জীবনের গল্প-৮

জীবনের গল্প-৭- এর শেষাংশ; আমরাও জাকিরিয়া সল্ট মিলে নিয়মিত কাজ করতে থাকি, দৈনিক মজুরি ২৫ টাকায়। এটাই ছিল আমার কোনও এক মিল ইন্ডাস্ট্রিতে জীবনের প্রথম চাকরি। হোক সেটা লবণের মিল। তাই এই চাকরি নিয়ে চার-পাঁচ বছর আগে এক অনলাইন দিনলিপিতে “জীবনের প্রথম চাকরি” শিরোনামে আমার একটা লেখা প্রকাশ হয়েছিল। সেই সাইটের লিংক লেখার মাঝে দেওয়া হলো।

রাস্তার কাজ ছেড়ে মনে অনন্দ নিয়ে ১২ থেকে ২৫ টাকা হাজিরায় গিয়ে লাগলাম, লবণের মিলে। কিন্তু লবণের মিলের কাজ যে ছিল এতো কষ্টের, তা আর আমরা তিনজনের একজনও কাজে লাগার আগে বুঝতে পারিনি। আমাদের দুইজনের আগে থেকে কাজ শুরু করা লোকমানও আমাদের কাছে কিছু খুলে বলেনি। যদি লোকমান আমাদের বলতো, ‘যেই কাজে আছিস সেই কাজেই থাক; লবণের মিলে কাজ করার আশা করিছ না’ তাহলেই আমরা বুঝে নিতাম যে, লবণের মিলে কাজ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। আমরা আর লবণের মিলে গিয়ে কাজে যোগদান করতাম না।

কিন্তু লোকমান তা না বলে, ও আমাদের প্রতিদিনই কাজে যোগদান করার জন্য তোষামোদ করেছিল। কেন তোষামোদ করেছিল, তা আমরা পরে বুঝতে পেরেছিলাম, লোকমানও আমাদের কাছে তা খুলে বলেছিল। আমাদের দুইজনকে ছেড়ে লোকমানের একা-একা লবণের মিলে ভালো লাগছিল না, তাই। যাইহোক, এরজন্য লোকমানের সাথে আমাদের কোনদিন মনমালিন্য হয়নি। আমরা তিনজনই মিলেমিশে একসাথে জাকিরিয়া সল্ট মিলে মনোযোগ সহকারে কাজ করতে ছিলাম। কিন্তু পারছিলাম না, অতিরিক্ত খাটুনির কারণে আর শরীরে ঘা হয়ে যাওয়ার কারণে। এই কাজ করতে গেলে মিলে ঢোকার আগেই সমস্ত শরীরের পান খাবার ‘খয়ের’ মাখিয়ে কাজ করতে হয়। নাহলে শরীরে থাকা একটা ঘামাচি থেকে বড় আকারে ঘা হয়ে যাবে-ই-যাবে। তবু্ও একদিন কাজ করে, আর দুইদিন বসে থেকে অতি কষ্টে কাজ করে যাচ্ছিলাম।

আমাদের শরীরের এ-অবস্থা দেখে সবাই তখন বললো, কাজ করতে করতে একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে। একসময় হয়েছিলও তা-ই।। কাজের সাথে নিজেদের শরীরও মানিয়ে গিয়েছিল। আমরা যে কাজটা করতাম, সেই কাজের নাম ছিল ‘দৌড়’। লবণের মিলের কাজের এমন আরও নাম আছে। যেমন–খালাসি কাজ, বোজা কাজ, খামালি খাজ, কাচানি বা বেলচা কাজ, দৌড় কাজ, মিস্ত্রি, ফোরম্যান ও রপ্তানি বা ডেলিভারি কাজ। যিনি কাজ চলাকালীন সময়ে দেখবাল করতো, তাঁকে বলা হতো মাঝি বা সরদার। আমরা তিনজনই ছিলাম দৌড়ে। যিনি আমাদের কাজে লাগতে সহায়তা করেছিল, তিনি ইসমাইল মিয়া খামালি কাজ করতেন। উনার নাম ইসমাইল হলেও, মিলের সবাই তাঁকে ইসলাম ভাই বলেই ডাকতো। আমরাও ইসলাম ভাই বলে ডাকতাম।

