মুক্তিযুদ্ধের কথা– বিজয় দিবসের কথা

বছরের শুরুতেই অনেক নতুন নতুন ক্যালেন্ডার বাজারে বিক্রি হয়। নানান রঙের, নানান কোম্পানির। নানান ব্যাংকের, নানান ইন্স্যুরেন্সের ক্যালেন্ডার। ইংরেজি ক্যালেন্ডারে জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ মাসের পরও কতগুলো মাস গত হয়ে যখন নভেম্বরের শেষে ডিসেম্বরের আগমন ঘটে, তখনই বাংলাদেশের বাঙালিদের মনে বাজতে থাকে মহান বিজয় দিবসের গান। আর ক’দিন পরেই ১৬ই ডিসেম্বর আমাদের মহান বিজয় দিবস। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ’র এই দিনটির (১৬ই ডিসেম্বর) জ্বলন্ত সাক্ষী আমি নিজে। তাই এই বিশেষ দিনটিকে আমি গভীরভাবে স্মরণ করি। যদি পারি কিছু লিখে সবার মাঝে শেয়ারও করি। সে-সময়কার শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির কিছু স্মৃতি রোমন্থন করে রাখি। তাই এই ২০১৯ইং বর্ষের বিজয়ের মাসে আসন্ন ১৬ই ডিসেম্বরকে সামনে রেখে স্বনামধন্য দিনলিপি শব্দনীড় ব্লগেও কিছু লিখে রাখলাম। যাতে আগামীতে এই লেখা আমার জীবনের একটি ডায়েরি হয়ে থাকে। আশা করি সবাই সাথে থাকবেন।

বর্তমানে আমরা সবাই জানি ইংরেজি বর্ষের ফেব্রুয়ারি আমাদের মাতৃভাষা দিবস। যা এখন সারাবিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত। এরপরই আসে অগ্নি ঝরা মার্চমাস। এই মার্চ মাসেই শুরু হয় বাঙালির মুক্তির জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালের আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ডাকে ৭ই মার্চ ঢাকার রমনায় একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসভায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সেই ভাষণের মাধ্যমেই স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম শুরু। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে আমাদের জাতির বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ভাষণে বজ্র কণ্ঠে বলেছিলেন, “এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

জনসভায় লাখো বাঙালি এই ঘোষণার অপেক্ষাই বাঙালি জাতি করছিল। সেদিন বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ গোটা জাতিকে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উন্মাতাল করে তুললো। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাষণে দিক নির্দেশনা পেয়ে সবাই প্রস্তুত হতে শুরু করে। শহর থেকে সাধারণ মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে শহর ছেড়ে গ্রামমুখী হতে লাগলো। বড়সড় নেতা কর্মীরা মফস্বল ও গ্রামে গিয়ে সাধারণ মানুষকে সংগঠিত করতে শুরু করল। আর পশ্চিমা শাসকেরা গোলাবারুদ সৈন্যসামন্ত পূর্ব-পাকিস্তানে এনে বাঙালি নিধনের নীল নকশা তৈরি করতে লাগল। তারপরও চলতে থাকে অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যদিয়ে মিছিল, মিটিং। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার চালায় গুলি, ধরপাকড়, লাঠিচার্জ, গ্রেফতার।

তারপরও ক্ষিপ্ত বাঙালি কিছুতেই থামছে না। আন্দোলন চলছেই। এরমধ্যেই পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তথা কথিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু করে। যার উদ্দেশ্য ছিল বাঙালির প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে একেবারে স্তব্ধ করে দেওয়া। তখন ঘড়ির কাটা মধ্যরাত পেরিয়ে যাওয়ায় আমাদের স্বাধীনতা ২৬ মার্চ। তারপরই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর পূর্ব বাংলা রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষে ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট থেকে স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র পাঠ করেন ও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। মেজর জিয়ার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ তখন স্বাধীনতাকামী মানুষের মাঝে উৎসাহ জোগায়। এমনিভাবে আগুনঝরা মার্চে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়। এই মুক্তিযুদ্ধ চলে দীর্ঘ ৯মাস। অর্থাৎ ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসের ১৬ তারিখে হয় বিজয়ের শুভসূচনা। মানে গৌরবোজ্জ্বল মহান বিজয় দিবস।

