ঘষন্তি মাজন্তি তিন খুর-মুখ অতিশয় গম্ভীর-১
প্রথম পর্বের শেষাংশ:
শেষতক এই খবর পৌঁছে গেল জীবন বামনার কানে। জীবন বামনা তখন আরেক মুল্লুকে থাকা এক মন্দিরে থেকে খেয়ে-না-খেয়ে দিন পার করছিল।
জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়িতে ঘটে যাওয়া ঘটনার হুলুধ্বনি যখন জীবন বামনার কানে আসলো, জীবন বামনা মনে মনে বলতে লাগলো, ‘না না, আমার লেখা এক টুকরা কাগজের লাইগা জমিদার কার্তিক বাবুর জীবন বাঁচে নাইক্কা। কার্তিক বাবু জীবন বাঁচছে হের সৎ কামের লাইগা। জমিদার কার্তিক বাবুর আয়ু আছিল দেইখাই, হের জীবন বাঁচছে। আমার লেখা এক টুকরা কাগজ হেদিন হেই জায়গায় না থাইকলেও জমিদার কার্তিক বাবুর জীবন বাঁইচতো। হেইডা যেমনেই ওক অইতো। এনো আমার লেখা কাগজখান খালি উছিলা, আর সাক্ষী অইয়া রইছে। ইল্লাইগা আমি যদি কার্তিক বাবুর তুন কিছু চাই, তয়লে আমার অইবো বড় অন্নাই।
এই ভেবে জীবন বামনা সিদ্ধান্ত নিলো, কিছুতেই সে জমিদার কার্তিক বাবুর কাছে গিয়ে কিছু চাইবে না, কাগজে লেখার ব্যাখ্যাও দিবে না। যদিও জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়িতে যেতে হয় তো বামনীকে সাথে করেই নিয়ে যাবে। কিন্তু বামনীকে তো বলে এসেছে টাকাপয়সার বস্তা সাথে করে নিয়ে যাবে। এখন খালি হাতে বামনীর সামনে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? বামনী যদি ঝাঁটা মেরে বাড়ি থেকে বের করে দেয়? এমনিতেই বামনী আমাকে বলে কুমিরা আইলসা!’ মনে মনে এসব ভাবতে ভাবতে জীবন বামনা খিটখিটে জোরে জোরে শব্দ করে হাসতে লাগলো।
জীবন বামনার হাসির শব্দে মন্দিরে থাকা ঠাকুরের একটু খারাপ লাগলো। ঠাকুর তখন মন্দিরে থাকা দেবমূর্তিতে পূজা দিচ্ছিলো। ঠাকুর মূর্তি পূজা বাদ দিয়ে বারান্দায় বসা জীবন বামনার সামনে এসে বললো, ‘ওই বেডা হারামজাদা, ‘পূজা দেওয়নের সুম আমার কোনও ভুল অইছে?’ জীবন বামনা বললো, ‘নাতো গোসাই!’ ঠাকুর উত্তেজিত হয়ে বললো, ‘তয়লে বেডা তুই এমনে বেটকাইলি ক্যা, ক?’ জীবন বামনা বললো, ‘আজ্ঞে গোসাই এমনেই হাইসলাম।’ তারপরও মন্দিরের ঠাকুর বিশ্বাস করতে পারছে না। ঠাকুর আবারও বললো, ‘হাছাকথা যদি না কছ, তয়লে তোরে অনকা মন্দিরের তুন খেদাইয়া দিমু! ভালা অইবো হাছা কইরা ক। এনো থাকলে অইলে কইতে অইবে জোরে জোরে বেটকাইলি ক্যা?’
জীবন বামনা কোনও অবস্থাতেই মিথ্যা বলার পাত্র নয়! এতে যেতো সমস্যাই হোক, সে সত্যই বলবে। তাই মন্দিরের ঠাকুরের চাপাচাপিতে জীবন বামনা জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়িতে সেদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য নিজেকে দায়ী করে বললো, ‘জমিদার কার্তিক বাবুর ঘরের দরজায় এক টুকরা কাগজ আমিই লাগাইয়া রাখছিলাম, ঠাকুর মশাই। হেই কাগজের লাইগা জমিদার কার্তিক বাবুর জীবন বাঁইচা গেছে। আইজ ক’দিন ধইরা হেই কাগজ কে লেখছে আর কে লাগাইছে, হিল্লাইগা হারা মুল্লুকে ঢোল পিডাইতাছে। এই কথা আমার মনে পরছে দেইখা আমি হাসতাছিলাম, ঠাকুর মশাই। হের লগে আবার আমার বামনীর কথাও মনে পইড়া গেছে। বামনী আমারে কতায় কতায় কয় কুমিরা আইলসা।’ এই বলেই জীবন বামনা আবারও হাসতে লাগলো, হা-হা-হা-হা!