ইসলাম ভাই’র আরো তিনজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন৷ তখন ইসলাম ভাই বলতেন, ‘আজ থেকে আমরা সাত বন্ধু’। আমরা এক সাথে খেতাম, এক সাথে ঘুমাতাম। মোট কথা সাত মাথা মিলিয়ে হলাম এক মাথা৷ মিলে কাজ করতে হতো আট ঘন্টা৷ ছুটি হতো বিকাল ৫ টায়৷ ছুটি’র পর গা-গোসল করে আর দেরি করতাম না, চলে যেতাম মহেশখালী বাজারে৷ তখন প্রতি কাপ চা’র দাম ছিল চারআনা (২৫) পয়সা৷ সাতজন মিলে চা খেতাম পৌনে দুই টাকা, আর চারআনা দিয়ে চট্রগ্রামের আবুল বিড়ি কিনে নিতাম৷ একেক দিন একেকজন প্রতিদিন বিকাল বেলার চায়ের বিল দিতে হতো। তারপর যেতাম আদিনাথ পাহড়ের উপরে থাকা আদনাথ মন্দিরে। আদিনাথ মন্দিরটি ছিল মহেশখালী বজার হতে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তর দিকে। মাঝপথেই জাকিরিয়া সল্ট মিল। সেখানে যাওয়াটা সবার চাইতে আমার একাই যাওয়া হতো বেশি! কারণ, আদিনাথ মন্দিরে নিয়মিত আসা-যাওয়া ফলে মন্দিরের পুরোহিতের সাথে আমার একরকম সখ্য গড়ে উঠেছিল। তখন এমন হয়েছিল যে, আদিনাথ মন্দিরে যদি এক বিকাল যাওয়া না হতো, পরদিন সকালবেলা ঠাকুর মশাই নিজে এসেই আমার তালাশ নিতো। বিকালবেলা মন্দিরে যেতে বলতো। আমিও যেতাম। মন্দিরের পরিবেশটা আমার খুবই পছন্দ হতো তাই। সেসময় আদিনাথ মন্দিরে বসে মন্দিরের ঠাকুর কর্তার সাথে বসে আমার অনেক সময় কেটেছিল।

অনেক সময় সন্ধ্যার পর ঠাকুর কর্তা নিজে অর্ধেক রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যেতো। এদিকে একটু দেরি হয়ে গেলেই ইসলাম ভাই-সহ মিলের সবার আমার জন্য অস্থির হয়ে যেতো। কারণ লবণের মিলের ভেতরেও আমি ছিলাম সবার পছন্দের একজন মানুষ। মিলের মাঝি, মিস্ত্রি, ম্যানেজার-সহ শ্রমিকদের কাছে আমি ছিলাম খুবই আদরের এবং পছন্দের। এই সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল শুধু একটুখানি লেখাপড়া জানতাম বলে। কিন্তু তাদের এই আচরণ দেখে আমার খুবই লজ্জা হতো। আমি তাদের সবসময়ই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতাম, কিন্তু না পারতাম না৷ সবাই আমাকে স্নেহ ভালোবাসার চোখেই দেখে রাখতো। কারোর বাড়িতে চিঠি পাঠাতে হলে, রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর খাতা-কলম নিয়ে আমাকে বসতে হতো। অনেক সময় কার আগে কারটা লিখবো, এই নিয়েও বাক-বিতণ্ডার সৃষ্টি হতো। পরে অবশ্যই সবই ঠিক হয়ে যেতো। এভাবেই মহেশখালী জাকিরিয়া সল্ট মিলে কেটে গেলো প্রায় চার মাসের মতো। একসময় লবণের মিল-সহ মহেশখালী বাজারে থাকা বেশকিছু দোকানদার ও এলাকার কিছু স্থানীয় লোকদের সাথে আমার খুব সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। যদিও মিল কর্তৃপক্ষের নিষেধ ছিল, এলাকার কারোর সাথে সখ্যতা বা বন্ধুত্ব না করার, তবুও আমরা কয়েকজন ছিলাম এই নিষেধাজ্ঞার বাইরে। এলাকার কিছু মানুষের সাথে ছিল সুগভীর ভালোবাসা। তাছাড়া ঢাকার লোক বলে একটা কথা আর সুনাম তো ছিলোই। সেই সুবাদে মিলেও ইজ্জত পেতাম, মিলের বাইরেও ইজ্জত পেতাম। চলতাম, ফিরতাম, ঘুরতাম, খেতাম, কাজও করতাম সমানতালে।

