রোগে হয় আক্রান্ত– ভয়ে হয় রুগীর মৃত্যু

কথায় আছে, “আহার নিদ্রা ভয়, যতো বাড়ায় ততই হয়!”
আহার হলো, খাওয়া, ভোজন বা খাদ্য। যা জীবের জীবনধারণে পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য যা দরকার, তা-ই। একজন ব্যক্তি প্রতিদিন স্বাভাবিক খাবারের চেয়ে যদি প্রতিদিন প্রতি বেলার সাথে এক ছটাক করে বেশি খায়, তাহলে প্রতিদিন তাঁর স্বাভাবিক খাবারের চেয়ে তিন ছটাক খাবার বেশি প্রয়োজন হয়। এভাবে আজ তিন ছটাক বেশি, কাল চার ছটাক বেশি, পরশু পাঁচ ছটাক করে যদি বাড়তে থাকে; তাহলে ওই ব্যক্তির খোরাক তো দিনদিন বাড়তেই থাকবে। তা-ই নয় কি? হ্যাঁ, হিসাব কষে দেখা যায় অবশ্যই আগের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়। তাই কথায় বলে “আহার” যতো বাড়াতে চায়, ততই বাড়ে! কিন্তু কমে না।

নিদ্রা: নিদ্রা বা ঘুম হলো একরকম দেহের ক্লান্তি দূর করার মহৌষধ! যা অলসতার চাবিকাঠিও বলা চলে। নিদ্রা বা ঘুমকে যতো আশ্রয় প্রশ্রয় দেওয়া যায়, ততই ব্যক্তির ঘাড়ে চেপে বসে। নিদ্রা বা ঘুম, এতোটাই অলস যে জীবন বাঁচানোর জন্য খাদ্যকেও দূরে ঠেলে দেয়। সে শুধু ঘুমাতেই চায়। তাই ‘নিদ্রা, বা ‘ঘুম’ যতো বাড়ায় ততই বাড়ে। কিন্তু কমে না।

ভয়: ভয় বা ডর, এ হলো জীবের জন্য একরকম মরণঘাতী ভয়ানক রোগ সংক্রমণ। মানুষের মনের এই ভয় জলাতঙ্ক, ডেঙ্গু, ক্যান্সার, টিবি, যক্ষা, বার্ডফ্লু, আর বর্তমান নভেল করোনা ভাইরাসকেও হার মানায়।

অনেকেই প্রশ্ন রাখতে পারেন, ‘তা কীভাবে?’ তার উত্তর দিতে হলে আমাকে অবশ্যই ভয় নিয়ে নিজের কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা এখানে তুলে ধরতে হচ্ছে। বাস্তব কথা হলো, আমরা অনেকেই জানি কুকুরের কামড়ে নাকি জলাতঙ্ক রোগ হয়! আর জলাতঙ্ক রোগের চিকিৎসা না করলে রুগীর মৃত্যু হয়। তা আমি নিজেও জানি এবং শুনেছিও। কিন্তু এই রোগ আমার কখনো হয়নি, আর কখনো এই রোগে ভুগিওনি!
এতে অনেকেই বলতে পারেন, ‘আপনাকে কখনো কুকুরে কি কামড় দিয়েছিল?’ বলবো হ্যাঁ, দিয়েছিল! কিন্তু আমি কুকুরের কামড়ে ভয় পাইনি। তাই আমার জলাতঙ্ক রোগও হয়নি। এই কথা শুনে হয়তো অনেকেই ঘাবড়ে যাচ্ছেন! কিন্তু আমি যা বলছি, তা সত্যি কথাই বলছি!