আমি তখন ৮ বছরের নাবালক এক শিশু। তখন আমার বাবা চাকরি করতেন নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম পাড় চিত্তরঞ্জন কটন মিলে। আর বড়দাদা চাকরি করতেন শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব পাড় আদর্শ কটন মিলে (বর্তমান সোহাগপুর টেক্সটাইল)। ঐ ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় শীতলক্ষ্যা নদী পাড়ের সকল শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরাও অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেই জনসভায় লাখো মানুষের মধ্যে আমার বাবাও একজন ছিলেন। সেদিন ঢাকার আশ-পাশের সকল শিল্পপ্রতিষ্ঠানই বন্ধ ছিল। শুনেছিলাম বাবার মুখে। তখনকার সময়ে এই মার্চ মাস থেকেই আমরা হয়ে পড়ি বিপদগ্রস্ত। বাবার মিল বন্ধ, চাকরি নেই। বড়দা শরণার্থী হয়ে ভারতে অবস্থান। আমার মা-সহ তিন বোন থাকতাম নোয়াখালী বেগমগঞ্জ থানাধীন বজরা রেলস্টেশনের পশ্চিমে মাহাতাবপুর গ্রামের বাড়িতে। আমাদের পরিবারে সদস্য সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে তখন কষ্টের আর শেষ ছিল না। আমাদের সংসারই চলতো বাবা বড়দা’র চাকরির বেতনে। তখন এই বঙ্গদেশে টাকার যেমন দাম ছিল। আবার চলছে যুদ্ধ! যুদ্ধের কারণে কেউ কাউকে টাকা-পয়সা ধারকর্জও দিত না। তাই কোনদিন দুপুরে খেতাম, রাতে না খেয়ে রাত কাটাতাম। আবার কোনদিন সকালে খেতাম দুপুরে না খেয়ে থাকতাম। কিছুদিন এভাবেই চলছিল আমাদের দিনগুলো।

তাই প্রতিবছর মার্চ মাসের আগমনেই ঐসব অতীত হয়ে যাওয়া দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে যায় বাবার কথা। রাজাকারদের হাতে প্রাণ হারানো এক মামার কথা। কানে বাজে মেশিনগান আর এলমজির গুলির শব্দের আওয়াজ। চোখে ভাসে হাট-বাজারে লাগানো আগুনের ধোঁয়া। তখন ছিলাম চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ুয়া ছাত্র। বাবা নারায়ণগঞ্জ থেকে বাড়িতে আসে। সময়টা তখন ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি। যুদ্ধের কারণে মিল বন্ধ। বাবার পকেট খালি। মিল এলাকার স্থানীয় সহকর্মীদের কাছ থেকে ২০ টাকা কর্জ করে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেয়। অনেক কষ্ট করে খালি হাত পা নিয়ে গ্রামের বাড়িতে আসে। বাবা বাড়িতে এসে জেঠা জেঠিমা আর মায়ের কাছে সব কথা বললেন। আমরা সবাই শুনলাম। কিন্তু বাড়িতে এসেও বাবা নিরুপায়! হাতে টাকা-পয়সা নেই। সংসারে খাবার নেই। কোথাও কোনও দিনমজুরের কাজও নেই। এদিকে বড়দা’রও খবর নেই। মা হয়ে গেলেন পাগলের মতো।