একসময় ঈদু-উল-ফিতরের আগমণ ঘটলো। রোজা আরম্ভ হলো। হঠাৎ করে বাজারে লবনের দাম কমে গেল৷ ছয়-আনা থেকে চার আনায় নেমে আসলো। মিলের কাজও আস্তে আস্তে কমতে লাগলো। এরমধ্যেই আমার সাথে আসা দুইজনের বাড়ি হতে তাদের ফিরিয়ে নিতে লোক এসে হাজির হলো৷ আমি তাদের দেখে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার মায়ের কথা। তাদের কাছ থেকে উত্তর মিলল, ‘তোমার মা আসার সময় আমাদের কিছু বলেনি।’ পরদিন সকালবেলা আমার সাথে আসা দুইজন জাকিরিয়া সল্ট মিল হতে বিদায় নিয়ে মহেশখালী ত্যাগ করলো। ওঁরা চলে যাবার পর আমি হয়ে গেলাম একা৷ তখন আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। ইসলাম ভাই, আজাহার ভাই, হানিফ ভাই ও আফাজ ভাই আমাকে সান্ত্বনা দিতেন। তাঁরা বলতেন, ‘তুই নিতাই আমাদের আপন ভাইয়ের মতো, আমরা খেলে তুই না খেয়ে থাকবি না।’ তাদের এই শান্ত্বনায় কিছুতেই আমার মন ভরছিল না৷ শুধু অামার মায়ের কথাই মনে পড়ছিল। সেদিন মিলেও তেমন কাজ ছিল না, আমিও আর কাজের ধান্দায় থাকলাম না। কাগজ-কলম নিয়ে বসে পড়লাম মায়ের কাছে একটা চিঠি লিখতে। চিঠি লিখে দুপুরের আগেই মহেশখালী বাজারে গিয়ে পোস্ট অফিস থেকে একটা এনভেলপ কিনে ঠিকানা লিখে ডাক বাক্সে ফেলে চলে আসলাম মিলে।

মিলে এসে শুনতে পেলাম, মিল কর্তৃপক্ষ লবণের দাম ঠিক না হওয়া পর্যন্ত মিল বন্ধ ঘোষণা করেছে। তবে কাউকে মিল ত্যাগ করার জন্য চাপ দিবে না। যে থাকার থাকবে, যে যাবার সে অন্যত্র যেতে পারবে। বন্ধ মিলে কেউ থাকলে খাওয়া খরচ মিল কর্তৃপক্ষ থেকে বহন করা হবে। পড়ে গেলাম বিপাকে! সাহস দিচ্ছিলেন, ইসলাম ভাই ও সাথের আরও তিনজন। তাঁরা যেকোনো সাইটে কাজের জোগাড় না করে আর মিল থেকে কোথাও যাবে না বলে আশ্বস্ত করেছে। আমি থেকে গেলাম তাঁদের সাথেই। এরমধ্যেই মিলের ফোরম্যান সাহেব মিলে যাঁরা-যাঁরা থাকবে তাঁদের নিয়ে নিজ খচরে ঈদ উপলক্ষে মিলের ভেতরেই একটা যাত্রানুষ্ঠান করার কথা জানালেন। এতো আমরা সবাই খুশি হলাম ঠিক, কিন্তু কাজ ছড়া নিজেদের হাত খরচ চালাবো কী করে, তা-ই নিয়েও পড়ে গেলাম দুঃশ্চিন্তায়! তখন মিল বন্ধ হলেও মিল কর্তৃপক্ষ শুধু দুইবেলা খাওয়াতো। দুপুরে আর রাতে। সকালের খাবার ছিল যাঁর-যাঁর কাঁধে। তখন আমরা পাঁচজন সকালের খাবার ও নিজেদের হাত খরচ চালানোর জন্য একটা বুদ্ধি করলাম। বুদ্ধি হলো, মিলের সাথেই একটা খাল ছিল। সাগরের জোয়ার-ভাটার সময় সেই খালের পানিও বাড়ত-কমতো। জোয়ারের পানির সাথে প্রচুর মাছ খালে চলে আসতো, আবার ভাটার সময় পানির সাথে মাছগুলো সাগরেই নেমে যেতো। খালটা ছিল খুবই চিকন। কিন্তু গভীর ছিল।