শুনুন তাহলে– একদিন হঠাৎ আমাকে একটা কুকুরে নিজের অজান্তেই ডান পায়ে কামড় বসিয়ে দিলে! সাথে সাথে কামড়ের জায়গা থেকে রক্ত বেরুতে লাগলো! তা দেখে সামনে থাকা লোকজন বলেছিল, ‘তাড়াতাড়ি করে ডাক্তারের কাছে যান! নাহয়, আপনার সমস্যা হতে পারে!’ আমি কারোর কথা মাথায় নিলাম না। কামড়ের জায়গায় পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকান থেকে একটু চুন নিয়ে ঘষে দিলাম। বাসায় গিয়েও কিছু বললাম না, নিজে নিজেই চুপচাপ থেকে গেলাম। এভাবে দুই-তিন দিন পর দেখা গেল, পায়ে কুকুরের কামড়ের জায়গাটি শুকাতে লাগলো। এতে আমি নিশ্চিত হলাম যে, আমার কিছুই হয়নি। আর যদি ভয় পেয়ে সাথে সাথে ডাক্তারের কাছে যেতাম! তাতে কী হতো? ডাক্তার বাবাজী আমার নাভীর চতুর্দিকে চৌদ্দটি ইঞ্জেকশন পুস করতে। এরপর রোজকার খাবার দাবারেও আরোপ হতো নানাবিধ বিধিনিষেধ। তা আর হয়নি, ভয় না পাবার কারণে। তাহলে বুঝতেই পারছে যে, কুকুরের কামড় খেয়ে রক্ষা পেলাম শুধু ভয় না পেয়ে।

এছাড়াও কিছুদিন আগে আমার মেয়ে ফোন করে আমাকে জানিয়েছিল, ওঁর ছোট ছেলেটাকে কুকুরে কামড় দিয়েছে। আমি তা শুনে আমার মেয়েকে ভয় না পাবার পরামর্শ দিলাম। এমনকি কুকুরে কামড় দিয়েছে বলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে নিষেধ করে বললাম! আরও বললাম, এ নিয়ে নিজেদের মনের ভেতর কোনপ্রকার ভয় না রেখে ধৈর্য ধরে অন্তত তিন-চারটা দিন অপেক্ষা করো! দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার কথামতো আমার মেয়ে তা-ই করলো। শেষতক সেই ঘটনা গত হলো, আজ প্রায় তিনমাসেরও বেশি সময়। মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ আশীর্বাদে আমার ছোট নাতির কিছুই হয়নি। আর যদি আমি আমার মেয়েকে ভয় না পাবার পরামর্শ না দিতাম, মেয়ে নাতিকে নিয়ে অবশ্যই ডাক্তারের কাছে যেতো। ডাক্তার নাতিকে অন্তত একমাসের জন্য চারটে ইঞ্জেকশন দিতো। তারপর সম্পুর্ন সুস্থ হয়ে গেলেও আমার মেয়ের মনে জলাতঙ্ক রোগের ভয় থেকেই যেতো। কিন্তু না, সেই ভয় আর এখন আমার মেয়ের মনের ভেতরে নেই! আমার নাতি এখন আগের মতনই সুস্থ আছে। তাহলে বুঝতেই তো পারছেন যে, ভয়ে মানুষকে কতদূর নিয়ে ঠেকায়? নিশ্চিত মৃত্যু পর্যন্ত নিয়েও ঠেকায়। তবে আমার মতো কেউ এমন সাহস দেখিয়ে ভয়কে উপেক্ষা করে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে ভুলবেন না কিন্তু। হয়তো আমার কিছু হয়নি ঠিক, অন্য কারোর যে কিছু হবে না; তা কিন্তু গ্যারান্টি নেই। তাই সবাই মনে ভয় না রেখে ডাক্তারের পরামর্শমত রোগ নিরাময়ের জন্য ঔষধও সেবন করতে হবে।

এবার আসি মহামারি ডেঙ্গু নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায়। গতবছর আমাদের দেশের খোদ রাজধানী ঢাকা-সহ প্রায় বিভাগীয় জেলা শহরগুলোতে ডেঙ্গুজ্বর একরকম মহামারি আকার ধারণ করেছিল। ওইসময় আমার নিজেরও কিছুদিন প্রচণ্ড জ্বর জ্বর অনুভূত হয়েছিল। কিন্তু ওই জ্বরের কথা আমি আমার নিজের সহধর্মিণীর কাছেও কখনো বলিনি। তখন ওইসময় যদি জ্বরের কথা সহধর্মিণীর কাছে বলতাম, তাহলে অবশ্যই আমাকে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হতো। আর যদি ওইসময় ওই জ্বর নিয়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতাম; তাহ‌লে অবশ্যই আমাকে হাসপাতালে থাকা ডেঙ্গু বিভাগে ভর্তি হতে হতো। কিন্তু তা আর হয়নি! এতোও রক্ষা পেয়েছি শুধ ভয় না পেয়ে। নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া এরকম আরও অনেক ভয়ের ঘটনার বর্ণনা উপস্থাপন করা যায়, কিন্তু তা না করে এবার আসল কথায় আসি।

