জীবনের গল্প-৭

জীবনের গল্প-৬-এর শেষাংশ: সেখানেই ওঁরা কাজ করবে।’ এই বলেই কন্ট্রাক্টর সাহেব আমাদের এই নির্মাণাধীন ভবনে রেখে উনার বাসায় চলে যায়। আমারা রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে যাঁর যাঁরমতো ঘুমিয়ে পড়ি। রাত পোহালেই যেতে হবে মহেশখালী।

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে আমারা তিনজন একসাথে ম্যানেজার সাহেবের সাথে দেখা করলাম। আমরা তিনজন চলে যাবো বলে ম্যানেজার সাহেব স্বইচ্ছায় আমাদের নিয়ে চলে আসলো টিলার নিচে চায়ের দোকানে। চারজন একসাথে বসে চা-বিস্কুট খেলাম। চা-বিস্কুটের দাম ম্যানেজার সাহেব নিজেই দিয়ে দিলেন, আমাদের কাউকে আর দিতে দিলেন না। তিনি আগেও পকেট খরচ করার জন্য নিজের পকেট থেকে সময় সময় আমাদের এক টাকা দুই টাকা করেও দিতেন। কিছুক্ষণ পর হয়তো কন্ট্রাক্টর সাহেব এসে আমাদের নিয়ে যাবেন। তাই আমাদের জন্য ম্যানেজার সাহেব খুবই আফসোস করলেন। বিশেষ করে আমরা তিনজন ঢাকাইয়া হওয়াতে ম্যানেজার সাহেব আমাদের খুবই পছন্দ করতেন, আদরও করতেন। কাজের ফাঁকে খোঁজখবর রাখতেন। আমাদের পারিবারিক বিষয় নিয়েও আলাপ করতেন। আমাদের কাজ করার সাহস দিতেন। আমরাও ম্যানেজার সাহেবকে সম্মান করতাম। উনার কথা ছাড়া এক পা-ও নড়তাম না। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই হয়তো আমরা আর এখানে থাকছি না। তাই ম্যানেজার সাহেবের মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেলো। মহেশখালী গিয়ে সেখানে ভালোভাবে কাজ করার জন্যও ভালো উপদেশও দিলেন। ভালোভাবে চলার জন্য বললেন। মহেশখালী এলাকার স্থানীয় লোকজনের স্বভাবচরিত্র কেমন এবং তাঁদের সাথে কীভাবে চলাফেরা করবো, সে বিষয়ে কিছু দিকনির্দেশনাও দিলেন।

চায়ের দোকানে ম্যানেজারের সাথে কথা বলতে বলতেই কন্ট্রাক্টর সাহেব বেবিট্যাক্সি চড়ে আমাদের সামনে এসে হাজির হলেন। আমাদের তাড়াতাড়ি করে টিলায় গিয়ে বেডিংপত্র নিয়ে আসতে বললেন। আমরা টিলার উপরে গিয়ে বেডিংপত্র গোছগাছ করে বেঁধে সবার সাথে দেখা করে টিলার উপর থেকে নিচে নেমে আসলাম। ম্যানেজারের কাছে আশীর্বাদ চেয়ে কন্ট্রাক্টর সাহেবের সাথে মহেশখালীর উদ্দেশে রওনা হলাম। বেবিট্যাক্সি চড়ে আসলাম কক্সবাজার যাওয়ার নির্দিষ্ট বাসস্ট্যান্ডে। তখনকার সময়ে চট্রগ্রাম থেকে কক্সবাজারের বাস ভাড়া ছিল জনপ্রতি ১০ টাকা। বাসে ওঠার আগে কন্ট্রাক্টর সাহেব এক হোটেলে নিয়ে আমাদের নাস্তা খাওয়ালেন।