তখন এই দেশে টাকার খুবই অভাব ছিলো। তখন জিনিসের দামও যেমন সস্তা ছিল, টাকার দামও অনেক ছিলো। সংসারে খানেওয়ালা ছিলাম ৫জন। বাবার পকেট শূন্য। মায়ের শেষ সম্বল একজোড়া কানের দুল ছিলো। সেই কানের দুল বন্দক রেখে কিছু টাকা সংগ্রহ করতে চাইল। কিন্তু না, তা আর হলো না। যুদ্ধের সময় মানুষের প্রাণ বাঁচানো যেখানে জরুরি, সেখানে সোনার জিনিস দিয়ে কী হবে? তার আর মায়ের কানের দুল রেখে টাকা জোগাড় করা হলো না। শেষ সম্বল বাড়ির দলিল। একজন সম্মানিত মুসলমান ব্যক্তির কাছে বাড়ির দলিল রেখে কিছু টাকা কর্জ করা হলো। ঐ টাকা থেকে ৫০ টাকার ধান কিনে বাবা মুড়ির ব্যবসা শুরু করে। গ্রামের আরও অনেকেই মুড়ির ব্যবসা করতো। একদিন বাবার সাথে মুড়ি নিয়ে নিকটস্থ একটা বাজারে যাই। বাজারটির নাম আমিষাড়া বাজার। বজরা রেলস্টেশন থেকে ৩ মাইল পশ্চিমে এই আমিষাড়া বাজার অবস্থিত।

সকাল দশটার মতো বাজে। বাবা বিক্রি করার জন্য মুড়ির বস্তা বাজারে রাখলো। এমন সময় হৈচৈ শোনা যাচ্ছে। পাকবাহিনী বাজারে হানা দিয়েছে। রাস্তার ধারে কয়েকটা দোকানে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। এই খবর ছড়িয়ে পড়া মাত্রই বাজারের মানুষ এদিক-সেদিক ছোটাছুটি শুরু করে দিলো। বাজারটিতে একেক পণ্যের একেক সাইট ছিলো। বাবার সাথে মুড়ি বিক্রেতা আরও অনেকেই ছিলো। সবাই সবার মুড়ি বস্তা নিয়ে পালাতে শুরু করে দিলো। বাবা আর পালাতে পারছে না, মুড়ির বস্তাটার জন্য। হুড়াহুড়ির কারণে মুড়ির বস্তাটা কেউ আর বাবার মাথায় উঠিয়ে দিচ্ছে না। বাপ-ছেলে দুইজনেই মুড়ির বস্তাটা নিয়ে অনেক পারাপারি করলাম। কিন্তু মুড়ির বস্তাটা বাবার মাথায় আর উঠিয়ে দিতে পারলাম না। তখন বস্তাটা ধরেই বাবা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। বাবাকে ঝাপটে ধরে কাঁদতে শুরু করলাম। মনের ভেতরে ভয়, শুধুই ভয়।

পাকবাহিনীরা গুলি করে মানুষকে মেরে ফেলে, তাই এতো ভয়। বাবা এক হাতে বস্তা আরেক হাতে আমাকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক কষ্টের মুড়ির চালান। সেজন্য বাবা মুড়ির বস্তা রেখেও পালাতে পারছে না। এরমধ্যে পুরো বাজার জনশূন্য হয়ে গেল। সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেলো। বাজারের কয়েকটা দোকানে লাগানো আগুনের তাপ শরীরে লাগতে শুরু করলো। চারজন পাকবাহিনী বাবার সামনে এসেই রাইফেলের বাঁট দিয়ে বাবাকে আঘাত করলো। বাবা মুড়ির বস্তা ছেড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। বাবাকে বললো কলেমা বাতাও। বাবা কলেমা বলতে পারল না। বাবা কাঁপছে আর কাঁদছে। পাকবাহিনী আমার দিকে বড়বড় চোখ করে কয়েকবার তাকালো। আমি বাবাকে ধরে কান্নাকাটি শুরু করে দিলাম। তাঁদের দয়া হলো। তারা আর আমাদের কিছুই বললো না, সোজা বাজারের দিকে চলে গেল। বড় হয়ে বুঝতে পেরেছি আমার কান্নাতে হয়তো তাদের মায়া লেগেছিল। তাই তারা আমাদের কিছু না বলে সোজা বাজারের ভেতরে চলে গেল। এর কিছুক্ষণ পরই পাকবাহিনী তাদের সাঁজোয়া যান নিয়ে বাজার ত্যাগ করলো। সেদিন আর আমাদের সব মুড়ি বিক্রি হলো না। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাবা কয়েক সের মুড়ি বিক্রি করে, কোনরকমে বাবা-সহ বাড়ি চলে আসি।

