালো লাগে।’ আমি কালামকে বললাম, ‘আমার কাছে ছোটটা ভালো লাগে।’ আমার কথা শুনে কানাই আর কালাম দুইজনেই হাসলো।

পুকুর ঘাটে গেলাম। স্নান করে কালামদের বাড়ি গেলাম। জামা-প্যান্ট পরে রেডি হলাম, ঠাকুরবাড়ি যাবার জন্য। মিষ্টি পান সুপারি কালাম হাতে নিয়ে আগে আগে যাচ্ছে। আমরা ওর পেছনে-পেছনে হাঁটছি। ঠাকুরবাড়ি গেলাম। কালাম মিস্টির প্যাকেট নিয়ে বড় ঘরের ভেতরে গেলো। মিষ্টি পান সুপারি দেখা আমাদের সমাদর আরও দুইগুণ বৃদ্ধি পেলো। আমরা উঠানে দাঁড়াতেই ঐ হাতল ভাঙা একটা ছেয়ার আর একটা পিড়ি এনে দিলো। কালাম ঘরে গিয়ে মিস্টির প্যাকেট আর পান-সুপারির পোটলা কারোর হাতে দিয়ে আমাদের সামনে উঠানে আসলো। বসার জন্য আরেকটা পিড়িও সাথে নিয়ে আসলো। তিনজনে বসে কথা বলতে বলতেই বড় ঘরে ডাক পড়লো। বড় ঘরে গিয়ে খাটের পর বসলাম। আমাদের সামনে তিনটা প্লেটে সাজানো কিছু মিষ্টি চলে আসলো। কালাম খেলো কানাইও খেলো। কিন্তু আমি খাইনি। কারণ মিষ্টি খেলে আর ভাত খেতে পারবো না, তাই।

কিছুক্ষন পরই ভাত খেতে দিলো। আমরা তিনজন একসাথে বসে ভাত খেলাম। ভাত খেতে বসে কালামের মনের ভাব দেখে বুঝলাম, কালাম মনে হয় মিষ্টি নিয়ে ঘরে ঢোকার পর আমার পছন্দের ব্যাপারটা ওদের কারো কাছে বলেছিল। এইজন্যেই মনে হয়,আমাদের খাওয়া-দাওয়ার সামনে ছোট মেয়েটা বেশি আসেনি। আমাদের খাওয়া-দাওয়া পরিবেশন করেছিল অবিবাহিত থাকা দুই বোনের মধ্যে বড় মেয়েই। খাওয়া-দাওয়া শেষে ঠাকুরবাড়ি থেকে বের হয়ে সামনে থাকা পুকুর ঘাটে গেলাম। পুকুর ঘাটে গিয়ে দেখি বেশ কয়েকজন মানুষ বসে গল্প করছে। সাথে কালামের বড় ভাই সালামও আছে। তাঁদের কথাবার্তার ভাবে বুঝলাম, তাঁরা আমাদের নিয়েই আলাপ আলোচনা করছিলো।