একদিন আমারা পাঁচজন সেই খালের কিছু অংশ দুইদিকে বাঁধ দিয়ে রাখলাম। জোয়ারের সময় পানি এসে খাল ভরে টবু-টুবু হলো। একসময় ভাটা লাগলো। বাঁধের ভেতরে পানি জমা হয়ে থাকলো। আমরা চারজন দুই ভাগে ভাগ হয়ে খালের পানি সেঁচতে লাগলাম। পানি সেঁচে দেখি, মাছ-আর-মাছ! অনেক মাছ! সেই মাছ টুকরি ভরে মহেশখালী বাজারে নিতেই পথিমধ্যেই সব মাছ বিক্রি হয়ে গেল। প্রথম দিনই মাছ বিক্রি হলো ৫০ টাকার মতো। আহা্! এতো টাকা খাবে কে শুনি! এরপর থেকে আমাদের দেখাদেখি মিলের আরও কয়েকজন ঠিক আমাদের বুদ্ধি কাজে লাগাতে শুরু করে দিলো। সাথে মিল এলাকার স্থানীয় মানুষেও। সেসময় আমরা বন্ধ মিলের ভেতরে যাঁরা ছিলাম, তাঁরা সবাই দিনের বেলা থাকতাম খালের মাছ ধরার ধান্দায়, আর সন্ধ্যার পর থাকতাম নিজেদের যাত্রাপালার রিয়েসাল নিয়ে ব্যস্ত।

যাত্রার নাম, ‘চাঁদ কুমারী ও চাষার ছেলে’। একসময় আমাদের রিয়েসাল শেষ হলো। ডাইরেক্টর ছিল স্বয়ং মিলের ফোরম্যান সাহেব নিজেই। ঈদের বাকি আছে দুইদিন। ফোরম্যান সাহেব যাত্রা করার জন্য মেকাপম্যান-সহ বাজনা দল ও প্রয়োজনীয় যা লাগে তা আনতে গেলেন চট্টগ্রাম। ঈদের আগের দিন থেকে এলাকায় মিলে যাত্রানুষ্ঠান নিয়ে পড়ে গেলো শোরগোল। ঈদের আগের দিন থেকেই যাত্রানুষ্ঠানের মঞ্চ তৈরি করা-সহ অনেক বড় জায়গা জুড়ে উপরে তেরপাল দিয়ে ছাউনি দেওয়া হলো। সেই যাত্রাপালায় আমি একাই নিলাম দুই চরিত্র। আমাদের সাথে কোনও মেয়ে অভিনেত্রী ছিলো না। মেকাপম্যান ছিলো খুবই দক্ষ। “চাঁদ কুমারী ও চাষার ছেলে” যাত্রাপালায় আমাদের থেকেই এক ছেলেকে নায়িকা বেছে নেওয়া হয়েছিল। ছেলেটাকে এমনভাবে মেকাপ করা হয়েছিল, তা দেখে এলাকার সবাই ছেলেটিকে মেয়েই ভেবে নিয়েছিল। আমার চরিত্র ছিলো, চাঁদ কুমারীর সখী। আমাকেও এমনভাবে মেকাপ করা হয়েছিল যে, আমাকে আর কেউ চিনতেই পারছিল না। আমার একা দুই চরিত্রের মধ্যে আরেকটি চরিত্র ছিল দাদা নাতি। ঈদের দিন সেই যাত্রানুষ্ঠান শেষ হতে রাত ভোর হয়ে গিয়েছিল। পরদিন এলাকার পরিচিত লোকেরা জিজ্ঞেস করতে লাগলো, ‘নায়িকা কোথা থেকে আনা হয়েছিল।’ আমার বলতাম, ‘চট্টগ্রাম থেকে বায়না করে নায়িকা আনা হয়েছে।’ এটাই এলাকাবাসী বিশ্বাস করেছিল। কিন্তু সত্য কথা কেউ বলিনি যে, নায়িকা তো আমাদের মধ্যেই একজন ছিল। বলিনি এলাকার দুশ্চরিত্র কিছু মানুষের ভয়ে। সেই মনের ভয় ক’দিন পরে এমনিতেই কেটে গিয়েছিল। এলাকার কেউ তখন আর এসব নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করতো না। কিন্তু দেখা দিলো খালে মাছ ধরা নিয়ে নতুন বিপদ!