রাইফেলের আঘাতে বাবা পুরোপুরিভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাবা রাইফেলের বাঁটের আঘাতে, ৬/৭দিন আর বাজারে যেতে পারেনি। তখন আমাদের গ্রামে তেমন কোনও নামিদামি ডাক্তারও ছিল না। পুরো গ্রামে কেবল একজন মাত্র ডাক্তার ছিলো, তাও হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। সেই ডাক্তারের ঔষধ মেশানো জলপড়া খেয়ে ক’দিন পর বাবা সুস্থ হলেন। আবার শুরু করে দিলেন মুড়ি নিয়ে জীবনসংগ্রাম। খবর পেলাম বড়দাদা শরণার্থী হয়ে ভারত ভ্রমণে। বড়দাদার জন্য মায়ের কান্নাকাটিতে বাতাস ভারী হতে লাগলো। কিন্তু বড়দাদা ফিরে আসার কোনও খবরও নেই। সেসময়ে এই বঙ্গদেশে মোবাইলের আগমন হয়নি। যা-ই সংবাদ পেতো, তা শুধু রেডিওর সংবাদ। আর চিঠির মাধ্যমে। কিন্তু চিঠি দিবে কে, আর পাবেই বা কে? পোস্ট অফিসও বন্ধ। ট্রেন বন্ধ, ব্যাংক বন্ধ, লঞ্চ-স্টিমার সবই বন্ধ। তাই আর বড়দা’র খবর আমরা কেউ জানতাম না। শুধু জানা যেত পাকবাহিনীরা কোথায় কোন বাজারে আগুন লাগিয়েছে, ক’জন মেরেছে এই খবর। আমরা থাকতাম ভয়ে ভয়ে! ভয় শুধু কখন যেন পাকবাহিনীরা গ্রামে ঢুকে পড়ে, সেই ভয়েই বেশি অস্থির হয়ে থাকতাম। অবশ্য পাকবাহিনীরা তাঁদের গাড়ি নিয়ে আমাদের ঢুকতে পারবে না। গাড়ি নিয়ে গ্রামে আসার মতো রাস্তা ছিল না। তবুও ছিল ভয়!

আমাদের বাড়িটা ছিল বজরা রেলস্টেশনের পশ্চিমে। বজরা পাকা সড়ক থেকে আমাদের গ্রামে আসার জন্য কোনও পাকা রাস্তা ছিল না। ছিলো সরু একটা মাটির রাস্তা। সেসময় ওই মাটির রাস্তা দিয়ে দু’একটা গরুর গাড়ি আসা-যাওয়া করতো। তাই পুরো যুদ্ধের সময়ও পাকবাহিনী আমাদের গ্রামে আসতে পারেনি। যা কিছু টুকিটাকি অত্যাচার-অবিচার করেছে, তা কেবল পার্শ্ববর্তী গ্রামের রাজাকাররা করেছে। মাহাতাবপুর গ্রামে ছিলো হিন্দু জনবসতি। পুরো গ্রামে মুসলমান বাড়ি ছিল মাত্র দুটি, তাও খরিদ সূত্রে তাঁরা মালিক ছিল। সারাদেশে যখন মুক্তিবাহিনীর জয়জয়কার। তখন মে মাস ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ। আমাদের বাড়িটি ছিল গ্রামে প্রবেশদ্বারের প্রথম বাড়ি। আমাদের বাড়ির পরেই পার্শ্ববর্তী গ্রাম ‘হিলমুদ’।