সিঁড়ি ঘাটলার উপরে গিয়ে সালাম ভাইয়ের সাথে বসলাম। সালাম ভাই জিজ্ঞেস করলো, কী দিয়ে খাওয়া হলো?’ জবাবে যা যা খেলাম আর যেসব আয়োজন করেছিলো, সবই বললাম। পুকুর ঘাটে কিছুক্ষণ বসার পরই ঠাকুরবাড়ি থেকে ছোট একটা ছেলে অনেকগুলো পান সুপারি নিয়ে আসলো। সবাই পান খেলো, আমি কানাই আর কালাম পান খেলাম না। কিছুক্ষণ পর সালাম ভাই-সহ আমরা কালামদের বাড়ি চলে গেলাম। কালামের মা জিজ্ঞেস করলো, ‘কেমন খেলে বাবা?’ বললাম, ‘ভালোই খেয়েছি খালা।’ বললো, ‘গরিব হলেও আত্মা আছে লোকটার! তো মেয়ের হতে কিছু দিয়ে এসেছ নাকি?’ আমি আর কিছু বললাম না, কানাই বললো, ‘আমরা কি মেয়ে দেখতে গেছি নাকি, খালা? আমরা নেমন্তন্ন খেতে গেছি।’ কালামের মা আর কিছু বলেনি, ঘরে গিয়ে বসতে বললো। আমি আর কানাই শোবার ঘরে গিয়ে বসতেই কালামের মা একটা পানের ঢালা হতে নিয়ে আমাদের সামনে এসে বসলো। আমাদের পান খেতে বললে, আমরা না করলাম। কালামের আমাদের বিশ্রাম করতে বলে ঘর থেকে চলে গেলো। তখন শেষ বিকালের শেষ সময়। কিছুক্ষণ পরই সন্ধ্যা হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছিল। তাই বিশ্রাম আর করলাম না, কালামকে সাথে নিয়ে নৌকা চড়ে ঐ গ্রাম্য বাজারেই গেলাম। চা-বিস্কুট খেয়ে কিছুক্ষণ ঘুরে-ফিরে সন্ধ্যার পর কালামদের বাড়িতে আসলাম।

কালামদের বাড়িতে এসে জামা-প্যান্ট চেঞ্জ করে পুকুর ঘাটে গিয়ে বসলাম। সেদিন পুরো নয়াবাড়ি গ্রাম জানা-জানি হয়ে গিয়েছিল, নারায়ণ সরকারে মেয়েকে দেখতে এসেছে। তাই সেদিন পুকুর ঘাটে অন্যদিনের চেয়ে বেশি মানুষ লক্ষ্য করলাম। অনেক মানুষের সাথে কথা বললাম। অনেককেই সিগারেট দিলাম। কালামও পুকুর ঘাটে বসে বসে উপস্থিত থাকা সকলকে আমার কাজের গল্প শোনালো। অনেকক্ষণ পুকুর ঘাটে আড্ডা দিয়ে কালামদের বাড়ি এসে গেখি কালামে ভাবী আমাদের জন্য খাবার রেডি করে বসে আছে। আমি খাব-না-খাব না বলার পরও সবার সাথে খেতেই হলো। নামমাত্র দুমুঠো খেয়ে বাড়ির বাইরে গিয়ে সিগারেট টেনে ঘরে আসলাম। শোবার ঘরে বসে ঘুমিয়ে থাকার ভাব করছিলাম। এমন সময় কালামের মা আমাদের সামনে এসে বসলো। হাতে পানের ঢালা। আমাদের পান খেতে বললে, আমার না করলাম।

কালাম মা উনার নিজের জন্যই একটা পান বানিয়ে মুখে দিয়ে নিজে নিজেই বললো, ‘ঠাকুরবাড়ির অনেক কাহিনী আছে বাবা।’ শোনার জন্য আগ্রহ নিয়ে বললাম, কেমন কাহিনী, খালা? বললো, “নরায়ন সরকার যেই বাড়িতে থাকে, এটা কিন্তু তার নিজের বাড়ি না। এই বাড়িটা সত্যগুরু নামে এক ঠাকুরের বাড়ি। আর নারায়ণ সরকার হলো, সত্যগুরুর শিষ্য। নারায়ণ সরকারের বাড়ি ছিলো পদ্মার পড়। একসময় নারায়ণ সরকারের বসতভিটা পদ্মায় বিলীন হয়ে গেলে, নারায়ণ সরকার এই সত্যগুরুর বাড়িতে আশ্রয় নেয়। সত্যগুরু ঠাকুর জীবিত থাকতে ওই বাড়িতে কোনও চোর চুরি করতে পারেনি। চুরি করতে আসলেই সারারাত আটকা পড়ে থাকতে, যেতে পারতো না। সকালবেলা সত্যগুরু ঘুম থেকে ওঠে চোরকে শাসিয়ে ছাড়ত।’