জীবন বামনার কথা শুনে মন্দিরের ঠাকুর অবাক হয়ে বললো, ‘আরে বেডা তুই কছ কী? হাছা হাছাই তুই কাগজ লাগাইছত? চল বেডা, পুরস্কার আছে। যেয় নিকি সন্ধান দিতে পারবো, কার্তিক বাবু হেরে দিবো এক হাজার টেকা। আর যেয় লিখছে, লাগাছে, হেরে দিবো দুই হাজার টেকা। চল তাড়াতাড়ি কইরা। আমি অইলাম গিয়া সন্ধানদাতা, আর তুই লেকছত লাগাইছত। তুই পাইবি দুই হাজার টেকা। চল চল, চলরে বেডারে চল!’ এই বলেই মন্দিরের ঠাকুর জীবন বামনার হাত ধরে টানাটানি করতে লাগলো। ঠাকুরের জবরদস্তি আর টানাটানিতে মন্দিরের সামনে আরও কয়েকজন মানুষ হাজির হয়ে গেলো। উপস্থিত সবাই যখন এই ঘটনা শুনে ফেললো। তখন মন্দিরের ঠাকুর ভাবছে, ‘হায় হায়, এই লোকগুলা তো আগে আগে জমিদার কার্তিক বাবুর কাছে যাইয়া কইয়া দিবো! তাইলে তো আমি হালায় ফাও যামু!’ এই ভেবে মন্দিরের ঠাকুর মন্দির ফেলে এক দৌড় দিলো জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়ির দিকে। আর যাঁরা এই ঘটনা শুনল, তাঁরাও ঠাকুরের পিছনে পিছনে দৌড়াতে লাগলো। জীবন বামনা তখনো মন্দিরের বারান্দায় বসে কি যেন ভাবছিল! আর লোকজনের দৌড়াদৌড়িতে এই কথা এক কান থেকে আরেক কানে যেতে লাগলো।
এভাবে এই খবর পৌঁছে গেল জীবন বামনার বামনীর কাছে আর জমিদার গণেশ বাবুর কাছে। জমিদার গণেশ বাবু খবর শুনে তাঁর লাঠিয়াল বাহিনী পাঠিয়ে দিলেন জীবন বামনাকে ধরে নিয়ে যেতে। এদিকে দশ গ্রামের মানুষও জীবন বামনাকে দেখার জন্য জড়ো হয়ে গেল মন্দিরের সামনে। গ্রামের লোকজনের ভিড়ের মধ্য থেকেও গণেশ বাবুর লাঠিয়াল বাহিনী এসে জীবন বামনাকে ধরে নিয়ে গেল, জমিদার গণেশ বাবুর বাড়িতে।
জমিদার গণেশ বাবু জীবন বামনাকে দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। জমিদার গণেশ বাবু রেগেমেগে হাতে একটা লাঠি নিয়ে জীবন বামনাকে বলছে, ‘ও-ই বেডা হাছা কইরা ক, আসলে কার্তিক্কার দরজার মাধ্যে কি তু-ই কাগজের টুকরা লাগাইছত? জীবন বামনা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, ‘আজ্ঞে হ, আমিই লাগাইছি। হিল্লাইগা কী অইছে?’ গণেশ বাবু ক্ষেপে বললো, ও-ই বেডা তুই কত্ত বড় শিক্ষিত অইছত দেহি!’ এই কথা বলেই জীবন বামনার ঝুলির ভেতরে হাত দিল। জীবন বামনার সাথে থাকা ঝুলিতে শুধু কাগজের টুকরো আর টুকরো।
এসব কাগজের টুকরো দেখে জমিদার গণেশ বাবু ভাবলো লোকটা মনে হয় পাগল। কিন্তু কাগজের টুকরোগুলোতে লেখা দেবদেবীর পূজার মন্ত্র, আর শাস্ত্রগ্রন্থের লেখা দেখে গণেশ বাবু তখন রীতিমতো অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, বাবা, তোর বাড়ি কই? তুই বাবা কী করছ? কার্তিক্কার ঘরের দরজার মাধ্যে তুই কী লেকছত? তর হেই লেখার লাইগগা নাপতা হালায় কার্তিক্কার গলা কাইটতে পারে নাইক্কা। ক তুই কাগজে কী লেকছত, ক?’ গণেশ বাবুর কথা শুনে জীবন বামনা হেসে বললো, ‘জমিদার বাবু, ‘এই দুইন্নাইত কেডা কারে মাইত্তে পারে? আয়ু থাকতে মানুষ মরে না। কেউ কারোরে মাইত্তেও পারে না। আমার কাগজখান অইলো উছিলা। হেদিন কার্তিক বাবুর ঘরের দরজার মাধ্যে আমার কাগজ লাগাইন্না না থাইকলেও কার্তিক বাবু যেমনেই ওক বাঁইচা যাইত। আম্নে বড় একখান ভুল করছেন বাবু। এই ভুলের পাচিত্ত আম্নের করন লাগবো।’