এরপরই কন্ট্রাক্টর সাহেব-সহ চারজন বাসে উঠে বাসলাম। তখন চট্রগ্রাম থেকে কক্সবাজার যেতে কয় ঘণ্টা সময় যে লেগেছিল, তা বলতে পারবো না। তবে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যেতে প্রায় বিকাল হয়ে গিয়েছিল। বাস থেকে নেমে আবার এক হোটেলে গিয়ে চারজনে ভাত খেয়ে মহেশখালী যাওয়ার ট্রলার ঘাটে আসলাম। তখন কক্সবাজার থেকে মহেশখালী যেতে ট্রলারে জনপ্রতি ২ টাকা করে ভাড়া ছিল। ট্রলারে চড়ে মহেশখালী যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। ট্রলার থেকে নেমে আবার এক চায়ের দোকানে চা পান করতে করতে কন্ট্রাক্টর সাহেব লোক মারফত উনার ম্যানেজারকে খবর পাঠালেন। ম্যানেজার সাহেব আসলেন। দুইজনে আমাদের থাকার জায়গায় নিয়ে গেলেন।

থাকার জায়গায়টা হলো, মহেশখালী বাজার থেকে নতুন বাজার যাওয়া রাস্তার পাশে থাকা সরকারি খাদ্য গোডাউন। সেই গোডাউনে তখন সরকারি কোনও খাদ্যশস্য মজুদ ছিল না। অনেক বড় পাকা দালানের গোডাউন। সেই গোডাউনেই হলো আমাদের তিনজনের থাকার জায়গা। সাথে নেওয়া বেডিংপত্র গোডাউনের এক কোণে রেখে কন্ট্রাক্টর সাহেবের সাথে বাজারে আসলাম। তিনি আমাদের হাঁড়িপাতিল-সহ ১০-১২ দিনের চাল, ডাল, তেল, লবণ যা লাগে প্রয়োজনীয় সবকিছু কিনে দিলেন। তিনজনকে নগদ ১০০ টাকা করে হাত খরচ দিলেন। সেখানকার কাজের সাইটে থাকা ম্যানেজারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং কবে থেকে কাজ শুরু হবে তা ম্যানেজার সাথে বুঝ পরামর্শ করতে বললেন। আর আমাদের যখন যা দরকার হয়, তা ম্যানেজারকে দিতে বললেন। এরপর তিনি মহেশখালী থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা হলেন। আমরা থেকে গেলাম মহেশখালী।

কন্ট্রাক্টর সাহেব আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাবার পর, আমরা তিনজন মহেশখালী বাজার থেকে মাছ-সহ কিছু কাঁচা তরিতরকারি কিনলাম। সাথে রান্না করার জন্য এক গাট্টি লাড়কিও কিনলাম। গোডাউনে এসে মাটি খুঁড়ে গর্ত করে রান্না করার চুলা তৈরি করলাম। একজন মাছ কাটছে। একজন ভাত রান্না করতে চাল ধুয়ে নিচ্ছে। আমি চুলায় আগুন জ্বালিয়ে দিলাম। এক তরকারি-সহ ভাত রান্না হয়ে গেল। তিনজনে মিলেমিশে খাওয়া-দাওয়া সেরে যাঁর যাঁর বিছানা বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে আবার আলুসিদ্ধ ভাত রান্না করে খেয়ে-দেয়ে কাজের ম্যানেজার সাহেবের সাথে দেখা করলাম। ম্যানেজার সাহেব উনার সাথে আমাদের কাজের সাইটে নিয়ে গেলেন। আমাদের যেই কাজের জন্য মহেশখালী নেওয়া হলো, সেই কাজটা হলো মহেশখালী থেকে সোজা পশ্চিমে নতুন বাজার পর্যন্ত মোট ১৩ মাইল সিসি ঢালাই রাস্তা তৈরির কাজ।

ম্যানেজারের সাথে কাজের সাইটে গিয়ে দেখা গেল, সেখানকার স্থানীয় লেবাররা সেদিন তখনো কেউ সাইটে আসেনি। ম্যানেজার সাহেব কাজের সাইটে কোথায় কী কী মাল আছে তা দেখিয়ে দিলেন। সেদিন সেখানে ম্যানেজার-সহ আমরা সেখানকার স্থানীয় লেবারদের জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিলাম। কিন্তু কারোর কোনও খবর হচ্ছিল না দেখে ম্যানেজার সাহেব সেদিনের জন্য কাজ পুরোপুরি বন্ধ করে আমাদের নিয়ে সোজা মহেশখালী বাজারে চলে আসে। সেদিনের জন্য আমরা পুরোপুরি ফ্রি হয়ে গেলাম। আমাদের কাছ থেকে ম্যানেজার বিদায় হবার পর, আমরা মহেশখালী পুরো বাজারটা ঘুরে-ফিরে দেখে চা-বিস্কুট খেয়ে দুপুরের আগে আমাদের গোডাউনে চলে আসি। নিজেরা রান্নাবান্না করে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরে আবার তিনজনে মহেশখালী বাজারের দক্ষিণ পাশে সাগর পাড়ে ঘুরা-ঘুরি করে করে সন্ধ্যাবেলা চলে আসলাম নিজেদের থাকার জায়গা গোডাউনে।