একসময় মাছ ধরা নিয়ে এলাকাবাসীর সাথে মিলের শ্রমিকদের মারপিট লেগে যাওয়া মতো অবস্থা সৃষ্টি হয়ে গেলো। তখন আমরা কেউ আর বাজারে যেতে পারতাম না। যদিও বাজারে যেতেম, তাহলে থাকতাম এলাকার কিছু লোকের ভয়ে ভয়ে, গা ঢেক। আবার এলাকাবাসীর সাথে গণ্ডগোল সৃষ্টি হবার পর মিল কর্তৃপক্ষও একরকম ঘাবড়ে যায়। তখন মিল কর্তৃপক্ষ সবাইকে হুশিয়ার করে দেয় এভাবে– “যদি কেউ মিলের বাইরে এলাকার লোকের হামলার শিকার হয়, তাহলে মিল কর্তৃপক্ষ তার দায় নিবে না।” তখন আমরা নিশ্চিত হলাম যে, এখানে আর থাকা যাবে না। এই ভেবে একদিন আমরা পাঁচজন মিল থেকে বিদায় নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দিলাম। যাওয়া হবে কালুরঘাট। ইসলাম ভাই-সহ আরও তিনজন এর আগে কালুরঘাটই থাকতো। কাজ করতো চট্রগ্রাম পোর্টে জাহাজ থেকে মাল নামানোর কাজ। তাই মহেশখালী থেকে আবার সেখানেই কাজ করার জন্য যাওয়া হচ্ছে।

আমরা মহেশখালী থেকে চট্রগ্রাম কালুরঘাট গিয়ে ইসলাম ভাইয়ের পরিচিত লোকজনের সাথে দেখা করলাম। আগের বাসা নেই। নতুন করে একটা বাসা ভাড়া করা হলো। রান্নাবান্না করার জন্য সবকিছু সংগ্রহ করা হলো। ইসলাম ভাই, আজাহার ভাই, হানিফ ভাই ও আফাজ ভাই আলরেডি কাজ করা শুরু করে দিলো। আমি জাহাজ থেকে চাল, গম, ভুট্টা-সহ আরও অন্যান্য মালামাল মাথায় করে নামাতে পারবো না দেখে, তাঁরা আমাকে বাসায় রান্না করার দায়িত্ব দিয়ে কাজে চলে যেতো। এর চার-পাঁচ দিন পর একদিন বিকালবেলা আমার বড়দাদা মহেশখালী জাকিরিয়া সল্ট মিলে গিয়ে আমার কথা জিজ্ঞাসা করলেন। তখন মিল ম্যানেজার আমার বড় দাদাকে আনুমানিকভাবে কালুরঘাটের ঠিকানা-সহ ইসলাম, আজাহার, হানিফ ও আফাজ ভাইয়ের নাম লিখে দেয়। আমার বড়দাদা সেই ঠিকানা মতো গিয়ে আমাকে খুঁজে বের করে এবং ইসমাইল, আজাহার, হানিফ ও আফাজ ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সেদিনই দিবাগত রাতে বড়দাদা আমাকে টিকেট-সহ ঢাকার ট্রেনে উঠিয়ে দেয়। বড়দাদা চলে যায় আমার ছোট কাকার বাড়ি পার্বত্যচট্টগ্রামের রামগড় গুইমারা বাজার।