‘আর পুকুরের ছিল এক অলৌকিক কাণ্ড! কারোর বিয়েসাদী হলে পুকুরপাড়ে এসে থালা-বাসনের কথা বললেই হতো। পরদিন ভোরবেলায় পুকুর ঘাটে থালাবাসন ওঠে থাকত। বিয়ে বা অন্যকোন ধর্মীয় কাজ ছিল মুখ্য বিষয়, এ ছাড়া অন্য কাজের জন্য নয়। কাজ শেষে থালা- বাসনগুলো ভালো করে ধুইয়ে আবার পানিতে ছড়ে দিতো। একদিন ঘটলো এক অন্যরকম ঘটনা। বিয়ের কাজ শেষে পুকুরের থালা-বাসন থেকে একটা কাঁসার থালা কেউ-না-কেউ রেখে দিয়ে, বাদবাকি থালাবাসন যখন পুকুরে দিচ্ছিল; তখন থালা- বাসনগুলো পানিতে ডুবছিলো না। তিনদিন যাবত থালা- বাসনগুলো ওইভাবেই পুকুরে ভাসমান অবস্থায় ছিল। তিনদিন পর থালা- বাসনগুলো পানিতে ডুবেছে ঠিক, কিন্তু কেউ আর কখনো কিছু চেয়ে পায়নি।’ এসব অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল সত্যগুরু জীবিত থাকতে।’

‘একসময় সত্যগুরু মারা যায়। সত্যগুরু মারা যাবার পর সত্যগুরুর ফ্যামিলি বেশ কয়েকবছর এই বাড়িতে ছিলো।হিন্দু-মুসলিম রায়টের পর একসময় সত্যগুরুর ফ্যামিলি নারায়ণ সরকারকে এই বাড়ির দায়দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে ভারতে চলে যায়। সেই থেকেই নারায়ণ সরকার এই বাড়ি নিজের বাড়ির মতো করে থাকছে।” কালামের মা আমাদের ঠাকুরবাড়ির গল্প শুনিয়ে শুয়ে থাকতে বললে, আমরা আগের রাতের মতো তিনজন একসাথে শুয়ে থাকি। পরদিন সকালবেলা

পরদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি ঠাকুরবাড়ির ছোট মেয়েটা কালামের বড় ভাবীর সাথে বসে বসে গল্প করছে। আমাকে দেখেই চলে যাওয়া প্রস্তুতি নিতেই, কালামের বড় ভাবী ধমক দিয়ে বসতে বললো। মেয়েটিও চুপচাপ বসে থাকলো। কানাই আমার আগেই ঘুম থেকে উঠে আম পাতা মুড়িয়ে কালামদের উঠানে দাঁড়িয়ে দাঁত ব্রাশ করছিল। আমাকে দেখেই কানাই মেয়েটির দিকে আমাকে ইশারা দিয়ে দেখালো। আমিও কানাইকে হাতে ইশারা দিয়ে কাছে ডাকলাম। কানাই আমার সামনে আসলে, আমি মেয়েটির সাথে কথা বলার জন্য কানাইকে বললাম। কানাই মেয়েটিকে কিছু না বলে আমাকেই মেয়েটির সাথে কথা বলতে বললো। আমি কানাই উপর রাগ না করে মেয়েটির সামনে গিয়ে ভাবীকে বললাম, ‘ভাবী, আমাদের জন্য কোনকিছুর আয়োজন করবেন না। কিছুক্ষণ পর তো চলেই যাচ্ছি।’ কালামের বড় ভাবী বললো, ‘সকালের নাস্তা রেডি করছি ভাই। নাস্তা না খেয়ে তো আর যেতে পারবেন না।’ বললাম, ‘ঠিক আছে ভাবী, নাস্তা খেয়েই রওনা দিবো। তো আপনার সামনে মেয়েটি কে?’ ভাবী বললো, ‘ও-তো ঠাকুরবাড়ির সরকারের ছোট মেয়ে।’ আমি মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমার নাম কি?’ মেয়েটি ওর নাম না বলে আমতা-আমতা করতে লাগলো। ভাবী ধমক দিয়ে বললো, ‘তোর নাম জিজ্ঞেস করছে, তুই তোর নাম বলছিস না কেন? নাম বলতে কি টাকা-পয়সার দরকার হয়?’ ভাবীর ধমক শুনে মিয়েটি নিজের নাম বললো। কয় ভাই-বোন বললো। লেখাপড়া কতটুকু বললো। কোন স্কুলে পড়ছে তা-ও বললো। কানাই আমার সামনেই দাঁড়িয়ে শুনছিলো। তারপর বললাম, তুমি এখন বাড়ি যাও, আবার দেখা হবে, কথাও হবে।