জীবন বামনার কথা শুনে জমিদার গণেশ বাবু অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, ‘আসলেই আমি ভুল করছিরে। কিল্লাইগা যে এই আকাম করতে গেলাম! মাথাডা ঠিক আছিল নারে।’ জীবন বামনা বললো, ‘জমিদার বাবু, শত্রুর লগে শত্রুতা না কইরা বন্ধু অন যায় না? তাইলেই ত শত্রু আম্নেরে গোসাই মনে কইরা পূজা দিবো।’ এবার জমিদার গণেশ বাবু নিজের ভুল স্বীকার করলো। আর কীভাবে এই ভুলের ক্ষমা পাওয়া যেতে পারে সে-ব্যাপারে জীবন বামনার কাছে জানতে চাইল। জীবন বামনা বললো, যাঁর কাছে অপরাধ করছেন, হে ও-ই ক্ষমা করতে পাইরবো। হে ছাড়া স্বয়ং ভগবানও ক্ষমা করতো না, বাবু। এই ভুলের ক্ষমা একমাত্র কার্তিক বাবুই করতে পারবো, অন্য কেউ না।’ জীবন বামনার কথা শুনে জমিদার গণেশ বাবু বললো, ‘ঠিক আছে কার্তিক বাবুর বাড়িত যাইয়া হের কাছ তুনে মাপ চাইয়া লমু। তুই বেডা আমার লগে থাকবি।’ জীবন বামনা হেসে বললো, ‘ঠিক আছে বাবু, আমি আম্নের লগেই থাকুম। চলেন আমার লগে কার্তিক বাবুর বাইত।’ জীবন বামনার কথায় জমিদার গণেশ বাবু আর দেরি না করে লোকজন সাথে নিয়ে জীবন বামনা-সহ জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়ির দিকে রওনা হলো।
এদিকে বামনী জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়িতে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিজের স্বামী ঘটিয়েছে জানতে পরে বামনীও জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়িতে এসে হাজির হলো। বামনী এসে দেখে জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়িতে লোকে লোকারণ্য। বাড়ির ভেতরে হাতাহাতি তর্কাতর্কি চলছে। কেউ বলছে আমি আগে খবর নিয়া আইছি। কেউ বলে আমি আগে আইছি। মন্দিরের ঠাকুর তো সবার আগে এসে কার্তিক বাবুর কাছে বলে সবার আগে বসে আছে। কার্তিক বাবু একজন একজন করে জিজ্ঞেস করছে, যে লিখেছে তাঁর নাম কী? তাঁর বাড়ি কোথায়? কিন্তু কেউ আর এসব প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারছে না। শুধু বলছে, লোকটা জীবন পুর গ্রামের কালীমন্দিরে থাকে। সবার মুখে জীবন পুর কালীমন্দিরের কথা শুনে জমিদার কার্তিক বাবু সবাইকে বসতে বলে লোক পাঠিয়ে দিলেন জীবন পুর কালীমন্দিরে। ততক্ষণে জীবন বামনাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল জমিদার গণেশ বাবুর লোকজন।