আসল কথা হলো বর্তমানে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়া নভেল কোরোনা ভাইরাস। এই নভেল করোনা ভাইরাস দেখা দিয়েছে গণচীন থেকে। যখন গণচীনের উহানে করোনা ভাইরাসের পাদুর্ভাব দেখা দেয়, তখন আমাদের দেশের অনেকেই ভেবেছিল এবার গণচীনকে হয়তো শয়তানে ধরেছে। এখন দেখা গণচীনের কথা পত্রপত্রিকায় বেশি শোনা যায় না, শোনা যায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ আক্রান্তের কথা। এখন এই করোনা ভাইরাস নিয়ে সারাবিশ্বই আতঙ্কিত শঙ্কিত। এই রোগটাও কিন্তু ডেঙ্গু রোগের মতনই জ্বর নিয়েই মানব দেহে দেখা দেয়! জানা যায়, এখন পর্যন্ত এই মরণঘাতী করোনা ভাইরাসের ভ্যাক্সিন বা ঔষধ আবিস্কার হয়নি এবং এই রোগ সংক্রমণেরর নির্ধারিত করণীয় কী; তাও সুনির্দিষ্টভাবে কোনও বিশেষজ্ঞ সঠিক মত দিতে পারেনি।

কেউ বলছে এটা করো। কেউ বলছে ওটা করতে হবে। কেউ বলছে এটা ছোঁয়াছুঁয়ি রোগ। একের শ্বাসপ্রশ্বাস থেকে অন্যজন আক্রান্ত হয়। তাই কেউ কারোর সাথে করমর্দন বা হ্যাণ্ডশেক করতে পারবে না। কেউ কারোর সাথে বুকে বুক মেলাতে পারবে না। কেউ কাউকে চুমু দিতে পারবে না। রাস্তায় বেশি ঘোরাফেরা করতে পারবে না ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়েও বিশেষজ্ঞরা মত দিচ্ছেন। আবার কিছু ভণ্ড তেলেসমাতি সাধু অসাধুরাও নানারকম বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। কেউ বলছে নিয়মিত গোমূত্র সেবন করতে। কেউ বলছে শরীরে গোবর মাখতে। কেউ বলছে আবে জমজম কুয়োর পানি সেবন করতে। কেউ বলছে পলিথিনের জামাপ্যান্ট পরে থাকতে। বাইরের আলো-বাতাস, ধূলো বালি যাতে শরীরে না লাগে!কেউ আবার বলছে ঘরে বাইরে না যেতে।

যে যা-ই বলুক-না-কেন, আসল কাজের কিন্তু বেজে যাচ্ছে বারোটা। কাজের কাজ কিন্তু কিছুই হচ্ছে না, বরং এই নভেল করোনা ভাইরাসের জন্মভূমি গণচীন থেকে বেড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারা দুনিয়াব্যাপী। প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে হাজারে-হাজার। আক্রান্ত হচ্ছে লক্ষলক্ষ মানুষ। এরমধ্যে ডাক্তার কবিরাজদেরও আদেশ উপদেশ আসছে জোরালোভাবে। এতে সাধারণ মানুষও নভেল করোনা ভাইরাসে ভয়ে হয়ে যাচ্ছে দিশাহীন, অস্থির, আতঙ্ক। মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা বাধাগ্রস্ত। সারাবিশ্বের সকল দেশের ব্যবসা বানিজ্য হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত। এর মূল কারণই হচ্ছে ভয়। মানে, কখন যেন কী হয়! নভেল করোনা ভাইরাসে কী হয় তা আমার জানা নেই। তবে জানা আছে রোগের চেয়ে বেশি ক্ষতিকারক হলো মানুষের মনের ভয়!