হিলমুদ গ্রামের পরেই বজরা বাজার ও রেলস্টেশন। তাই আমাদের বাড়িটা ছিল মুক্তিবাহিনীদের পছন্দের বাড়ি। আমার দুই জেঠা ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত পাকিস্তানি পুলিশ। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা প্রতিদিন সন্ধ্যার পর আমাদের বাড়িতে আসতো। এসেই আমার দুই জেঠার সাথে বসে গল্প করতো। মাঝেমাঝে চা’র আড্ডা হতো। বাড়িতে বানানো মুড়ির মোয়া থাকতো। নারিকেল কোরা সহ মুড়ি তাদের দেওয়া হতো। তারা আনন্দের সাথে খেতো আর জেঠা মহাশয়ের সাথে কথা বলতো। সময় সময় জেঠার সাথে বসে বসে নিজেও তাদের কথা শুনতাম। মা চা বানিয়ে দিতেন, সেই চা তাদের এনে দিতাম। সেসব হৃদয়বান মুক্তিযোদ্ধাদের কথা কোনদিন ভুলবো না। পাকবাহিনী আর রাজাকার বাহিনীদের ভয়ে অনেক মানুষই গ্রাম ছেড়ে শরণার্থী হয়ে ভারত চলে গেছে। আমাদের তেমন টাকা-পয়সা ছিল না বিধায় আমরা নিজ গ্রামেই থেকে যাই।

আমাদের ভরসাই ছিল একমাত্র হৃদয়বান মুক্তিযোদ্ধারা। সেসব বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সুনজরের কারণে, রাজাকার আর পাকবাহিনীরা গ্রামের একটা বাড়িতেও ক্ষতি করতে পারেনি। এভাবে চলতে চলতে কেটে গেল দীর্ঘ ৮ মাস। সময় তখন নভেম্বর ১৯৭১ সাল। রেডিওর শুধু সংবাদ ছিল বিবিসি, আর আকাশবাণী কোলকাতার বাংলা সংবাদ। প্রতিদিন সন্ধ্যার পরপর মায়ের সাথে বড়বাড়িতে গিয়ে রেডিওর খবর শুনতাম। মুক্তিবাহিনীদের কাছেও একটা রেডিও ছিলো। যা দিয়ে তারা খবর শুনতো। তখন চারিদিকে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের জয়জয়কার। জাগায় জাগায় ঘটতে লাগলো পাকবাহিনীর পরাজয় এর আত্মসমর্পণ। আর পিছু হঠার খবর। সামনেই ডিসেম্বর মাস। পুরো ডিসেম্বর মাসই ছিল সবচেয়ে বেশি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। কুকুর পাগল হলো যেমন এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি করে মানুষকে কামড়ায়, ঠিক সেই অবস্থাই হয়েছিল পাকবাহিনীদের বেলায়। তারা ঠিক হিংস্র জানোয়ারের মতো হিংসাত্মক হয়ে উঠলো। নিরস্ত্র সাধারণ মানুষদের গুলি করে মারতে লাগলো।

তাদের মুখে ছিলো শুধু ইদুর কাঁহা (হিন্দু)? মুক্তিবাহিনী কোন আদমি হ্যাঁ? এটাই ছিল তাদের প্রথম জিজ্ঞাসা। হিন্দুদের বেশি খুঁজতো এই কারণে যে, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে পার্শ্ববর্তী ভারত সহযোগিতা করছিল, তাই। আমাদের বীর বাঙালিরা ভারত গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করার ট্রেনিং নিয়ে আসছে, তাই। তাই পাকবাহিনীদের প্রথম শত্রুই ছিলো ভারত ও হিন্দু। রাস্তাঘাটে পাকবাহিনীরা চেকপোস্ট বসিয়ে মুক্তিবাহিনী আর হিন্দুদের খুঁজতো। যাকেই ধরতো, আগেই জিজ্ঞেস করতো, ‘তুমি হিন্দু না মুসলমান?’ যদি বলতো, আমি মুসলমান। তাহলে আদেশ আসতো, ‘কলমা পড়ে শোনাও।’ কলমা পড়ে শোনানোর পরও বলা হতো, ‘কাপড়া উঠাও।’ কাপড় উঠিয়ে দেখানোর পরই ওরা নিশ্চিত হতো লোকটি হিন্দু না মুসলমান। হিন্দু হলে মরণ অনিবার্য। আর মুসলমান হলেও তবু সন্দেহ থেকেই যেতো।