এরমধ্যেই জীবন বামনার স্ত্রী বামনী এসেই দেখে বাড়ি ভর্তি লোকজন। বামনী এসেই জমিদার কার্তিক বাবুকে বললছে, ‘আমার স্বামী কই? আমার স্বামীরে কি বাইন্দা রাখছেন?’ জমিদার কার্তিক বাবু জানতে চাইলো, ‘কে তোমার স্বামী?’ বামনী বললো, ‘আম্নের ঘরের দরজার মাধ্যে যেয় কাগজখান লাগাইছে, হেয় আমার স্বামী জীবন চক্রবর্তী।’ তখন বাড়িতে উপস্থিত লোকজনের মাথা ঘুরপাক খাচ্ছিল। কেউ বলছে, ‘যা, সন্ধানদাতা তো কাগজ লাগাইন্নার বউ। তয়লে দুইডা পুরস্কার হেরাই পাইতাছে। আমরা খালি খালি আইয়া নিজেরা নিজেরা গোলমাল লাগাইলাম।’ বামনীর কথা শুনে জমিদার কার্তিক বাবুর বিশ্বাস হলো। বামনীকে সম্মান করে বসতে দিলো। বামনী বসলো। অপেক্ষা এখন জীবন বামনার।
এদিকে বাড়িতে অনেক লোকের মাঝে একজন বললো, জীবন পুর কালীমন্দির থেকে জীবন বামনাকে জমিদার গণেশ বাবু তুলে নিয়ে গেছে। সাথে সাথে জমিদার কার্তিক বাবু ১০/১২ জন লোক পাঠিয়ে দিলো জমিদার গণেশ বাবুর বাড়িতে। পথিমধ্যেই কার্তিক বাবুর লোকজন দেখে জমিদার গণেশ বাবু লোকজন নিয়ে কার্তিক বাবুর বাড়ির দিকে আসছে। কার্তিক বাবুর লোকজন তা দেখে দৌড়ে আবার কার্তিক বাবুর বাড়িতে এসে বললো, ‘জমিদার বাবু, গণেশ বাবু লোকজন নিয়া আম্নের বাড়ির দিকে আইতাছে।’ এই কথা শুনে কার্তিক বাবুর তাঁর লাঠিয়াল বাহিনীকে প্রস্তুত হতে বললো। লাঠিয়াল বাহিনী লাঠিসোটা নিয়ে প্রস্তুত হলো। এখন পুরো বাড়িতে থমথমে অবস্থা বিজার করছিল। এমন সময় জমিদার গণেশ বাবু জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়ির ভেতরে ঢুকতে চাইলে কার্তিক বাবুর লোকজন বাধা দিলো। জীবন বামনা কার্তিক বাবুর লোকদের বললো, ‘আম্নেরা যাইয়া কার্তিক বাবুরে কন, আমি জীবন চক্রবর্তী, জীবন বামনা আইছি। জমিদার গণেশ বাবুরে আমিই লগে কইরা লইয়া আইছি। যাইয়া কনগা।’ কয়েকজন লোক গিয়ে কার্তিক বাবুর কাছে বললো, ‘জীবন বামনা জমিদার গণেশ বাবুরে লগে কইরা লইয়া আইছে। অন আম্নে কইলে হেগো আইতে দিমু।’ কার্তিক বাবু বললো, ‘ঠিক আছে আসতে দাও।’
কার্তিক বাবুর অনুমতি পেয়ে জীবন বামনা আর গণেশ বাবুর লোকজন কার্তিক বাবুর বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। কার্তিক বাবু সবাইকে বসতে দিলো। সবাই বসলো। সাথে সাথে জীবন বামনার স্ত্রী বামনী এসে জীবন বামনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। জীবন বামনা বামনীকে শান্তনা দিয়ে আগের জায়গায় গিয়ে বসতে বললো। বামনী গিয়ে চুপ করে বসে থাকল।
এবার কার্তিক বাবু জীবন বামনাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘গত তিনদিন আগে আমার বাড়িতে এসে আমার ঘরের দরজায় একটুকরো কাগজ তুমি লাগিয়েছিলে?’ জীবন বললো, ‘হ বাবু, আমি আইছিলাম ভিক্ষা করনের লাইগগা। হেসুম আম্নেরা কেয় ঘুমেতুন উডেন নাই। আমি বহুতক্ষণ বইয়া থাইক্কা আম্নের দরজার মাধ্যে একখান কাগজের টুকরা লাগাই থুইয়া গেছি, আম্নে যন জানতে পারেন যে আমি আইছিলাম।’