পরদিন সকাল হতে-না-হতেই সেখানকার স্থানীয় লেবাররা গোডাউনে এসে আমাদের ঘুম থেকে ডেকে ওঠালো। তাড়াতাড়ি ভাত রান্না না করেই মহেশখালী বাজারে গিয়ে নাস্তা করে তাঁদের সাথে কাজে যোগদান করি। সেদিন কাজ করে স্থানীয় লেবারদের সাথে পরিচিত হলাম। পরদিন সকাল থেকেই বৃষ্টি। সেই বৃষ্টি আর থামছিল না। সারাদিন গোডাউনে আর বাজারে ঘুরা-ঘুরি করে সময় শেষ করলাম। এভাবে সেখানে প্রতিদিন হাঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টির কারণে সেই কাজ আর আমরা বেশিদিন করতে পারিনি। প্রতিদিন সারাদিনের মধ্যে একবেলাও ঠিকমতো কাজ চলছিল না। ম্যানেজার সাহেবও আমাদের ঠিকমতো বাজার সাদাই করার খরচ দিচ্ছিল না। কন্ট্রাক্টর সাহেবেরও খবর ছিল না। তখনকার সময়ে এখনকার মতো হাতে হাতে মোবাইল ফোনও ছিল না। কন্ট্রাক্টর সাহেবের ডাক ঠিকানাও আমাদের জানা ছিল না। তাই নিজেদের পকেট খরচের কথা চিন্তা করে গোডাউনে থেকেই কাজ না থাকলে অন্য কাজ খুঁজতে থাকি।

একসময় বাজারে আসা-যাওয়ার মাঝেই এক লোকের সাথে আমাদের পরিচয় হয়ে গেল। লোকটির নাম মোহাম্মদ ইসমাইল মিয়া । তিনি মহেশখালী বাজারের উত্তরে জাকিরিয়া সল্ট নামে এক লবণের মিলে কাজ করতো। তিনি খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি আমাদের সব বিষয়-আশয় জানলেন, শুনলেন। আমাদের কোনপ্রকার চিন্তা না করার পরামর্শ দিলেন এবং জাকিরিয়া সল্টে তাঁদের সাথে কাজ করার ব্যবস্থা করে দিবেন বলে আশ্বস্ত করলেন। তিনি জাকিরিয়া সল্টে গিয়ে উনার আরও তিন ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সাথে আমাদের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করলেন। এরপর দুইদিন যেতে-না-যেতেই তিনি ইসমাইল মিয়া আমাদের কাজ রেডি করেছেন বলে জানালেন। কিন্তু আমরা গোডাউন খালি রেখে তিনজন একসাথে যেতে রাজি হচ্ছিলাম না। কারণ এরমধ্যেই যদি কন্ট্রাক্টর সাহেব চট্টগ্রাম থেকে এখানে এসে আমাদের খুঁজে না পায়, তাহলে হয়তো আমাদের গার্ডিয়ানের ভয়ে মহেশখালী বাজারে থাকা থানায় জিডিও করতে পারে। সেজন্য আমরা তিনজন একসাথে এখান থেকে সরাসরি লবণের মিলে কাজে যোগদান করতে রাজি হয়েছিলাম না।