সন্দেহ শুধু একটাই, তা হলো- সাধারণ মানুষ, না মুক্তিবাহিনী? অনেক সময় সাধারণ মানুষকে মুক্তিবাহিনী সন্দেহ করে মেরেও ফেলেছে ঐ হিংসাত্মক পাকবাহিনী। আবার অনেকসময় একটু স্বাস্থ্যবান মানুষদেরও ধরে নিয়ে মেরে ফেলতো। তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে দেশীয় রাজাকারবাহিনীও হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড শুরু করে দিলো। কার বাড়িতে কয়টা যুবতী মেয়ে আছে, সেসব তালিকা পাকবাহিনীদের কাছে পৌঁছাতে লাগলো। সময় সময় পাকবাহিনীদের মনোরঞ্জনের জন্য, বাড়ি থেকে জোরপূর্বক যুবতী মা-বোনদের তুলে নিয়ে যেতো। এসব দেশীয় আলবদর-রাজাকাররাই পাকবাহিনীদের সবকিছু শিখিয়েছিলো। অচেনা রাস্তাঘাট চিনিয়ে দিয়েছিলো। হিন্দুদের কিভাবে চেনা যায়, সেটাও শিখিয়েছিল। ডিসেম্বরের আগমনের সাথে সাথে পাকবাহিনী সহ তাদের দোসররাও মানুষ খেকো রাক্ষসের মতন হয়ে উঠলো।

ডিসেম্বরের প্রথম থেকে এভাবে চলতে চলতে একসময় সারাদেশেই পাকবাহিনী পরাজয় বরণ করতে লাগলো। ১৫ ডিসেম্বর দেখেছি, মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো থেকে রাজাকারদের হাত বেঁধে রাস্তা দিয়ে নিয়ে যেতে। সেই দৃশ্য দেখার জন্য গ্রামের অনেক মানুষের মধ্যে আমিও রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। মা-বাবা বড়দিদিদের সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছি। মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে জয়বাংলা ধ্বনি শুনেছি। গ্রামের হাজার হাজার মানুষের মুখেও শুনেছি জয়বাংলা বাংলার জয়। যা-ই দেখেছি বা শুনছি, সবকিছুই ১৯৭১ সালের স্মরণীয় মার্চ মাস থেকে শুরু করে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত। তাই প্রতিবছর মার্চমাস আর ডিসেম্বর মাস আসলেই মনে পড়ে সেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ মুক্তিযুদ্ধের কথা। মুক্তিযোদ্ধাদের কথা। বিজয়ের কথা। বিজয় দিবসের কথা।

GD Star Rating
loading...
GD Star Rating
loading...
এই পোস্টের বিষয়বস্তু ও বক্তব্য একান্তই পোস্ট লেখকের নিজের,লেখার যে কোন নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব লেখকের। অনুরূপভাবে যে কোন মন্তব্যের নৈতিক ও আইনগত দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্তব্যকারীর।
▽ এই পোস্টের ব্যাপারে আপনার কোন আপত্তি আছে?

১৬ টি মন্তব্য (লেখকের ৮টি) | ৮ জন মন্তব্যকারী

  1. দাউদুল ইসলাম : ১৫-১২-২০১৯ | ১৬:৫১ |

    “এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

     