আমি পরদিন ভোরবেলা কমলাপুর রেলস্টেশনে নেমে নারায়ণগঞ্জের ট্রেনে চড়ে প্রথমে নারায়ণগঞ্জ, তারপর পায়ে হেঁটে চলে যাই আদর্শ কটন মিলে। মিলে পৌঁছার সাথে সাথে শুরু হয় ঘরে থাকা মা-বাবা, বড় এক দিদি ও বৌদির কান্না-কাটি। বাবা তখন প্রায়ই মৃত্যুশয্যায় শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছিল। এর দুইদিন পরই আবার শুরু করলাম আদর্শ কটন মিলে ১২ টাকা রোজে ডেইলি কাজ। এর দুইমাস পর-ই বাবা পর-পারে পাড়ি দেয় স্বর্গের ঠিকানায়। আমি তখন আদর্শ কটন মিলে ছিলাম না। আমি ছিলাম, কুমিল্লা দাউদকান্দি থানাধীন গৌরীপুর সংলগ্ন মলয় বাজার সন্নিকটে চিনামুড়া গ্রামে সেজো দিদির বাড়ি। বাবার মুখখানা আর শেষ দেখা আমি দেখতে পারিনি। মেজো দিদির বাড়ি থেকে আসলাম এর পরদিন। বাসায় গিয়ে দেখি মায়ের পরনে সাদা কাপড়। বড় দাদার পরনে সাদা মার্কিন কাপড়। হাতে বগলে কুশান। গলায় সাদা কাপড়ে চিকন দড়ির মতো মালার সাথে একটা লোহার চাবি ঝুলানো। সেদিনই সেই বেশ আমারও ধরতে হয়েছিল।

চলবে…

জীবনের গল্প-৯ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৬ টি মন্তব্য (লেখকের ৩টি) | ৩ জন মন্তব্যকারী

  1. ফয়জুল মহী : ০৩-০৯-২০২০ | ১:১০ |

      লেখা পড়ে বিমোহিত হলাম।

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ০৩-০৯-২০২০ | ২৩:৪৪ |

      অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি শ্রদ্ধেয় দাদা । আশা করি ভালো থাকবেন।

      GD Star Rating
      loading...
  2. মুরুব্বী : ০৩-০৯-২০২০ | ৮:২৫ |

    ক্রমশঃ পড়তে গিয়ে আপনার জীবনী-কথন'কে নিজের উপলব্ধির সাথে মিশিয়ে ফেলছি। মানুষের জীবনে কত কথা, কত শত স্মৃতি, উত্থান ঘটনাবলী কিভাবে যেন জড়িয়ে যায়, ভাবলেই অবাক হই। জীবনের সঙ্গে আপোষ এটাও হচ্ছে আমাদের আরেক জীবন।

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ০৩-০৯-২০২০ | ২৩:৪৭ |

      ঠিকই বলেছেন শ্রদ্ধেয় দাদা। তবে আরও দশজনের জীবনের চেয়ে আমার জীবনটা অনেক ভিন্নরকম। সুন্দর গঠনমূলক মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। 

      GD Star Rating
      loading...
  3. আলমগীর সরকার লিটন : ০৩-০৯-২০২০ | ১০:১২ |

    অসাধারণ প্রিয় নিতাই দা

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ০৩-০৯-২০২০ | ২৩:৫১ |

      গোলাপের শুভচ্ছা।

      GD Star Rating
      loading...