মেয়েটি মাথা নিচু করে বাড়িতে চলে গেলো। আমারা হাতমুখ ধুয়ে নামমাত্র কিছু খেয়ে কালামদের বাড়ির সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হলাম। নৌকায় উঠার আগে ঠাকুরবাড়ি গেলাম। ঠাকুরবাড়িতে গিয়ে বাড়িতে থাকা সবার কাছে বলেকয়ে নৌকায় গিয়ে উঠলাম। কালাম নৌকা বেয়ে সুবচনী বাজার নিয়ে এলো। ঢাকার লঞ্চে না ওঠা পর্যন্ত লঞ্চ ঘাটেই ছিলো। একসময় লঞ্চ আসলে কানাই আর আমি লঞ্চে উঠলাম। লঞ্চ ঢাকার উদ্দেশে রওনা রওনা হলো। মাঝপথে ফতুল্লা লঞ্চঘাট নেমে নিজের বাসায় চলে গেলাম।
চলবে…

জীবনের গল্প-১৭ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৭ টি মন্তব্য (লেখকের ৩টি) | ৪ জন মন্তব্যকারী

  1. ফয়জুল মহী : ০৪-১০-২০২০ | ১:২৮ |

    এর নাম জীবন । বয়ে চলে সাগরের মত

    GD Star Rating
    loading...
    • টেক প্রশাসক : ০৪-১০-২০২০ | ১১:১৯ |

      লবনাক্ত জীবন

      GD Star Rating
      loading...
    • নিতাই বাবু : ০৫-১০-২০২০ | ৩:২১ |

      সুন্দর মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি, শ্রদ্ধেয় দাদা।         

      GD Star Rating
      loading...
  2. মুরুব্বী : ০৪-১০-২০২০ | ৭:৫৭ |

    জীবন গল্পের চলতি পর্বটি গতরাতে অর্ধেক পড়তেই বিদ্যুৎ হাওয়া।

    সকালে বেশ তৃপ্তি ভরেই পড়ে নিলাম পুরাটাই। শুভেচ্ছা জানবেন মি. নিতাই বাবু। Smile

    GD Star Rating
    loading...
  3. রিয়া রিয়া : ০৪-১০-২০২০ | ২১:২০ |

    জাদুমাখা বর্ণনা। প্রতি লাইনে প্রতি অক্ষরে যেন চোখ সেঁটে থাকে। আমি খুব আগ্রহ করে পড়ছি দাদা।

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ০৫-১০-২০২০ | ১২:৩৯ |

      শ্রদ্ধেয়া কবি রিয়া দিদি, আপনার মন্তব্যে লেখার উৎসাহ বেড়ে যায়। নিরন্তর শুভকামনা থাকলো।  আর হ্যাঁ, এটা পরীক্ষামূলক মন্তব্য।          

      GD Star Rating
      loading...
  4. নিতাই বাবু : ০৫-১০-২০২০ | ৩:২৩ |

    সকল সম্মানিত মন্তব্যকারীদের মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।       

    GD Star Rating
    loading...