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ১৬-১২-২০১৯ | ০:২৯ |

      মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি, শ্রদ্ধেয় দাদা।       

      GD Star Rating
      loading...
  2. মুরুব্বী : ১৫-১২-২০১৯ | ১৭:৫৯ |

    আপনার এই জীবন ডায়েরিটি পড়ে আমি অশ্রু সিক্ত হয়েছি মি, নিতাই বাবু।

    এমনও সময় আমাদের গিয়েছে। এই দুঃসহ স্মৃতিভার আজীবন তাড়া করে ফিরবে। Frown

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ১৬-১২-২০১৯ | ০:৩১ |

      বিজয়ের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি, শ্রদ্ধেয় দাদা।      

      GD Star Rating
      loading...
  3. সাজিয়া আফরিন : ১৫-১২-২০১৯ | ১৯:৩৮ |

    কী ভয়াবহ স্মৃতি !!! Frown

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ১৬-১২-২০১৯ | ০:৩৩ |

      বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানবেন, শ্রদ্ধেয় দিদি।       

      GD Star Rating
      loading...
  4. সুমন আহমেদ : ১৫-১২-২০১৯ | ২০:২২ |

    ৭১ এর দৃশ্যপট আমার সম্যক শোনা স্বল্পবিস্ত জানা অজানা'র মধ্যেই সীমিত। আজকে আপনার লেখাটি পড়ে মনে হলো আমি আপনার সাথেই যেন চলেছি সেই সময়টাতে। কী নিষ্ঠুর পাষণ্ডদের অত্যাচারে মানুষ অত্যাচারিত হয়েছে !! কত কষ্ট করেছে। কত নিরাপত্তাহীনতায় রাত দিন কাটিয়েছে।

    সেই বিজয়ের সুফল আমাদের কাছে কতটা সফল হয়ে ফিরেছে তার হিসাব এই বিংশ শতাব্দীতে বসে ভাবলে আমি শংকিত হই। Frown

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ১৬-১২-২০১৯ | ০:৩৫ |

       

      উড়িয়ে দিলাম মহান বিজয় দিবসের লাল-সবুজের পতাকা। আপনাকে বিজয়ের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি, শ্রদ্ধেয় দাদা।            

      GD Star Rating
      loading...
  5. রিয়া রিয়া : ১৫-১২-২০১৯ | ২০:৪০ |

    অফলাইনে পড়ে নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম আর বিজয় এমন সহস্র ত্যাগ আর তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে। কতটা ত্যাগ ভয় অনিরাপত্তায় মানুষ ছিলো আপনার মতো করে অনুভব করতে না পারলেও অনুমান করে নিয়েছি। ঈশর আপনার মঙ্গল করুন। বাংলাদেশ দীর্ঘজীবি হোক। নমস্কার।

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ১৬-১২-২০১৯ | ০:৩৯ |

      এই বিজয়ের পেছনে ভারতের অবদানের কথাও ভুলে যাবার নয়, শ্রদ্ধেয় দি।। সেইসাথে সকল শহীদ এবং জীবিত বীর মুক্তিযুদ্ধেরও স্মরণ করছি। অনেক কষের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই মহান বিজয় দিবস। আপনাকে মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি, শ্রদ্ধেয় রিয়া দিদি।                        

      GD Star Rating
      loading...
  6. সৌমিত্র চক্রবর্তী : ১৫-১২-২০১৯ | ২১:৪৪ |

    জীবনের কথা গুলো পড়ে স্তম্ভিত হলাম কবি নিতাই বাবু। Frown

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ১৬-১২-২০১৯ | ০:৪১ |

      এই বিজয়ের পেছনে ভারতের অবদানের কথাও ভুলে যাবার নয়, শ্রদ্ধেয় দাদা। সেইসাথে সকল শহীদ এবং জীবিত বীর মুক্তিযুদ্ধেরও স্মরণ করছি। অনেক কষের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই মহান বিজয় দিবস। আপনাকে মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি, শ্রদ্ধেয় দাদা। 

      GD Star Rating
      loading...
  7. আবু সাঈদ আহমেদ : ১৫-১২-২০১৯ | ২২:২৬ |

    প্রতিবছর মার্চ মাস আর ডিসেম্বর মাস আসলেই মনে পড়ে সেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ মুক্তিযুদ্ধের কথা। মুক্তিযোদ্ধাদের কথা। বিজয়ের কথা। বিজয় দিবসের কথা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_sad.gif

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ১৬-১২-২০১৯ | ০:৪২ |

      মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি,শ্রদ্ধেয় দাদা।       

      GD Star Rating
      loading...
  8. শাকিলা তুবা : ১৫-১২-২০১৯ | ২৩:০৪ |

    লেখাটি আমি দিনের বেলা পড়েছি। এই সত্য আমাদের বিজয়ের চেয়ে বেশী সত্য। 

    GD Star Rating
    loading...
    • নিতাই বাবু : ১৬-১২-২০১৯ | ০:৪৫ |

      বিজয়ের শুভেচ্ছা জানবেন, শ্রদ্ধেয় দিদি।     

      GD Star Rating
      loading...