তখন ইসমাইল মিয়া আমাদের বুদ্ধি দিলেন সপ্তাহে একজন করে রাস্তার কজা ছেড়ে লবণের মিলে কাজে যোগদান করতে। আমরা তা-ই রাজি হয়ে আগে আমাদের সাথে থাকা লোকমান নামে লোকটিকে জাকিরিয়া সল্ট মিলে কাজ করার জন্য সুপারিশ করি। প্রতিদিন কাজের মজুরি ২৫ টাকা। আহা্! শুধু টাকা আর টাকা! এতো টাকা খরচ করেও শেষ করা যাবে বলে আমারা তিনজনই মনে মনে হিসাব কষতে ছিলাম। পরদিন সকালে লোকমান নামে বন্ধুটিকে জাকিরিয়া সল্ট মিলে পাঠালাম। লোকমান লবণের মিলে কাজে লেগে গেলেন। আমরা দুইজন রাস্তার কাজেই থেকে গেলাম কন্ট্রাক্টর সাহেবের আগমণের আশায়। কিন্তু না, বেশকিছু দিন গত হয়ে গেলেও যখন আর কন্ট্রাক্টর সাহেব আসছিলেন না, তখন একদিন জাকিরিয়া সল্ট মিলের ইসমাইল মিয়ার শরণাপন্ন হলাম। ওই রাস্তার কাজ থেকে সরিয়ে আনতে আমাদের পক্ষ হয়ে ওই কাজের ম্যানেজারের সাথে আলাপ করার জন্য অনুরোধ করালাম।

তখন ইসমাইল মিয়া তাঁর আরও দুইতিন জন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে নিয়ে একদিন বিকালবেলা ম্যানেজারের সাথে আলোচনা করে আমাদের দুইজনকে জাকিরিয়া সল্ট মিলে কাজে লাগিয়ে দেয়। আমরাও জাকিরিয়া সল্ট মিলে নিয়মিত কাজ করতে থাকি, দৈনিক মজুরি ২৫ টাকায়। এটাই ছিল আমার কোনও এক মিল ইন্ডাস্ট্রিতে জীবনের প্রথম চাকরি। হোক সেটা লবণের মিল। তাই এই চাকরি নিয়ে চার-পাঁচ বছর আগে এক অনলাইন দিনলিপিতে “জীবনের প্রথম চাকরি” শিরোনামে আমার একটা লেখা প্রকাশ হয়েছিল। সেই সাইটের লিংক লেখার মাঝে দেওয়া হলো।
চলবে…

জীবনের গল্প-৮ এখানে।

জীবনের গল্প-১ এখানে।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৮ টি মন্তব্য (লেখকের ৪টি) | ৩ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০১-০৯-২০২০ | ১১:৫১ |

    জীবনের গল্প পরিসরের প্রথম সিরিজেই রয়েছি। মন দিয়ে পড়ে চলেছি। শুভেচ্ছা কবি।

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ০১-০৯-২০২০ | ১২:১১ |

      আমার এই অধ্যম জীবনের কাহিনী যদি কেউ চাপা অক্ষরে বইয়ের পাতায় পাতায় ছেপে প্রকাশ করে দিতো, তাহলে আমার এই অদম্য জীবনটা স্বার্থক হতো। কিন্তু এই সাহায্য সহযোগিতা কে করবে আমাকে। করার মতো আমার কেউ নেই। তাই শব্দনীড়ের পাতায় লিপিবদ্ধ করে রাখছি। যাতে কোনোএক সময় আমার আদরের নাতি-নাতনিরা এখন থেকে পড়তে পাড়ে। জানতে পাড়ে।     

      শুভকামনা থাকলো শ্রদ্ধেয় দাদা।    

      GD Star Rating
      loading...
      • মুরুব্বী : ০১-০৯-২০২০ | ১৯:১৭ |

        সেই ভালো কবি নিতাই বাবু। থাক শব্দনীড়ের পাতায়।

        GD Star Rating
        loading...
      • নিতাই বাবু : ০২-০৯-২০২০ | ০:০৬ |

        হ্যাঁ দাদা,তা-ই হোক। শুভকামনা থাকলো।

        GD Star Rating
        loading...
  2. আলমগীর সরকার লিটন : ০১-০৯-২০২০ | ১২:২০ |

    আবার পড়লাম প্রিয় নিতাই দা

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ০২-০৯-২০২০ | ০:০৮ |

      পড়েছেন শুনে ভালো লাগলো দাদা। শুভকামনা থাকলো।

      GD Star Rating
      loading...
  3. ফয়জুল মহী : ০১-০৯-২০২০ | ১৫:০১ |

     মনোলোভা কথা। 

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ০২-০৯-২০২০ | ০:০৯ |

      অনেক অনেক শুভকামনা থাকলো শ্রদ্ধেয় দাদা।

      GD Star Rating
      loading...