জমিদার কার্তিক বাবু এবার জানতে চাইল, ‘কাগজে কী লিখেছিলে, তা কি তোমার মনে আছে?’ জীবন বামনা বললো, কি যে কন বাবু, আমি লেখছি, আমিই লাগাইছি। আর আমিই কইতে পারতাম না, তয় কইবো ডা কেডা?’ কার্তিক বাবু বললো, ‘বলো দেখি তুমি কী কী লিখেছিলে?’ জীবন বামনা বললো, ঘষন্তি মাজন্তি তিন খুর, মুখ অতিশয় গম্ভীর, শ্রী শ্রী বিশ্বপানি তুমি যাহা করিবা তাহা আমি জানি।’ কার্তিক বাবু জানতে চাইলেন, এসবের মানি কী?’ সুন্দর করে ব্যাখ্যা দিতে পারবে?’ জীবন বামনা হেসে বললো, ‘তাইলে ত পুরা ঘটনা আবার নতুন কইরা কন লাগে, বাবু। হুনতে যন চাইছেন, তয় ত কনই লাগে। তয় হুনেন, হেদিন আমার বামনীর লগে কাইজ্জা কইরা ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে লইয়া ঘরের তুন বাইর অইয়া, আটতে আটতে আম্নেগো বাড়ির রাস্তায় আইছি। দেহি রাস্তার মাধ্য কেডা যানি একটা বলদ গরু খুডা গাইডরা থুইয়া দিছে। গরুডা রাস্তার মধ্যখানে আইয়া খারাইয়া রইছে। গরুডার লাইগগা আমি আর আম্নের বাড়ির দিকে আইতে পাত্তাছিলাম না। গরুডায় খালি সামনের একখান পায়ের তিনডা খুর দিয়া মাডি খুদ্দাছে।
হিল্লাইগা আমি লেখছি, “ঘষন্তি মাজন্তি তিন খুর।”
কদ্দুর পরে দেহি, গরু মুখ কালা গম্ভীর কইরা অনক্ষণ খারাইয়া রইছে।
হিল্লাইগা আমি লেখছি, “মুখ অতিশয় গম্ভীর।”
হের পরে দেহি পেছ পেছ কইরা মুত্তা আস্তে কইরা রাস্তার নিচে নাইম্মা গেছে। হিল্লাইগা আমি লেখছি, “শ্রী শ্রী বিশ্বপানি তুমি যাহা করিবা তাহা আমি জানি।”
এই লেখার কাগজখানই আমি আম্নের দরজার মাধ্যে আমগাছের আডা দিয়া লাগাইয়া থুইয়া গেছিগা, বাবু। হের পরে আম্নের বাইত কি অইছে আমি কিচ্ছুই কইতে পাত্তামনা। আম্নের দরজার মাধ্যে একখান কাগজের টুকরা লাগানে যদি আমার ভুল অয়, তয় আমারে ভগবানের দিকে চাইয়া মাপ কইরা দেন।’
জমিদার কার্তিক বাবু জীবন বামনার কাছ থেকে কাগজে লেখার ব্যাখ্যা পেয়ে চেয়ার থেকে উঠে বামনাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘তোমার সেই অসাধারণ লেখা কাগজের টুকরো সেদিন আমার জীবন বাঁচিয়েছিল। আর তুমি বলছ, মাপ করে দিতে? তুমি কোনও অপরাধ করোনি জীবন বামনা। তোমার নাম যেমন জীবন চক্রবর্তী। ঠিক তুমি মানুষের জীবন রক্ষায় সবসময় নিয়োজিত। তোমার বুদ্ধিতে আমি নতুন করে জীবন পেলাম। তাই আজ থেকে সবসময় তুমি আমার জীবনের সাথেই মিশে থাকবে। তোমার যাকিছু দরকার তা আমিই দেখবো। আর আমার ঘোষণা করা তিন হাজার টাকা একমাত্র তুমিই পাওনা।’
কার্তিক বাবুর কথা শেষ হতে-না-হতেই জমিদার গণেশ বাবু কার্তিক বাবুর সামনে গিয়ে হাতে ধরে বললো, ‘কার্তিক বাবু আপ্নে আমারে মাপ কইরা দেন। আমি রাগের মাথায় একটা আকাম কইরা ফালাইছি। আইজকা আম্নের বাইত আমারে লইয়া আইছে এই জীবন বামনায়।’ জীবন বামনাও জমিদার কার্তিক বাবুর হাতে ধরে বললো, জমিদার বাবু, আম্নে গণেশ বাবুরে মাপ কইরা দেন। আইজগার তুন আম্নেরা দুইজন বন্ধু অইয়া থাকবেন। আর যেই নাপিত আম্নের গলা কাটতে আইছিল, তাঁরেও মাপ কইরা দেন। জীবন বামনার কথায় জমিদার কার্তিক বাবু তা-ই করলো। এরপর সবাই মিলে কোলাকুলি করলো। খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। সবাই মিলে খাওয়া-দাওয়া করে যার যার বাড়ি চলে গেল। জীবন বামনা আর বামনী জমিদার কার্তিক বাবুর বাড়িতেই থেকে গেল।
এখানেই সমাপ্তি
loading...