আমার মতে এই করোনা ভাইরাস বা রোগটি যত না মরণঘাতী, তারচেয়ে বেশি মরণঘাতী হলো আমাদের মনের ভয়! আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, এই রোগ মানব দেহে ঢুকে যতটুকু ক্ষতি না করে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করছে মানুষের মনের ভয়ে। বিশ্ব বিশেষজ্ঞরাও বেশি বেশি করে মানুষের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিচ্ছে। তাই বলছি, করোনা ভাইরাস যেমন-তেমন, মানুষ ভয়ে কাতর হয়ে মৃত্যুবরণ করছে সবচেয়ে বেশি।

আমার পরামর্শ:
পরামর্শ হলো, ‘ভয়’! মানে নিজের মনের ভয়কে জয় করতে হবে। পাশাপাশি বিজ্ঞ ডাক্তারদের পরামর্শও গ্রহণ করতে হবে। করোনা ভাইরাস আসুক বা না আসুক। ধরুক বা না ধরুক রোগে। আমাকে থাকতে হবে নির্ভয়ে। আমি যদি ভয়ে কাতর হয়ে পড়ি, তাহলে শুধু করোনা ভাইরাসই নয়, আমাকে নানারকম রোগেও কাবু করে ছাড়বে। মনের ভয় না যাওয়া পর্যন্ত আমাকে কোনও বিশেষজ্ঞের ভালো নামী-দামী ঔষধেও ধরবে না। আর আমিও কঠিন রোগ থেকে মুক্তি পাবো না। বরং দিনদিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বো। তাই আসুন, আমরা আগে ভয়কে জয় করতে শিখি। তারপর নিজেদের মনের সাহস দিয়ে মরণঘাতী করোনা ভাইরাসকে প্রতিহত করি।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

৫ টি মন্তব্য (লেখকের ২টি) | ২ জন মন্তব্যকারী

  1. মুরুব্বী : ০৭-০৩-২০২০ | ১২:৩২ |

    "নিজের মনের ভয়কে জয় করতে হবে। পাশাপাশি বিজ্ঞ ডাক্তারদের পরামর্শও গ্রহণ করতে হবে। করোনা ভাইরাস আসুক বা না আসুক।" এমনই হোক আমাদের প্রত্যয়। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ০৭-০৩-২০২০ | ১৭:১৬ |

      শ্রদ্ধেয় দাদা, আমার যেটা ধারণা; তা হলো যেকোনো মারাত্মক রোগ থেকে বেশি মারাত্মক হলো মনের ভয়। এই ভয়েই মানুষ অর্ধেক কাহিল হয়ে পড়ে। যেমন বর্তমানে আমার সহধর্মিণীর অবস্থাও ঠিক তেমন। যে যেটা বলছে, সে সেদিকেই কান দিচ্ছে। রোগ নিরাময়ে বেজে যাচ্ছে ঘণ্টা। জানি না ক’দিন পর কী পরিনতি ঘটতে যাচ্ছে! ঈশ্বর আমার সহায় হোক। আপনাদের সকলের আশীর্বাদ প্রার্থী!

      GD Star Rating
      loading...
    • মুরুব্বী : ০৭-০৩-২০২০ | ১৯:২৯ |

      মনের সাহসে মরণঘাতী করোনা ভাইরাসকে প্রতিহত করতে হবে। ধ্রুব।

      GD Star Rating
      loading...
  2. আলমগীর সরকার লিটন : ০৭-০৩-২০২০ | ১৫:৪০ |

    সুন্দর লাগল  নিতাই দা

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ০৭-০৩-২০২০ | ১৭:২২ |

      আজ বেশকিছু দিন ধরে নিজের সহধর্মিণীকে নিয়ে খুবই টেনশনে আছি। অন্যদিকে বহির্বিশ্বে চলছে করোনা ভাইরাসের তেলেসমাতি! সহধর্মিণী একেক সময় একেক কথা বলে এবং নানাজনের নানান কথা শুনে। মানে, যে যা বলে, তা-ই শুনে! এতে সুচিকিৎসার নামে বেজে যাচ্ছে বারোটা। এর কারণ শুধু একটাই, দাদা। তা হলো মনের ভয়! এই ভয় দূর না করা পর্যন্ত কারোর কোনও রোগ ভালো হয় না। এটা আমার বিশ্বাস! 

      সুন্দর মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।                           

      GD Star Rating
      loading...