loading...
এ গল্পটিই ও দারুণ এ গল্প আপনার নিজস্ব রচনা কি
শুভকামনা রইল
loading...
হ্যাঁ, দিদি। পড়েছেন বলে খুবই খুশি হলাম শ্রদ্ধেয় কবি দিদি।
loading...
বর্ণিত গল্পের প্রত্যেকটি ক্যারেক্টার-ফোকাসিং ফ্যান্টাস্টিক। এ পর্যন্ত যে কয়টি গল্প আপনার হাত হয়ে এসেছে, তারমধ্যে "বামনা আর বামনী" এটাও একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। অভিনন্দন মি. নিতাই বাবু। আনন্দ পেয়েছি। আসলেই আপনি রসিক মানুষ।
loading...
আপনাদের সকলের ভালোবাসা আর অনুপ্রেরণায় আরও লিখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমি সত্যিকারের এক সময়হীনা ব্যক্তি। সময় আমাকে সময় দিতে চায় না। যতটুকু পেয়ে থাকি, তা সময়ের কাছ থেকে জোরপূর্বক ছিনিয়ে রাখি। তাই শব্দনীড়ে একটু সময় দিতে পারি, শ্রদ্ধেয় দাদা। সুন্দর মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
loading...
সমাপ্তি সহ গল্পটি বেশ উপভোগ্য হয়েছে বলে আমার মনে হলো নিতাই বাবু।

loading...
গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সাথে ছিলেন বলে আমার রচনায় গল্পটা সার্থক হয়েছে, শ্রদ্ধেয় সুমন দাদা। আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
loading...
মনে আনন্দের বন্যা বইয়ে দিলেন দাদা। সফল সফল গল্প এমন হলে খুব ভাল লাগে।
loading...
শ্রদ্ধেয় দিদি, এ তো সবই আপনাদের সকলের দেওয়া অনুপ্রেরণার ফসল। আপনি পড়ছেন, মন্তব্যে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন বলেই ভালো লাগে। তাই লিখি। এমন আরও কয়েকটি গল্প আমার রেডি করা আছে। সময় আর সুযোগ বুঝে ব্লগে প্রকাশ করবো। আশা করি সাথে থাকবেন।
loading...
ভাগ্যিস জীবন বামনা মন্দিরে বসে কাহিনী উচ্চারণ করছিলো। নইলে জমিদারের তো ভীষণ অবস্থা হতো।
ভালোবাসা কবি নিতাই বাবু।
loading...
ভগবান যা করেন, মানুষের মঙ্গলের জন্যই করে থাকেন, শ্রদ্ধেয় কবি দাদা। সুন্দর মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
loading...
* অনেক সুন্দর পরিসমাপ্তি হয়েছে।
loading...
প্রথম পর্ব থেকে সাথে ছিলেন বলে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি, শ্রদ্ধেয় কবি দাদা। আশা করি ভালো থাকবেন সবসময়।
loading...
মনটা ভালো হয়ে গেলো প্রিয় কবি দা।
loading...
গল্পের শুরু থেকে সাথে ছিলেন বলে আমি ধন্য, আমার গল্পটাও সার্থক। আশা করি ভালো থাকবেন সবসময় দিদি।
loading...
আপনার প্রত্যেকটি উপস্থাপনা আমি ভীষণ আগ্রহ নিয়ে পড়ার চেষ্টা করি দাদা। দুই পর্বের সুন্দর গল্প। মন ভালো হয়ে যায়।
loading...
আপনাদের সুন্দর মন্তব্যের জন্য আমি সবসময়ই কৃতজ্ঞ থাকি। আশা করি ভালো থাকবেন শ্রদ্ধেয় কবি দিদি।
loading...